নবির মধ্যে মারফতিটাও ছিল। শরিয়ত আর মারফতে তফাত একটাই—অন্য কিছু নয়। শরিয়তে দেখার ও বাহ্যিক, আর মারফতে গোপন। নামাজ দমে পড়তে হয়, জিকির করতে হয়— এগুলো মারফতের কাজ। দমের সাধনা না করলে আল্লাকে পাওয়া যাবে না।
ফকিরি সাধনার পথে বহু লোকে বাধা দেবে। ভাল কাজে তো বাধা আছেই। আমিও বাইরে থেকে বাধা পেয়েছি, পরিবার থেকে বাধা পেয়েছি। যখন জানত না, তখন আমার পরিবারও বাধা দিয়েছে। যখন জানতে পারল যে এই পথ খারাপ নয়— তারপর আর কোনও বাধা নাই।
গোঁড়া মুসলমান বা মৌলবিরা এসব জিনিসের কিছু জানে না। তারা নিজেকে বড় ভাবে— যে আমার উপর আর কেউ নাই। …ভাবে— এরা কিছুই না, কিছু জানে না, ব্যোমভোলার মতো ঘুরে বেড়ায়, চিমটে বাজায় আর গাঁজা খায়। এদের কী দাম আছে? কে কি জানে সে সম্পর্কে লালন ফকির বলেছেন:
কুতর্ক কুস্বভাবী তাদের ঘরে নেয় না নবী
ভেদের ঘরে মেরে চাবি শরার মতে চালায়।
যারা নবির কাছে কুতর্ক, সুস্বভাব নিয়ে গেছে, নবি তাদের বলেছেন— তুমিই বড় জানলেওয়ালা বাবা, তুমি মক্তব-মাদ্রাসায় চলে যাও। আর যারা নতি স্বীকার করেছে, তাদের তিনি ভেদ খুলে দিয়েছেন। যাও বাবা, তুমি মাল নিয়ে যাও। …তবে ফকিররা মৌলানা-মৌলবিদের আসল কথাটাকে স্বীকার করে না। ওরা যেমন ফকিরদের পছন্দ করে না, তেমনি ফকিররাও বলে—ওরা কিছু জানে না, ওদের কাছে কিছু নাই। তবে ওরা কিছু না জানলেও ওদের পছন্দ করতে হয়; কেননা ওদের ক্ষমতা বেশি, দল বেশি।
আমার মন্তব্য
এতক্ষণে গোলাম শাহ মূল কথায় এসে পড়লেন। ফকিরদের পথ আর গোঁড়া মুসলমানদের পথ একেবারে আলাদা। মুসলমানদের কুতার্কিক বা কুস্বভাবী বলাটা হয়তো কিছুটা প্রান্তীয় মন্তব্য। তবে ভেদের (রহস্যের) ঘরে চাবি মেরে নবি তাঁদের শরিয়তি মতের বাহ্য করণকারণে পরিচালিত করেন আর আত্মসমর্পিত শান্ত ফকিরদের তিনি বুঝিয়ে দেন মূল রহস্যের জ্ঞান (মারেফত) এই তত্ত্ব বহুদিনের বিশ্বাসী ফকিরি তত্ব। বলতে গেলে এটাই তাঁদের দাঁড়াবার জায়গা। কিন্তু মুসলমানদের ক্ষমতা বেশি, দল বেশি বলে, ফকিররা তাদের বাধ্য হয়ে পছন্দ করে এ হল নির্মম সামাজিক সত্য। কারণ ফকিরদের মুসলমান মহল্লায় বসবাস করতে হয়। তাদের রীতিমতো বহু সময় অন্তত লোকদেখানো ভাবে পালন করতে হয়।
কিন্তু গোলাম শাহ-র একটা মন্তব্যে খটকা লাগে। তিনি জন্মসূত্রে ফকির এবং ফকির পরিবারেই বিয়ে করেছেন, তা হলে ফকিরি সাধনায় বাধা আসবে কেন? বাইরের বাধা হতেই পারে কিন্তু আত্মজনরা এমনকী স্ত্রী কেন প্রথমে বাধা দিয়েছিলেন?
গোলাম শাহ-র কথা—৮
আমাদের ওপর কোনও অত্যাচার হয়নি। এ ধরনের অত্যাহার হলে প্রতিবাদ কী করব? এতো সহ্যের রাস্তা। হজরত মহম্মদকেও অনেকে ঢিল মেরেছে, ফকিরদেরও যদি কেউ মারে, ঢিল ছোড়ে— সহ্য করতেই হবে।
ফকির হয়েছি বলে আমার মনে কোনও আপশোস নাই। কোনও প্রতিবন্ধকতাও নাই। প্রতিবন্ধকতা করতে হলে আমাদের বোঝাতে হবে। আমরা জোর গলায় বলি— যদি পারো আমাদের বোঝাও, না হলে আমাদের কাছে তুমি বোঝো।
আমার টাকাপয়সা নাই, সম্পত্তি নাই— আর আমি এসব চাইও না। ওসব পেতে আমার কখনও মন হয় না— অন্য কারও হয় কিনা জানি না। আমি যা আছি খুবই ভাল আছি— ওসব সম্পত্তিঅলা লোকেদের থেকেও ভাল আছি।
আমার মন্তব্য
গোলাম শাহ ফকিরের আত্মতুষ্টি বেশ তারিফ করার মতো। টাকাপয়সা সম্পত্তি তিনি চান না, এমন মনোভাব সংসারী মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক নয়— তার মানে তিনি মনেপ্রাণে ফকির। এ প্রসঙ্গে অনিবার্যভাবে বাউলদের কথা মনে আসে। তাদের মধ্যে ঘুরে দেখেছি, অন্তত এখন। বয়স্ক বাউলদের মধ্যেও খুব অতৃপ্তি, খুব প্রতিষ্ঠাকামিতা, খুব প্রচারপ্রবণতা কয়েকজন ব্যতিক্রম। এই বহিরঙ্গ জগতের প্রতি সাম্প্রতিক আকর্ষণ বহুরকম সুযোগ সুবিধার সূত্রে তৈরি হচ্ছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় ঘটনা হল শহরে বাউলদের গানের সমাদর ও ব্যাপক চাহিদা। প্রচার-মাধ্যম খুব তৎপর বাউলদের তুলে ধরতে। ফকিরদের ক্ষেত্রে এমন ঘটেনি, তাই তাঁদের মধ্যে এখনও সহজ সরল জীবনবোধ অবিচল আছে।
গোলাম শাহ মানুষটি আসলে গান পাগল এবং মধ্যপন্থী স্বভাবের। উচ্চাশা যেমন নেই তেমনই কোনও বিরোধী ভূমিকাতেও যেতে রাজি নন। কখনও তাঁর বা তাঁর চেনাজানা বীরভূমের ফকিরদের ওপর অত্যাচার হয়নি বলে প্রতিবন্ধকতার আসল চেহারা তাঁর দেখা নেই! সেটা নিয়ত দেখছেন গত দু’-তিন দশক ধরে নদিয়া-মুর্শিদাবাদের ফকিররা। সামাজিক বয়কট, শারীরিক নিগ্রহ এবং ধর্মীয় উৎপীড়ন তাঁদের মরিয়া করে তুলেছে। তাঁরা সংঘবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছেন। মহম্মদকে ঢিল ছুড়েছিল তিনি সয়েছিলেন, তাই এখন যদি কেউ ফকিরকে মারে তবে সইতে হবে— গোলাম শাহ-র এই সহনশীলতা এখনকার দিনে অচল। তাসলে বীরভূমের ফকিররা পরস্পর বিচ্ছিন্ন, দরিদ্র ও অলস প্রকৃতির। অনেক সন্তানসন্ততি আর দুই পত্নী নিয়ে ভিটেমাটিহীন চাহিদাহীন এমন ফকির আমাদের সমাজের একটা স্ববিরোধ আর বৈপরীত্যের চেহারা ফুটিয়ে তুলছেন নিজের অজান্তে। হেমাঙ্গ বিশ্বাস লক্ষ করেছিলেন, লোকায়ত বাউল মতবাদে বিভিন্ন পশ্চাদমুখী ধর্মীয় মিশ্রণ। তার ফলে বাউল ফকিররা শ্রমজগৎ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে আত্মকেন্দ্রিক দর্শনের মধ্যে নিমজ্জিত করতে চেয়েছিলেন। উৎপাদনকারী শ্রমজীবন থেকে সম্পূর্ণ বিশ্লিষ্ট ফকিরদের আত্মরতি তাঁকে ব্যথিত করেছিল।