গান গেয়েছিলুম তো কী হয়েছিল? একটা মশা জীবনভর গান গায়– সেটা কি ফুর্তির তোড়ে?– বিরস কণ্ঠে সেরগেই উত্তর দিল।
খানিকক্ষণের জন্য দুজনাই চুপচাপ। সেরগেইয়ের পূর্বরাগকীর্তন শুনে কাতেরিনার হৃদয় পরিপূর্ণ ভাবাবেশে বিহ্বল হয়ে গিয়েছে। কাতেরিনার বাসনা আরও কথা বলে কিন্তু সেরগেই ভুরু কুঁচকে কেমন যেন মৌত অবলম্বন করেছে।
ফুলে ফুলে ভরা আপেলগাছের শাখা-প্রশাখার পর্দার ভিতর দিয়ে স্বচ্ছ নীলাকাশ আর শান্ত প্রশান্ত পূর্ণচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে কাতেরিনা আবেশভরা কণ্ঠে বলে উঠল, দেখ দেখ, সেরেজা– এ যে স্বর্গপুরী, স্বর্গপুরীতে যেন মেলা বসেছে।
কাতেরিনা শুয়ে ছিল চিৎ হয়ে চাঁদের আলো আপেলগাছের ফুল আর পাতার ভিতর দিয়ে এসে কাতেরিনার মুখ আর দেহের উপর বিচিত্র শুভ্র আলপনার কম্প্রমান শিহরণ জাগাচ্ছিল; বাতাস স্তব্ধ, শুধু সামান্যতম ক্ষীণ মলয় অর্ধসুপ্ত পত্রাবলিতে ঈষৎ কম্পন জাগিয়ে পূর্ণকুসুমিত তরু আর নব উদাত তুণের মৃদু সৌরভ দূর-দূরান্তে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। বাতাস যেন অলসাবেশে পরিপূর্ণ যেন সে বাতাস এনে দেয় সর্ব কর্মে অরুচি, আত্মার অসংযম, আর মনের ভিতর দুর্বোধ যত কামনারাজি।
কাতেরিনা কোনও সাড়া না পেয়ে আবার চুপ করে গেল, আর তাকিয়ে রইল ফিকে গোলাপি আপেলফুলগুচ্ছের ভিতর দিয়ে আকাশের দিকে। সেরগেইও কথা বলছিল না কিন্তু তার চিত্তকে আকাশ বিমোহিত করেনি। আপন হাঁটু দুটো দু হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে সে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে রইল আপন বুট-জোড়ার দিকে।
আহা, যেন স্বর্ণজ্যোতি দিয়ে তৈরি রাত্রিটি। শান্ত, লঘু, সৌরভভরা আর প্রাণদায়িনী ঈষৎ উষ্ণতা! দূরে বহুদূরে, উপত্যকার পিছনে, বাগানের বহুদূরে কে যেন ধরেছে সুরেলা গীত; ঘন চেরি-তরু-ভরা বাগানের বেড়ার কাছে গেয়ে উঠল একটি পাপিয়া শিহরিত উচ্চকণ্ঠে; উঁচু খুঁটিতে ঝোলানো কুয়েইল পাখিটি উত্তেজিত কণ্ঠে গেয়ে চলেছে সুরের প্রলাপ; ওদিকে আস্তাবলের দেয়ালের পিছনে বিরাট একটা অশ্ব তালু হ্রেষারব তুলল, আর বাগানের বাইরে গোচারণ মাঠের উপর দিয়ে একপাল কুকুর দ্রুতবেগে ছুটে চলে গিয়ে অর্ধভগ্ন প্রাচীন নুনের ভাণ্ডারের কালো আবছায়ায় বিলীন হয়ে গেল।
কনুইয়ের উপর ভর করে কাতেরিনা একটুখানি উঠে বাগানের লম্বা লম্বা ঘাসের দিকে তাকাল– উজ্জ্বল চন্দ্রালোক ঘাসের উপর পড়ে ঝিলিমিলি লাগিয়েছে, তারই আভা গাছগুলোর ফুলে পাতায় নেচে নেচে বিচ্ছুরিত হচ্ছে। যেন কল্পলোকের অবর্ণনীয়, অত্যুজ্জ্বল লক্ষ লক্ষ চন্দ্রচূর্ণ দীর্ঘ তৃণরাজিকে স্বর্ণমণ্ডিত করে দিয়েছে; এমনই তাদের নিরবচ্ছিন্ন কম্পন, এমনই তাদের নিরবচ্ছিন্ন স্পন্দন যে মনে হয় এরা বহ্নিশিখার প্রজাপতি কিংবা যেন বৃক্ষ নিম্নের তুণরাজি চন্দ্ররশ্মির জাল-আবরণে বন্দি হয়ে এদিকে-ওদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায়।
কাতেরিনা তাকিয়ে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে বলল, আহা, সেরেজা, কী মধুর, কী সুন্দর সব সব!
সেরগেই চতুর্দিকের দৃশ্যের দিকে তাচ্ছিল্য নয়নে একবার শুধু তাকাল।
তুমি অমন মনমরা হয়ে আছ কেন, সেরেজা? না, আমার ভালোবাসার প্রতিও তোমার অবসাদ এসে গেছে?
কী আবোল-তাবোল বকছ?– সেরগেই নীরস কণ্ঠে উত্তর দিল; তার পর নিচু হয়ে কাতেরিনাকে অলসভাবে চুমো দিল।
কাতেরিনার হৃদয়ে হিংসা এসেছে; বলল, তুমি প্রতারণা করছ সেরেজা; তোমার প্রেমে স্থিরতা নেই।
সেরগেই শান্তকণ্ঠে উত্তর দিল, তোমার কথাগুলো আমার উদ্দেশে বলেছ একথাই আমি স্বীকার করব না।
তা হলে তুমি আমাকে এভাবে চুমো খেলে কেন?
সেরগেই তাচ্ছিল্যভরে এর কোনও উত্তরই দিল না।
সেরগেইয়ের কোঁকড়া চুল নিয়ে খেলা করতে করতে কাতেরিনা বলে যেতে লাগল, স্বামী-স্ত্রীই তো শুধু একে অন্যকে এরকম চুমো খায়– যেন একে অন্যের ঠোঁট থেকে ঠোনা মেরে ময়লা মুছে দেয়। তুমি আমাকে এমন চুমো খাও, যেন আপেলগাছ উপর থেকে আমাদের উপর সবে-ফোঁটা ফুলের বর্ষণ লাগিয়ে দেয়।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক এইরকম ঠিক এইরকম, ঠিক এইরকম! চুপি চুপি কানে কানে গুঞ্জন করল কাতেরিনা।- দয়িতকে ঘনতর আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে সে তখন হৃদয়াবেগে নিজেকে সম্পূর্ণ জলাঞ্জলি দিয়েছে।
কিছুক্ষণ পরে কাতেরিনা বলল, সেরেজা, এবারে যা বলছি, তুমি মন দিয়ে শোন। আচ্ছা বল তো, সবাই কেন একবাক্যে বলে, তোমার প্রেমে স্থিরতা নেই।
আমার সম্বন্ধে কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করে এসব মিথ্যে কথা বলে কে?
সবাই তো এই কথা বলে।
হয়তো যেসব হাড়ে হাড়ে অপদার্থগুলোকে আমি ত্যাগ করেছি, তারাই।
ওরে হাবা, ওসব অপদার্থগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার তোমার কী দরকার ছিল? যে মেয়ে সত্যি অপদার্থ তার সঙ্গে তুমি আদপেই প্রেম করতে যাবে কেন?
বল, বলে যাও, বলা বড় সোজা। মানুষ কি সূক্ষ্ম বিচার-বিবেচনা করে প্রেমে পড়ে? এর পিছনে কাজ করে একমাত্র প্রলোভন। ওদের কোনও একটার সঙ্গে বিধিভঙ্গ করলে অতি সোজা, কোনও মতলব না, কিছু না, ব্যস্ হয়ে গেল। তার পর মেয়েটা রইল তোমার গলায় ঝুলে! গুলে খাওগে তার পর সেই প্রেম।
তা হলে, শোন, সেরেজা! আমার পূর্বে কারা সব এসেছিল তাদের সম্বন্ধে আমি কিছুই জানিনে, আর আমি ওদের সম্বন্ধে কোনও কিছু জানতেও চাইনে। শুধু এইটুকু বলার আছে : তুমি নিজে আমাদের এই প্রেমের পথে আমাকে প্রলোভিত করে টেনে এনেছ, এবং তুমি নিজে খুব ভালো করেই জানো, আমি যে এতে পা দিয়েছি তার জন্য তোমার ছলা-কৌশল যতখানি দায়ী আমার নিজের কামনাও ততখানি– আমি তোমায় কথা দিচ্ছি, সেরেজা, তুমি যদি কোনওদিন বেইমানি কর, তুমি যদি অন্য কারওর জন্য তা সে যে-ই হোক না কেন, আমাকে বর্জন কর, আমি তা হলে কস্মিনকালেও– মাফ কর, আমার হৃদয়ের বন্ধু এ-দেহে প্রাণ থাকতে কস্মিনকালেও তোমাকে কিছুতেই ছেড়ে যাব না।