- বইয়ের নামঃ পঞ্চতন্ত্র – ২য় পর্ব
- লেখকের নামঃ সৈয়দ মুজতবা আলী
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
অদ্যাপিও সেই খেলা খেলে গোরা রায় মধ্যে মধ্যে ভাগ্যবানে দেখিবার পায়
এই ‘দেশ’ পত্রিকাতেই আমার এক সতীর্থ কিছুদিন পূর্বে ‘ফরেন ডিগ্রি’-ধারীর দম্ভের প্রতি ক্ষণতরে ঈষৎ ভ্রুকুটিকুটিল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মর্মঘাতী আপন মূল বক্তব্যে চলে যান। হয়তো সে স্থলে এ বিষয় নিয়ে সবিস্তর আলোচনা করার অবকাশ ছিল না, অর্থাৎ তিনি শেখ চিল্লির মতো মূল বক্তব্যের লাভ এবং ঈষৎ অবান্তর বক্তব্যের ফাউ দুটোই হারাতে চাননি।
ওহ! গল্পটি বোধ হয় আপনি জানেন না, কারণ শেখ শ্রীযুক্ত চিল্লি জাতে খোট্টা এবং বাংলা দেশে কখনও পদার্পণ করেননি। যদ্যপি শ্ৰীযুক্তা সীতা এবং শান্তা এবং খুব সম্ভব তাদের অগ্রজও মিয়া শেখ চিল্লির সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেবার চেষ্টা করেছেন উপকথার মারফতে– স্বর্গত রামানন্দের পরিবার যে খোট্টাই দেশে বাল্যকাল কাটিয়েছেন সে কথা আগে জানা না থাকলেও তার শতবার্ষিকী উপলক্ষে লিখিত প্রবন্ধাদি পড়ে বহু বাঙালিই জেনে গিয়েছে। কিন্তু এ স্থলে আমার যে গল্পটি স্মরণে এল সেটি বোধ হয় তারা ইতোপূর্বে সবিস্তর বয়ান করে আমাকে পরবর্তী যুগের ‘চোর’ প্রতিপন্ন করার সুব্যবস্থা করে যাননি– এই ভরসাতেই সেটি উল্লেখ করছি। করে গেলেও ঝুটমুট ‘ঝেপবার ভয় নেই কারণ গল্পটি ক্লাসিক পর্যায়ের, অর্থাৎ এর বিষয়বস্তু সর্বসাধারণের কার্যকলাপে নিত্য নিত্য সপ্রকাশ হয় বলে এটি নিত্যদিনের ব্যবহার্য গল্প।
মা সরস্বতীর বর পাওয়ার পূর্বে কালিদাস যে আক্কেল-বুদ্ধি ধারণ করতেন, হিন্দি-উর্দু ভাষীদের শেখ চিল্লিও সেই রকম আস্ত একটি ‘পন্টক’ (‘কণ্টক’ থেকে ‘কাঁটা’, সেই সূত্রানুযায়ী ‘পন্টক’ থেকে কী উৎপন্ন হয় সে তত্ত্ব সুচতুর পাঠককে বুঝিয়ে বলতে হবে না; আসলে এই গূঢ় তত্ত্বটি আবিষ্কার করার ফলেই শ্রীযুক্ত সুনীতি চট্টো অস্মদ্দেশীয় শব্দতাত্ত্বিকদের পঙক্তিতে আপন তখৎ-ই-তাউসে গ্যাঁট হয়ে বসবার হকক কব্জা করেন।)
সেই শেখ চিল্লিকে তাঁর মা হাতে একটি বোতল আর পয়সা দিয়ে বাজার থেকে তেল কিনে আনবার আদেশ দিলেন এবং পুত্রের পেটে কী পরিমাণ এলেম গজগজ করছে সেটা জানতেন বলে পইপই করে স্মরণ করিয়ে দিলেন, আসল তেলটা পাওয়ার পর সে যেন ফাউ আনতে না ভোলে। শেখ চিল্লি একগাল হেসে বললেন, ‘তা-ও কখনও হয়!’
আমি জানি, আজকের দিনের পাঠক কিছুতেই বিশ্বাস করবেন না যে, কোনও জিনিসের দাম বাজারে কস্মিনকালে কখনও কমে। কিন্তু কমতেই হবে, এই হালের সুকুমার রায়ের যুগেও ‘বাড়তি’ ‘কমতি’ ছিল– এমনকি বয়সের বেলাও। আমি যে যুগের বয়ান দিচ্ছি সেটা তারও বহু পূর্বেকার। তাই মিয়া চিল্লির আম্মাজানের অজানতেই বাজারে তেলের দর হঠাৎ কমে গিয়েছিল! হয়তো কোনও ‘রাধা’কে নাচাবার জন্য নবাব সাহেবের ‘ন মণ তেলে’র প্রয়োজন হওয়াতে তিনিও শায়েস্তা খানের মতো তেলের দর সস্তায় বেঁধে দিয়ে বাজার শায়েস্তা করেছিলেন। সেটা এ যুগের ‘সন্দেশ’ শায়েস্তা করতে গিয়ে স্বহস্তে স্বপৃষ্ঠে ভূতের কিল খাওয়া নয়।
তা সে যা-ই হোক, তেল সস্তা হয়ে যাওয়ার দরুন মূল তেলেই বোতল কানায় কানায় ভরে গেল। শেখ চিল্লির ঘটে বুদ্ধি কম ছিল সত্য কিন্তু তার স্মৃতিশক্তিটি আমাদের ‘দাদখানি তেল, মসুরির বেল’-এর মতো ছিল না। তিনি দোকানিকে বললেন, ‘ফাউ?’
দোকানি বললে, ‘কী আপদ, বোতলে জায়গা কোথায়?’
শেখ বললেন, ‘বট্যে! চালাকি পেয়েছ? এই তো জায়গা।’ বলে তিনি বোতলটি উপুড় করে বোতলের তলার গর্তটি দেখিয়ে দিলেন। মেরি মাগডেলেন যে খ্রিস্টের পদদ্বয় তৈলাক্ত করেছিলেন সেটাকেও হার মানালেন শেখ– অবশ্য স্বহস্তে। দোকানি মুচকি হেসে সেই গর্তটি এক কাচ্চা তেল নিয়ে ভরে দিয়ে শেখের ফাউয়ের খাইও ভরে দিল।
বোতলটি অত সন্তর্পণে ‘স্টাটুস কুয়ো’ বজায় রেখে ধরে ধরে শেখ বাড়ি পৌঁছে মাকে বললেন, ‘এই নাও আম্মা, তোমার ফাউ।’ তার পর বোতলটি উল্টে খাড়া করে ধরে বললেন, ‘আর ভেতরে তোমার আসল।’
আম্মা-জানের পদদ্বয় অবশ্য খ্রিস্টের তুলনায় অল্পই অভিষিক্ত হল।
***
দেশ থেকে যে বোতলটি নিয়ে এ-দেশের ছাত্র বিদেশে বিদ্যার তেল–না ভুল বললুম, ডিগ্রির তেল কিনতে যায়, সেটি নিয়ে সে কোনও শেখ চিল্লির মতো কী বেসাতি করে সে তত্ত্বটি অনেকেরই জানা নেই। না জানারই কথা, কারণ ইংরেজ আমলের পূর্বে এ-দেশে কখনও এই ‘ফরেন’ ভূতের উপদ্রব হয়নি। মুসলমান আমলে কী হয়েছিল সেটা পরের কথা। তার পূর্বে কোনও ভারত-সন্তান ফরেন ডিগ্রির জন্য কামচাটকা থেকে কাসাব্লাঙ্কা কোথাও গিয়েছে বলে শুনিনি। তবে জাতক পড়লে পাই, ওই যুগে তক্ষশিলা ছিল বৌদ্ধজ্ঞানবিজ্ঞানচর্চার কেন্দ্র এবং বারাণসী ছিল সনাতন ধর্ম-জ্ঞানবিজ্ঞান-চর্চার জন্য সর্বপ্রসিদ্ধ তীর্থ। তাই জাতকের একাধিক গল্পে পাই, বৌদ্ধ কিংবা বৌদ্ধভাবাপন্না বারাণসী গৃহী পুত্রকে তক্ষশিলায় বিদ্যার্জনের জন্য পাঠাতেন। তদ্রূপ কাশী সর্বকালেই সনাতন ধর্ম ও জ্ঞানবিজ্ঞানের কেন্দ্রভূমি থাকা সত্ত্বেও হয়তো বিক্রমাদিত্যের যুগে সারা-ভারতের কোনও কোনও অঞ্চল থেকে কিছু ছাত্র উজ্জয়িনীতে বিদ্যাভ্যাস করতে গিয়েছে।
মুসলমান আমলে রাজকার্য তথা জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা ফার্সিতে হত। (বৌদ্ধধর্ম লোপ পাওয়ার ফলে বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো লোপ পায়; কিন্তু কাশী ও পরবর্তী যুগে বৃন্দাবনে হিন্দুশাস্ত্র চর্চার ব্যাপক ব্যবস্থা ছিল এবং এখনও আছে।) কিন্তু ফার্সি যদিও পারস্যের ভাষা, তবু এ দেশের কোনও ফার্সি শিক্ষার্থী তেহরান বা মেশেদ শহরে ফার্সি শিখতে যেত না। ধর্ম-চর্চার জন্য ছাত্রেরা পড়ত আরবি, কিন্তু তারাও মক্কা, মদিনা বা কাইরোতে গিয়ে ফরেন ডিগ্রি নিয়ে আসত না। অবশ্য কোনও কোনও ছাত্র এ দেশে পাঠ সমাপন করে মক্কায় গিয়ে হজ করার সময় কাবার চতুর্দিকে যে পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তৃতা দেওয়া হয়, সেগুলো শুনে নিত। অধীনের মাতামহ তাই করেছিলেন।
বিদেশে না যাওয়ার কারণ এ-দেশেই আরবি-ফার্সির মাধ্যমে উত্তম জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ব্যবস্থা ছিল। এবং পাঠান-মোগল যুগেও কাবুল, কান্দাহার বা মজার-ই-শরীফে কোনও বড় কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি উঠেছিল দেওবন্দ, রামপুর, সুরট অঞ্চলের রাঁদেরে, হায়দ্রাবাদে, ঢাকায়, সিলেটে। বস্তুত কাবুল অঞ্চলের মেধাবী ছাত্র মাত্রই আমানুল্লার আমল পর্যন্ত দিল্লি অঞ্চলেই পড়াশুনো করতে আসত। আমি কাবুলে যাই ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে। তখন যে কয়টি আরবি-ফার্সিজ্ঞ পণ্ডিতের সঙ্গে সেখানে আমার আলাপ-পরিচয় হয় তারা সকলেই উর্দুও জানতেন, কারণ সকলেই বিদ্যাভ্যাস করেছিলেন ভারতে। ঠিক সে রকম বৌদ্ধ যুগে চীনা তথা অন্যান্য বৌদ্ধধর্মাবলম্বী শ্ৰমণরা এদেশে শিক্ষালাভের জন্য আসতেন, এখনও অল্পবিস্তর আসেন।
এমনকি, যে কাইরোর আজহার বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় এক হাজার পনের বছর ধরে ধীরে ধীরে মুসলিম শাস্ত্রচর্চার সর্বশ্রেষ্ঠ সর্ববৃহৎ সর্বাপেক্ষা বিত্তশালী কেন্দ্ররূপে স্বীকৃত হয়েছে, সেখানেও ভারত থেকে কখনও খুব বেশি ছাত্র যায়নি। আমি যখন (১৯৩৪-৩৫) কাইরোতে ছিলুম তখন পাক (বর্তমান)-ভারত উভয় মিলিয়েও ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ জনারও বেশি ছাত্র ছিল না। পক্ষান্তরে, সেখানে আরবি দর্শনের যে পাঠ্যপুস্তক সম্মানিত ছিল, সেটি জনৈক ভারতীয় মৌলানা দ্বারা লিখিত।
এস্থলে সম্পূর্ণ অবান্তর নয় বলে উল্লেখ করি, সাত শ বছর আরবি-ফার্সির কঠিন একনিষ্ঠ সাধনা করে ভারতীয় মৌলবিরা জ্ঞানবিজ্ঞান ধর্মচর্চায় খ্যাতি অর্জন করেছিলেন সত্য, কিন্তু আরবি দূরে থাক, ফার্সি সাহিত্যেও কোনও কৃতিত্ব দেখাতে পারেননি। তার একমাত্র কারণ মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য কোনও ভাষায় সাহিত্যের কুবৃমিনার গড়া অসম্ভব। তাই যখন দেখি, মাত্র এক শ বছর ইংরেজি চর্চার পর এদেশে কেউ কেউ সে সাহিত্যে টিপি তৈরি করে ভাবছেন সেটি মিনার তখন বড়ই বিস্ময় বোধ হয়। তারা কি সত্যই ভাবেন, সেই সাত শ বছরের তাবৎ গুণীজ্ঞানীরা এবং তারা রাজার্থানুকূল্য পেয়েছিলেন চেরাপুঞ্জির বর্ষণের চেয়েও বেশি এদের তুলনায় অতিশয় কুকুট মস্তিষ্কধারী ছিলেন? তখন যখন দেখি র্যাঁবোর বদলে হ্র্যাঁবো–তা হলে ‘rare’ অর্থাৎ ‘বিরল’ হবে ‘হ্রাহ’, France হবে ফৃহাঁস এবং সেখানে ‘r’ অক্ষরের সঙ্গে উ-কার যুক্ত, যেমন ‘প্রুস্ত’, সেখানে গতি কী? কারণ ‘প’র নিচে হ’ তারও নিচে উ-কার দিয়ে তৈরি কোনও হাঁসজারুই’ (হাঁস+সজারু+রুই) জাতীয় অক্ষর তো বাংলা ছাপাখানায় নেই- তখন শুধু সবিনয় সকাতর সভয়ে প্রশ্ন শুধোতে ইচ্ছা করে, ‘আপনারা তরুণরা, যে নানাবিধ ভাষা শিখেছেন সেটা বড়ই আনন্দের কথা, কিন্তু একবার একটু ভেবে নিলেই তো হয় যে মাইকেল, জ্যোতি ঠাকুর, বীরবল, ধ্বনিবিদ সুনীতি চট্টো, শহীদুল্লা এঁরা কেউই এই বিদকুটে ফরাসি ‘র’ ধ্বনি যে আলাদা সেটা লক্ষ করলেন না, এটা কী প্রকারে সম্ভবে?’ এবং শেষ নিবেদন জানি আপনারা পেত্যয় যাবেন না, ফরাসি জর্মন এমনকি ইংরেজি ও বাংলা ‘র’-এর মতো নয় সেটা সত্য, কিন্তু তাদের ‘r’-এর সঙ্গে যে আমাদের ‘র’ মিলছে না সেটা আমরা ‘র’-এর উচ্চারণ করার সময় মুখগহ্বরের অন্য জায়গা থেকে করি বলে নয়–তাদের আপত্তি আমরা ‘r’ উচ্চারণের সময়ে সেটিকে ‘ট্রিল’ করি বলে, অর্থাৎ আমরা যখন বলি ‘পারি’ (প্যারিস) তখন ফরাসি শুনতে পায় যেন আমরা ‘r’-টা তিনবার উচ্চারণ করে বসে আছি। বিচক্ষণ ফরাসি শুরু তদ্দণ্ডেই বলেন, ‘কিন্তু মসিয়ো, Paris শব্দে মাত্র একটি “r “, আপনি তিনটে “r” উচ্চারণ করলেন যে?’ আমি আরও জানি– আপনারা আরও পেত্যয় যাবেন না। যদি বলি, ফরাসি-জর্মন উভয় অভিনেতাই [এবং উচ্চারণের ক্ষেত্রে ধ্বনিবিদ পণ্ডিতের চেয়ে এরাই সর্বসাধারণের কাছে অধিকতর সম্মান লাভ করেন–ইংলন্ডেও বার্নার্ড শ-কে যে বিবিসি উচ্চারণ-বোর্ডে সসম্মানে নিমন্ত্রণ করা হত তার কারণ তাঁর সাহিত্যিক খ্যাতি নয়, নাট্যে উচ্চারণ বাবদে তার ওয়াকিবহালত্ব]। চেষ্টা করেন বাঙালির ‘র’-র মতো আপন ‘r’ উচ্চারণ করতে!!! –কিন্তু ট্রিল না করে। অর্থাৎ জৰ্মনে যাকে বলে হ্যাল(১)– উজ্জ্বল, ফরাসিতে যাকে বলে ক্ল্যার– ক্লিয়ার, পরিষ্কার, স্বচ্ছ ‘r’ উচ্চারণ করাটাকে আদর্শ ‘r ‘ উচ্চারণ মনে করেন। তাই মোটামুটি ভাবে বলা যায় ফরাসি বা জর্মন এমন ইংরেজি ‘r’ উচ্চারণ করার সময় যদি জিভটাকে মুখের ভিতর ঝুলিয়ে রেখে অর্থাৎ সেটাকে তালু, মূর্ধা বা দাঁতের পিছনে ছুঁতে না দিয়ে, এবং কাজে কাজেই কোনও প্রকারের ট্রিল বা ফ্ল্যাপ করবার সুযোগ না দিয়ে বাংলা ‘র’ ধ্বনি উচ্চারণ করা হয় তবে ওই তিন ভাষায় ধ্বনিবিদ পণ্ডিতরাই আদর্শ ‘r’ উচ্চারিত হয়েছে বলে মনে করেন। তার পর অবশ্য যদি কেউ সেটাকে খাঁটি প্যারিসিয়ান করতে চান তবে সেটা গলা থেকে আরবি ‘গাইন’ ঘেঁষা করবেন, দক্ষিণ-ফ্রান্সের মতো করতে হলে ফার্সি ‘খে’ ঘেঁষা করবেন এবং জর্মন বলার সময় কলোন-বন্ অঞ্চলের ‘r’ উচ্চারণ করতে হলে সেটাকেও ওই ফার্সি ‘খ’ ঘেঁষা করবেন। কিন্তু সর্বক্ষণ সাবধান থাকতে হবে যে, ট্রিলিং দুষ্কর্মটি যেন করা না হয়। বীরভূম অঞ্চলে যখন ‘রাম’-এর পরিবর্তে আম উচ্চারণ শোনা যায় তখন ওই ট্রিলটি করা হয় না বলে এবং রেডুকৎসিয়ো আড আবসুর্ডুম হয়ে যাওয়ার ফলে ‘r’-এর সর্বনাশ হয়ে ‘অ’ ধ্বনিতে পরিবর্তিত হয়। ইংরেজিতেও তাই, কিংবা প্রায় তাই হয় যখন ‘r’ কোনও স্বরবর্ণের পরে আসে। যথা hard’; এস্থলে ‘r’ শুধু আগের a-টিকে দীর্ঘ করে। ‘r’-এর পরিপূর্ণ ব্যঞ্জনধর্ম লোপ পায় কি না সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে বলে কোনও কোনও ধ্বনিবি উচ্চারণ দেখাবার সময় তাই ‘r’ হরফটি উল্টো করে দিয়ে লেখেন এবং ছাপাখানায় হরফটি উল্টো করে ছাপা হয়– লাইনো বা টাইপ রাইটারে অবশ্য সেটা সম্ভব নয়। আর ‘r’ বলার সময় যদি বাংলার মতো সেটাকে ট্রিল করতে চান, তবে প্রাণ ভরে করা যায় ইতালির ‘r’ উচ্চারণ করার সময়। ইংরেজিতে যে স্থলে ‘Irregular’ বলার সময় প্রথম যে দুটো ‘r’ একসঙ্গে এল, সে দুটো দু বার উচ্চারণ করতে তো দেয়ই না, একবারই বাংলার হিসেবে প্রাণভরে করতে দেয় কই? সেখানে ইটালিয়ান ‘birra’ (বিয়র) বলার সময় যদি ‘r’টা প্রেমসে ট্রিল না করেন কম-সে কম দু বার– তবে বিয়ারের বদলে সেই যে ফুটোয় ভর্তি একরকম পনির হয়, বেয়ারা তারই ফুটোগুলো শুধু প্লেটে করে হয়তো নিয়ে আসবে! এবং শেষ কথা : ফরাসি-জর্মন ধ্বনিবিদ যে তাঁদের ‘r’ পরিষ্কার ক্ল্যার হ্যাল উজ্জ্বল রাখতে চান, তার অন্যতম কারণ, গ্রিক এবং লাতিনে যে ‘r’ আছে সেটা সংস্কৃত ‘র’-এরই মতো পরিষ্কার উজ্জ্বল এবং জানা-অজানাতে ইয়োরোপীয় পণ্ডিত মাত্রই গ্রিক-লাতিন থেকে খুব দূরে চলে যেতে চান না। (এরই উদাহরণ ‘গুডবাই, মি. চিপস’ ফিল্মে আছে।)।
সত্যলাভের জন্য তৃষ্ণার্ত জন যুগে যুগে বিদেশে গিয়েছে, বিধর্মীর কাছে গিয়েছে। পয়গম্বর বলেছেন, ‘জ্ঞানলাভের জন্য যদি চীন যেতে হয় তবে সেখানে যেয়ো, বলা বাহুল্য, তাঁর আমলে চীন দেশে কোনও মুসলমান ছিলেন না এবং তাই ধরে নিতে পারি বিধর্মী ‘কাফেরে’র কাছ থেকে জ্ঞানসঞ্চয় করতেও তিনি আপত্তিজনক কিছু পাননি।
কিন্তু এই যে ‘ফরেন’ যাওয়ার হিড়িক আরম্ভ হল প্রায় শ’খানেক বছর আগে এবং স্বরাজ পাওয়ার পর কিমাশ্চর্যমতঃপরম এখনও বাড়তির দিকে, তার বেশিরভাগই ছিল “ইস্টাম্বো’ নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে পেটকে এলেমে ভর্তি করার জন্য নয়। পাঠান এবং মোগল রাজারা এ দেশেই বাস করতেন, এইটেই তাঁদের মাতৃভূমি, কাজেই বিদেশের ইস্টাম্বোর প্রতি তাঁদের কোনও অহেতুক মোহ ছিল না– যদিও বিদেশাগত হুনুরি গুণীকে তারা আদর করে দরবারে স্থান দিতেন। কিন্তু ইংরেজ কলকাতায় বসেও চোখ বন্ধ করে তাকিয়ে থাকত লন্ডনের দিকে, Kedgeree (কেজরীঃ– খিচুড়ি– কৃশর, কৃশরান্ন?) খাওয়ার সময় চিন্তা করত আল্লায় মালুম কিসের!
অতএব সেখানে থেকে যদি কপালে একটি ‘ইস্টাম্বো’ মারিয়ে নিয়ে আসা যায় তবে পেটে আপনার এলেম গজগজ করুক আর নাই করুক, আপনি ‘ফ্রেশ ফ্রম্ ক্রিস্ট্রিয়ান হোম’, আপনিও এখন গোরা রায়। তাই স্বরাজ লাভের পরও।
অদ্যাপিও সেই খেলা খেলে গোরা রায়।
দিবাভাগে মন্দ ভাগ্যে তার মার খায়।
১৬।১০।৬৫
———-
১. কথাটা জর্মনে hell, কিন্তু বাংলায় আমি ‘হেল’ না লিখে হাল কেন লিখলুম সে বিষয় নিয়ে সুদূর ভবিষ্যতে আলোচনা করবার আশা রাখি। কারণ জনৈক পত্ৰলেখক ইটিকে আমার ‘হিমালয়ান ব্লান্ডার’ পর্যায়ে ফেলেছেন।
অনুবাদ সাহিত্য
কিছুদিন ধরে লক্ষ করছি, অনুবাদ যে অনুবাদ সেটা স্বীকার করতে প্রকাশক, সম্পাদক, স্বয়ং লেখকেরও কেমন যেন একটা অনিচ্ছা। কেন, এ প্রশ্ন শুধাতে একজন প্রকাশক সোজাসুজি বললেন, ‘বাঙালি অনুবাদ পড়তে ভালোবাসেন না, তাই অসাধু না হয়ে যতক্ষণ পারি ততক্ষণ তথ্যটা চেপে রাখি।’ কিছুকাল পূর্বে আমিও একটি বড় গল্প অনুবাদ করি ও তার প্রথম বিজ্ঞাপনে সেটি যে অনুবাদ সে কথা প্রকাশিত হয়নি। আমি সেই সম্পাদককে বেনিফিট অব ডাউট দিয়ে মনকে সান্তনা দিচ্ছি এই বুঝিয়ে যে দ্বিতীয় বিজ্ঞাপনে এই গাফিলতি মেরামত করা হবে। ওই সময়ে আমারই সহকর্মী (কারণ দু জনাই দেশ-সেবক এবং তিনি অন্যার্থেও) শ্ৰীযুত বিদুর ওই নিয়ে কড়া মন্তব্য করে যা বলেন তার নির্যাস, যত বড় লেখকই হোন না কেন, তিনি যদি অনুবাদ-কর্ম করেন তবে সেটা যেন পরিষ্কার বলে দেওয়া হয়। অতিশয় হক কথা। তবে এটা আমি গায়ে মাখছিনে, কারণ আমি ‘যত বড়’ কেন অ্যাটটুন বড় লেখকও নই। আমি বরঞ্চ গোড়াতেই চেয়েছিলুম যে ফলাও করে যেন বলা হয়, এটি অনুবাদ। এবং সেই মূল প্রখ্যাত লেখকের অনুবাদ প্রসাদাৎ তার সঙ্গ পেয়ে আমি কিছুটা খ্যাত হয়ে যাব—‘রাজেন্দ্র সঙ্গমে, দীন যথা যায় দূর তীর্থদরশনে।’(১) কিংবা কালিদাস রঘুবংশের অবতরণিকায় যে কথা বলেছেন–বজ্র কর্তৃক মণি সছিদ্র হওয়ার পর আমি সুতো সুরুৎ করে বেতলিফ উৎরে যাব।
এবং এ-স্থলে এটাও স্মরণ রাখা উচিত, কালিদাস বা মধুসূদন কেউই বাল্মীকির আক্ষরিক কেন, কোনও প্রকারেরই অনুবাদ করেননি। সম্পূর্ণ নিজস্ব মৌলিক কৃতিত্ব দেখিয়েও এরা অতখানি বিনয় দেখিয়েছেন। মডার্ন কবিতা যে আমার পিত্তি চটিয়ে দেয়, তার অন্যতম কারণ এঁদের অনেকেরই অভ্রংলিহ দম্ভ। ‘আধুনিক’ গাওয়াইদের কণ্ঠেও সেই সুর শুনতে পাই। আর মডার্ন পেন্টাররা কী করেন–অন্তত তাঁদের দু জনার ব্যবহার সম্বন্ধে তো অনেক কথাই বেরিয়েছে।
কিন্তু সেকথা থাক। আমার প্রশ্ন, অনুবাদ পড়তে বাঙালি ভালোবাসে না কেন?
আমার কিন্তু কথাটা কেন জানি বিশ্বাস করতেই ইচ্ছে যায় না।
বাংলাভাষার কচিকাঁচা যুগে কালীপ্রসন্ন সিংহ মহাভারতের অতি বিশুদ্ধ আক্ষরিক অনুবাদ করেন। আজ পর্যন্ত যে তার কত পুনর্মুদ্রণ হল তার হিসাব হয়তো আজ বসুমতীই দিতে পারবেন না। পাঠকদের শতকরা ক-জন নিছক পুণ্য-সঞ্চয়ার্থে এ অনুবাদ পড়েছে। এমনকি রাজশেখর বসুর অনুবাদও– যদিও একটি বারো বছরের ছেলেকে বলতে শুনেছি, ‘ওই বসুমতীরটাই ভালো। বেশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে লেখা– ধীরেসুস্থে পড়া যায়। রাজশেখর বাবুরটায় বড় ঠাসাঠাসি।’ ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’ ‘বত্রিশ সিংহাসন’ এ যুগের ছেলেমেয়েরাও তো গোগ্রাসে গেলে। (বিষ্ণুশর্মার ‘পঞ্চতন্ত্রে’র আরবি অনুবাদ ইরাক থেকে মরক্কো পর্যন্ত আজও আরব্য রজনীর সঙ্গে পাল্লা দেয়।) ঈশান ঘোষের জাতক জনপ্রিয় হওয়ার পূর্বেই বাজার থেকে উধাও হয়ে গেল– (পরম পরিতাপের বিষয় যে এখনও তার পুনর্মুদ্রণ হল না) অথচ তার থেকে নেওয়া বাচ্চাদের জাতক তাদের ভিতর খুব চলে। জ্যোতি ঠাকুরের সংস্কৃত নাটক ও ফরাসি কথাসাহিত্যের অনুবাদ এককালে বিদগ্ধ বাঙালিই পড়ত। ওদিকে এসবের বহু পূর্বে আলাওল অনুবাদ করলেন– যদিও আক্ষরিক নয়—জয়সী’র ‘পদুমাবৎ’। এবং তার পরপর বেরুল ‘ইউসুফ-জোলেখা’, ‘লায়লী-মজনু’ ইত্যাদি। মোল্লার বাড়িতে এবং পুব-বাংলার খেয়াঘাটে, বটতলায় এখনও তাদের রাজত্বের অবসান হয়নি; ওদিকে কাশীরাম, কৃত্তিবাস। ‘আরব্যোপন্যাস’, ‘হাতিমতাই’, ‘চহারদরবেশ’ ঊনবিংশ শতাব্দীতেই বাংলা দেশে নাম করেছে। তার পর ‘রবিনসন ক্রুসো, ‘গালিভার্স ট্রেভল’ এবং ফরাসি থেকে ‘লে মিজেরাবল’ এদেশে কী তোলপাড়ই-না সৃষ্টি করল।
আমি অতি সংক্ষেপে সারছি। কিন্তু আমার বয়েসী কোনও পাঠক ‘তীর্থসলিল’ ‘তীর্থরেণু’র কথা ভুলতে পারবেন? সত্যেন দত্ত অনুবাদের যাদুকর। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ সত্যেন দত্তের শোকসভাতে বলেছিলেন, ‘যে-দিন দেখলুম সত্যেন আমার চেয়ে ঢের ভালো অনুবাদ করতে পারেন ও ছন্দের উপর তাঁর দখল আমার চেয়ে অনেক বেশি, সেই দিনই অনুবাদ-কর্ম থেকে অবসর নিলুম। তার পর ভালো কবিতা চোখে পড়লেই সত্যেনকে অনুবাদ করতে বলতুম।’ (এস্থলে যদিও অবান্তর তবু স্মরণে আনি, রবীন্দ্রনাথ নিজের মৌলিক রচনা কিছুক্ষণের জন্য ক্ষান্ত দিয়ে সত্যেন দত্তের ‘চম্পা’ কবিতাটি ইংরেজি
অনুবাদ করেন।)
আর বর্তমান যুগের হীরেন দত্ত মহাশয়ের ‘তিন সঙ্গী’ যাঁরাই পড়ছেন, তাঁরাই স্বীকার করবেন, এরকম অনবদ্য অনুবাদ হয় না।
এর একটু তথাকথিত ‘নিম্নপর্যায়ে’ নামলেই দীনেন্দ্রকুমারের ‘রহস্যলহরী’। বাংলা দেশের হাজার হাজার নারী-নরকে এর অনুবাদ আনন্দ দিয়েছে। দীনেন্দ্রকুমার লিখতেন অতি সরল, ছলছল-গতির বাংলা পাঠককে কোনও জায়গায় হোঁচট খেতে হত না। তার মৌলিক গ্রন্থ ‘পল্লীচিত্র’ নামটি আমার ঠিক মনে নেই– পড়লে তার বাংলা-শৈলী ও ভাষার সরলতা ও আপন বৈশিষ্ট্য পাঠককে আরাম ও চমক দুই-ই দেয়। (অরবিন্দ ঘোষ যখন বরোদায় চাকরি নিয়ে বাংলা শেখার জন্য গুরুর সন্ধান করেন, তখন দীনেন্দ্রকুমারকে সেখানে পাঠানো হয়। পরবর্তী যুগে যখন তিনি তাঁর অতুলনীয় মধুর বাংলায় পাঠকের কৌতূহল সদাজাগ্রত রেখে তাঁর জীবনস্মৃতি বিশেষ করে বরোদার ইতিহাস ও শ্রীঅরবিন্দের সাহচর্য সম্বন্ধে লেখেন, তখন তিনি দুর্ভাগ্যক্রমে দু-একটি বিতর্কমূলক তথ্য বলে ফেলেন। আমার ব্যক্তিগত মতে তিনি সম্পূর্ণ সত্যভাষণই করেছিলেন। ও আমার অগ্রজ, কাঙাল হরিনাথ, দীনেন্দ্রকুমার, মীর মুশররফ হুসেন কুষ্টিয়ায় সরেজমিন গবেষণা করে ওই সিদ্ধান্তেই পৌঁছন। ফলে তখনকার দিনের মাসিক-সাহিত্য মহলের এক বলবান ক্লিক্ দীনেন্দ্রকুমারকে, জাস্ট হাউন্ডেড় হিম আউট অব বেঙ্গলি লিটারেচার। সেই অনুপম জীবনস্মৃতি শেষ করার সুযোগও তখন তিনি পাননি। অথচ আমি যখন তাঁর লিখিত শ্রীঅরবিন্দের সহকর্মী খাসেরাও যাদব অংশ বরোদার যাদব গোষ্ঠী ও অন্যান্য মারাঠাদের অনুবাদ করে শোনাই তখন তাঁরা অশ্রুবিসর্জন করে বলেন, ‘বাংলা দেশই শুধু সে যুগের মারাঠী বিপ্লবীদের স্মরণে রেখেছে। বাঙালি প্রাদেশিক এ কুসংস্কার আমাদের ভাঙল।’ এরপর হঠাৎ যখন দীনেন্দ্রকুমারের ধারাবাহিক বন্ধ হয়ে গেল, তখনও তারা উদগ্রীব হয়ে শুনতে চাইলেন পরের পর্বের কথা। আমি কোন লজ্জায় স্বীকার করি কেন তার লেখা বন্ধ হয়ে গেল।)
কোথা থেকে কোথা এসে পড়লুম! কিন্তু এই বিষয় নিয়ে আমার বহুদিনের মনস্তাপ— আজ বেমোকায় বেরিয়ে গেল, পাঠক ক্ষমা করবেন।
আমার মনে একটা সন্দেহ জাগে। প্রাচীন যুগের সব অনুবাদই যে উত্তম ছিল, একথা ঠিক নয়। কিন্তু এঁদের বেশিরভাগই উত্তম সংস্কৃত ও তকালীন প্রচলিত বাংলা ভাষার সঙ্গে সুপরিচিত ছিলেন। এবং পণ্ডিতজন যত বাঁকা বাংলাতেই অনুবাদ করুন-না কেন, তাঁদের শব্দভাণ্ডারের দৈন্য ছিল না বলে অনুবাদ মূল থেকে দূরে চলে যেত না। জ্যোতিরিন্দ্রনাথকৃত পিয়ের লোতির ‘ইংরেজবর্জিত ভারত’-এর অনুবাদ পড়লেই পাঠক আমার বক্তব্য বুঝতে পারবেন। লোতির শব্দভাণ্ডার ছিল অফুরন্ত (উত্তর-মেরু-সমুদ্রের আলো-বাতাসের বর্ণনা দিতে গিয়ে এক জায়গায় তিনি পর পর তিনটি শব্দ দিয়েছেন, ডায়াফনাস, এফিমেরাল, কাইমেরিক– এর অনুবাদ তো দীন শব্দভাণ্ডার নিয়ে হয় না!)। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ জানতেন অত্যুত্তম সংস্কৃত ভাসের নাটক তখনও ছাপায় প্রকাশিত হয়নি বা তাঁর হাতে পৌঁছয়নি– ভাসকে বাদ দিলে তিনি সংস্কৃতের প্রায় সব নাট্যলেখকের অনুবাদ করেছেন– তাই সে ভাষা থেকে তিনি অনায়াসে শব্দচয়ন করে মূলের বৈচিত্র্যের মর্যাদা রক্ষা করতে পারতেন। অক্ষম অনুবাদকের হস্তে সেস্থলে অনুবাদ হয়ে যায় একঘেয়ে পড়তে গিয়ে পাঠকের ক্লান্তি এসে যায়।
অধুনা একাধিক যোগ্য ব্যক্তি অনুবাদ-কর্মে লিপ্ত হয়েছেন। এঁদের কেউ কেউ ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞ। এঁরা আমার চেয়ে অনেক বেশি যুক্তিতর্ক দিয়ে প্রমাণ করতে পারেন, ইংরেজি সাহিত্য বহু ভাষা থেকে বহু বস্তু অনুবাদ করে কীভাবে পরিপুষ্ট হয়েছে, নব নব অনুপ্রেরণা পেয়েছে, নব নব অভিযানে বেরিয়েছে সেই আদিযুগের শুভক্ষণ থেকে।
আমি অনুবাদ করতে গিয়ে পদে পদে নিজের কাছে লাঞ্ছিত হয়েছি। এই লেখাটি তারই অভিজ্ঞতাপ্রসূত।
———-
(১) এই সুবাদে একটি ঘটনার কথা মনে পড়ল। গুরুদেব আমাকে কয়েক পাতা প্রুফ মেরামত করতে দেন। সেটা তৈরি হলে তার কাছে নিয়ে যেতে গিয়ে দেখি তিনি ক্ষিতিমোহন ও বিধুশেখরের সঙ্গে গল্প করছেন। আমি থামের আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে শুনি, তিনি বলছেন, বনমালী (কিংবা সাধুও হতে পারে, কিন্তু সে গুরুদেবের সঙ্গে ছিল অল্প দিন) তো গেল আমার সঙ্গে এলাহাবাদ। আমি বললুম, “ওরে বনমালী, প্রয়াগে এসেছিস; স্নান করে নিস্।” কিন্তু মশাই কী বলব, সে ও-পাশই মাড়াল না। বোধ হয় আমার সঙ্গে থেকে থেকে দেবদ্বিজে আর ভক্তি নেই। কিংবা ওই ধরনেরই। মাইকেলের কথা তা হলে সব সময়ে ফলে না।
অর্থং অর্থং
একটা ‘ফরেন’-ওলার কথাই বলি।
ইন্টারভ্যুতে আমিও ছিলুম। সেই ছাব্বিশ বছরের ‘ফরেন’–বাট ড্যাম কালা আদমি ছোকরাটা তার বাপের বয়সী ওমেদার অধ্যাপককে যা বেহায়া প্রশ্ন শুধোতে লাগল তাতে আমি স্তম্ভিত। কারণ সেই অধ্যাপকের কিছু কিছু লেখার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। এ যুগে আর কটা হিন্দু ফার্সি শিখে ভারতবর্ষের সাতশ বছরের ইতিহাস অধ্যয়ন করে? ইনি তাদেরই একজন। অথচ ওই ‘ফরেন’-পন্টক ফার্সির এক বর্ণও জানে না। শুধু ইতিহাসের অধ্যাপক ঠিক ইতিহাসও নয়, ইভলজির– বলেই গুণধর বোর্ডে এসেছেন, এবং যে-মোগল ইতিহাস সম্বন্ধে তিনি নিরেট আকাট, সেই সম্বন্ধে চোখাচোখা প্রশ্নবাণ ঝাড়ছেন। সেগুলো তৈরি করে নিয়ে এসেছেন গতকাল লাইব্রেরি থেকে, দু-তিনখানা মোগল ইতিহাসের ইংরেজি অনুবাদ পড়ে– প্রধান উদ্দেশ্য, বাদবাকি মেম্বরদের তাক লাগিয়ে দেওয়া। সে সব মেম্বররা এসেছেন অপরাপর যুনি থেকে। ফলে সে সব য়ুনিতে তিনি একসূটেশন লেকচারে নিমন্ত্রিত হবেন, এগজামিনার হবেন, বহুবিধ কনফারেন্সে নিমন্ত্রিত হবেন, তাঁর প্রিয় ছাত্রের অখাদ্য থিসিসে তারা একটারনল পরীক্ষক হিসেবে ডিটো মারবেন, তিল্লো এ-বাগে তাই করবেন, গয়রহ, ইত্যাদি এটসেটরা। কী কী প্রশ্ন শুধিয়েছিলেন, আমার ঠিক মনে নেই তবে রেডুকৎসিয়ো আড আবসুর্ডুমে পরিণত করতে যদি অনুমতি দেন তবে কাল্পনিক দু-একটি পেশ করতে পারি : ‘আকবর যখন আহমদাবাদ আক্রমণ করেছিলেন তখন সাবরমতী বেয়ে হাওয়া পূর্ব না দক্ষিণ থেকে বইছিল?’ ‘সিলেটের শাহজলাল মসজিদে পূর্বে যে জলালি কবুতর ছিল তারা এখন চলে যাচ্ছে কোথায়?’
এবং এমনই খাজা ইংরেজি উচ্চারণে যে আমি একবার দু-প্রশ্নের ফাঁকে তাঁকে কানে কানে বললুম, ‘I am glad, Oxbridge has not been able to damage your original pronunciation.’
আমি সবিনয়ে নিবেদন করছি, আমি সে অধ্যাপককে বাঁচাতে পারিনি। সেই প্রাচীন গল্প তা হলে আবার বলি। বার্নার্ড শ’র একটি নাট্য করে থিয়েটার থেকে গম গম্ করে তুলে ধরেছে, দ্রষ্টাদের সপ্রশংস চিৎকার, ‘নাট্যলেখককে স্টেজে বেরুতে বল, আমরা তাকে দেখব।’ শ’ এলেন। মিনিট পাঁচ ধরে চলল তুমুল হর্ষরব, করতালি যাবতীয়। সবাই যখন শান্ত হলেন, এবং শ তার ধন্যবাদ জানাবার জন্য মুখ খুলতে যাবেন এমন সময় সর্বশেষ সস্তা গ্যালারি থেকে একটা আওয়াজ এল ‘বূ বূ বূ বূ’! শ’ ওই দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ব্রাদার, ঠিক বলেছ; এ নাট্যটা রদ্দি। কিন্তু তোমাতে-আমাতে, মাত্র দু জনাতে, এই শত শত লোকের পাগলামি ঠেকাই কী করে!’
***
তার পরই আমি বিদেশ চলে যাই। না, স্যার! sory, কোনও সোভিয়েট, মার্কিন, বার্লিন ডেলিগেশনে নয়। তা সে যাক। ফিরে এসে বোম্বায়ে আমার বন্ধু প্রসাদদাস মানিকলাল শুক্রের বাড়িতে উঠলুম। ওই অকসব্রিজওলার কথা কী করে উঠল জানিনে, কারণ লেখাপড়ির ব্যাপারে আমরা charleton-ধাপ্পাবাজদের নিয়ে কখনও আলোচনা করতুম না।
শুক্ল বললে, ‘সে বড় মজার ব্যাপার! তোমার ওই ব্রাদার চৌধুরী শনৈঃ শনৈঃ উঠতে লাগলেন খ্যাতির শিখর পানে। আজ এই কলেজে, কাল অন্য য়ুনিভার্সিটিতে আস্ত একটা হনুমানের মতো চড় চড় করে পদোন্নতির অশথ গাছের মগডালে, বয়েস পঁয়ত্রিশ পেরুতে না পেরুতে। ইতোমধ্যে তাঁর নিজস্ব উমদা গ্যোবেলসি শানাই তাঁর গুণের রাগ-রাগিণী বাজাতে বাজাতে এটাও জাহির করেছে যে, ওই চৌধুরী স্বচেষ্টায় ফরাসি, জর্মন, রুশ গয়রহ ভাষাও আয়ত্ত করে ফেলেছেন।’
শুল্ক ফিক করে একটুখানি হেসে বললে, ‘সে বড় মজার। তোমার ওই চৌধুরীর তখন এমনই আস্পদ্দা বেড়ে গেছে যে, সে ছাপিয়ে দিলে বুর্নফের একটি অচলিত ছোট লেখার অনুবাদ ইংরেজিতে– চটি বই, ব্রশ্যুর বলতে পার। আসলে সে সেটা করেছিল এক আনাড়ি ছোকরার সাহায্যে, যার ফরাসি জ্ঞান ছিল অত্যন্ত কাঁচা– কিন্তু ছোকরা ধাপ্পা মারতে জানত চৌধুরীর চেয়েও দুই বাঁও বেশি।
শুক্ল বললে, ‘ওহ! সে বই নিয়ে এ দেশে কী তুলকালাম, ফাঁ ফাঁর! অবশ্য তার চোদ্দ আনার উৎপত্তি চৌধুরীর গ্যোবেলসি কলসি থেকে। এবং এখনও এ দেশের লোকের বিশ্বাস এ রকম অনুবাদ হয় না। মাত্র দু-একটি প্রাণী জানে যে, কী করে যেন ওই অনুবাদ প্যারিসে পৌঁছে গেলে তাদের এক পত্রিকায় বেরোয় “The originality of the translator has come out with extraodinary success in those passages where he has failed to understand the original!” অবশ্য তাতে করে চৌধুরীর রত্তিভর লোকসান হয়নি, কারণ এই ফরাসিতে লেখা সমালোচনা– তাও প্রকাশিত হয়েছে পণ্ডিতীয়া — এই দেশে পড়ে কটা লোক! তা সে যাক।
ইতোমধ্যে এদেশে একটি পোলিটিশিয়ানের প্রাণ হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠল জননী ভারতের লুপ্ত ইতিহাস উদ্ধার করার জন্য। আসলে তুমি তো জানো, এসব নির্জলা ব্লা। ভদ্রলোক চান, তিনি যে ‘কলচর’-জগতেও সম্মানিত হোন। অবশ্য পরের হাত দিয়ে তামাক খেয়ে। সেই “পরে”রও অভাব হল না। এ অঞ্চলে শেঠীয়াদের টাকের ঠিক জায়গায় হাত বুলোতে পারলে গৌরীশঙ্করের শিখরে মরূদ্যান নির্মাণের জন্যও পিলপিল করে টাকা বেরিয়ে আসে।
তার পর শ্যানায় শ্যানায়(১) কুলাকুলি। তোমার এই প্যারা চৌধুরী–
আমি বললুম, ‘শট্ অপ’।
‘আহা, চটো কেন? তার পর সাড়ম্বর স্থাপিত হয়, “জম্বুদ্বীপ-সমন্বিতা সমুদ্র—” যাকগে যাক, আমার নামটা ঠিক মনে নেই, ওই “কলচর” “মলচর” নিয়ে কী যেন একটা প্রতিষ্ঠান, আর চৌধুরী হলেন তার “সর্বাধিকারী” “মহাস্থবির” না কী যেন একটা।… কিছুদিন পর ইতোমধ্যে অবশ্য প্ল্যানমাফিক দু-দশখানা ভালো-মন্দ-মাঝারি “কলচরল” বই “জম্বুদ্বীপসমন্বিত–“ দুচ্ছাই আবার ভুলে গেলুম প্রতিষ্ঠানের নামটা– বই বেরিয়েছে। সর্বাধিকারী চৌধুরী প্রতিষ্ঠানের কর্তাকে বোঝালেন–
(ক) ঋগ্বেদের যেসব অনুবাদ গত এবং এই শতকে ইংরেজি-বাংলা-ফরাসি-জর্মনে বেরিয়েছে, সেগুলো ইতোমধ্যে বিলকুল বেকার ঔট অব ডেট হয়ে গিয়েছে, (খ) একটি নতুন অনুবাদ দরকার, (গ) সেটিকে সর্বাঙ্গসুন্দর করতে হলে বড় বড় পণ্ডিতদের সাহায্য নিতে হবে, (ঘ) এবং তাঁদের দক্ষিণা এবং ছাপা বাবদ লাগবে আশি হাজার টাকা।
আমি তাজ্জব মেনে বললুম, ‘কী বললে, আশি হাজার টাকা? বল কী! ‘
‘বিলক্ষণ! আশি হাজার টাকা! ব্যাপারটা হল গিয়ে, ওই যে প্রতিষ্ঠাতা পলিশিয়ান কলচরড হতে চান, তিনি শেয়ারবাজার, টেভয় টিন থেকে ওমরা তুলো, শিবরাজপুর মেঙ্গানিজ সব বোঝেন, কিন্তু কিন্তু বড় বড় পণ্ডিতদের তেজিমন্দি বাবদে বিলকুল না-ওয়াকিফহাল। ঢেলে দিলেন টাকাটা। তার পর বেরুতে লাগল কিস্তিতে কিস্তিতে বেদের নবীন ইংরেজি অনুবাদ! যে রকম আমাদের হরিবাবুর বাংলা কোষ বেরিয়েছিল। উত্তম প্রস্তাব! কিন্তু, ব্রাদার, নিরবচ্ছিন্ন শান্তি এই দগ্ধ সংসারে কোথায়? হঠাৎ পুণার এক পণ্ডিত আমাদের কলচর-প্রতিষ্ঠাতার কাছে এসে উপস্থিত হয়ে অনুবাদের খুনিয়া খুনিয়া সব ভুল দেখাতে লাগলেন। যেমন মনে কর– কথার কথা কইচি, আমি তো ওখানে ছিলুম না– “রবিকর” অনুবাদে হয়েছেন, “সূর্য যে খাজনা দেন” কিংবা “রাজকর” অনুবাদে হয়েছেন “রাজা যে রশ্মি দেন”। এ রকম বিকুটে বরবাদ অনুবাদ কেন হল কিছুই বোঝা গেল না। সামান্যতম বৈদিক ভাষা যে জানে সে-ও তো এরকম ভুল করবে না। হ্যাঁ, আলবৎ, ‘ক্রন্দসী’ ‘রোদসী’ ধরনের অচলিত শব্দ নিয়ে সাতিশয় সাধু মতান্তর হতে পারে, কিন্তু এ ধরনের আকাট, বর্বর– রহস্যটা তবে কী?’
আমিও সময় দিয়ে বললুম, ‘রহস্যটা তবে কী?’
‘ওই কলচরকামী প্রতিষ্ঠাতা বেদবেদান্ত বাবদে বেকুব হতে পারেন, কিন্তু তিনি “ইঁদুরের গন্ধ পান”–শয়তানির শ্বাস পান। নইলে সাদা-কালো-গেরুয়া বাজার কনট্রোল করছেন বৃথাই। তিন দিন যেতে না যেতে স্বয়ং চৌধুরীই এসে যা বললেন তার থেকে স্পষ্ট বোঝা গেল, তিনি কি ভারতীয়, কি ফরাসি, কি ইংরেজ, কি জর্মন কোনও পণ্ডিতকেই অনুবাদ-কর্মে নিযুক্ত করেননি। তাবৎ কর্ম করিয়েছেন একটি দুঃস্থা জর্মন রমণীকে দিয়ে। সে বেচারি সংস্কৃতের এক বর্ণ জানে না– বেদের ভাষা মনোজের ভাষায় কহঁ কহাঁ মুল্লুকে! সে স্রেফ জর্মন পণ্ডিত গেল্টনার-কৃত কয়েক বৎসর পূর্বে প্রকাশিত বেদের অনবদ্য জর্মন অনুবাদ ইংরেজিতে অনুবাদ করে গেছে। মেয়েটি ভালো জর্মন জানে বটে, কিন্তু তার ইংরেজি কাঁচা। কিন্তু সেইটেই মূলতত্ত্ব নয়। আসল বিপদ হয়েছে, বেদের অনেক বস্তু অস্পষ্ট, রহস্যময়, দ্ব্যর্থক কেন– বই অর্থসূচক। সেগুলো জর্মন পণ্ডিত গেল্টনারও করেছেন সন্তর্পণে, ‘আবছা-আবছা’ রেখে, –যেন সান্ধ্যভাষায়। এ নারী তাই তার অনুবাদে –আদৌ সংস্কৃত জানে না বলে–রবিকর, রাজকর, নরকর, হাতির কর (কথার কথা কইচি!) গুবলেট করে বসেছে। তখন পরিষ্কার হল রহস্যটা।
‘তস্য বিগলিতাৰ্থ, চৌধুরী দশ-বিশজন পণ্ডিত লাগিয়ে, তাদের ন্যায্য দক্ষিণা দিয়ে অনুবাদ করাননি। মেমসাহেবকে দিয়ে কম্মটি করিয়ে নিয়েছেন।
‘আরও, অর্থাৎ– এবং সেখানেই অর্থ’, মেমসাহেবকে তিনি দিয়েছেন এক হাজার টাকা, ছাপার খরচা বাদ দিয়ে তিনি পকেটস্থ করেছেন সত্তর হাজার টাকা! হল?’
***
চৌধুরী এখন ফটকা-বাজারে ভালো পয়সা কামায় ॥
৬।১১।৬৫
———-
১. চলন্তিকা বলেন সজ্ঞান থেকে সেয়ানা। বড়বাবু বলেন, শ্যেনদৃষ্টি রাখে যে জন তার থেকে শেয়ানা, শ্যানা।
আধুনিকা
থেকে থেকে ‘মর্ডান’ মেয়েদের বিরুদ্ধে খবরের কাগজে নানা জাতের চিঠি বেরোয়। সেগুলোর মূল বক্তব্য কী, তার সবিস্তার বয়ান দেবার প্রয়োজন নেই এবং সেগুলো যে সর্বৈব ভিত্তিহীন সে-কথাও বলা যায় না। হালে পাড়ার বুড়োরা আমাকে দফে দফে মডার্নিদের ‘কুকীর্তি’র কাহিনী কয়ে গেলেন। সেই সুবাদে আমার একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল।
ত্রিশ বছর আগেকার কথা। তখনও এদেশে ‘পেট-কাটা’ ‘নখরাঙানো’ মডার্নিদের আবির্ভাব হয়নি, এ তো জানা কথা, কিন্তু ‘মর্ডান’ মেয়ে সর্বযুগে সর্বদেশেই থাকে। আমার মনে হত, সে যুগের মডার্নতম দেখা যেত চাঁদপুর-নারায়ণগঞ্জ-গোয়ালন্দি জাহাজে। এরা ওইসব অঞ্চলের ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়েথদের মেয়ে– তবে বৈদ্যই বেশি– কলকাতায় আসত-যেত কলেজে পড়বে বলে। এক-একটির চেহারা ছিল অপূর্ব। তন্বী, শ্যামাঙ্গী, স্বাস্থ্যবতী– আপন আনন্দে থার্ড ক্লাস ডেকের যত্রতত্র ঘুরে বেড়ায়, চায়ের স্টলে বসে খেতেও ওদের বাধে না। প্রাচীনরা ওদের দিকে একটু বাঁকা নয়নে তাকালেও একথা আমি কিছুতেই স্বীকার করব না, ওরা বেহায়া বা বেশরম ছিল।
সে-আমলে ইন্টার ক্লাস প্যাসেঞ্জারের জন্য দুটো জালে ঘেরা কামরা–বা খাঁচা থাকত। একটা পুরুষ, একটা মেয়েদের। খুব যে আরামের ছিল তা নয়, তবে যে-সব লাজুক বউঝিরা পরপুরুষের সামনে কখনও বেরোয়নি তারা সেখানে খানিকটা আরাম বোধ করত।
সেকেন্ড ক্লাসের কামরাতেই শুয়ে শুয়ে শুনতে পেলুম, থার্ড ক্লাস ডেকে ও দুটো খাঁচা অঞ্চলে হঠাৎ আন্দোলন-উত্তেজনা আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। বয়েস আমার তখনও কম, তাই কৌতূহল ছিল বেশি। কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে শুধাই, ব্যাপারটা কী?
হট্টগোল হচ্ছে বটে, কিন্তু যাকেই প্রশ্ন শুধোই সে-ই পাশ কাটিয়ে যায়। এস্তেক চা’র স্টলের দোকানটি পর্যন্ত এমন ভাব করলে যেন আমার প্রশ্নটা আদৌ শুনতে পায়নি।
সুর-রিয়ালিজম দাদাইজম যাঁরা জানেন তারা বুঝতে পারবেন, আমি যদি তখনকার অবস্থার বর্ণনাটা দিতে গিয়ে বলি, ডেকের সর্বত্র যেন ‘ছি ছি’ আঁকা, কানে আসছে ‘ছি ছি’ স্বর, নাকের ভিতরও যেন ‘ছি ছি’ ঢুকছে।
টুয়েন্টিনাইন খেলা বন্ধ হয়ে গিয়েছে, দশ-পঁচিশের দান একদিকে অবহেলে পড়ে আছে, এদিকে ওদিকে ছোট ছোট দলের ঘোটালা, আর সারেঙ্গ জাহাজময় হন্তদন্ত হয়ে ছুটোছুটি করছে। কিন্তু সর্বোপরি ওই ছি ছি ভাব।
তখন হঠাৎ চোখে পড়ল, মেয়েদের ইন্টার ক্লাসের খাঁচা বেবাক ফাঁকা– খানিকক্ষণ পূর্বেও যেটাকে কাঁঠাল-বোঝাই দেখে গিয়েছি– অবশ্য আড়নয়নে। আরও ভালো করে তাকিয়ে দেখি, খাঁচাটার এককোণায় আপাদমস্তক চাদরে ঢাকা কী যেন একটা বস্তু– মানুষই হবে– পড়ে আছে মেঝেতে। মনে হল, সেটা গোঙরাচ্ছে, কিন্তু ওই ‘ছি ছি’র ভিতর দিয়ে ঠিক ঠিক ধরতে পারলুম না।
এমন সময় খানসামার সঙ্গে দেখা। পূর্বেই লোকটির সঙ্গে আলাপ হয়েছিল– সে সিলেটি।
ইতিউতি করে বললে, ‘কেলেঙ্কারি ব্যাপার। ইন্টার ক্লাসের ওই মেয়েটি গর্ভযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।’
আমি অবাক হয়ে বললুম, ‘সে কী ব্যাপার! একে কেউ সাহায্য করছে না কেন? স্টিমারে তো গণ্ডায় গণ্ডায় বুড়ি-হাবড়ি রয়েছে যারা কুড়িবুড়িতে আণ্ডাবাচ্চা বিইয়েছে?’
খানসামার পো ঈষৎ লাজুক প্রকৃতি ধরে। আবার গাঁই-গুঁই করে বললে, ‘ব্যাপারটা কী হয়েছে, হুজুর, মেয়েটার বিয়ে হয়নি।’
‘তা হলে এল কোত্থেকে? সঙ্গীসাথি নেই?’
‘যা শুনেছি, তাই বলছি হুজুর। কেউই সঠিক খবর জানে না। মেয়েটার সঙ্গে একটা ছোকরা ছিল ওরই বয়সী। সে মাঝে মাঝে ওকে চা-টা পৌঁছে দিয়েছে। ছেলেটা আমার কাছেই মুরগি-কারি খেয়েছে। মেয়েটা কোনওকিছুই খেতে রাজি হয়নি। শুধু চা-টি খেয়েছে অনেক চাপাচাপির পর– বোধ হয় জাতঘরের হিন্দু মেয়ে।’
আমি অসহিষ্ণু হয়ে বললুম, ‘তা তো বুঝলুম, কিন্তু ছেলেটা কোথায়? সেই তো জিম্মেদার।’
‘গর্ভর্যন্ত্রণার প্রথম লক্ষণ দেখা দিতেই সে গা-ঢাকা দিয়ে মাঝখানের স্টেশনে নেমে পড়ে পালিয়েছে। লোকে অনুমান করছে, মেয়েটাকে সে নিয়ে যাচ্ছিল কলকাতায় কোনও একটা ব্যবস্থা করার জন্য। দেশ থেকে বেরুতে দেরি হয়ে যায়, তাই হঠাৎ এ গর্দিশ এসে পড়েছে।’
আমি বললুম, ‘সেও বুঝলুম, কিন্তু মেয়েটা বিপদে পড়েছে, আর কেউই সাহায্য করছে না! এটা একটা কথার কথা হল?’
অসহায় ভাব দেখিয়ে বললে, ‘হিন্দুদের ব্যাপার; কী করে বুঝি বলুন! দু-একটি মুসলমান আছে। তারাও হিন্দুদের ওই সব দেখে বোধ হয় সাহস পাচ্ছে না।’
আমি বললুম, ‘জাহাজে ডাক্তার নেই? প্যাসেঞ্জারের ভেতরেও?’
‘তারই সন্ধান চলছে, হুজুর।’
তার পর খানসামা বিজ্ঞভাবে দাড়িতে হাত বুলোত বুলোতে যেন আপন মনে বললে, ‘যত সব নাদান বেকুবের কারবার। আরে বাপু, মেয়েটার মাথায় এক থাবড়া সিঁদুর আগে লেপটে দিলেই তো পারত।!’
(জানিনে, তাতে করে কী হত! হালে অ্যারোপ্লেনে নাকি এমতাবস্থায় অ্যারহোস্টেস্ সাহায্য করতে রাজি হয়নি।)
আপন ক্যাবিনে ফিরে যাচ্ছি। এমন সময় এক সহৃদয় প্যাসেঞ্জার আমাকে পাকড়ে বললে, ‘আপনি চলুন না, স্যার।’
তাজ্জব মেনে বললুম, ‘আমি!’
‘কেন? আপনি তো ডাক্তার!’
বুঝলুম, আমার ট্রাঙ্কে রিজার্ভেশন কার্ডে দেখেছে, লেখা Dr.। কাতর কণ্ঠে বোঝাতে চেষ্টা করলুম, সেটা ভিন্ন বস্তু, বেকার, ফরেন। এটা দিয়ে মাছিটার ছেঁড়া পাখনাও জোড়া দেওয়া যায় না। লোকটি বড়ই সরল। তাকে কিছুতেই বোঝাতে পারিনে, চিকিৎসার ডাক্তার এক প্রাণী, আমার ডক্টরেট ত্রিসংসারে কারও কোনও কাজে লাগে না। এ ধরনের গেরো আমার জীবনে আরও দু বার হয়ে গিয়েছে।
ইতোমধ্যে জাহাজে নতুন চাঞ্চল্য। কোত্থেকে পাওয়া গেছে এক না-পাস কম্পাউন্ডার। সে বোধ হয় ‘শ্মশান-চিকিৎসাটা’ করতে রাজি হয়েছে। তবে বলছে, একটি মেয়েছেলের সাহায্য পেলে ভালো হত।
তার পর যা দেখলুম, সে দৃশ্যটি আমার জীবনে ভুলব না।
ওই যে পূর্বে বলছিলুম, জাহাজে তখনকার দিনের কলেজের দু-পাঁচটা ‘আধুনিকা’, নিঃসঙ্কোচে ঘুরে বেড়াত, তাদেরই একটি– লম্বা, ছিপছিপে শ্যামবর্ণ, পরনে সাদামাটা শাড়ি ব্লাউজ– গমগম করে কম্পাউন্ডারের দিকে এগিয়ে গেল দু হাত দিয়ে ভিড় ঠেলে ঠেলে। তখন চতুর্দিক থেকে উঠেছে তার দিকে ‘ছ্যা ছ্যা ছি ছি’ রব। সক্কলের টার্গেট তখন ওই আসন্নপ্রসবা নয়– তখন এই ভদ্রকন্যা।
আমি জীবনে দু জন পরমহংস দেখেছি।
আর এই দেখলুম, একটি পরমহংসী। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নয়, সর্ব ধিক্কার, সব ব্যঙ্গ, সব বিদ্রূপ উপেক্ষা করে প্রসন্ন বদনে সে এগিয়ে যাচ্ছে!!
১৩।১১/৬৫
আলবের্ট শ্বোয়াইৎসার
“আজিকে একেলা বসি শোকের প্রদোষ-অন্ধকারে
মৃত্যুতরঙ্গিণীধারা-মুখরিত ভাঙনের ধারে
তোমারে শুধাই,- আজি বাধা কি গো ঘুচিল চোখের
সুন্দর কি ধরা দিল অনিন্দিত নন্দনলোকের
আলোকে সম্মুখে তব,– উদয়শৈলের তলে আজি
নবসূর্য বন্দনায় কোথায় ভরিলে তব সাজি
নবছন্দে, নতুন আনন্দগানে?”
এই কবিতাটি রচিত হবার পর প্রায় চল্লিশ বৎসর কেটে গিয়েছে। আমার চেনা-অচেনা অনেক প্রখ্যাত পুণ্যশ্লোক জন ইহলোক ত্যাগ করেছেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এ প্রশ্নটি তাঁদের উদ্দেশে শুধাইনি। হয়তো ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু আজ আর এ প্রশ্ন না শুধিয়ে থাকা গেল না।
কারণ এই মহাপুরুষ জীবনে সত্য সুন্দর শিবের যে সাধনা করেছিলেন সেটা সর্বযুগেই বিরল। এবং তার চেয়েও আশ্চর্য, তিনি একই পথে আজীবন সাধনা করেননি।
আলুসেসের কাইজারবের্ক অঞ্চলে ১৪ জানুয়ারি ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে এঁর জন্ম।(১) সে অঞ্চল তখন জর্মন ছিল বলে তিনি জর্মন। ধর্মতত্ত্ব (প্রটেস্টান্ট বা এভানজেলিক) পড়ে তিনি চব্বিশ বছর সহপাদ্রিরূপে ঈশ্বর-মানুষ-গির্জার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। কিন্তু বছর তিন যেতে না যেতেই খ্রিস্টধর্মের মূলতত্ত্ব নিয়ে তাঁর মনে যেসব প্রশ্নের উদয় হয় সেগুলো নিয়ে চিন্তা, গবেষণা ও সাধনা গির্জার সেবায় নিযুক্ত থেকে হয় না। তাই তিনি বিখ্যাত স্ট্রাসবুক বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হয়ে কাজে যোগ দেন। এই অল্প বয়সেই তিনি যে গবেষণা করেন সেটা খ্রিস্টধর্মের ইতিহাসবিদদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এবং সে গবেষণার প্রধান উদ্দেশ্য পাণ্ডিত্য সঞ্চয় বা পাণ্ডিত্য প্রকাশ আদৌ নয়। তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল কী প্রকারে খ্রিস্টের বাণী ও তৎপরবর্তী খ্রিস্টধর্মের প্রথম উৎপত্তিযুগের একটি অর্থপূর্ণ সর্বাঙ্গসুন্দর ছবি পাওয়া যায়, যেটা আজও এবং আবার নতুন করে খ্রিস্টসমাজে নতুন প্রাণ, নতুন ভক্তি, চরিত্র-সংগঠন ও সমাজবাস করার জন্য নতুন নীতি নির্মাণ করে দেবে।
এদেশে রামমোহন তাই করেছিলেন। অর্থাৎ উপনিষদের স্বর্ণযুগ পুনরায় আলোকিত করতে চেয়েছিলেন।
সউদি আরবের রাজা ইন্ সউদ যে সম্প্রদায়ভুক্ত তার প্রতিষ্ঠাতা ওয়াহ্হাবও তাই করেছিলেন।
শ্বোয়াইৎসার এইসব তত্ত্বচিন্তায় ধ্যানধারণায় নিযুক্তকালীন প্রচুর সময় ব্যয় করেন সঙ্গীতস্রষ্টা য়োহান্ সেবাস্টিয়ান্ বাখৃ-এর ওপর। এখানেও সেই নবাবিষ্কারের কথা। এটা সত্য যে, বহু বৎসর দু-চারিটি কেন্দ্র ভিন্ন অন্য সর্বত্র বা অনাদরে থাকার পর সঙ্গীতস্রষ্টা মেন্ডেলজো পুনরায় রসিক-জনের দৃষ্টি বাখ-এর দিকে আকৃষ্ট করেন। এর পরেই বাখ-এর অন্যতম প্রধান ভাষ্যকার শ্বোয়াইৎসার। গির্জার অর্গেনসঙ্গীত তারই প্রচেষ্টা ও প্রচারের ফলে পুনরায় নবজীবন লাভ করে। (অর্গেন ও অর্গেল এদেশের সঙ্গীতকে ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রচুর প্রভাবান্বিত করে। এই নিয়েই কিঞ্চিৎ গবেষণা কিছুদিন পূর্বে এদেশে হয়। তার অন্যতম প্রশ্ন তখন ছিল অর্গেনকে কেটে হারমোনিয়ামরূপে প্রবর্তিত করে কে জনপ্রিয় হন কী করে, এর প্রতি আকাশবাণীর এত রাগ কেন, যদিও খান আবদুর করিম খানের মতো মহাপুরুষ যখন এরই সঙ্গতে গেয়েছেন? এ নিয়ে আরও আলোচনা হলে ভালো হয়। আবার কৃতজ্ঞচিত্তে শার্সদেবের শরণ নিচ্ছি। এবং এর সঙ্গে আরেকটি নিবেদন, ইয়োরোপীয় সঙ্গীতের সঙ্গে পরিচয়কামী নবীন ভারতীয় শাগরেদকে একাধিক ইয়োরোপীয় বাখ নিয়ে আরম্ভ করতে বলেন। বাখ-এর রস খাওয়া আমাদের পক্ষে সহজতর। এ বিষয় নিয়েও তুলনাত্মক সঙ্গীতমহলে আলোচনা হওয়া উচিত।) এমনকি বলা হয় শ্বোয়াইৎসার স্বহস্তে উত্তম অর্গেনও নির্মাণ করতে শেখেন।
উপরের দুটি সাধনা– খ্রিস্টের জীবনানুসন্ধান ও বাখ– ভিন্ন তাঁর প্রধান অনুসন্ধান ছিল রাষ্ট্রবিজ্ঞানে, রাষ্ট্ৰচালনায়, ধর্মনীতিকে পুনরায় দৃঢ় ভূমিতে স্থাপন করা।
***
সাধনা, অধ্যয়ন, ধ্যানধারণা, বাখ-এর ভগবদ্সঙ্গীত এ সমস্ত নিয়ে যখন শ্বোয়াইৎসার তন্ময়, যখন তাঁর খ্যাতি জৰ্মনির বাইরে বহুদূরে চলে গিয়েছে, তখন এই মহাত্মা হঠাৎ একদিন ত্রিশ বৎসর বয়সে, অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে ভর্তি হলেন মেডিকেল কলেজে। কারণটি সরল অথচ সুদূরে নিহিত।
ফরাসি-কঙ্গো অঞ্চলে যে-সব অনাচার হয়ে গিয়েছে তার খেসারতি মেরামতি করতে হবে। কঙ্গোর গভীরতম জঙ্গলে যে শত শত আফ্রিকাবাসী কুষ্ঠরোগে দিন দিন ক্ষয় হচ্ছে তাদের সেবা করতে।
তার পূর্বে কিন্তু তা হলে তো চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়ন করতে হয়। ঠিক সেই জিনিসটিই সমাধান করে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে মিশনারি ডাক্তাররূপে তিনি ফরাসি-কঙ্গোর দুর্গম অরণ্যের লাঁবারেনে-অঞ্চলে গিয়ে কুষ্ঠরোগীদের জন্য হাসপাতাল খুললেন। তার স্ত্রী দেশে নার্সের ট্রেনিং নিয়ে সেখানে সেবিকার কাজ গ্রহণ করলেন।
কিন্তু এই কঙ্গোবাসী কুষ্ঠরোগীদের অর্থসামর্থ্য কোথায়? শ্বেয়াইৎসা আবার সর্বশ্রেষ্ঠ ওষধি, সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি, সর্বোত্তম সহকর্মী নিয়ে চিকিৎসা করতে চান। তার জন্য অর্থ কোথায়?
এর পরের ইতিহাস দীর্ঘ। তাতে আছে আদর্শবাদ, নৈরাশ্য, অকস্মাৎ অযাচিত দান এবং সর্বোপরি শোয়াইৎসারের অকুণ্ঠ বিশ্বাস : “মানুষের জীবন বিধিদত্ত রহস্যাবৃত– এর প্রতি প্রত্যেকটি মানুষের ভক্তির বিস্ময় ভয় থাকা উচিত।” এই অটল বিশ্বাস নিয়ে তিনি কিছুদিন পর পর সেই দুর্গম জঙ্গল অতিক্রম করে, ইয়োরোপে এসে অত্যুকৃষ্ট স্বরচিত আপন অভিজ্ঞতাপূর্ণ (বিশেষ করে অন্ধকার-কঙ্গোর) পুস্তক প্রকাশ করে, প্রাচীন দিনের বাখ-এর সঙ্গীত বাজিয়ে অর্থোপার্জন করতেন। প্রথম যুদ্ধের সময় তাঁর কাজে বাধা পড়ে; কারণ তিনি জাতে জর্মন হয়েও বাস করছেন ফরাসি কলোনিতে কিন্তু সেটা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি এতই ভুবনবিখ্যাত যে দুই যুযুধান সৈন্যদলই তার হাসপাতালকে এড়িয়ে বাঁচিয়ে যুদ্ধ করে।
কিন্তু ১৯১৩ থেকে ১৯৬৫– এই দীর্ঘ বাহান্ন বৎসরের একনিষ্ঠ সাধনা তো ক্ষুদ্র একটি প্রবন্ধে শেষ করা যায় না। যদি কখনও সে সাধনার সিকি পরিমাণ খবরাখবর সংগ্রহ করতে পারি তবে পুনরায় চেষ্টা নেব।(২)
৯।১০।৬৫
———
১. মৃত্যু : ৪৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৫ কঙ্গোতে।
২. শ্বোয়াইৎসার ভারতীয় চিন্তাধারা সম্বন্ধে ১৯৩৫ সালে Dei Weltanse-hauung der indischen Denker নামক একখানা বই লেখেন। এই বই সম্বন্ধেও অনেক কিছু বলার আছে। আমি বহু বৎসর পূর্বে পড়েছি। সেখানি ফের পেলে কিছু লেখার দুরাশা আছে।
ইন্টারভ্যু
‘ইন্টারভ্যু’ নামক চরম বেইজ্জতির মস্করা যে কত নব নব রূপে প্রকাশিত হয় তার বর্ণনা আরেক দিন দেব। ‘দেশে’ এই মর্মে একাধিক চিঠি বেরিয়েছে, এবং আগে-ভাগে কাকে চাকরি দেওয়া হবে সেটা ঠিক করে নিয়ে যে চোট্টামির ইন্টারভ্যু-প্রহসন করা হয় তারও বর্ণনা এ চিঠিগুলোতে ও আমার সতীর্থের মূল প্রবন্ধে আছে। তবে এ বাবদে শেষ কথা বলেছে আমার এক তুখোড় তালেবর ভাগিনা। ডাঙর নোকরি করে, ঢাউস যা গাড়ি ব্যাঙ্ক দিয়েছে তার ভিতর। এক পক্ষে মা-সহ তার তিন মাসী, অন্য পক্ষে তার তিন মামী রীতিমতো ব্যূহ নির্মাণ করে কাশ্মির-শিয়ালকোট-কচ্ছের রনের(১) রণমোহড়া দিতে পারেন (বলা বাহুল্য মামীরাই হারেন, কারণ তাঁরা এসেছেন তিন ভিন্ন ভিন্ন পরিবার থেকে)। ভাগিনাটিকে প্রায়ই ইন্টারভ্যু নিতে হয়– অর্থাৎ সিটস অন দি রাইট সাইড অব দি টেবল। একদিন বেজায় উত্তেজিত হয়ে সে আমাকে একটি কর্ম-খালির বিজ্ঞাপন পড়ে শোনালে। তাতে ওমেদারের বয়স কত হবে, কী কী পাস থাকা চাই, এপেনডিকসের দৈর্ঘ্য তার কতখানি হবে, তার পরিবারে নিদেন কটা খুন হয়ে থাকা চাই ইত্যাদি বেবাক বাৎ ছিল। ভাগিনা তার পর ভ্রুকুঞ্চিত করে খানিকক্ষণ খুঁত খুঁত করে বললে, ‘খাইছে! ফোডোগেরাপ দ্যাওনের বাৎ বেবাক ভুল্যা গ্যাছে। হুইডার তলায় লেখা থাগব, “None need apply whose appearance does not resemble the above photograph.” কী কন, মামু?’ আমি আর কী বলব? এটা করলে তো অত্যন্ত সাধু জনোচিত আচরণ হত। এর চেয়ে ঢের নাস্টি (ইচ্ছে করে ন্যাষ্টি উচ্চারণ করতে, সে উচ্চারণে ঘেন্নাটার খোলতাই হয় বেশি যেমন ‘পিশাচ’ বা ‘পিচাশ’ না বলে সর্বোৎকৃষ্ট হয় ‘পিচেশ’ বললে!) উদাহরণ আমি এটা জানি।
ফার্সির লেকচারার নেওয়া হবে। আমাকে স্পেশালিস্ট হয়ে যেতে হবে। আমি বেকসুর না-মঞ্জর করে দিলুম। যদিও চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে মনে হল না, এর ভেতরে কোনও নষ্টামি আছে। তবু, আমি এই ‘জামাই ঠকানো’র– সুনন্দের ভাষায়– ফিকিরি-মস্করার হিস্যেদার হতে চাইনে। দু দিন পর মৌলানা আজাদ ফোন করে জানতে চাইলেন, আমি যেতে আপত্তি করছি কেন? তখন বুঝলুম, উনিই আমার নাম স্পেশালিস্ট রূপে প্রস্তাব করেছিলেন এবং এখন আমি সেটি গ্রহণ করতে অস্বীকৃত হচ্ছি বলে কর্তৃপক্ষ তাঁকে সেটা জানিয়ে ফরিয়াদ করেছেন–। মৌলানার পাণ্ডিত্যের প্রতি আমার অসাধারণ শ্রদ্ধা ছিল। তাই কাঁচুমাচু হয়ে এই ইন্টারভ্যু বাবদে পরীক্ষক হিসেবেই, আমার পূর্ব পূর্ব নোংরা (ন্যাষ্টি!) তজরুবা-অভিজ্ঞতা জানালুম। দেখি, মৌলানা সমুচাহ্ ওয়াকিফ-হাল! কোনও প্রকারের তর্কাতর্কি না করে বললেন, আপনি গেলে ওরা সোজা পথে চলবে। যদি অন্যায় আচরণ দেখেন, আমাকে জানাবেন। ইন্টারভ্যুতে যেসব অনাচার হয় তার কোনও বিচার নেই বলে, আমি টেবিলের কি এদিকে কি ওদিকে কোনও দিকে বসতে চাইনে (পেত্যয় না। পেলে শ্রীযুক্ত কালিদাস ভশ্চাযকে শুধোন!); কিন্তু এক্ষেত্রে মৌলানা আমার কাছ থেকে অনাচার-সংবাদ পেলে যে ওদের কান মলে দেবেন সেই ভরসায় গেলুম।
আমার সঙ্গে আরেকটি স্পেশালিস্ট ছিলেন। বাকিরা পাকা মেম্বার। তাদের একমাত্র কামনা, কাম খতম করে বাড়ি ফেরার। বিশেষত ‘লেড়ে’র ব্যাপার– চাকরিটা মিম্বরুল্লা পেল, না মৃদম খান পেল সে নিয়ে তাদের ‘মাতাব্যাতা’ হবে কেন, ছাই!
তবু ভদ্রতার খাতিরে তাঁরা দু-একটি প্রশ্ন শুধোলেন। সে ভারি মজা। যেমন ‘আপনার মাদ্রাসায় ইংরেজিও পড়ানো হত?’– কথাবার্তা অবশ্য আংরেজিতেই হচ্ছে। কারণ প্রশ্নকর্তারা ফারসি ও ফরাসির তফাৎ জানেন না।
‘জী, হ্যাঁ।’
‘কী পড়েছেন?’
‘জী রাসকিনের “সিসেম অ্যান্ড লিলিজ”, মিলটনের “এরিয়োপেজি—”
‘শেকসপিয়র?’
‘জী।’
‘কী?’
‘হ্যামলেট’।
এবারে প্রশ্নকর্তা দারুণ উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘বাব্বা, বাব্বা! বেশ, বেশ। সুপ্রস্তাব!’
তার পর তিনি সোৎসাহে আরম্ভ করলেন, হ্যামলেটের আত্ম-আর্তনাদ– সলিলকি– “To be or not to be” তাকিয়ে আছেন কিন্তু আমার দিকে, ওমেদারের দিকে না– আমার অপরাধ? ইংরেজি খবরের কাগজেও একটা অত্যন্ত বেকার খবর বেরিয়েছে, আমার কী একটা বই কী যেন একটা প্রাইজ পেয়েছে, এবং স্বয়ং রাষ্ট্রপতি নাকি আমাকে প্রাইজটি দেবেন স্বহস্তে! আমাকেই ইমপ্রেস করা তখন তাঁর জীবন্মৃত্যুর চরম কাম্য–বলা তো যায় না, এখন থেকেই যদি রীতিমতো আমাকে তোয়াজ করে ইমপ্রেস করা যায় তবে আমি হয়তো প্রাইজ নেবার সময় কানে কানে রাষ্ট্রপতিকে বলে দেব, ‘হুঁজুরের আন্ডার-সেক্রেটারি অনন্তভূত-পরাশরলিঙ্গমকে এখন একটি প্রমোশন দেওয়া উচিতস্য উচিত!’ অবশ্য সেটা সেরকম মোকা নয়। কিন্তু বলা তো যায় না– যদি হয়েই যায়। নেপোলিয়ন (আজকালকার ‘জ্ঞানী’রা যাকে নাপোলেও বলেন, যেন আমাদের মতো সে-যুগের রাম-পন্টকরা খাঁটি উচ্চারণ জানত না বলে বাংলাতে তদনুযায়ী সঠিক বানান লিখতে পারেনি!) বলেছেন, অসম্ভব বলে কিছুই নেই। নিশ্চয়ই তিনি জানতেন, কখন কীভাবে কাকে লুব্রিকেট– তেলাতে হয়!
তা সে যাই হোক, আমাকে ন’সিকে ইমপ্রেস করে হকচকিয়ে দেবার পর ওমেদারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বাকিটা কও কী? “Or to take arms against a sea of-” বাকিটা বলে যাও তো?’
কালো চামড়ার তৈরি সর্বোৎকৃষ্ট স্প্রিং-সম্বলিত, পঞ্চাধিক ক্যুশনবিজড়িত গভীর আরামকেদারার তলা থেকে তিনি হাস্যরসের তুফানে ওঠা-নাবা করতে করতে বার বার বলেন, ‘তার পর কী, go on! ইউ সেড ইউভ রেড হ্যামলেট against a sea of troubles– আরও সাহায্য করলুম তোমাকে। বাকিটা বলে যাও!’ আবার তিনি সোফাতে বৃন্দাবনের রসরাজসুলভ হিন্দোল-দোলে দুলতে লাগলেন।
আমি তাজ্জব! বেচারি ওমেদার এসেছে ফার্সি ভাষায় মেস্টারির চেষ্টায়। আঁ পাসাঁ, বেচারি একটুখানি ইংরেজি শিখেছিল বটে, কিন্তু সেইটেই তার ফর for, সেইটেই তার piece de resistance, সেইটেই তার বলতে গেলে, কিছুই নয়– ইংরেজির মাধ্যমে ফার্সি পড়াতে গেলে যতখানি ইংরেজি জানবার প্রয়োজন তার চেয়েও সে বেশি জানে সেটা তো ইতোমধ্যে তার কথাবার্তাতেই প্রমাণ হয়ে গেছে। তা সে যাকগে। ওমেদার বেচারি তো ঘেমে-নেমে ঢোল। আমি তখন তার দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বললুম, ‘ওরকম নার্ভাস হবেন না। আপনি কতখানি ইংরেজি জানেন না-জানেন তার গুরুত্ব সামান্যই। ওটা আপনি ভুলে যান। এবারে চলুন ফার্সিতে। সেইটে কিন্তু আসল। ওই যে আপনার সামনে ফার্সি বই কয়েকখানি রয়েছে তারই যে কোনও একখানা থেকে কয়েক লাইন পড়ুন– প্রথম আপন মনে চুপে চুপে, পরে আমাদের শুনিয়ে। অনুবাদ? না, না, অনুবাদ করতে হবে না। আপনার পড়ার থেকেই তো বুঝে যাব, আপনি ফার্সি বোঝেন কি না। আর যেটা পড়বেন তার দু-একটা শব্দ আপনার জানা না থাকলে কোনও ক্ষতি নেই। সবাই কি আর সব ফার্সি শব্দ জানে? তা হলে দুনিয়াতে অভিধান লিখত কে, পড়ত কে? তা সে যাক। আমার আর কোনও প্রশ্ন-ট্রশ্ন নেই।’
এবারে ছেলেটার– হ্যাঁ, আমার ছেলের বয়সী– মুখে শুকনো হাসি ফুটল; একটুখানি ভর্সা পেয়েছে। সেই হ্যামলেটওলা লোকটিও আসলে কিন্তু মানুষ ভালো। পাঁচটা কুশন দুলিয়ে ঠাঠা করে হেসে উঠলেন। বললেন– তাঁরই হ্যামলেটের স্মরণে ‘জন্টিস্ ডিলেড হয়নি। হা হা, হা হা।’
ছেলেটি সুন্দর উচ্চারণে গড় গড় করে ফার্সি পড়ে গেল। কাশ্মিরি ব্রাহ্মণসন্তান; এবং পরে দেখা গেল, আরও হিন্দু ওমেদার ছিল। ফার্সি আবহাওয়াতে আপন ঠাকুন্দার কাছে লেখাপড়া শিখেছে। চেয়ারম্যান বললেন, ‘আপনি এখন যেতে পারেন!’ ছেলেটি সবাইকে মুসলমানি কায়দায় সেলাম জানালে, আমার দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতার একটু শুকনো হাসি হাসতে গিয়ে থেমে গেল– কী জানি ওটা ঠিক হবে কি না, যদি ওতে করে নম্বর কাটা যায়। আমি মনে মনে বললুম’ মারো ঝাড়ু, স্লা নোকরি ওর উসকি ইন্টারভ্যু পর।
উঁহু! এটা শেষ নয়, এটা আরম্ভ মাত্র। ছেলেটির সেলামপর্ব শেষ হওয়ার পূর্বে আমার সঙ্গে দ্বিতীয় স্পেশালিস্টটি বললেন, ‘একটু বসুন’–এবং সঙ্গে সঙ্গে আপন পকেট থেকে একটি চিরকুট বের করে তার হাতে দিয়ে বললেন, ‘পড়ুন’।
হায় বেচারা ক্যান্ডিডেট! ভেবেছিল তার গব্বযন্তনা শেষ হল। এখন এ আবার কী ফাঁসি! বেচারি পর্চাখানির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। স্পেশালিস্ট দশ সেকেন্ড অন্তর অন্তর গুতোচ্ছেন, ‘পড়ুন। পড়ছেন না কেন?’ ছেলেটি হোঁচট ঠোকর খেতে খেতে খানিকটা পড়ল। স্পেশালিস্ট বললেন, ‘অনুবাদ করুন।’ রাম পাঁঠা! পড়ার কায়দা থেকেই তো পরিষ্কার হয়ে গেছে যে পাঠ্যবস্তু তার এলেমের বাইরে, তবে স্যাডিস্টের মতো মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা কেন।
ছেলেটা নড়বড়ে পায়ে বেরিয়ে গেল।
আমি পৰ্চাটির জন্য স্পেশালিস্টের দিকে হাত বাড়ালুম। তিনি ‘কুছ নহি, কুছ নহি’ বলে সেটি পকেটে পুরে নিলেন। দুসরা ক্যান্ডিডেট এল। এবারে হ্যামলেটের বদলে গ্রে’র কবিতা। সর্বশেষে আবার ওই অভিনয় সেই পর্চা নিয়ে। আমি স্পেশালিস্টের উদ্দেশে মনে মনে বললুম, ‘তুমি ব্যাটা খোট্টা মুসলমান, আম্মো হালা বাঙাল পাঁতি ল্যাড়ে! দেখাচ্ছি তোমাকে।’ এবারে ক্যান্ডিডেট পর্চাটি যেই ফেরত দিতে যাচ্ছে অমনি, তৈরি ছিলুম বলে, আমি সেটা নিয়ে নিলুম। ওমা! যত পড়ি, আগা-পাস্তালা ঘুরিয়ে দেখি, ততই কোনও মানে ওৎরায় না। ইতোমধ্যে আরেক ওমেদার এসে গেছে এবং চসার না পৌন্ড কী যেন আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। আমার দৃষ্টি ওই পর্চাটির দিকে নিবদ্ধ।
ইয়াল্লা! অব্ সমঝলন বা। যে দু লাইন কবিতা ছিল সেটা অনেকটা আমাদের
হরির উপরে হরি
হরি বসে তায়
হরিকে দেখিয়া হরি
হরিতে লুকায়!
‘হরি’ শব্দের কটা মানে হয়, আমি সত্যই জানিনে– কান ছুঁয়ে বলছি। কিন্তু ছিঃ। কারও বাংলা জ্ঞানের পরীক্ষা যদি নিতান্তই নিতে হয় তবে এই ধরনের ‘জামাই-ঠকানো’ কবিতাই কি ন্যায্যতম, প্রশস্ততম!!
কিন্তু এহ বাহ্য।
পরে, অন্তত আমি বুঝতে পারলুম দই খাচ্ছেন কোন রমাকান্ত আর বিকার হচ্ছে কোন গোবদ্দনের।
দু-একটি পাকা মেম্বরও হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন ব্যাপারটা কী। লেখাপড়ায় এক-একটি আস্ত বিদ্যাসাগর বলেই ওঁদের নাসিকায় থাকে সারমেয়বিনিন্দিত গন্ধসন্ধানী অন্ধিসন্ধি।
ক্যান্ডিডেটের পরে ক্যান্ডিডেট– কেউ ভালো, কেউ মন্দ, কেউ মাঝারি, সংসারে যা হয়–ইন্টারভ্যু স্বয়ংবরে আমাদের মতো ইন্দুমতীর সামনে স্বপ্রকাশ হলেন। কিন্তু সবাই মার খেলেন, ওই পর্চাটুকুর সামনে, ওই চিরকুটটি সব্বাইকার ওয়াটারলু।
ইতোমধ্যে কী আশ্চর্য, কী তিলিস্মাৎ– একটি ওমেদার পর্চাটি পাওয়া মাত্রই সেটি গড়গড়িয়ে পড়ে গেল, আদ্যন্ত! যেন তার প্রিয়ার আড়াইশ’ নম্বরি প্রেমপত্র।
***
ইন্টারভ্যু শেষে লাঞ্চ। সরকারি লাঞ্চকে আমি বলি লাঞ্ছনা। অবশ্য সর্বোচ্চ মহলে নয়। সেখানে লাঞ্চের অজুহাতে আপনার জন্য পেলেটে করে রোলস-রইস গাড়ি আসতে পারে তন্বঙ্গী পরী-পয়করী চালিতা। ড্রাইভারিণীটি ফাউ, থ্রোন ইন্ ফর গুড মেঝার!
পালাবার চেষ্টা করার সময় ধরা পড়লুম সেই পঞ্চ-কুশন-মর্দন মহাজনের হাতে! বললেন, ‘হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ, আপনাদের ওই স্পেশালিস্টটি আপন ওমেদারকে একটু ভালো করে রিহার্সেল করালেন না কেন? ও যদি সাতবার ঢোঁক গিলত, এগারোবার হোঁচট খেয়ে খেয়ে চিরকুটটির কবিতা পড়ত, তবে হয়তো, আমাদেরও বিশ্বাস জন্মত, সে ওই কবিতাটি ইতোপূর্বে কখনও দেখেনি।’
৩০।১০৬৫
———- ১. আমার যদ্দুর
এমেচার ভার্সস স্পেশালিস্ট
সব ব্যাপারেই আজকাল: স্পেশালিস্ট। সেদিন মার্কিন মুলুকে এক স্পেশালিস্টই আবিষ্কার করেন যে শোভাযাত্রা, বয়কট বা ধর্মঘটে যারা কালো ঝাণ্ডা তুলে হই হই করে, তাদের অনেকেই ভাড়াটে। এ তত্ত্ব আমাদের কাছে নতুন নয়; দিল্লিতে থাকাকালীন স্বর্গত অশ্বিনী গুপ্ত আমাকে দিল্লিতে যে ‘হাঙার স্ট্রাইকে’র জন্য প্রতিষ্ঠান আছে, যিনি হাঙার স্ট্রাইক করবেন তার জন্য শামিয়ানা, তাকিয়া-বালিশ, নির্জলা না হলে নিম্বুপানি– তদভাবে জিন্ (যদি তিনি মদ্যপ হন), কারণ বলতে গেলে একমাত্র জিনই সহজলভ্য কড়া ড্রিঙ্কের ভিতর জলের রঙ ধরে, আহারাদি, হ্যাঁ, আহারাদিই বলছি কারণ লুকিয়ে লুকিয়ে হাঙার স্ট্রাইকার যদি খেতে চান তবে গভীর রাত্রে তার সুব্যবস্থা– সেদিকে আমার ভোঁতা দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এবং যিনি আজও এ-প্রতিষ্ঠানটি চালিয়ে যাচ্ছেন, তিনি মার্কিনি স্পেশালিস্ট নন, নিতান্ত দিশি মাল– এবং সর্বোপরি তিনি ‘এমেচার’!
এসব তো মস্করার কথা– যদিও দুটোই ডাহা ইমানসে সত্য। তবে দিল্লির প্রতিষ্ঠানটি নাকি ‘সদাচার কদাচারে’র উৎপাতে ইদানীং বড়ই উৎপীড়িত (‘তংগ আ গয়ে’); তার অর্থ অবশ্য এ-নয় যে ‘হাঙার স্ট্রাইক’ করার কারণের কিংবা/এবং অকারণের অজুহাত অছিলার অভাব ঘটেছে কিংবা ‘হাঙার’-এর হাঙরদের ক্ষুধানিবৃত্তি ঘটেছে– আসল কারণ ওটা নাকি রেশন্ড হয়ে গিয়েছে, অর্থাৎ ‘লুকিয়ে হাঙার স্ট্রাইক’, ‘ফাস্ট আনটু ডেথ’ এসব করতে হলে সেগুলো এখন করবেন সরকার স্বয়ং! আনাড়ি এমেচারদের হাতে আর এসব টপ প্রায়োরিটির বস্তু ছেড়ে দেওয়া যায় না। দেশ-বিদেশে বড্ড বেইজ্জতি হয়। আইরল্যান্ডের কে যেন ম্যাকসুইনি না কী যেন নাম, সে নাকি বাষট্টি বা বিরানব্বই দিন নাগাড়ে উপোস মেরেছিল– এমতাবস্থায় ভারত যদি বাহান্ন দিনের রেকর্ড দেখায় তবে সেটা হবে সত্যই ‘শরমকি’ ঘুড়ি ‘লজ্জাকি, ঔর আফসোস–’ থুড়ি পশ্চাত্তাপকি বাৎ!
তৎসত্ত্বেও এমেচারকে ঠেকানো যায় না– বারট্রান্ড রাসূলের মতো নিরহঙ্কার লোক পর্যন্তও চেষ্টা দিয়ে হার মেনেছেন।(১) স্বয়ং রবি ঠাকুর এই এমেচারি কর্মে বড়ই সুখ পেতেন। আমি তামা-তুলসী স্পর্শ করে একশ’বার কিরে কাটতে রাজি আছি, তাঁকে মধ্যমশ্রেণির হোমিওপ্যাথ ডাক্তার বললে তিনি সেটাকে কবিতায় নোবেল প্রাইজ পাওয়ার চেয়ে লক্ষণে শ্রাঘনীয় বলে মনে করতেন। ঠিক তেমনি স্পেশালিস্ট সত্যেন বোস তাঁকে দিলেন টুইয়ে– বিজ্ঞান শিখতে হয়, সে-ও না হয় বুঝি শেখাতে! অর্থাৎ ‘মেস্টারি’ করতে। তা হলে পাঠ্যপুস্তকের প্রয়োজন। বাজারে যেগুলো মেলে সেগুলো লিখেছেন বটে বিশেষজ্ঞরা– একশ’বার মানি– কিন্তু যে বাংলাভাষায় লিখেছেন সেটা, ওই যে ফরাসিতে বলে, ‘ইলজ এক্ৰিভ ফ্রাঁসে কমলে ভাশ এস্পানিয়োল’–তেনারা ফরাসি লেখেন স্প্যানিশ গাইয়ের মতো।(২) রবি ঠাকুর আর যা করুন, তাঁর বাংলাটা অন্তত বোধগম্য হবে। থাক না দু-পাঁচটা ভুল এদিক ওদিক। সেগুলো মেরামত করার জন্য তো ওই হোথায় সত্যেন বোস বসে।
যৌবনে রবীন্দ্রনাথ একদিন শব্দতত্ত্ব নিয়ে তর্কাতর্কির দায়ে মজে যান। বৃদ্ধ বয়সে বোধ হয় সুনীতিবাবু এবং/কিংবা গোসাঁইজির প্ররোচনায়– তাবৎ বাংলাভাষাটা নিয়ে খুব একচোট তলওয়ার খেলা দেখিয়ে দিলেন। আহা সে কী স্বচ্ছ সুন্দর তরল ভাষা– যেন বোতল থেকে তেল ঢালা হচ্ছে। কে বলবে, বিষয়বস্তু নিরস শব্দতত্ত্ব– হুস হুস করে পাতার পর পাতা সিনেমার ডেলি ক্যালেন্ডারের পাতার পর পাতা ওড়ার মতো পেরিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ দুম করে সম্বিতে ফিরে আসবেন। এমেচার আর্টিস্ট যেন লাজুক হাসি হেসে ঘন ঘন করতালির মধ্যিখানে শেষ বক্তব্য নিবেদন করছেন। কী বলছেন? বলছেন, তিনি শব্দতাত্ত্বিক নন– নিতান্ত এমেচার– তাই খুব সম্ভব হেথা হোথা বিস্তর গলদ থেকে যাবে।
তার পর তিনি যে মুষ্টিযোগের শরণ নিয়েছেন সেইটে তিনি কালিদাসের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন। সেটা তার শক্তি (fort)-ও বটে, দুর্বলতাও যদি অপরাধ না নেন– বটে, কিন্তু এস্থলেও তিনি যে-তুলনাটি ব্যবহার করেছেন সেটি উপমা কালিদাসস্যকেও হার মানায়। তিনি বলছেন, ‘কোনও কোনও বিখ্যাত রূপশিল্পী শরীরতত্ত্বের যথাতথ্যে ভুল করেও চিত্রকলায় প্রশংসিত হয়েছেন (যেমন সেজানের ওয়েস্ট কোট-পরা ছোকরাটির হাত আজানুলম্বিত না বলে আগুলফ-লম্বিত বললেই ঠিক হয় কিন্তু তৎসত্ত্বেও ছবিটি রসে ভর্তি যাকে আজকের দিনে রসোত্তীর্ণ’ বলা হয়, ঠিক তেমনি কবির ভাষা সম্বন্ধে এ-বইয়ে দুই-পাঁচটি ভুল বা অর্ধসত্য পরিবেশিত হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু এসব ভুল মেনে নিয়েও দেখা যায় এরকম তুলনাহীন প্রবন্ধ হয় না।’ কারণ তথ্য-পরিবেশনে অসম্পূর্ণতা থাক আর না-ই থাক, সবসুদ্ধ মিলিয়ে প্রবন্ধটি বাংলা ব্যাকরণ (খাঁটি বাংলা ব্যাকরণ– বাংলার ছদ্মবেশ পরে সংস্কৃত ব্যাকরণ নয়।) এবং খাঁটি বাংলা অলঙ্কার নিয়ে এক অভূতপূর্ব রচনা। যেমন তিনি বলছেন, চলতি বাংলাতে শুরুচণ্ডালী এখন আর দোষের মধ্যে গণ্য নয়।
ঠিক এই জিনিসটেই আমরা অন্যান্য সাহিত্যিকের কাছে প্রত্যাশা করি। কারণ সাহিত্যিকের সঙ্গে ভাষার যে-পরিচয় হয় সেটা আদৌ শব্দতাত্ত্বিক বা ভাষাতাত্ত্বিকের মতো নয়। সে-ভাষা ব্যবহার করে নতুন নতুন সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিয়ে। তাই তার ভাষা সদা পরিবর্তনশীল। অত্যুত্তম গ্রন্থ লিখে ভাষাবাবদে আপামর জনসাধারণ তথা বৈয়াকরণিকের অকুণ্ঠ প্রশংসা পেলেও লেখক তার পরবর্তী পুস্তকে সেই অনুমোদিত ভাষার পুনরাবৃত্তি করতে চায় না, রবীন্দ্রনাথের তুলনায়, আপনার মালের রিসিভার অব স্টোলেন প্রপার্টি হতে চায় না। তাই তাকে প্রতিদিন নিত্য নবীন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় এবং সেখানে সে কোনও বৈয়াকরণিক, কোনও শব্দতাত্ত্বিকের সাহায্য পায় না। তাই, প্রাচীন লেখক যখন নতুন শব্দভাণ্ডার বচনভঙ্গি নিয়ে পুনরায় একখানা সার্থক গ্রন্থ লেখেন, তখন সাহিত্যের সঙ্গে সঙ্গে ভাষারও শ্রীবৃদ্ধি হয়। এ কর্ম শব্দতাত্ত্বিক করতে পারেন না– অবশ্য তিনি যদি সাহিত্যিকও হন ও তার তত্ত্বগ্রন্থখানি সাহিত্যের পর্যায়ে তুলতে পারেন তবে অন্য কথা।
তাই ভাষার নব নব রূপ দেখাবার জন্য সাহিত্যিককেও এমেচারি শব্দতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে হয়।
এবং শুধু সাহিত্যিকই না, যে-ব্যক্তিই জ্ঞান-বিজ্ঞান বা অন্য যে-কোনও চিন্ময় বিষয় নিয়ে চিন্তা করেন, আলোচনা করেন, তাঁকেই কিছু-না-কিছু শব্দতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে হয়। এই তত্ত্বটি হঠাৎ আমার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ফুটে উঠল, মুসলমানদের সন্ত ইমাম আবু হানিফার বিরাট ন’ভল্যুমি গ্রন্থের একটি জায়গা পড়ে।
ইমাম আবু হানিফা শিষ্যসমাবৃত হয়ে প্রতি প্রাতে বসতেন মুসলিমধর্ম আলোচনায়। তার রায় লিখে রাখা হত তো বটেই, তাঁর প্রধান শিষ্যদের কেউ ভিন্ন রায় (মিনিট অব ডিসেন্ট) প্রকাশ করলে সেটিও সযত্নে পাশাপাশি লিখে রাখা হত।
একদা প্রশ্ন উঠল, ‘নগরে জুমার নমাজ অবশ্য পালনীয়; কিন্তু গ্রামে জুমার নমাজ হয় না’– এ-আদেশ শিরোধার্য করব কি না? ইমাম সাহেব, বললেন, ‘শিরোধার্য করা,–করার পূর্বে প্রথম দেখতে হবে “নগর” বলে কাকে, আর “গ্রাম” বলে কাকে?’ জনৈক শিষ্য বললেন, ‘অভিধান দেখলেই হয়।’ এবারে ইমাম যা বললেন, সেটি মোক্ষম তত্ত্বকথা– সর্বভাষাতে সর্বকালে প্রযোজ্য। তিনি বললেন, ‘কোষকার দেবে সাধারণ প্রচলিত অর্থ। পক্ষান্তরে আমরা ধর্মশাস্ত্রের অধ্যয়ন করে জনসাধারণের জন্য অনুশাসন প্রচার করি (অর্থাৎ আমরা theologians); থিয়োলজিয়ানের দৃষ্টিবিন্দু থেকে কোটা শহর– যেখানে জুম্মার নমাজ সিদ্ধ– এবং কোনটা গ্রাম যেখানে জুমার নমাজ অসিদ্ধ– তার শেষ বিচার তো আমাদের হাতে।’
অত্যন্ত খাঁটি কথা। যেমন ধরুন গরুর বাথান, যেখানে রাখালরা শীতকালে থাকে। সেটাকে হয়তো গ্রামের পর্যায়েও ফেলা যাবে না। কিংবা উত্তম মরূদ্যান পেয়ে হাজার লোকের কাফেলা (ক্যারাভান) কয়েক দিন বিশ্রাম করল। সেখানে জুম্মার নামাজ সিদ্ধ না অসিদ্ধ?
ইমাম সাহেব বলছেন, থিয়োলজিক্যাল অর্থে কোনটা গ্রাম, আর কোনটা শহর, তার সংজ্ঞার (definition-এর) জন্য কোষকার তো আসবে আমাদেরই কাছে।
ঠিক তেমনি আইনজ্ঞ পণ্ডিতরা সংজ্ঞা দেন কোনটা crime, আর কোনটাই-বা tort; তবে তো কোষকার সেটা তার অভিধানে লিপিবদ্ধ করে। সে তো আর বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রত্যেকটিতে বিশেষজ্ঞ নয় যে, নিছক আপন বুদ্ধির ওপর নির্ভর করে প্রত্যেক শব্দের সংজ্ঞা দেবে, বর্ণনা দেবে, প্রতিশব্দ দেবে।
ঠিক এই জিনিসটি বাংলা দেশে এখনও আরম্ভ হয়নি।
সবাই তাকিয়ে আছেন কোষকারের দিকে। সে পরিভাষা বানিয়ে দেবে। আর সে বেচারি তাকিয়ে আছে ভিন্ন ভিন্ন জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শন, চিকিৎসা, আইন ইত্যাদির পণ্ডিতদের দিকে। তাঁরা সংজ্ঞা দেবেন এবং তাঁদের অধিকাংশই শব্দ বা ভাষাতাত্ত্বিক নন, সে বাবদে নিতান্তই এমেচার–তবে তো কোষকার সেগুলো লিপিবদ্ধ করবে–
২৬।২।৬৬
———
১. এ বাবদে তাঁর বিদকুটে রায়; সর্ব পণ্ডিত যখন কোনো তত্ত্ব একবাক্যে স্বীকার করে নেন, তখন তুমি এমেচার সেখানে ফপরদালালি করতে যেয়ো না। আর যেখানে তারাই একমত হতে পারছেন না সেখানে তুমি নাক গলাতে যাও কোন দুঃসাহসে? এর বিগলিতাৰ্থ : তুমি এমেচার ঠোঁট দুটি সেলাই করে বসে থাকো। এমনকি কেউ যদি বলে, Fine Weathereh? তুমি হ্যাঁ না। বলতে পারবে না। তুমি ওয়েদারের জানো কী? প্রথম গ্রিনিজকে শুধোবে আবহাওয়ার দফতরে। তারা যদি বলে ফাউল’ তবে ফাউল– তা তুমি যেখান থেকে কথা বলছ সেখানে থাক না মলয় পবন আর সূর্যাস্তের লালিমায় রঙিন গোলাপি আকাশ! এস্তেক তোমার নাম যদি অতুল’ হয় তবে তোমার বিপদ প্রত্যাসন্ন। শিশির ভাদুড়ী বলতেন অ (ঘর-এ যে অ’ উচ্চারণ), আর রবি ঠাকুর বলতেন ‘ওতুল’– কিন্তু তিনিও আবার ‘ওতুলনীয়’ না বলে বলতেন ‘অতুলনীয়’। অর্থাৎ বারট্রান্ড রাসলের অনুশাসন মানলে তোমাকে নাম বদলে ‘মাকাল-টাকাল’ কিছু একটা ‘দশদিশি নিরদ্বন্দ্বা’ নাম রাখতে হবে।
২. আমার টায়-টায় মনে নেই তবে রাজশেখর লেখেন, ‘নেত্রজনের উপস্থিতিতে অসিতলীনের উপর কুলহরনীর প্রতিক্রিয়া’ শুনে মনে হয় সক্কলের সজাগ দৃষ্টির সামনে (এখানে পাঠক আমার তরফ থেকে একটা ভদ্রজনোচিত গলাখাকারি অনুমান করে নেবেন। ধন্যবাদ!) কোনো বেহেড় বেলেল্লাপনা। উঁহু, আপনার পাপ মন, পাঠক, আপনার পাপ মতি। এর অর্থ হচ্ছে আবার বলছি টায়-টায় মনে নেই– The reaction of chlorine (কুলহরনীর) on actylene (অসিতলীন) where nitrogen (নেত্রজন) is present.
ঐতিহাসিক উপন্যাস
কলকাতায় এসে শুনতে পেলুম, বর্তমানে নাকি ঐতিহাসিক উপন্যাসের মরসুম যাচ্ছে। আশ্চর্য লাগল। বঙ্কিম আরম্ভ করলেন ঐতিহাসিক উপন্যাস দিয়ে, রবীন্দ্রনাথ লিখলে সামাজিক কিঞ্চিৎ রোমান্টিক-ঘ্যাঁষা-উপন্যাস, শরৎচন্দ্র লিখলেন মধ্যবিত্ত শ্রেণি নিয়ে, তারাশঙ্কর তথাকথিত নিম্ন সম্প্রদায় নিয়ে। এরপর আবার হঠাৎ ঐতিহাসিক উপন্যাস কী করে যে ডুব-সাঁতারে রিটার্নজার্নি মারলে ঠিক বোঝা গেল না। আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি; কাজেই আর পাঁচজনের মতো হতভম্ব হতে আমার কোনও আপত্তি নেই।
ঐতিহাসিক উপন্যাসের নাকি এখন জোর কাটতি। আবার একাধিক জন বলছেন, এগুলো রাবিশ। পাঁচজনের মতো আমি আবার হতভম্ব।
কিন্তু এতে করে আমার ব্যক্তিগত উপকার হয়েছে। বছর পঁচিশেক পূর্বে আমাকে বিশেষ কারণে মোগল সাম্রাজ্যের পতন ও মারাঠা শক্তির অভ্যুদয় নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়। সে যুগের প্রায় সব কেতাবপত্রই ফার্সিতে। বহু কষ্টে তখন অনেক পুস্তক যোগাড় করেছিলুম। তার কিছু কিছু এখনও মনে আছে। মাঝে মাঝে আজকের দিনের কোনও ঘটনা হুবহু ‘শেষ মোগলদের’ সঙ্গে মিলে যায় এবং লোভ হয় সেদিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করি। কিন্তু সে সব কেতাবপত্র এখন পাই কোথায়? স্মৃতিশক্তির ওপর নির্ভর করলে হয়তো ইতিহাসের প্রতি অবিচার করা হবে।
কিন্তু ওই ঐতিহাসিক উপন্যাসই এক্ষণে আমার পরিত্রাণ এনে দিয়েছে। ধরে নিন, আমি ঐতিহাসিক উপন্যাসই লিখছি।
.
মারাঠারা যখন গুজরাত সুবা (বা সুবে অর্থাৎ প্রদেশ, প্রভিন্স) দখল করে তার রাজধানী আহমদাবাদে ঢুকল তখন সেখানকার দেওয়ান (প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী) মুহাফিজখানার (আর্কাইভস-এর) তাবৎ কাগজপত্র বাড়ি নিয়ে গিয়ে গুজরাত-কাঠিয়াওয়াড়ের একখানা প্রামাণিক ইতিহাস লেখেন। বইখানি তিনি দিল্লির বাদশা-সালামৎ মুহম্মদ শাহ বাদশাহ রঙ্গিলাকে ডেডিকেট করেন। ইতিহাসের নাম ‘মিরাৎ-ই-আহমদী’। পুস্তকের মোকদ্দমায়(১) তিনি বাদশা সালামৎকে উদ্দেশ করে বলেন, যে রাজনীতি অনুসরণ করার ফলে দিল্লির বাদশারা গুজরাতের মতো মাথার-মণি প্রদেশ হারালেন সে নীতি যদি না বদলানো হয় তবে তাবৎ হিন্দুস্তানই যাবে। সেই নীতির প্রাথমিক স্বর্ণযুগ, ক্রমবিকাশ ও অধঃপতন তিনি সেই ইতিহাসে ধারাবাহিক লিপিবদ্ধ করেছেন।
সেই ইতিহাস থেকে একটি ঘটনার কথা মনে পড়ল। স্মৃতিশক্তির ওপর নির্ভর করে লিখছি– তাই আবার বলছি ভুলচুক হলে ধরে নেবেন, এটি ঐতিহাসিক উপন্যাস।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে একবার পর পর কয়েক বৎসর ধরে গুজরাতে বৃষ্টি না হওয়ার ফলে ভীষণ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। দলে দলে লোক আহমদাবাদ পানে ধাওয়া করে; সেখানে যদি দু মুঠো অন্ন জোটে। অগণিত পিতামাতা তাদের পুত্র-কন্যাকে দাস-দাসীরূপে বিক্রয় করে দেয়। গুজরাতি মেয়েরা যে টাকা-মোহর ফুটো করে অলঙ্কার হিসেবে পরে সেগুলো পর্যন্ত বিক্রয় করে দেয়। বিস্তর লোক উপবাসে মরল।
গুজরাত সুবার সুবেদার (গভর্নর কিন্তু বর্তমান গভর্নরের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতা ধরতেন এবং দেওয়ানের সঙ্গে একজোটে প্রদেশ চালাতেন) তখন আহমদাবাদের সবচেয়ে ধনী শ্রেষ্ঠীকে পরামর্শের আমন্ত্রণ জানালেন। এইসব শ্ৰেষ্ঠীরা প্রধানত জৈন, এবং স্মরণাতীত কাল থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য করে করে বহু অর্থের অধিকারী হয়েছিলেন (বর্তমান দিনের শ্রেষ্ঠী কস্তুরভাই লালভাই, হটিসিং এই গোষ্ঠীরই লোক)।
সুবেদার সেই শ্ৰেষ্ঠীকে শুধালেন, দুর্ভিক্ষ নিবারণের জন্য কিছু করা যায় কি না। শ্ৰেষ্ঠী বললেন, মালওয়া অঞ্চলে এবারে প্রচুর ফসল ফলেছে, সেখানে গম-চাল পাওয়া যাবে। তবে দুই প্রদেশের মাঝখানে দারুণ দুর্ভিক্ষ। মালবাহী গাড়ি লুট হবে। অতএব তিনি দুই শর্তে দুর্ভিক্ষ-মোচনের চেষ্টা করতে পারেন : ১. সুবেদার নিরাপদে মাল আনানোর জন্য সঙ্গে গার্ডরূপে ফৌজ পাঠাবেন, ২. মাল এসে পৌঁছলে সুবেদার-শ্ৰেষ্ঠীতে মিলে যে দাম বেঁধে দেবেন মুদিরা যদি তার বেশি দাম নেয় তবে তদ্দণ্ডেই তাদের কঠোর সাজা দেবার জিম্মাদারি সুবেদার নেবেন। সুবেদার সানন্দে সম্মতি দিলেন। এখানে উল্লেখযোগ্য শ্রেষ্ঠী সুবেদারের কাছে থেকে অর্থ-সাহায্য চাননি।
বাড়িতে এসে শ্রেষ্ঠী বংশানুক্রমে সঞ্চিত অর্থ, অলঙ্কার-জওহরা বের করলেন, স্ত্রী-কন্যাকে তাদের অলঙ্কার পর্যন্ত খুলে দিতে বললেন।
সেই সমস্ত ঐশ্বর্যভাণ্ডার নিয়ে শ্রেষ্ঠীর কর্মচারীরা সুবেদারের ফৌজসহ মালওয়া পানে রওনা দিলেন। কিছুদিন পরেই মুখে মুখে আহমদাবাদে রটে গেল, মাল পৌঁছল বলে। পথে লুটতরাজ হয়নি।
সেইসব গম ধান ও অন্যান্য শস্য যখন আহমদাবাদে পৌঁছল শ্ৰেষ্ঠী তার একাধিক হাভেলি– বিরাট চক-মেলানো বাড়ি, একসঙ্গে গোষ্ঠীর বহু পরিবার একই বাড়িতে বসবাস করতে পারে–খুলে দিয়ে আঙ্গিনার উপর সেসব রাখলেন। তার পর সুবেদারের সঙ্গে হিসাব করলেন, কী দরে কেনা হয়েছে, রাহ-খর্চা (ট্রান্সপোর্ট) কত পড়েছে এবং তা হলে এখন কী দর বেঁধে দেওয়া যায়? সুবেদার বললেন, ‘আর আপনার মুনাফা?’ শ্ৰেষ্ঠী বললেন, ‘যুগ যুগ ধরে মুনাফা করেছি ব্যবসা বাণিজ্যে! এ ব্যবসাতে করব না। যা খর্চা পড়েছে সেই দর বেঁধে দিন। মুদির সামান্য লাভ থাকবে।’ দাম বেঁধে দেওয়া হল।
এবারে শুনুন, সবচেয়ে তাজ্জবকী বাৎ! শ্রেষ্ঠী শহরের তাবৎ মুদিদের ডেকে পাঠালেন এবং কোন মুদি কটা পরিবারের গম যোগায় তার শুমারি (গণনা) নিলেন। সেই অনুযায়ী তাদের শস্য দেওয়া হল। সোজা বাংলায় আজকের দিনে একেই বলে রেশনিং। এবং তার সঙ্গে গোড়াতেই ব্যবস্থা, যাতে হোর্ডিং না হতে পারে। এবং ফেয়ার প্রাইস।
আহমদাবাদের চতুর্দিকে আনন্দোচ্ছ্বাস। ইতোমধ্যে শ্রেষ্ঠীর চর এসে জানালেন অমুক মহল্লার দু জন মুদি ন্যায্যমূল্য থেকে এক না দুপয়সা বেশি নিয়েছে।
শ্ৰেষ্ঠী তৎক্ষণাৎ স্বয়ং সেই মহল্লায় গিয়ে সর্বজন সমক্ষে তদন্ত করলেন। এবং সঙ্গে সঙ্গে সোজা সুবেদারের বাড়ি গেলেন। সুবেদার তখন ইয়ার-বক্স(২) সহ গমগমন সেলেব্রেট করছিলেন। কিন্তু পূর্বপ্রতিজ্ঞা অনুযায়ী বেরিয়ে এসে সবকিছু শুনে সেপাই পাঠালেন মুদিদের ধরে আনার জন্য। সাক্ষী-সাবুদও যেন সঙ্গে সঙ্গে আনা হয়।
তদ্দণ্ডেই সুবেদারের সামনে সাক্ষীসাবুদ তদন্ত-তফতিশ হয়ে গেল। প্রমাণ হয়ে গেল সত্যই তারা বেশি দাম নিয়েছে।
সুবেদার হুকুম দিলেন, বড্ড বেশি ‘খেতে চেয়েছিল’ বলে মুদি দুটোর পেট কেটে ফেলা হোক। তাই করা হয়। নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে গেল।
সবাই যেন এই দৃষ্টান্ত থেকে সজাগ সতর্ক হুশিয়ার খবরদার হয় সেই উদ্দেশ্যে সুবেদার হুকুম দিলেন, শহরের সবচেয়ে উঁচু দুটো উটের পিঠে তাদের লাশ বেঁধে দিয়ে নগর-পরিক্রমা করা হোক।
সমস্ত রাত ধরে তাই করা হল।
এরপর ঐতিহাসিক যেন নিতান্ত সাদামাটা ডালভাতের কথা বলছেন, ওইভাবে মন্তব্য করছেন, ‘অতঃপর আর কেউ অন্যায্য মুনাফা করার চেষ্টা করেনি।’
(আমার হাতে যে পাণ্ডুলিপিখানা পৌচেছিল তাতে দেখি এ জায়গাটায় এ যুগের কোনও এক সুরসিক পাঠক লিখেছেন, ‘we are not surprised’)।
আমি আর কী মন্তব্য করব? রেশনিং, ফেয়ার-প্রাইস, নো চানস্ ফর হোডিং, তনুহূর্তে তদন্ত, তদ্দণ্ডে দণ্ড, জনগণকে হুঁশিয়ারি দেওয়া এসবই হয়ে গেল চোখের সামনে। অবশ্য আমি নিরীহ প্রাণী, পেট কেটে নাড়িভুঁড়ি বের করার আদেশ শুনলে আমার গা শিউরে ওঠে। তবে যারা দিনের পর দিন রেশন-শপের লাইনে দাঁড়িয়েছেন, চোখের সামনে কালো-বাজার এবং যাবতীয় অনাচার দেখেছেন, পুত্রকন্যাকে কচুঘেঁচু খাওয়াতে বাধ্য হয়েছেন এবং বিত্তশালীরা কী কৌশলে তোফা খানাপিনা করছেন সবিশেষ অবগত আছেন, তারা হয়তো উল্লাস বোধ করবেন। আমি আপত্তি করব না–কারণ পূর্বেই বলেছি, আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি।
———
১. বাংলায় মোকদ্দমা বলতে মামলা, ‘কে’ বোঝায়। আরবিতে অর্থ অবতরণিকা। ‘কদম’ মানে পদক্ষেপ (‘কদম্ কদম্ বঢ়হায়ে যা’); মোকদ্দমা প্রথম পদক্ষেপ, অবতরণিকা; আবার প্রথম পদক্ষেপ বলে তার অর্থ মামলা রুজু করার প্রথম কদম– একদিক দিয়ে দেখতে গেলে লাতিনে যাকে বলে প্রিমা ফাশি কেস– কিন্তু বাংলায় এখন মোকদ্দমা বলতে পুরো কেসটাই বোঝায়।
২. বকসি বা বখ্শি (বখশিশ কথা একই ধাতু থেকে) অর্থ একাউন্টেন্ট জেনারেল, অডিটার জেনারেল ও ফৌজের চিফ পে-মাস্টার– এ তিনের সমন্বয়। কায়স্থরা প্রধানত এই দায়িত্বপূর্ণ চাকরি করতেন। প্রধান বা মীর বখ্শি নিয়োগ করতেন স্বয়ং দিল্লির বাদশা সালামৎ। আর সরাসরি নিয়োগ হতেন কাজী উল কুজ্জাৎ অর্থাৎ চিফ জাস্টিস, সদ-উস-সদর (সেই অঞ্চলে বাদশা সালামতের আপন-জমিজমা তদারকের জন্য, তথা কেউ নিঃসন্তান মারা গেলে তার সম্পত্তি অধিকার করতে)। সরকার= চিফ-সেক্রেটারি, কানুনগো= লিগেল রিমেমব্রেনসার পরে নিযুক্ত হতেন। বখশির কাছ থেকে টাকা পেয়ে ব্যবসায়ীরা সঙ্গে সঙ্গে সামনের বাজারে হুণ্ডি কাটতো বলে সে বাজারকে ‘বখশি বাজার’ বলা হত। বখ্শি সরকার ইত্যাদি বড় বড় এডমিনিট্রেটিভ চাকরি প্রধানত কায়স্থরাই করতেন। ইংরেজ মোটামুটি এই পদ্ধতিই চালু রাখে।
কচ্ছের রান
ঐতিহাসিক উপন্যাস নিয়ে কথা হচ্ছিল। আর বলছিলুম, এতে করে আমার বড্ডই উপকার হয়েছে। ইতিহাস নিজেকে মাঝে মাঝে পুনরাবৃত্তি করে। চোখের সামনে যখন তাই কোনও কিছু একটা ঘটে, তখন স্মৃতিপথে আসে প্রাচীন দিনের ওইরকম কোনও একটি ঘটনা। প্রথম যৌবনে কোনও এক প্রাচীন ইতিহাসে পড়েছি। সে বই এখন আর পাব না। একে ফার্সিতে লেখা, তদুপরি, বইখানা হয়তো সে ভাষার পুস্তকের মাঝেও দুপ স্মৃতিশক্তির ওপর নির্ভর করলে হয়তো ঐতিহাসিকের প্রতি অবিচার করা হবে।
ইতোমধ্যে ঐতিহাসিক উপন্যাস এসে আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। কেউ যদি ত্রুটিবিচ্যুতি দেখিয়ে দেয় তবে নিঃশরমে বলব, আমি ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখেছি।
গুজরাতের ইতিহাস ‘মিরৎ-ই-আহমদী’র কথা হচ্ছিল। বইখানা লেখা হয়, নাদির শাহ যখন ভারতবর্ষ লণ্ডভণ্ড করে যান মোটামুটি সেই সময়। এ পুস্তক গ্রন্থকার আরম্ভ করেছেন জৈন সাধু মেরুতুঙ্গাচার্যের সংস্কৃতে লেখা গুজরাতের প্রাক্-মুসলিম যুগের ইতিহাসের(১) সারাংশ নিয়ে, তার পর আছে গজনীর সুলতান মাহমুদ(২) কর্তৃক সোমনাথ আক্রমণ।
সুলতান মাহমুদ এমনিতে বলতেন, তিনি কাফিরের বিরুদ্ধে জিহাদ করেন, কিন্তু সিন্ধুদেশ সপ্তম-অষ্টম শতাব্দী থেকে মুসলমান অধিকারে। সে দেশ কী করে আক্রমণ করা যায়? সুলতান বললেন, ‘সিন্ধুদেশের মুসলমানরা যদিও কাফির নয়, তবু কাফির-তুল্য তারা হেরেটিক; অতএব আক্রমণ করা যায়।’
তা সে যাই হোক, তাঁর আসল উদ্দেশ্য ছিল কাঠিওয়াড়ের সোমনাথ মন্দিরের বিরাট ধনভাণ্ডার লুণ্ঠন করা। সেটা সিন্ধুদেশ জয় না করে হয় না।
কিন্তু তার পরই আসে কচ্ছের রান। সেটা অতিক্রম করা সিন্ধু-বিজয়ের চেয়েও কঠিন। মাহমুদের সাঙ্গোপাঙ্গ তাঁকে নিরস্ত করার চেষ্টা দিয়ে নিষ্ফল হলেন।
কচ্ছের রান অতিক্রম করতে গিয়ে মাহমুদের ফৌজের অসংখ্য সৈন্য ও অশ্ব তৃষ্ণায় প্রাণ হারাল। চোরাবালিতেও অনেক। তখনকার দিনের ঐতিহাসিকরা তার জন্য গাইডকে জিম্মেদার করেছেন; সে নাকি বিশ্বাসঘাতকতা করে। কিন্তু মাহমুদকে বাধ্য হয়ে ওই পথেই ফিরে যেতে হয়েছিল। মাহমুদ ছিলেন ল্যান্ডল (অর্থাৎ যে দেশের সঙ্গে সমুদ্রের কোনও সংস্পর্শ নেই) দেশের লোক–হিটলারের মতো।(৩) তাই দ্বারকা থেকে নৌবহর যোগাড় করে ‘ঠাট্টা’ (করাচির কাছে প্রাচীন বন্দর) যাবার সাহস করেননি।
এরপর পাগলা রাজা মুহম্মদ তুগলুক এই কচ্ছের রানের কাছে মার খান।
ফার্সি ঐতিহাসিক লিখেছেন ‘তগী’, ফার্সিতে ‘ঠ’ ধ্বনি নেই– শব্দটা বোধ হয় তাই ‘ঠগী’। সেই তগী মধ্য-পশ্চিম ভারতে লুটতরাজ আরম্ভ করে। বাদশাহি ফৌজ বারবার তার বিরুদ্ধে অভিযানে বেরিয়ে বারবার বিফলমনোরথ হয়ে দিল্লি ফিরে আসেন। মুহম্মদ রেগে টঙ। বললেন, ‘আমি স্বয়ং যাব।’
একটা সামান্য ডাকুর বিরুদ্ধে স্বয়ং হুজুর যাবেন!
না, যাবই।
হুজুর স্বয়ং আসছেন জেনে তগী আহমদাবাদ পালাল। হুজুর বললেন, চল আহমদাবাদ। পারিষদরা মহা অসন্তুষ্ট। সেই সুদূর আহমদাবাদ– দিল্লি থেকে কতদিনের রাস্তা! হুজুর কিন্তু গোঁ ছাড়লেন না। আহমদাবাদে পৌঁছলে পর জানা গেল, তগী পালিয়েছে কাঠিয়াওয়াড়ে। হুজুর বললেন, ‘চল কাঠিয়াওয়াড়’। কিন্তু তখন বর্ষা নেমে গিয়েছে। এবং শ্রান্তি-ক্লান্তিতে হুজুরের হল জ্বর। কী জ্বর, আমি বর্ণনা থেকে বুঝতে পারিনি। ম্যালেরিয়া খুব সম্ভব নয়। ম্যালেরিয়া বোধ হয় এ-দেশে পরে এসেছে। তা সে যাই হোক, হুজুর তামাম বর্ষাকালটা আহমদাবাদে জ্বরে ধুকে। ধুকে রোগা দুবলা হয়ে গেলেন। কিন্তু বর্ষা-শেষেও গো ছাড়লেন না– তাঁকে যে পাগলা রাজা বলা হত সেটা প্রধানত তার গোর জন্যই চললেন কাঠিয়াওয়াড়। তগী পালাল কচ্ছে। হুজুর গেলেন কচ্ছ। তগী পালালো কচ্ছের রানের উপর দিয়ে সিন্ধুদেশে। সে ডাকাত রানের কোথায় কী, জানে সেখানে একাধিক বার আশ্রয় নিয়েছে। তদুপরি সে তো আর বিরাট সৈন্যবাহিনী নিয়ে যাচ্ছে না; তার দানাপানির আর কতটুকুই-বা দরকার।
এবার পারিষদরা তারস্বরে প্রতিবাদ জানালেন। গজনীর মাহমুদ বাদশা যে রানে কী রকম নাজেহাল হয়েছিলেন সে কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। সঙ্গে ছিলেন রাজসভার সরকারি ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বরনী (ইনি ‘দিল্লি দূর অস্ত’-এর সাধু নিজামুদ্দীন আউলিয়া ও কবি আমির খুসরুর নিত্যালাপী বন্ধু ছিলেন); তিনিও নিশ্চয়ই প্রাচীন ইতিহাস কীর্তন করেছিলেন। তদুপরি তুগলুক নিজে ছিলেন সুপণ্ডিত। ইতিহাস ভূগোল উত্তমরূপেই জানতেন। কিন্তু হিটলার যদিও অত্যুত্তমরূপেই নেপোলিয়নের রুশ-অভিযান ও তার মারাত্মক ফলাফল সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞ ছিলেন এবং যদিও তাঁর সেনাপতিরা তাকে বারবার রুশ অভিযান থেকে নিরস্ত থাকতে উপদেশ দেন, তবুও তিনি সেই কর্মটি করেছিলেন। এখানেও তাই হল। তুগলুক নিরস্ত হলেন না।
কচ্ছের রানে বাদশা মুহম্মদ তুগলকের কী নিদারুণ দুরবস্থা হয়েছিল, তার বর্ণনা একাধিক ঐতিহাসিক দিয়েছেন। আজ আমার আর ঠিক মনে নেই, তার সৈন্য এবং ঘোড়া খচ্চরের ক-আনা বেঁচেছিল, আর ক-আনা মরেছিল।
এ সময়ের একটি ঘটনা ঐতিহাসিক বর্ণনা করেছেন। রোগে জীর্ণ দুর্বল দেহ নিয়ে ঘোড়ার উপরে বসে মুহম্মদ তুগলুক ধুঁকতে ধুঁকতে এগোচ্ছেন। এমন সময় তিনি ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বরনীকে ডেকে পাঠালেন– কাউকে ডেকে না পাঠালে হুজুরের কাছে যাবার কারও অনুমতি ছিল না। বরনী কাছে এলে তুগলুক তাকে বললেন, ‘আচ্ছা বরনী, তুমি তো জানো আমি আমার প্রজাদের কতখানি ভালোবাসি। আমি যে-সব ফরমান-হুকুম জারি করেছি সে তো একমাত্র তাদেরই মঙ্গলের জন্য। তবে তারা একগুঁয়েমি করে আমার আদেশ অমান্য করে কেন?’ তার পর শুধোলেন, ‘আচ্ছা বরনী, তোমার কি মনে হয়, আমি বড় কড়া হাতে শাসন করেছি, প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত শাস্তি দিয়েছি? তবে কি এখন আমার উচিত আরও ক্ষমা-দয়ার সঙ্গে শাসন করা?’
বরনী লিখেছেন, ‘এই শেষকালে যদি হুজুর হঠাৎ তার নীতি বদলান তবে হয়তো আরও বিপর্যয়ের সৃষ্টি হবে ভেবে আমি নীরব থাকাটাই যুক্তিযুক্ত বলে মনে করলুম।’
এদিকে দিল্লিতে বসে তুগলুকের প্রধানমন্ত্রী পড়েছেন মহাবিপদে। হুজুরের কোনও খবর নেই। রান থেকে তো দূত পাঠানো যায় না, যে দিল্লি আসবে। দূত আর তার পার্টি পথে জল পাবে কোথায়? পিছনপানে অবশ্য মৃত্যু, সম্মুখ দিকে তবু বাঁচবার আশা আছে। কাজেই দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছে, হুজুরের কোনও খবর নেই। প্রধানমন্ত্রীর ভয়, খবরটা রটে গেলে তুগলুকের কোনও আত্মীয় বা অন্য কোনও দুঃসাহসী রাজা মরে গেছেন, এই সংবাদ রটিয়ে কিছু সৈন্যসামন্ত যোগাড় করে দিল্লির তখতে না বসে যায়। রাজকোষ তখন তার হাতে এসে যাবে এবং ফলে সে আরও সৈন্য সংগ্রহ করে নেবে। হুজুর যখন ফিরে আসবেন তাঁর সঙ্গের সৈন্যদল পরিশ্রান্ত ক্লান্ত। হুজুর তখন লড়াই দেবেন কী করে? প্রধানমন্ত্রী তখন শুরু করলেন স্রেফ ধাপ্পা। হুজুর রোজ সকালে যে ঝরোকায় দাঁড়িয়ে দেখা দিতেন সেখানে প্রধানমন্ত্রী দাঁড়িয়ে বলতেন, বড় আনন্দের বিষয়, আজও হুজুরের চিঠি পেয়েছি। হুজুর বহাল তবিয়তে আছেন। শিগগিরই রাজধানীতে ফিরে আসছেন। তার পর আঙ্গরখার (অঙ্গরক্ষা) ভেতরের জেল থেকে বোগাস চিঠি বের করে, গভীর সম্মানের সঙ্গে সেটি চুম্বন করে উচ্চকণ্ঠে সেটি পড়ে শোনাতেন– আগাগোড়া নিছক গুল! তার পর আরও সসম্মানে চিঠিখানা চুম্বন করে পকেটে রেখে দিতেন।
প্রধানমন্ত্রী হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। ধাপ্পা, গুল, থিয়েডারি সব কুছকা এলেম পেটে ধরতে হয়।
ওদিকে অশেষ ক্লেশ ভুঞ্জে হুজুর সিন্ধুনদের তীরে এসে পৌঁছলেন। তগীর কী হল আমার মনে নেই। পৌঁছেই হুজুর দিল্লি-পানে ঘোড়সওয়ার রওনা করলেন। তারা দিল্লি পৌঁছলে প্রধানমন্ত্রীর ধড়ে জান এল।
হুজুর আর কচ্ছের রান ধরে দিল্লি ফিরলেন না। স্থির হল, নৌকায় করে সিন্ধু উজিয়ে উজিয়ে তারই উপনদী দিয়ে লাহোর পৌঁছবেন। উত্তম ব্যবস্থা। ইতোমধ্যে রোজার মাস বা রমজান এল। হুজুর বললেন, ‘উপোস করব।’ আমীর-ওমরাহ বললেন, ‘হুজুর একে অসুস্থ, দুর্বল, তদুপরি ভ্রমণকালে উপবাস করা ইচ্ছাধীন– কুরান শরীফের আদেশ।’ হুজুর তেড়ে বললেন, ‘যে মুসাফিরিতে (ভ্রমণে) তকলিফ হয় আল্লাতালা সেইটের কথাই বলেছেন। আমরা তো যাচ্ছি আরামসে নৌকায় শুয়ে শুয়ে। আমি উপোস করবই।’ পুনরায় গোঁ। তর্ক করবে কে? মুহম্মদ তুগলুকের সঙ্গে শাস্ত্র নিয়ে তর্ক করবার মতো এলেম কারও পেটে ছিল না। (আরেক ধনুর্ধর পণ্ডিত ছিলেন ঔরঙ্গজেব)।
কয়েকদিন পরে ধরা পড়ল একটি চমৎকার মাছ। কিন্তু এ জাতের মাছ দিল্লিবাসীরা কখনও দেখেননি। তারা বললেন, ‘যে মাছ চিনিনে সেটা খাব না।’ হুজুর বললেন, ‘কুরান, হদীস কোনও শাস্ত্রে ও-জাতীয় মাছের বর্ণনা দিয়ে খেতে যখন বারণ করা হয়নি তখন আমি ইটি খাবই।’ আবার গোঁ।
খেলেন! দারুণ তেলওলা মাছ ছিল। হুজুরের শরীরও ছিল রোগা, রানের ধকলে দুর্বল। পেট ছাড়ল। কিছুতেই বন্ধ হয় না। বোধ হয় তৃতীয় দিনে হুজুর ইন্তিকাল করলেন, অর্থাৎ পটল তুললেন।
ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন লিখলেন, এই প্রকারে হুজুর তার অবাধ্য প্রজাকুলের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে রক্ষা পেলেন; প্রজাকুলও হুজুরের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে বাঁচল!
***
আমি বঙ্গসন্তান। মাছের নামে অজ্ঞান। আমার মনে প্রশ্ন জাগল, বাদশা-সালাম কী মাছ খেয়ে শহিদ হলেন!
বরনী, মিরাৎ দিয়েছেন মুসলিম চান্দ্র মাসের হিসাবে তুগলুকের মৃত্যুদিবস। তার থেকে কোন ঋতুতে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল ধরা যায় না। বিস্তর ক্যালেন্ডার ঘেঁটে যোগবিয়োগ করে বের করলুম ঋতুটি।
আমার এক সিন্ধি দোস্ত আছেন; ইতিহাসে তাঁর বড়ই শখ। তাঁর বাড়ি গিয়ে তাঁকে শুধালুম।
তিনি বললেন, নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে, পাল্লা মাছ।
***
গঙ্গা উজিয়ে যেটা আসে বা আসত, সেটা ইলিশ– হিলসা। নর্মদা উজিয়ে ওই মাছটা যখন আসে তখন ব্রৌচের (broach ভৃগুকচ্ছ) লোক এটাকে বলে মদার, পার্সিরা বলে বিম্। সিন্ধু উজলে এই মাছকেই বলে পাল্লা।
অনেকেই অনেক কিছু চড়ে স্বর্গে যান; ঐরাবত, পুষ্পকরথ, কত কী? শাহ-ইন-শাহ বাদশা-সালামৎ মুহম্মদ তুগলুক শাহ ইলিশ চড়ে স্বর্গে গেলেন। স্বর্গে যাবেন না তো কোথায় যাবেন? ইলিশ খেয়ে যে প্রাণ দেয় সে তো শহিদ–মার্টার!
———–
১. সংস্কৃত বইখানার নাম আমার মনে পড়ছে না, বোধ হয় ‘প্রবন্ধ চিন্তামণি’।
২. মাহমুদ ও মুহম্মদ দুই ভিন্ন নাম। যে রকম হাসন, হুসেন ও হাস্সান (সুহরাওয়ার্দী) তিনটি ভিন্ন ভিন্ন নাম।
৩. ফ্রান্স জয়ের পর হিটলার ইংলন্ড আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। এর নাম অপারেশন ‘সি লায়েন’ (সমুদ্ৰসিংহ, ‘জে ল্যোয়ে’) কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটা বাতিল করে দেওয়া হয়। তার বহুবিধ কারণ নিয়ে নানা গুণী নানা আলোচনা করেছেন। অন্যতম কারণ বলা হয়, হিটলার ল্যান্ডল দেশের লোক ছিলেন বলে সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে আভুআ করতেন। গ্রিস জয় করার পর তিনি তাই মাদ্বীপ আক্রমণ ক্রমাগত পিছিয়ে দিয়ে ভুল করেন। ফলে রমেলও পুরো সাহায্য পেলেন না। এ-দেশের মোগল-পাঠান রাজাদের বেলাও তাই। নৌ-বাহিনীর সঙ্গে তাদের পরিচয় ছিল না বলে তারা ইংরেজকে অবহেলা করেন। ফলে ভারতবর্ষ সমুদ্রপথে বিজিত হয়।
কবিগুরু ও নন্দলাল
রসাচার্য নন্দলাল বসুর জীবন এমনই বহু বিচিত্র ধারায় প্রবাহিত হয়েছে, তিনি এতই নব নব অভিযানে বেরিয়েছেন যে তার পরিপূর্ণ পরিচয় দেওয়া অতি কঠিন, শ্রমসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ। তদুপরি তিনি যে পরিচয় দিতে দিতে যাবেন তাঁর সর্বরসসৃষ্টিতে অপর্যাপ্ত কৌতূহল ও সে রস আস্বাদ করার মতো অপ্রচুর স্পর্শকাতরতা থাকার একান্ত, অত্যন্ত প্রয়োজন। মানবসমাজে নন্দলাল ছিলেন স্বল্পভাষী তথা আত্মগোপনপ্রয়াসী– তার নীরবতার বর্ম ভেদ করে তাঁকে সর্বজন সম্মুখে প্রকাশ করার মতো ক্ষমতা, সে প্রকাশের জন্য প্রয়োজনীয় শৈলী ও ভাষার ওপর অধিকার এ-যুগে অত্যল্প আলঙ্কারিকেরই আছে। আমাদের নেই; আমরা সে দুঃসাহস করিনে।
আমরা তাঁকে চিনেছি, গুরুরূপে, রসসৃষ্টির জগতে বহু বিচিত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সতত রত স্রষ্টারূপে এবং কবিগুরুর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিষ্য ও কর্মীরূপে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিশ্বভারতীতে প্রধানত পণ্ডিতদেরই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন– আচার্য বিধুশেখর, ক্ষিতিমোহন, অ্যানড্রুজ, কলিন্স, শ্যামের রাজগুরু, উইনটারনিস, লেভি, গোস্বামী নিত্যানন্দ, জগদানন্দ ইত্যাদিকে। এঁদের কেউই রসস্রষ্টা ছিলেন না, এমনকি যে দিনেন্দ্রনাথ সঙ্গীতে, কাব্যে অসাধারণ সৃজনশক্তি ধরতেন তিনি পর্যন্ত তাঁর নিজস্ব সৃজনশক্তির দ্বার রুদ্ধ করে সব ক্ষমতা নিয়োজিত করেছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের রক্ষণাবেক্ষণ কর্মে। একমাত্র নন্দলালই এই পরিপূর্ণ পাণ্ডিত্যময় বাতাবরণের মাঝখানে অপ্রমত্ত চিত্তের আপন সৃষ্টিকর্মে নিয়োজিত ছিলেন।
রবি-নন্দ সম্মেলন যে মণিকাঞ্চন সংযোগ। এ তত্ত্ব অনস্বীকার্য যে রস কী, চিত্রে প্রাচীগাত্রে তথা দৃশ্যমান কলার অন্যান্য মাধ্যমে তাকে কী প্রকারে মৃন্ময় করা যায় এ-সম্বন্ধে নন্দলাল তাঁর গুরু অবনীন্দ্রনাথের কাছে উৎকৃষ্টতম শিক্ষাদীক্ষা লাভ করেন। তাই নন্দলাল শান্তিনিকেতনে আগমন করার পূর্বেই বঙ্গদেশ তথা ভারতে সুপরিচিত ছিলেন ও পশ্চিমের বহু সদাজাগ্রত রসিকজনের মুগ্ধ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু কবিগুরুর নিত্যালাপী সখা, সহকর্মী ও শিষ্যরূপে শান্তিনিকেতনে আসন গ্রহণ করার পর তাঁর চিন্ময়ভুবন ধীরে ধীরে সমৃদ্ধতর হতে লাগল ও রবীন্দ্রাহত পণ্ডিতমণ্ডলীর সংস্পর্শে এসে তিনি এমন সব বিষয়বস্তুর সঙ্গে পরিচিত হলেন যেগুলো সচরাচর আর্টিস্টকে আকৃষ্ট করে না। একটি মাত্র উদাহরণ নিবেদন করি; দ্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারা সম্বন্ধে একাধিক প্রবন্ধ লিখেছেন, বিশ্বভারতীর সাহিত্যসভায় তথা অন্যান্য জ্ঞানচক্রে শতাধিকবার আলোচনা করেছেন, তর্কবিতর্ক উদ্বুদ্ধ করেছেন। ১৯২১ থেকে পূর্ণ কুড়িটি বৎসর এসব সম্মেলনে নন্দলাল উপস্থিত থাকতেন, কিন্তু আমি তাঁকে কখনও (১৯২১-২৬) এ সবেতে অংশগ্রহণ করতে দেখিনি।
অথচ ১৯৩৬/৩৭-এ বরোদার মহারাজা যখন তাকে সেখানকার কীর্তি-মন্দিরে দেয়ালছবি (মরাল) আঁকতে অনুরোধ করেন তখন তিনি চার দেয়ালে এঁকে দিলেন ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারা।১. ‘গঙ্গাবতরণ’ (গঙ্গা বিনা যে ভারতে আর্যসভ্যতার পত্তন ও বিকাশ হত না সে কথা বলাই বাহুল্য), ২. ‘কুরুক্ষেত্র’ ৩. ‘নটীর পূজা’, ৪. ‘মীরাবাঈ’ (সন্তন সঙ্গ বৈঠ বৈঠ লোক লাজ খোঈ– চিত্রে) আর্য, হিন্দু, বৌদ্ধ, মধ্যযুগীয় ভক্তি– এই চার দৃষ্টিবিন্দু থেকে নন্দলাল দেখেছেন ভারতের সমগ্র ইতিহাস।
কিন্তু এহ বাহ্য। আসলে যদ্যপি চিত্রের মাধ্যমে রসসৃষ্টি সম্বন্ধে নন্দলাল পরিপূর্ণ শিক্ষাদীক্ষা শুরু অবনীন্দ্রনাথের কাছ থেকে পেয়েছিলেন, সে রস কাব্যে, সঙ্গীতে, নৃত্যে কীভাবে প্রকাশ পায় সেটি তিনি দেখতে পেলেন দিনের পর দিন, বহু বৎসর ধরে শান্তিনিকেতনে। রসের প্রকাশে কোন কলার অধিকার কতখানি নন্দলাল সে সম্বন্ধে পরিপূর্ণ মাত্রায় সচেতন হলেন শান্তিনিকেতনে, রবীন্দ্রনাথের সাহচর্যে। কারণ রবীন্দ্রনাথ প্রকৃত আলঙ্কারিকের (নন্দনতত্ত্বজ্ঞের) ন্যায় রস নিয়ে আলোচনা করার সময় নিজেকে সাহিত্য, সঙ্গীত বা নাট্যরসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতেন না। স্বনামধন্যা স্টেলা কামরিশের সঙ্গে তিনি দিনের পর দিন রস নিয়ে যে আলোচনা (হোয়াট ইজ আর্ট) করেন তাতে টলস্টয়ের অলঙ্কারশাস্ত্রও বাদ পড়ত না এবং তিনি বেটোফনের ক্রয়েৎসার সনাটা’র বিরুদ্ধে যে মন্তব্য প্রকাশ করেন সেটিও উভয়ের মধ্যে আলোচিত হত। এসব আলোচনা সাধারণত হত বিশ্বভারতীর সাহিত্যসভায়– এবং নন্দলাল সে স্থলে নিত্য-নীরব শ্রোতা। সে সময় নন্দলালের চিন্তাকুটিল ললাটের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করলেই স্পষ্ট বোঝা যেত, আর্ট সম্বন্ধে তাঁর যা ধারণা, অভিজ্ঞতা, তাঁর যা আদর্শ সেগুলোর সঙ্গে তিনি এ-সব আলোচনার মূল সিদ্ধান্ত, মীমাংসাহীন জল্পনা-কল্পনা সবকিছু মিলিয়ে দেখছেন।
স্পষ্টই প্রতীয়মান হয়, নৃত্য যতখানি গতিশীল (ডাইনামিক) চিত্র ততখানি হতে পারে না। পক্ষান্তরে নটনটী রঙ্গমঞ্চ থেকে অন্তর্ধান করার সঙ্গে সঙ্গেই তার ভানুমতী থেকে যায় শুধু স্মৃতিতে– বাস্তবে সে অবলুপ্ত। কিন্তু চিত্র চোখের সামনে থাকে যুগ যুগ ধরে এবং চিত্রের মতো চিত্র হলে প্রতিবারেই যে তার থেকে আনন্দ পাই তাই নয়, প্রতিবারেই সেই প্রাচীন চিত্রে নব নব জিনিস আবিষ্কার করি, নিত্য নিত্য নবীন রসের সন্ধান পাই। তাই কোনও নৃত্য-দৃশ্য যদি চিত্রে সার্থকরূপে পরিস্ফুট করা যায়, তবে মঞ্চ থেকে অন্তর্ধান করার সঙ্গে সঙ্গে যে-চিত্রের চিরতরে অবলুপ্ত হওয়ার কথা ছিল, সে হয়ে যায় অজর অমর। কিন্তু চিত্রে সার্থকরূপে পরিস্ফুট করার অর্থ, সে যেন ফটোগ্রাফ না হয় তা হলে মনে হবে, নর্তক-নর্তকী নৃত্যকলা প্রকাশ করার সময় হঠাৎ যেন মুহূর্তের তরে পাষাণ-পুত্তলিকায় পরিণত হয়ে গিয়েছিলেন। যাঁরাই নন্দলালের ‘নটীর পূজা’ চিত্রটি প্রাচীরগাত্রে দেখেছেন, তারাই আমার সামান্য বক্তব্যটি সম্যক উপলব্ধি করতে পারবেন। সে চিত্র তো স্টাটিক নয়, স্তম্ভিত’ নয়–বস্তুত তার দিকে অনেকক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলে মনে হয়, এই বুঝি নটী আরেকখানি অলঙ্কার গাত্র থেকে উন্মোচন করে দর্শকের দিকে, আপনারই দিকে অবহেলে উৎক্ষেপ করবে, এই বুঝি মৃদঙ্গে ভিন্ন তাল ভিন্ন লয়ের ইঙ্গিত ভেসে উঠবে আর সঙ্গে সঙ্গে নটী তার নৃত্য দ্রুততর করে দেবে, লাস্য-নৃত্য তাণ্ডবে পরিণত হবে, মন্দমন্থর ‘নমো হে নমো’ অকস্মাৎ অতিশয় দ্রুত ‘পদযুগ ঘিরে’ চন্দ্রভানুর মদমত্ত নৃত্যে নবীন বেশ গ্রহণ করবে।
বস্তুত আপন মনে তখন প্রশ্ন জাগবে, নন্দলাল মঞ্চে বিভাসিত যে নৃত্য স্বচক্ষে দেখেছিলেন, সে-নৃত্য কি সত্যই এতখানি প্রাণবন্ত, উচ্ছ্বসিত শান্ত থেকে মন্থর, মন্থর থেকে উন্মত্ত পাবন বেগে ধাবিত ছিল, না তিনি অঙ্কন করেছেন তাঁর নিজস্ব কল্পলোকের মৃন্ময় নৃত্যের আদর্শ প্রকাশ।
***
সুন্দরের পরিপূর্ণ আনন্দ-রূপের ধ্যানের বীজমন্ত্র নন্দলাল গ্রহণ করেন কবিগুরুর কাছ থেকে। এবং তার সর্বোচ্চ বিকাশে সে বীজের যেন কোনও চিহ্নই নেই। সে যেন পত্রপুষ্পে বিকশিত মহীরুহ।
এবং একমাত্র নন্দলালই তাঁর গুরুর ওপরও প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। সকলেই জানেন, পরিপূর্ণ বৃদ্ধ বয়সে কবি রবীন্দ্রনাথ চিত্রের মাধ্যমে আপন সৃজনী-শক্তি প্রকাশ করেন। কিন্তু কবির প্রভাবে ছবির নন্দলাল তো কখনও কবিতা রচনা করেননি।
১৪।৫।৬৬
খেলেন দই রমাকান্ত
ইহুদি যাজক সম্প্রদায়ের সুপুত্র শ্রীযুক্ত লেভির সঙ্গে তার বাড়িতে খানা খেতে যাচ্ছি। তার আছে গল্পের অফুরন্ত ভাণ্ডার। তারই একটা ছাড়লেন :
“জারের আমলে রোববার দিন গির্জেয় গেছে গ্রামের সবাই। রুশ জাতটা একদা ছিল বড়ই ধর্মানুরাগী! কুলোকে বলে, কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভূতপ্রেত-তাবিজ-কবচে-বিশ্বাসী উজবুকের ভায়রাভাই। এবং সাতিশয় পাষণ্ডেরা বলে, সেই প্রাচীন কুসংস্কারই আজ তাদের টেনে নিয়ে যায় লেনিনের দর্গায় শিরনি চড়াতে। তা যে যা গে– মোদ্দা কথা : তারা কায়মনোবাক্যে বিশ্বাস করে, তাদের গাঁয়ের পাদ্রি সায়েব যা বলেন তাই আপ্তবাক্য। যদ্যপি এসব পাদ্রিদের অনেকেই নিজের নামটি পর্যন্ত সই করতে পারে না–”
আমি শুধালুম, “নিরক্ষর জন গির্জায় ধর্মোপদেশ দেয় কী প্রকারে?”
বললেন, “আশ্চর্য! রাসপুতিন যে কী মাথার ঘাম পায় ফেলে কুল্লে আড়াই আউন্স বাইবেল গলাধঃকরণ করতে পেরেছিলেন সে না হয় পড়োনি, তাই জানো না। নিচ্চেভো– অর্থাৎ কুছ পরোয়া নেহি। সেই আড়াই আউন্স বাইবেল ডাইলুট করে তিনি মহারানি জারিনা মায় জার প্রাসাদ জয় করলেন। তাঁকেও নাম সই করতে হলে ঘেমে নেয়ে কাঁই হতে হত।
আর এরই উলটো দিক– অর্থাৎ ভালোর দিকের সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ খুঁজতে হলে অন্তত তোমাকে তো আর উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু অবধি মাকু মারতে হবে না। তোমার নবী পয়গম্বর তো ছিলেন সম্পূর্ণ নিরক্ষর! তা সে যাক্ গে।
সে রোববারে পাদি সায়েবের সারমন বা বক্ততার বিষয়বস্তু ছিল ইহুদিরা কী অন্যায়ভাবে প্রভু যিশুকে ক্রুশের উপর খুন করল। এ বিষয়ে বক্তৃতা শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব পাদ্রিই দেন। তফাৎ শুধু এইটুকু যে, শিক্ষিত পাদ্রি জানেন, প্রভু যিশু ক্রুশের উপর থেকে তার হত্যাকারীদের ক্ষমা করে গিয়েছিলেন। তাই তিনি বক্তৃতা দেবার সময় সতত সতর্ক থাকেন, অজ্ঞ খ্রিস্টানগণ যেন উত্তেজিত হয়ে ইহুদি নির্যাতন আরম্ভ না করে। কিন্তু ওই যে রুশ পাদ্রির কথা বলছিলুম, তিনি সেদিন উঠেপড়ে লেগে গিয়েছেন, কী প্রকারে মূঢ় জনতাকে প্রতিহিংসাপরায়ণ করে তোলা যায়। অবশ্য তার জন্য অত্যধিক বাগ্মিতাশক্তির কোনও প্রয়োজন নেই কারণ রুশ দেশে আবহমান কাল থেকে ইহুদিবৈরিতা বংশানুক্রমে চলে আসছে। কাজেই সারমন শেষেই বিক্ষুব্ধ চাষিরা একজোট হয়ে ধাওয়া করল মাঠের অন্য প্রান্তের খাস ইহুদি গ্রামটার দিকে। দূর থেকে তাদের চিত্তার হুঙ্কার শুনে ইহুদিরা ব্যাপার কী জানবার জন্য গ্রাম থেকে বেরিয়ে এল। তাদের চিৎকারে তখন পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে ‘খুন করব, ব্যাটাদের খুন করে রক্ত দিয়ে রক্তের দাদ নেব! ’
সবাই একে অন্যকে চেনে। তাই ইহুদি গাঁওবুড়ারা করজোড়ে শুধালে, ‘আমরা কী অপরাধ করেছি যে আমাদের খুন করবে, এতকাল ধরে পাশাপাশি গ্রামে বাস করছি—’
উত্তেজিত জনতা বললে, ‘চালাকি রাখো। তোমরা আমাদের প্রভুকে খুন করেছ, তার দাদ আমরা নেবই নেব।’
যেন পরদিনের ঘটনা! লেভি গল্প বলা ক্ষান্ত দিলেন। কারণ হঠাৎ পিটির পিটি করে বৃষ্টি নামল। এই পোড়ার দেশে মনসুন নেই বলে বারো মাসের যে কোনও দিন আচমকা বৃষ্টি নামে। আমি বললাম, ‘চলুন, হার ডক্টর, ট্রাম শেড-এ আশ্রয় নিই।’
বললেন, “ছোঃ! কিসসু জানো না। ইহুদিরা ছাতা কেনে না কেন, তার খবর রাখো? খ্রিস্টানদের বিশ্বাস, ইহুদিরা এমনই দুর্দান্ত চালাক যে, বৃষ্টির ফাঁকে ফাঁকে জামাকাপড় বাঁচিয়ে দিব্য চলাফেরা করতে পারে। তার পর কী বলছিলুম? সেই রুশ ইহুদিদের কথা। তারা ছিল সত্যই চালাক! চট করে ভেবে নিয়ে দেখলে, ওই সব জড়ভরত কেরেস্তান রুশদের বোঝানো হবে অসম্ভব, ঘটনাটা ঘটেছে দু হাজার বছর পূর্বে, রুশ দেশে নয়– বহু দূর-দুরান্তের প্যালেস্টাইনে– যারা মেরেছিল, তারা সেই দেশ ছেড়ে কবে কোন আদ্যিযুগে ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর সর্বত্র, বিয়ে করেছে জাতেবেজাতে– এখন যাদের ঠ্যাঙাতে যাচ্ছ–”
আমি বললুম, “বুঝেছি। খেলেন দই রমাকান্ত, বিকারের বেলা গোবদ্দন!”
লেভি বললেন, “লাখ কথার এক কথা!”
অতএব ইহুদি ডাঙরিয়ারা হন্তদন্ত হয়ে বললে, ‘ইহুদিরা প্রভু যিশুকে না হক খুন করেছিল, এ তো অতিশয় সত্য কথা–বিশ্ব-সংসার জানে। কিন্তু ভাই, তোমরা করেছ ভুল। আমরা, এ গাঁয়ের লোক, ওঁকে মারিনি– তা কখনও পারি! মেরেছে–’ বলে আঙুল দিয়ে দেখালে পাশের গাঁ। বলল, ‘মেরেছে ওই ও–ই গাঁয়ের ইহুদি রাস্কেলরা। বুঝলে তো ভায়া?” বলে লেভি গম্ভীর হয়ে গেলেন।’
আমি একগাল হেসে বললাম, “যা শত্রু পরে পরে। কিন্তু গল্পটা তো সে রকম ঝাঁঝালো না –আপনার সেদিনকার রাব্বি, জানালার শার্সি আর আয়নাতে তফাৎ নিয়ে গল্পটার মতো?”
লেভি বললেন, “ক্যারেকটারিস্টিক গল্পের ফানকশন হচ্ছে কোনও বিশেষ জাত বা শ্রেণি বা যা-ই হোক না কেন, তার ক্যারেকটার, তার বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তোলা। ভেড়ার বাচ্চা আর নেকড়ে বাঘের মতো তর্কাতর্কি নিয়ে যে গল্প ঈশপ লিখেছেন সেটাতে ঝাঁঝ কোথায়? কিন্তু গল্পটা সাতিশয় ক্যারেকটারিস্টিক– অর্থাৎ ভেড়া আর নেকড়ের ক্যারেকটার ওতে চমৎকার ফুটে উঠেছে– নইলে গল্পটা দেশ-দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ল কী করে, আর এত যুগ ধরে বেঁচে আছেই-বা কী করে? আমি রুশ ইহুদিদের সম্বন্ধে যে গল্প বললুম– গল্প না হয়ে সত্য ঘটনাও হতে পারে সেটা কিন্তু সর্ব-ইহুদিদের সম্বন্ধেই প্রযোজ্য। বিপদকালে তারা এক হতে তো জানেই না, বরঞ্চ নিজেকে বাঁচাবার জন্য জাতভাই অন্য ইহুদিকে বিসর্জন দিতেও তার বাধে না।”
আমি বললুম, “উঁহু।”
“মানে?”
আমি বললুম, “আমার দেশ বাংলার উত্তর প্রান্তে এক শ্রেণির ব্রাহ্মণ আছেন, তাঁদের সম্বন্ধে বলা হয়, স্বার্থ থাক আর নাই থাক তারা একে অন্যের সাহায্য কস্মিনকালেও করেন না। একটা নদী পেরুবার সময় নাকি পর পর পাঁচজন ব্রাহ্মণ একটা পাথরে ঠোক্কর খান, কিন্তু কেউই পরের জনকে হুঁশিয়ার করে দেবার প্রয়োজন বোধ করেননি। শেষটায় একজন যখন ‘বাপ রে’ বলে অন্যদের সাবধান করে দিলে, তখন তারা সবাই সমস্বরে চিৎকার করে বললেন, ‘ব্যাটা নিশ্চয়ই আমাদের শ্রেণির ব্রাহ্মণ নয়।’ তখন ধরা পড়ল, সত্যি সে অন্য শ্রেণির ব্রাহ্মণবর্ণচোরা আঁবের মতো এদের সঙ্গে মিশে এদেরই একজন হতে চেয়েছিল। গল্পটা আপনারই সংজ্ঞা অনুযায়ী খুবই ক্যারেকটারিস্টিক বটে, কিন্তু আমার মনে এ বাবদ একটা ধোঁকা রয়ে গেছে।”
লেভি বললেন, “তুমি দেখি হেরোডকেও হেরোড শেখাতে চললে অর্থাৎ যারে বলে গুরুমারা বিদ্যেতে ওস্তাদ হয়ে উঠছ। বুঝিয়ে বল।”
আমি বললাম, “যে ব্রাহ্মণ শ্রেণির গল্পটি আপনাকে বললাম, তাঁরা যে অতিশয় তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ধরেন, সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, এবং বুদ্ধিমান জীব মাত্রেই ঐক্যে বিশ্বাস করে। তাই আমি বহুকাল ধরে পর্যবেক্ষণ করে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছলুম, এঁরা একে অন্যকে খুবই সাহায্য করে থাকেন– যে রকম ফ্রিমেসনরা একে অন্যের প্রতি বড়ই সদয়– কিন্তু সে সাহায্যটি করেন অতিশয় সঙ্গোপনে। এবং অন্য শ্রেণির ব্রাহ্মণরা যাতে করে এ-তত্ত্বটি আবিষ্কার না করতে পারেন, তাই তারা নিজেরাই বাজারে একাধিক কামুফ্লাজ গল্প ছেড়েছেন এই মর্মে যে, তাদের ভিতর মারাত্মক ঐক্যাভাব। তাই আমার মনে হয়, আপনি যে গল্প দিয়ে প্রমাণ করতে চাইলেন, ইহুদিরা সবদ্ধ হয় না, সেটা স্বয়ং ইহুদিরাই তৈরি করেছেন, খ্রিস্টানদের সন্দেহ না জাগানোর জন্য।”
ইহুদি আর স্কচম্যানের একটা মহৎ গুণ–তাদের নিয়ে কেউ রসিকতা করলে সেটা তারা উপভোগ করতে পারে। লেভি আমার সত্য-সিদ্ধান্ত শুনে হেসে বললেন, “এটা আজ খানা-টেবিলে আমি পেশ করব। দেখি, ঠাকুন্দা-বাবা কী বলেন। কিন্তু জানো, এর থেকে একটা গুরুতর সমস্যায় উপনীত হওয়া যায়। তুমিই সেদিন প্রশ্ন করেছিলে, ইহুদিরা যে প্যালেস্টাইনে ‘হোম’ বানাতে চায়, সেটা ভালো না মন্দ? আমি বলেছিলুম, সময় এলে আলোচনা করা যাবে। তাই এ-স্থলে প্রশ্ন শুধানো যায়, পৃথিবীর সব ইহুদি এই হোম চায় কি না? এই দাবির পিছনে কি তারা ঐক্যবদ্ধ? তোমার প্যারা কবি হাইনে একদা এই আন্দোলনের সঙ্গে ঠিক ঠিক বলতে গেলে ওই আন্দোলনের আলোচনাচক্রের সঙ্গে সংযুক্ত হন। কিন্তু কিছুদিনের ভিতরই তিনি সে-চক্র থেকে নিজেকে মুক্ত করে ফেলেন। তার থেকে অবশ্য এটা বলা চলে না, প্যালেস্টাইনে ইহুদি হোম নির্মাণের ব্যাপারে তার কোনও ঔৎসুক্য ছিল না। আসলে ব্যাপারটা অন্য ধরনের; সংখ্যালঘুদের ভিতর একরকম লোক থাকে, যারা আপন সম্প্রদায়ের ক্ষুদ্র গণ্ডির ভিতর নিজেকে সীমাবদ্ধ করে রাখতে চায় না– তারা ভাবে, বাড়িতে বাপ-ভাই তো সে-গণ্ডি বানিয়ে রেখেছেনই, বাইরে গিয়েও তাদেরই জাতভাইদের সঙ্গে মিশে কী লাভ? আমার মনে হয়, হাইনের বেলা হয়েছিল তাই।” তার পর হঠাৎ রাস্তার উপরই থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, “তোমার দেশে তুমিও তো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোক। তুমি দেশে কাদের সঙ্গে মেলামেশা কর?” উত্তর দেবার পূর্বেই তিনি বললেন, “এ বিষয় নিয়ে অনেকক্ষণ আলোচনা চলতে পারে, অতএব এটা এখন মুলতুবি থাক, কারণ বাড়ি পৌঁছে গিয়েছি।”
বাউমশূল আলের শেষ প্রান্তে ছোট্ট একখানা ছিমছাম তেতলা বাড়ি।
ল্যাচ-কি দিয়ে দরজা খুলে বললেন, “স্বাগত জানাই তোমাকে। মঙ্গল হোক, জয় হোক তোমার। তোমার বংশধর যেন অসংখ্য হয় ॥”
২১/৫/৬৬
গাড়োলস্য গাড়োল
আদরের ডাক-নাম য়প বা ইয়প– সারা দেশটা জুড়ে তোলা-নাম হ্যার ডক্টর ইয়োজেপ (য়পপ) গ্যোবলস, রাষ্ট্রের প্রপাগান্ডা মন্ত্রী, রাজধানী বার্লিনের গাও-লাইটার (অঞ্চলাধিকারী) এবং ফ্যুরার অ্যাডলফ হিটলারের শেষ জুয়োখেলার পাশা যখন ব্লাঙ্কো মেরে মেরে যাচ্ছে, তখন সর্বাত্মক, টোটাল ওয়ারের জন্য কুল্লে তাগৎ ‘ইকট্টে’ করার জন্য সর্বাধিকারী। পার্টির ব্রেন-বাক্সো। শত্রু-মিত্র সবাই এক সুরে বলেছেন, ‘হ্যাঁ, প্রপাগান্ডা কারে কয়, সে-বস্তু দেখিয়ে গেছে ওই ব্রেন-বাক্সোটা।’ বাক্সোটির এক দিক দিয়ে ঢুকত সাদামাটা তথ্য, হাফ-তথ্য, ডাহা মিথ্যে, ঘৃতলবণতৈলতণ্ডুলবস্ত্রইন্ধন বেরিয়ে আসত অন্যদিক দিয়ে। এক-একখানা চাঁছাছোলা, নিটোল, অব্রণ, অনিন্দনীয় কলাসৃষ্টি! দাঁড়ান, এই ‘কলাসৃষ্টি’ রহস্যটা একটু গুছিয়ে বলতে হয় কারণ এ বাবদ তাবৎ টেকনিক্যাল টার্ম একমাত্র ফরাসির মারফত প্রকাশ করা সম্ভব। তদুপরি গ্যোবলস্ সায়েবের দিলের দোস্ত থেকে জান-এর দুশমন্তক, স্বীকার করেছেন, ভোঁতা হোঁৎকা টিউটন নাৎসি পাঁঠাদের ভেতর ওই গ্যোবলসই ছিলেন একমাত্র জিনিয়াস, যাঁর স্কন্ধে বিরাজ করত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মস্তিষ্ক-কুণ্ডলী পরিপূর্ণ লাতিন মাথা– তাই তাঁর লিখন-কথন উভয়েতেই ছিল, ফরাসিসুলভ ফটিক স্বচ্ছতা।(১) এ-কলাসৃষ্টিকে অ্যভর দা’র বলা যেতে পারে, মাস্টার পিস অব আর্ট বললে ঠিক ঠিক মানেটা ওত্রায় না। অবুজে দা’র শব্দসমষ্টি আমি শুনেছি; এটা বোধ হয় morale-এর মতো ইংরেজিতে চালু ভেজাল ফরাসি মাল (আমরা যেরকম কলকাত্তাই উর্দুতে ‘একঠো’ দুঠো’র ভেজাল বরাব্বর ব্যবহার করে আসছি!)– অর্থ, যে কলাসৃষ্টি কোনও কাজে লাগে না, যেমন ‘পাপিয়ে মাশে’তে তৈরি কাশ্মিরি-ফুলদানি-পারা সৃষ্টিছাড়া বস্তু, যেটাতে ফুল রাখা যায় না বটে, কিন্তু দেখতে খাসা। গ্যোবলস্ সায়েবের বেতার বক্তৃতা বা সম্পাদকীয় প্রবন্ধ বিলকুল বেকার নয়– টায়-টায় কাজে লাগত। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে তিনি টলস্টয়কে নিশ্চয়ই পরম আপ্যায়িত করতে পারতেন; পার্থক্য মাত্র এইটুকু যে, টলস্টয় তাঁর কলা দ্বারা নির্মাণ করতেন স্বর্গরোহণের সোপান, য়পপ নির্মাণ করতেন রসাতলের খাড্ডায় সবচেয়ে নিপতিত হওয়ার তরে অত্যুত্তম পিচ্ছল সানুপ্রদেশ। আর ইহুদিকুলের কল্যাণার্থে গ্যাস-চেম্বার!
হিটলার বক্তৃতা-গর্জনও রুদ্রের তাণ্ডব নৃত্যতুল্য প্রলয়ঙ্কর, কিন্তু সেটাকে অত সহজে বিশ্লেষণ করা যায় না। সেটাও কলাসৃষ্টি এবং সেটি য়পপ-মার্কার চেয়ে লক্ষগুণে কার্যকরী। কড়া পাক।
দু জনার মুখে একই জিগির : ইহুদিকুল সর্বনেশে। এদের সমূলে বিনাশ করতে হবে।(২)
কিন্তু দু জনের মনের ভিতর দু প্রকারের যুক্তি। য়পপের বিশ্বাস, ইহুদিরা সর্ব ব্যাপারেই সাতিশয় ধুরন্ধর। এদের সঙ্গে ‘নর্ডিক আর্যরা’ অর্থাৎ জর্মনরা কিছুতেই পাল্লা দিতে পারবে না। পক্ষান্তরে হিটলার এটা মানতে পারেন না– জান্ কবুল। তাঁর মতে, এই বসুন্ধরায় যে-কটা ডাঙর ডাঙর জাত, গোষ্ঠী, বংশ–যা খুশি বলুন, ইংরেজিতে Race–জর্মনে Rasse–তার মধ্যে ‘আর্য’ রেস সর্বোত্তম। এবং সেই আর্য রেসের ভিতর সর্বোত্তমেরও সর্বশ্রেষ্ঠ জর্মনির নর্ডিক, নীল চোখ, ব্লন্ড (সোনালি, কোনও কোনও ক্ষেত্রে রুপালি– যেটাকে বলা হয় প্রাটিনাম ব্লন্ড) চুলধারী ‘আর্য’ রেস। ইহ-বিশ্বের সর্ববাবদে তারাই সর্বশ্রেষ্ঠ। কিন্তু সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যসম্পন্ন শক্তিমান যুবার শরীরেও যেমন ক্যানসার দেখা দিতে পারে, ঠিক তেমনি জর্মন সমাজে এসে ঢুকেছে ইহুদি গোষ্ঠী। এবং ছারপোকার মতো ভার্মিন। ছারপোকা বেশি বুদ্ধিমান না মানুষ বেশি বুদ্ধি ধরে, এ প্রশ্ন বুদ্ধিমান মানুষ তুলবে না–বুদ্ধিমান বা মূর্খ ছারপোকা তুলবে কি না, সেটা হিটলার বলেননি।
য়পপ বললেন, ‘এটা হল তুলনা। তুলনা যুক্তি নয়।’
ফ্যুরার বললেন, ‘তুলনা মাত্রই তিন ঠ্যাঙের উপর দাঁড়ায়। টায়-টায় যুক্তির স্থান নিতে পারে না সত্য, কিন্তু আপন বক্তব্য জোরদার ও প্রাঞ্জল করার জন্য, তুলনার ব্যবহার করেছেন। সর্বগুণীজ্ঞানীই।’
য়পপ বললেন, ‘তর্কস্থলে মেনে নিলুম।’ গ্যোবলস্ বড়ই প্রভুভক্ত ছিলেন। নইলে প্রভুর আত্মহত্যার চব্বিশ ঘন্টার ভিতর তাঁর ছ’টি শিশু পুত্রকন্যাদের ডাক্তার দিয়ে খুন করিয়ে সস্ত্রীক আত্মহত্যা করবেন কেন?(৩) বললেন, ‘তাই সই। কিন্তু আমি আপনাকে হাতেনাতে দেখিয়ে দেব, ইহুদিরা অন্তত ব্যবসার ক্ষেত্রে আর্যের চেয়ে বেশি বুদ্ধি ধরে।’
‘কোনও ক্ষেত্রেই না।’
‘বাজি ধরুন।’
‘বিলক্ষণ! কত?’
‘এক লাখ।’
‘গেমাখট– পাক্কি বাৎ।’
দু জনাতে ছদ্মবেশে বেরোলেন। তার জন্য বেশি বেগ পেতে হয় না। এমনিতেই ঠোঁটকাটা বার্লিন-ককনিরা বলত ফ্যুরারের চুল নেবে পড়ে কপাল ঢাকেনি অকল্পনীয়; আর গ্যোবলস্ এক লহমার তরে বকর বকর বন্ধ করেছে– এটা ততোধিক অবিশ্বাস্য। হিটলার তাই চ্যাটচেটে পমেটম দিয়ে যেন প্রায় ভৈরবচণ্ডীর মতো চুড়ো-খোঁপা বাঁধলেন– এবারে আর চুল খসে পড়ে, কপাল ছাপিয়ে চোখ এস্তেক ঢেকে দেবে না। ব্যস্, এতেই হয়ে গেল ছদ্মবেশ। আর য়পপ? তিনি বললেন, তিনি প্রতি দশ মিনিটে মাত্র একটি সেনটেনস বলবেন। এ-রকম বিকট চুপচাপ লোককে কে চিনবে য়পপ বলে!
য়পপেরই প্রস্তাবমতো দু জনাতে ঢুকলেন এক পাঁচমিশিলি খাঁটি আর্য দোকানে। চাইলেন একটা টি-সেট। দোকানি একটি রমণীয় ট্রের উপর সবকিছু সাজিয়ে সামনে ধরল। গ্যোবলস তো তাঁর মুণ্ডটি ডান থেকে বাঁয়ে, ফের বাঁ থেকে ডাইনে নাড়িয়ে নির্বাক প্রশস্তি শুনিয়ে দিলেন। তার পর হঠাৎ যেন মনে পড়ল ওইরকম ভাবখানা করে বললেন, ‘কিন্তু আমার যে-দোস্তকে আমি এই জন্মদিনের সওগাৎটা দেব তিনি তো ন্যাটা; আপনাদের কাছে কি লেফট-হ্যান্ডারদের জন্যে কোনও টি-সেট আছে?’ হিটলার বললেন, ‘হুঁ।’ ভদ্র আর্যসন্তান আমাদের দোকানি তো বেবাক বে-বাক– অবাক। ‘লেফট-হ্যান্ডারস টি-সেট?’ সে আবার কী গব্বযন্ত্রণা রে বাপু! বাপের জন্মে নাম এস্তেক শোনেনি। অনেকক্ষণ ঘাড় চুলকে, বিস্তর আন্দেশা করে আপসা-আপসি করে সবিনয় জানালে, তার কাছে নেই।
হিটলার দিলদরাজ আদমি। একগাল হেসে বললেন, ‘মাখটনিকস, মাখটনিকস– বিলক্ষণ, বিলক্ষণ! তাতে এসে-যায় না। আমরা অন্য দিন দুসরা জিনিসের জন্য আসব’খন– খাসা দোকানটি কিন্তু! কী বল হ্যার ডক্– থুড়ি! ঔফ বিডার জেএন! গুটে নাখট! আসি তবে। হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ।’
এবারে য়পপ প্রভুকে নিয়ে ঢোকালেন এক ইহুদির দোকানে।
দোকানি ছিল না। তার চোদ্দ বছরের ছেলে ছুটে এসে অদৃশ্য স্যামপুতে (কথাটা আজকাল বড়ই ‘ফেশিনিবিল’ হয়েছে; আম্মো ব্যাভার করতে চাই) হাত কচলাতে কচলাতে একবারের জায়গায় তিন-তিনবার বলে বসল, ‘য়ুটন ময়েন, য়ুটন ময়েন, য়ুটন ময়েন (গুটন মর্গেনের অর্ধশিক্ষিত’ উচ্চারণ), মাইনে হেরেন!’
উত্তরে হিটলার বিড়বিড় করে কী একটা বললেন, ঠিক ঠাহর করা গেল না। দক্ষিণে কোনও কোনও ব্রাহ্মণ নাকি একদা রাস্তায় (‘সড়ক’ ‘সরকে’ বা ‘সরণিতে’–ওহ! কী স্টর্ম ইন এ টি ‘সেট’!) বেরোলে চিৎকার করতেন, অস্পৃশ্য যেন সরে যায়, তার ছায়া যেন ওঁর গায়ে না পড়ে–তবে এদের পঞ্চাশ বা ষাট লক্ষকে বামুন গ্যাস চেম্বারে(৪) খুন করে পুড়িয়েছে একথা কখনও শুনিনি। অতএব হিটলার যে ইহুদি ছোকরাকে হেল-ফোলো– উয়েল-মেট (hail-fellow-well-met) করেননি, সেটা স্পষ্টই বোঝা যায়। ইহুদি ছোকরা কাঁচুমাচু হয়ে বললে, ‘আমার বলে দেওয়া উচিত, সরকারের হুকুম, কোনও “আর্য” যদি ইহুদির দোকানে ঢোকেন তবে দোকানদার যেন তাঁকে সতর্ক করে দেয়, এটা ইহুদির দোকান, এখানে কেনাকাটা করলে আর্যই দায়ী। সাইন-বোর্ডেও স্পষ্ট করে লেখা আছে, আপনারা হয়তো লক্ষ করেননি।’
হিটলার বিড়বিড় করলেন, “শোন্ গুট শোন্ গুট’–অনেকটা যেন ঠিক আছে, ঠিক আছে, মেলা বকো না।
টি সেট চাওয়া হল। এল। গ্যোবলস্ ন্যাটার সেট চাইলেন।
ছোকরা প্রথমটায় হকচকিয়ে গেল।
পরমুহূর্তেই সম্বিত ফিরে একগাল হেসে বললে, ‘এখুনি নিয়ে আসছি, স্যার! বলে যে সেট ট্রের উপর সাজিয়ে রেখে দেখিয়েছিল সেইটে তুলে নিয়ে গুদোমঘরে অদৃশ্য হল। দু-মিনিট পরেই আরেকটা আরও বাড়িয়া ট্রের উপর সাজিয়ে নিয়ে এল ন্যাটাদের সেট।
তালেবর ছোকরা করেছে কী, এবার ওই আগেকার সেটই উল্টো করে সাজিয়েছে অর্থাৎ টি-কাপগুলোর আঙটিগুলো রয়েছে খদ্দেরের-বাঁ দিকে; তার মানে, খদ্দের বাঁ-হাত বাড়ালে আঙুল ঠিক আঙটার যথাস্থানে পড়বে।
গ্যোবলস্ বাক্যব্যয় না করে যথামূল্যে সেট কিনে নিলেন।
বেরিয়ে এসে বললেন, ‘দেখলেন ইহুদিটার চালাকিটা?’
হিটলার অতিশয় সরল দরদী কণ্ঠে বললেন, ‘চালাকিটা আবার কোথায়? বেচারি আর্যের ন্যাটা সেট ছিল না স্টকে তো সে আর করবে কী?
***
এবারে সিরিয়স কথা– ব্যাটারা বলে, তারা নাকি আর্যোত্তম। আরে মোলো, আর্যোত্তম যদি হবিই, তবে সর্ব-আর্যের– তা সে গ্রিকই হোক, লাতিনই হোক কিংবা তাদের বহু পূর্বের মিটানির হিটাইটই হোক– সর্বপ্রাচীন সংহিতা চতুর্বেদ আছে ভারতীয় আর্যের শ্রুতিতে ভিন্ন অন্য কোন আর্য গোসাঁইয়ের খট্টাঙ্গ প্রত্যঙ্গে?
কিন্তু, আমরা তো দিয়েছি আশ্রয়– প্রথম ইহুদিরা যখন জীবনমৃতাবস্থায় নিমজ্জমান তরণীতে করে বোম্বাই উপকূলে পৌঁছয়। গ্যাস-চেম্বারের কথা এই দু-বা আড়াই হাজার বছর ধরে আমাদের মাথায়ই খেলল না! তবে, হ্যাঁ, এদানির কেউ কেউ বলেন, আমরা যে অস্মদ্দেশে ইজরায়েল প্রেসিডেন্টের শুভানুগমনোপলক্ষে উদ্বাহু হয়ে ‘লৃত্ত’ করিনি সেটা গ্যাস চেম্বারে পোরার চেয়েও সৎ গুনাহ্! তোবা! তোবা!
৩০/৪/৬৬
———-
১. অক্সফোর্ডের ইতিহাস-অধ্যাপক ট্রেভর-রোপারের মতো জর্মনির জাতশত্রু শতকে গোটেক; তদুপরি তিনি একটি আস্ত স্নবশ্য স্নব। তিনি বলেন “and it was the Latin luidity of his Goebbels’) mind, the un-German suppleness of his argument which made him so much more successful as a preacher than the forthblowing nationalists of the South.”
অবশ্য অধ্যাপককে বোঝা ভার। তিনি শতাধিক বার বলেছেন, জর্মনরা অতিশয় অগা জাত। উত্তরে বলি, অগারা পরিষ্কার যুক্তি বোঝে না; রহস্যের সন্ধানে কোটে মাথা। তাই জর্মন দার্শনিকদের ভিতর লাতিন ধরনের স্বচ্ছ লেখক শোপেনহাওয়ার ভোতা লেখক হেগে-এর তুলনায় অবহেলিত।
২. নূরনবেরগের মোকদ্দমায় যখন আসামি নাৎসিদের বিরুদ্ধে বলা হল যে তাঁদের ফ্যুরার গুরুই ইহুদিদের ausrotten ‘সবংশে নির্বংশ করবেন বলে একাধিকবার সর্বজন সমক্ষে কবুল করেছিলেন, তখন আসামি পক্ষ বলে, “ওসব কথার কথা। কেউ যখন বলে “তোমার চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজাব” (বাংলায় বলতে গেলে এই অনুবাদই জুৎসই) তখন অন্য পক্ষ সেটা সিরিয়াসলি শব্দার্থ নিয়ে বিশ্বের তাবৎ ডুগডুগি বানাবার যন্ত্রপাতি বিনষ্ট করতে মাথায় গামছা বাঁধে না।’
৩. সবিস্তর কাহিনী পাঠক পাবেন, অধীনের ‘দু-হারা’ পুস্তকে, ‘হিটলারের শেষ দশ দিন’ প্রবন্ধে।
৪. এর অন্যতম বড়কর্তা হ্যাঁস নুরনবের্গ মোকদ্দমায় সাক্ষী দেন, এবং পরে এঁর ফাঁসি হয়। দু-জন হাড়ে-পাকা মনস্তত্ত্ববিদ মার্কিন চিকিৎসক এঁকে আগা-পাশতলা পুনঃপুন পরীক্ষা করেও এর ভিতর কোনো কিছু অ্যানরমাল পাননি। ইনি বলেন, হাজার খানেক মানুষ গ্যাস দিয়ে মারতে আমার ১০ থেকে ১২ মিনিট সময় লাগত, কিন্তু আসল মুশকিল ছিল এদের পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করা– দিনের পর দিন নাগাড়ে চব্বিশ ঘন্টা চুল্লিগুলো চালু রেখেও কাজ খতম হত না। গ্যাস চেম্বারে ইহুদিদের চাবুক মেরে মেরে ঢোকানো থেকে, চুল্লি চব্বিশ ঘণ্টা চালু রেখে তাতে লাশ পুড়িয়ে ছাই করে জলে ভাসানো পর্যন্ত সব কাজ করত কোনও কোনও স্থলে ইহুদিরাই। তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে এই প্রলোভনে। পরে অবশ্য তাদেরও ঘাড়ে গুলি করে করে মারা হত, পিছন থেকে, অতর্কিতে।
চোখের জলের লেখক
ইংরেজির শব্দভাণ্ডার অতুলনীয়। তন্মধ্যে একটি শব্দ ‘গ্যাগা’– এর সঠিক উচ্চারণ না জানা থাকলেও ক্ষতি নেই। ‘গ্যাগা’ শব্দের অর্থ, লোকটার ব্রেন বকসে যা আছে–যদি কিছু আদৌ থাকে– সেটা এমনই হযবরল গোবলেট পাকানোর জগা-খিচুড়ি যে কেউ কিছু বললে তার গলা দিয়ে যে ধ্বনি বেরোয় সেটা ‘গাগা,’ ‘গ্যাগো’, ‘গ্যাগ্যা’ গোঙরানো ঢপের– কাজেই শব্দটির যে-কোনও উচ্চারণই মঞ্জুর। অর্থাৎ গাগার সঙ্গে ইমবেসাইল, ইডিয়ট, (‘পন্টক’ বললুম না, কারণ সুনীতিবাবু শব্দটির কপিরাইট মেরে দিয়ে সেটার পাইরেটিং সংস্করণ বের করার দরুন পাড়ার ছোঁড়ারা আমাকে ‘কণ্টক’ থেকে ‘কাঁটা’, ‘পন্টক’ থেকে ‘পাঁঠা’ বের না করে আড়াল থেকে আমাকে ‘পনঠক’ বলতে আরম্ভ করেছে), গোবর-গণেশ যে-কারও সঙ্গে তুলনা করলে শেষোক্তদের অপমান করা হয়।
সেই গ্যাগাদের গ্যাগা– গ্যাগায়েস্টের মতো আমি শুধু অর্থহীন কতকগুলো ধ্বনি বের করলুম যখন আমার এক নিত্যালাপী গুণী বললেন, জনৈক অধ্যাপক নাকি প্রকাশ্য সভাস্থলে রায় প্রকাশ করেন, স্বৰ্গত, প্রাতঃস্মরণীয় শিল্পীরাজ, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নাকি থাডোকেলাস ‘চোখের জলের লেখক’! আচ্ছা, পাঠক তুমিও কও, সেস্থলে তুমি কী করতে! শরশ্চন্দ্র কাঁদিয়েছেন! শরৎচন্দ্র হাসাননি! সামাজিক নিষ্ঠুরতর কাঁটাবনের উপর দিয়ে আমাদের কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাননি!–-কাঁদাবার জন্য নয়, যন্ত্রণায় চিৎকার করার জন্য! ব্যঙ্গ, শ্লেষ, বিদ্রূপ-বাণে আমাদের জর্জরিত করেননি?
এই পুণ্য বঙ্গভূমিতে শতাধিক বর্ষ ধরে দুটি দল আছে। রামমোহন বনাম সতীদাহের দল, বিদ্যাসাগর বনাম নিরস্তু উপবাসের দল, রবীন্দ্রনাথ বনাম– তা সে যাই হোক। সেই দল চেষ্টা করেছিলেন শরৎচন্দ্রকে নেতা বানিয়ে রবীন্দ্রনাথকে অতিষ্ঠ করে তুলতে। তাঁরা মাষা পরিমাণ কৃতকার্য হয়েছিলেন সন্দেহ নেই, কিন্তু শেষপর্যন্ত দেখা গেল শরৎচন্দ্র দলের বাইরে। শরৎচন্দ্র যেমন ‘দত্তা’র ‘রাসবিহারী’ চরিত্র আঁকেন, ঠিক তেমনি ‘নারীর মূল্য’ও লিখতে জানেন। (আশা করি বলার প্রয়োজন নেই যে শরৎচন্দ্র এই অমূল্য গ্রন্থ কঁদাবার জন্য লেখেননি; পাঠক, আপনি সে বই পড়ে কী ভেবেছেন সঠিক বলতে পারব না; আমার মনে হয়েছে, আমি যেন দু গালে চড় খাচ্ছি এবং জানি যখন এ-ই আমার প্রাপ্য তাই আমি তখন কঁদিনি– কারণ কাঁদবার হক্কও সঞ্চয় করতে হয়।)
এদিকে কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ‘অন্ধভক্তে’র দল ডেকে আন্ বললে যাঁরা বেঁধে আনে– (যদিও আমি রবীন্দ্র-শিষ্য হিসেবে শপথ করে বলতে পারি, তিনি ডেকে আনতেও বলেননি) লাগলেন শরৎচন্দ্রের পিছনে। তার জের আজও চলেছে। অবশ্য এস্থলে আমি করজোড়ে ক্ষমা ভিক্ষা করে নিবেদন করি, পূর্বোল্লিখিত অধ্যাপক এ-‘দলে’র না-ও হতে পারেন। তিনি হয়তো তার স্বাধীন ধর্মবুদ্ধি অনুযায়ী তার বক্তব্য বলেছেন।
কিন্তু এসব বৃথা বাক্য। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ একটি ‘তুলনাহীনা’ কবিতা লিখতে লিখতে হঠাৎ লিখেছেন, ‘বৃথা বাক্য থাক’। গুরুবাক্য স্মরণে এবং সেই নীতি অনুযায়ী আমারও মন তাই এতক্ষণ ধরে বৃথা বাক্য ভুলে গিয়ে শুধু আঁকুবাকু করছে, মেজদার স্মরণে– যিনি দুর্দান্ত শীতের রাতে লেপের ভিতর কচ্ছপটির মতো শুয়ে আছেন আর শ্রীকান্ত তাঁর জন্য পাতা উল্টে দিচ্ছেন, হঠাৎ ব্যাঘ্ররূপী ‘বউরূপী’র আবির্ভাব, ভিরমি কাটলে পর মেজদা ক্ষীণকণ্ঠে বললেন, ‘দি রয়েল বেঙ্গল টাইগার’– ইতোমধ্যে খড়ম পেটাতে পেটাতে (আহা, কী সুন্দর ছবিটি!) কটুবাক্য, ‘খোট্টার ব্যাটারা কাঁঠাল পাকা দিয়া’– এবং সর্বশেষে পিসিমা’র সাতপাকের সোয়ামির প্রতি অত্যন্ত প্র্যাকটিক্যাল সময়োপযোগী সদুপদেশ– কাটা ন্যাজটি ভবিষ্যতের সুব্যবহারার্থে তরিবৎ করে তুলে রাখার জন্য সেকালে বোধ হয় ভাগলপুরে ব্যাঙ্কে ভলটের ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু সাবধান! আমাকে সর্বক্ষণ সচেতন হয়ে থাকতে হবে যেন ফাঁদে পা না দিই;– শরৎচন্দ্র যে বাংলা দেশকে হাসিয়েছেন তার উদ্ধৃতি দেবার প্রলোভন সম্বরণ না করলে বর্তমানে যাদের হাতে শরৎ-গ্রন্থাবলির কপিরাইট তাঁরা আমাকে জেলে পুরবেন– পাতার পর পাতা নিছক পুনর্মুদ্রণ তাঁরা বরদাস্ত করবেন কেন? অথচ আমার বক্তব্য তো স্পষ্টতম হবে, যদি আমি একটিমাত্র বাক্যব্যয় না করে নিছক উদ্ধৃতির পর উদ্ধৃতি দিয়ে যাই।
তর্কস্থলে স্বীকার করছি কাঁদানো সহজ। হাসানো কঠিন। টেকো ভদ্রলোক তাঁর বাদবাকি কুলে আড়াইগাছা চুল দিয়ে মাথার সামনের দিকের চালটা যেন খড় দিয়ে ছাওয়ার নিষ্ফল প্রচেষ্টা করেছেন– তাই দেখে রকে বসে আমার তিন ভাগনে যে শ্রোমীয়’ টিপ্পনী কাটলে সেটি অনায়াসে অলিম্পিকে পাঠানো যায় এবং সেটি আমি ঘরের ভিতর থেকে স্পষ্ট শুনতে পেলুম। কিন্তু, হায়, ওদের সঙ্গে যোগ দিতে পারলুম না, কারণ, সরলতম কারণ, আমার আপন টাকটি– থাক, বৃথা বাক্য থাক। কিন্তু ঠিক ওই সময় অন্য একটি ভদ্রলোক রাস্তা। দিয়ে যাবার সময় রক্ থেকে যদি শব্দ আসত, ‘আহা বেচারা, কাল রাত্রে তার ছেলেটি–জানিস, কী হয়েছে?’–বাকিটা শুনতে পেলুম না বলে হেঁকে শুধালুম, ‘কেন রে, কী হয়েছে?’ ‘টাইফয়েডে একটা চোখ গেছে।’ আমি তখন রকেরই একজন হয়ে গেলুম।
কিংবা সরলতর উদাহরণ দিই।
ওই বৈঠকখানায়ই বসে আছি। বাড়ির বউঝিরা রান্নাঘরে ফিসফিস করে গালগল্প করতে করতে– রাধে মেয়ে কি চুল বাঁধে না হঠাৎ সবাই একসঙ্গে হেসে উঠল। আমি যত গ্যাগা-ই হই না কেন, উঠে শুধাব না, ‘হ্যাঁ বউমা, তোমরা হাসছিলে কেন?’
কিন্তু তারা যদি হঠাৎ একসঙ্গে ডুকরে কেঁদে ওঠে তবে আমি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গিয়ে জানতে চাইব তারা এরকম ধারা হঠাৎ কেঁদে উঠল কেন? অর্থাৎ হাসি একে অন্যের কাছ থেকে দূরে নিয়ে যায়, কান্না কাছে টেনে আনে।
***
শরৎচন্দ্র ‘চোখের জলের লেখক’? আর বিদ্যাসাগর? বিধবা-বিবাহ আন্দোলনের সময় তিনি যেসব ব্যঙ্গ-পি করেছেন, তখন আমরা ঠাঠা করে হেসেছি?– না? তার শকুন্তলা’ পড়তে পড়তে আমি হেসেই গড়াগড়ি! রবীন্দ্রনাথের হাস্যরস নিশ্চয়ই অত্যন্ত অপ্রচুর ছিল। নইলে তিনি লিখবেন কেন, কেহ দুঃখ পায় ইহা তিনি (শ্ৰীকণ্ঠবাবু) সহিতে পারিতেন না– ইহার কাহিনীও তাঁহার পক্ষে অসহ্য ছিল। এই বালকদের কেহ যখন কৌতুক করিয়া তাহাকে পীড়ন করিতে চাহিত তখন বিদ্যাসাগরের “সীতার বনবাস” বা “শকুন্তলা” হইতে কোনও একটি করুণ অংশ তাঁহাকে পড়িয়া শোনাইত, তিনি দুই হাত তুলিয়া নিষেধ করিয়া অনুনয় করিয়া কোনওমতে থামাইয়া দিবার জন্য ব্যস্ত হইয়া পড়িতেন।
আশ্চর্য! আমি তো গ্রন্থ দু খানা পড়ে হেসেই কুটিকুটি! তবে হ্যাঁ, আমি পূর্বেই স্বীকার করেছি আমি গ্যাগা।
সাহিত্যিক বিদ্যাসাগর মশাইকে লোকে চেনে তার চোখের জলের বইয়ের জন্য। অবতার বিদ্যাসাগরকে বাঙালি চেনে তিনি মানুষের চোখের জল মুছিয়ে দিতেন বলে। বিদ্যাসাগর মশাই দুটোই পারতেন। কিন্তু সবাই তো তা পারে না। সমাজের অত্যাচার-অনাচার দেখে সত্য সাহিত্যিক মানুষকে কাঁদায়। তাদের ভেতরে যাঁরা সত্যকার মানুষ তখন তাঁদের অনেকেই সেসব অনাচারের বিরুদ্ধে নাঙ্গা তলওয়ার নিয়ে জেহাদ ঘোষণা করে। কারণ আমাদের অধিকাংশই জড়। সাহিত্যিক স্পর্শকাতর। সে যখন করুণ বর্ণনা দিয়ে আমাদের কাদায়, তখন আমাদেরই মতো জড়ভড়তদের কেউ কেউ ওই সম্বন্ধে সচেতন হয়।(২)
ড্রাইফুসের প্রতি নষ্টাধম ফরাসি মিলিটারি মদমত্ত হয়ে যে অবিচার করে তার প্রতিকারের জন্য তাঁর সতীসাধ্বী স্ত্রী প্যারিসের বড় বড় রাজনৈতিক শক্তিধর শাসক সম্প্রদায়ের দ্বারে দ্বারে গিয়ে করুণ আর্তনাদ করেছে। কিন্তু সে বেচারি তো আমাদের তুলনাহীনা’ লেখিকা আশাপূর্ণা নয়। শেষটায় চরম দীনজন যেরকম ভিক্ষুকের কাছে ভিক্ষা চায়, ঠিক সেইরকম সে গেল সাহিত্যিক এমিল জোলার কাছে। তাঁর তখন বয়স হয়ে গিয়েছে। তিনি মাফ চাইলেন। শেষটায় বেচারি তার কাগজপত্র জোলার টেবিলে ফেলে রেখে চলে গেল।
এই পৃথিবীর পরম সৌভাগ্য সে রাত্রে জোলার কোনওকিছু করার ছিল না।
এটা-ওটা নাড়াচাড়া করতে করতে হঠাৎ সেই রমণীর কাগজপত্র চোখে পড়ল।
অলস-ভরে পড়া আরম্ভ করে বুড়ো হঠাৎ সোজা হয়ে বসল– তার পর গেল ক্ষেপে! তখন লিখল ‘জ্যাকুজ (Jaccuse) আই একুজ’। ‘ফরাসি সরকারকে আমি একুজ করি।’
তার পর কী হল সেটা বলতে গেলে ওই বইখানা ছাড়িয়ে আরও দু খানা বই লিখতে হয়।
মনে নেই, ক’বছর নির্বাসনের কারাযন্ত্রণা ভোগ করে ‘কাঁদানো’র লেখক জোলার কৃপায় ড্রাইফুসের প্রতি সুবিচার হল।
শেষ কথা : বহু বহু প্রকৃত লেখক, ‘চোখের জলের লেখক’ নন কিংবা শুধু ‘হাসাবার’ লেখক নন। দুই-ই।
তবে কে কোথায় হাসবে, কে কোথায় কাঁদবে, বলা কঠিন। সেই “অরক্ষণীয়া” মেয়েটি যখন পড়ি-মরি হয়ে ‘সেজেগুজে’ কনে দেখবার পক্ষের সামনে বেরুতে যাচ্ছিল তখন একটি ছোট মেয়ে হাসি থামাতে না পেরে বলেছিল, পিসিমা সং সেজেছে।
আমি গ্যাগা। আমি ষোল বছর বয়সে কেঁদেছিলুম।
৪।১২/৬৫
———-
১. যে-কোনও কারণেই হোক, বন্ধুবর নাম উল্লেখ করলেন না, আমিও শুধোইনি।
২. বিদ্যেসাগর ছদ্মনামে হাস্য– বরঞ্চ বলা উচিত ব্যঙ্গরসও করে গেছেন। কিন্তু তাঁর খ্যাতি সেজন্য নয়। বস্তুত তাঁর সেসব ছদ্মনামে লেখা পুনরায় ‘আবিষ্কৃত’ হয় বছর বিশ-ত্রিশ পূর্বে।
ছাত্র বনাম পুলিশ
০১.
‘দেখি! বের কর অভিজ্ঞান-পত্র- আইডেনটিফিকেশন কার্ড!’
কী আর করে বেচারি– দেখাতে হল কার্ডখানা। নামধাম ঠিকানা তো রয়েইছে, তদুপরি রয়েছে বেচারির ফোটোগ্রাফ, তার নিচে ছোকরার দস্তখত, এবং দুটোর দু কোণ জুড়ে য়ুনিভার্সিটির ট্যাম্প। হোমিওপ্যাথিক পাসপোর্ট আর কী!
হায় বেচারা! যখন য়ুনিভার্সিটিতে প্রবেশ করার ওক্তে সগর্বে কর্তৃপক্ষের সম্মুখে ফোটোগ্রাফের নিচে দস্তখত করেছিলে তখন কি জানত এটা ‘দস্তখত’ নয়, এই ‘কুকর্ম’, করে তার ‘দস্ত’ (হাত) ‘ক্ষত’ হয়েছিল– এ ‘পান’টি আমার নয়, বিদ্যেসাগর মশাইয়ের। তাঁর প্রোতেজে মাইকেল পান করতেন প্রচুর, স্বয়ং বিদ্যেসাগর ‘পান’ করতেন অত্যল্পই।
প্রাগুক্ত সরস প্রেমালাপ হচ্ছিল জর্মনির কোনও এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং পুলিশম্যানে (চলতি জৰ্মনে ‘শুপো’)। ছোকরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে রাত দুটোর সময় কাকর ছুড়ছিল একটি বিশেষ জানালার শার্সিকে নিশান করে, এবং যেহেতু তৎপূর্বে– অর্থাৎ শনির সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত দুটো অবধি চেন-স্মোকারদের মতো অ্যাট্টুখানি, মানে ইয়ে, ওই যাকে বলে বিয়ার পান করেছিল বলে তাগটা স্বভাবতই টালমাটাল হয়ে পাশের যার-তার জানালার শার্সির উপর পড়েছিল। অবশ্য একথা অবিসম্বাদিত সত্য যে, সে কাপুরুষের মতো শুপোর হাতে আত্মসমর্পণ করেনি– আপ্রাণ পলায়ন-প্রচেষ্টায় নিষ্ফল হয়ে তবে ধরা পড়ে।
ব্যাপারটা সবিস্তার কী?
অতি সরল। জর্মন ছাত্রছাত্রী ডিগ্রি লাভের পূর্বের তিন বৎসর ভূতের মতো খাটে। কিন্তু শনি-সন্ধ্যা থেকে রবির সকাল পর্যন্ত দল বেঁধে ‘পাবে’ বসে প্রেমসে বিয়ার পান করে। এবং যেহেতু বাড়াবাড়ি না করলে খ্রিস্টধর্ম মদ্যপান সম্বন্ধে উচ্চবাচ্য করে না, তাই কোনও কোনও ধর্মানুরাগী ছেলে তোর সাতটার ‘মেস’-এ (উপাসনায়) যোগ দিতে যায় ‘পাব’ থেকেই, সোজা গির্জার দিকে– শনির সন্ধ্যা থেকে রবির ভোর ছটা সাড়ে ছ’টা অবধি বিয়ার পান করার পর। অবশ্যই মত্তাবস্থায় নয়– তবে ইংরেজিতে যাকে বলে ঈষৎ মডলিন।
তা সে যাক। এ লেখকের বিষয়বস্তু পুলিশ বনাম স্টুডেন্ট (স্টু’ডেন্ট’ বলতে জর্মনে একমাত্র য়ুনিভার্সিটি স্টুডেন্টই বোঝায়– স্কুলবয়কে বলে ‘শ্যুলার’)। এই দুই দলের মধ্যে হামেহাল অবশ্য সাধারণত সন্ধ্যার পর থেকে ভোর পর্যন্ত এবং বিশেষ করে শনি দিনগত রাতে– একটা অঘোষিত বৈরিতা বিরাজ করছে, য়ুনিভার্সিটি সৃষ্টির প্রথম দিন থেকে। আমি যা নিবেদন করতে যাচ্ছি তার ঐতিহাসিক পটভূমিটি কিন্তু কিংবদন্তিমূলক, অর্থাৎ পুরাণ জাতীয়। সেইটুকু সয়ে নিন। তার পরই মাল।
আমরা সকলেই জানি কতকগুলো উপাধি মানুষের নামের অচ্ছেদ্য অংশ : যেমন (১) রেভারেন্ড, (২) কর্নেল, (৩) ডক্টর (শুধু চিকিৎসক অর্থে নয়; যে কোনও বিষয়ে পিএইচডি, ডিএসসি জাতীয় ডক্টরেট পাস করা থাকলে)। প্রথম শ্রেণির উপাধিগুলো বিধিদত্ত, দ্বিতীয়গুলো রাজদত্ত এবং তৃতীয়গুলো য়ুনিভার্সিটিদত্ত।
রাজাতে-চার্চে লড়াই বহু যুগ ধরে চলেছে। এ লড়াইয়ে শেষের দিকে এলেন য়ুনিভার্সিটি। তার পূর্বে শিক্ষা-দীক্ষার ভার ছিল প্রধানত পাদ্রিদের হাতে। কিন্তু মহামতি লুথারের আন্দোলনের ফলে বহু পিতা পুত্রকে আর ‘কুসংস্কারাচ্ছন্ন’ যাজক সম্প্রদায়ের কাছে মানসিক, হার্দিক এমনকি আধিভৌতিক উন্নতির জন্য পাঠাতে চাইলেন না। এছাড়া আরও বিস্তর কারণ ছিল, কিন্তু সেগুলো এস্থলে অবান্তর না হলেও নীরস। মোদ্দা কথা, চার্চ ও রাজার লড়াইয়ের মধ্যিখানে য়ুনিভার্সিটিগুলো তক্কে তক্কে রইল আপন আপন স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বাধীনতা-স্বরাজ লাভের জন্য। তাদের মধ্যে অনেকেই ছিল লুথারপন্থী এবং তাদের মূল নীতি ছিল অনেকটা—‘যখন পোপের “গুরু-বাদ” ত্যাগ করে স্বয়ং স্বাধীনভাবে বাইবেল পড়তে চাও, এবং তদ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে একমাত্র স্বাধীন চিন্তার ওপর নির্ভর করে জীবন যাপন করতে চাও, তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দিতে হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বাধীনতা, (অটোনমাস ইন্ডিপেনডেন্ট)–নইলে তারা স্বাধীন চিন্তা, স্বাধীন বিচার-বিশ্লেষণ করবে কী প্রকারে?’
যে করেই হোক সে স্বাধীনতা য়ুনিভার্সিটি-টাউনগুলোর (অর্থাৎ যে শহরগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ই সর্বপ্রধান সর্বজনমান্য প্রতিষ্ঠান) রাস্তাঘাটেও সক্রিয় হয়ে উঠল। অর্থাৎ নিতান্ত খুন, ধর্ষণ জাতীয় পাপাচার না করলে স্বয়ং বিশ্ববিদ্যালয়ই ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আপন জেলে (?) পুরে দিত– বিচারের ভার নিতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ল’ বা আইন, জুরিসপ্রুডেন্সের প্রফেসরগণ ‘ছাত্র আসামি’ এদেরই একজন বা একাধিকজনকে আপন উকিল নিয়োগ করত– এবং সবকুছ ফ্রি-গ্যাটিস-অ্যান্ড-ফর-নাথিং!
সে-সব দিন গেছে। তবু শুনেছি হাইডেলবের্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংবা অন্য কোনও একটা হতে পারে আমার ঠিক মনে নেই– জেলখানাটা নাকি এখনও মিউজিয়ামের মতো বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে এবং সেটি নাকি সত্যই দ্রষ্টব্য বস্তু!
যে পাঠক বাংলা ভাষায় অতুলনীয় (আমার মতে বাংলা ভাষায় ‘অদ্বিতীয়’) পুস্তক, উপেন বাঁড়ুয্যের নির্বাসিতের আত্মকথা’ পড়েছেন, তিনি হয়তো স্মরণে আনতে পারবেন (আমিও স্মৃতির ওপর নির্ভর করে বলছি; তাই ভুলচুক হবে নিশ্চয়ই, এবং তার জন্য মাফ চাইছি) যে, যখন অরবিন্দ-বারীন-উল্লাস-উপেন-কানাই-সত্যেন এট আল-এর বিরুদ্ধে আলীপুরে বোমার মামলা হয় তখন হাজতে থাকাকালীন ছোকরাদের মধ্যে যাদের অদম্য কবিতৃপ্রকাশব্যাধি ছিল তার লেখনীমস্যাধারাভাবৎ কাঠকয়লা দিয়ে দেয়ালে পদ্য লিখত। তারই একটি,
‘ছিড়িতে ছিড়িতে পাট শরীর হইল কাঠ
সোনার বরণ হৈল কালি
প্রহরী যতেক ব্যাটা বুদ্ধিতে তো বোকা-পাঁঠা
দিনরাত দেয় গালাগালি।’
যতদূর মনে পড়ছে, ‘উপীন’বাবু যেন মুচকি হেসে মন্তব্য করছেন, আহা কী ‘সোনার বরণ’ই বঙ্গসন্তানের হয়!
তার পর যা লিখছেন তার সারমর্ম; মাঝে মাঝে দু-একটি ভালো কবিতাও চোখে পড়ত। উদাহরণস্বরূপ দিয়েছেন,
‘রাধার দুটি রাঙা পায়ে
অনন্ত পড়েছে ধরা,
ওঠে ভাসে কত বিশ্ব
চিদানন্দে মাতোয়ারা।’
এবারে তিনি যেন তাঁর চোখে একফোঁটা জল আসতে না আসতে দুঃখ করছেন, হায়, রে মানুষের মন! কারাগারের পাষাণ-প্রাচীরের ভেতরেও রাধার দুটি রাঙা পায়ের জন্য সে আছাড় খায়!(১)
***
জর্মন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন যুগের আপন জেলখানার কথা হচ্ছিল। তার অন্যতম প্রাচীনতমের নিঃসন্দেহ সর্বোকৃষ্ট বর্ণনা দিয়েছেন মার্ক টুয়েন। সে বর্ণনাটি এমনই সদ-জাতের-বাড়া চৌম্বকীয় আকর্ষণীয় বর্ণনা যে তারই টানে আমারই চেনা এক সহযাত্রী জর্মন-সীমান্তে পৌঁছেই নাক-বরাবর চলে যান ওই জেল দেখতে– সাঁ সুসি প্রাসাদ, ড্রেসডেনে সঞ্চিত রাফায়েলের মাদোন্না নস্যাৎ করে।
আলীপুরের যেসব ‘কবিরা’ প্রহরীকে পাঁঠা নাম দিয়েছিলেন, কিংবা চোখ বন্ধ করে রাখার দুটি রাঙা পায়ের ধ্যানে মজে গেছেন, তাঁরা কিন্তু বিলক্ষণ জানতেন, তাঁদের জন্য মৃত্যু জেলের চতুর্দিকে ঘোরাফেরা করছে–শহিদ হওয়ার সম্ভাবনা কবি, অকবি সকলেই প্রায় সমান। কিন্তু জর্মন-বিশ্ববিদ্যালয়-জেলে ছাত্রেরা যেত অল্প কয়েক দিনের জন্য, ফাঁসির তো কথাই ওঠে না। তাই মার্ক টুয়েনের পক্ষে সম্ভব হয়েছে অপূর্ব হাস্যরসে রঞ্জিত করে সেই জেলটির বর্ণনা দেবার। কাজেই উপস্থিত আলীপুরের কথা ভুলে যান।
***
বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাঁসি-কাঠ না থাকতে পারে, ক্যাবারে কাঁ কাঁর ব্যবস্থা না থাকতে পারে, কিন্তু লেখনী-মস্যাধারের অভাব!–এটা কল্পনাতীত। যদিস্যাৎ ওই জর্মনিরই সর্বোৎকৃষ্ট দশ লিটার বিয়ার প্রসাদাৎ কল্পনাটা করেই ফেলি, তখন চোখের সামনে, বিকল্পে, ভেসে উঠবে পেনসিল– একথা তো ভুললে চলবে না, এদেশের কেতাবপত্রে মহামান্য কাইজারের (ভারতীয় কাইসর-ই-হিন্দ পদক, লাতিন সিজার ইত্যাদি) নাম পড়ার বহু পূর্বেই ভারতীয় ছেলেবুড়ো ব্যবহার করেছে, Koh-i-noor, made by L. &C. Hardmuth in Austria, graphite drawing pencil, compressed lead.
তাই সেই পেনসিল অকৃপণ হস্তে ব্যবহৃত হয়েছে ছাত্র, ‘কয়েদি’র দল দ্বারা বংশপরম্পরায়– সাদা দেয়ালের উপর। শুধু কবিতা না, বহুবিধ অন্যান্য চিজ।
কিন্তু তৎপূর্বে তো জানতে হয়, এরা জেলে আসত কোন কোন ‘অপরাধ’ করে। এর অনেকগুলোই আমি স্বচক্ষে দেখেছি, এবং সাতিশয় সন্তোষ সহকারে স্বীকার করছি, সবল সক্রিয় হিস্যেদারও হয়েছি বহু ক্ষেত্রে অর্থাৎ শুপো-স্টুডেন্টেন, পুলিশ, ভর্সস ছাত্র ‘যুদ্ধে’ কিংবা যুদ্ধ আসন্ন দেখে দ্রুততম গতিতে পলায়নে। কিন্তু সেটা অন্য অধ্যায়।
.
০২.
‘পাজিটা এখনও এল না, ব্যাপারটা কী? বলেছিল না, তার কাকা আসছেন ডানৎসিগ থেকে, ওর জন্য নিয়ে আসবে কয়েক বোতল অত্যুকৃষ্ট ডাৎসিগার গোল্ট ভাসার (ডানৎসিগের-স্বর্ণবারি– সোনালি সোমরস), আমরা সবাই হিস্যে পাব।’
‘একটা ফোন করলে হয় না?’
‘হ্যাঁ! সেই আনন্দেই থাক! টেলিফোন! বুড়ির বাড়িতে এখনও দড়ি টেনে ভেতরের ঘণ্টা বাজাতে হয়। ইলেকট্রিক বেল পর্যন্ত নেই। তবে, হ্যাঁ, গার্লফ্রেন্ডদের যখন তখন আপন কামরায় নিয়ে যেতে দেয়। তদুপরি বুড়ি বদ্ধ কালা। শুনেছি, পায়ের উপর গরম ইস্ত্রিটা হঠাৎ হাত থেকে ফসকে পড়ে গিয়েছিল– শুনতে পায়নি।’
রসালাপ হচ্ছিল শনির সন্ধ্যায় ‘পাব’-এ। জনসাতেক মেম্বর জমায়েত হয়ে একটা গোল টেবিল ঘিরে বিয়ার পান করছেন। সেটার উপর কোনও টেবিল-ক্লথ নেই। আছে গত একশ বছরের স্টুডেন্ট খদ্দেরদের নাম, যারা প্রতি শনিবার এই টেবিলটা ঘিরে গুলতানি করেছে– ছুরি দিয়ে খোদাই করা। আমাদের পলের বাপ ভি হেমের নামও এই টেবিলে আছে। সমস্ত টেবিলটা নামে নামে সম্পূর্ণ ভর্তি হয়ে গিয়েছে– আর নতুন নাম খোদাই করার উপায় নেই।
এদের গুলতানির বর্ণনা বা ইতিহাস দেওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। কারণ সবাই জানেন, সেই সোক্ৰাতেসের যুগ থেকে ইয়োরোপে গুণীজ্ঞানী থেকে চোরচোট্টা সবাই মদ্যালয়ে বসে বিশ্রম্ভালাপ করেছেন এবং সহজেই অনুমেয়, চোরচোট্টারা প্লাতোর ‘আইডিয়া’র সংজ্ঞা খুঁজতে গিয়ে ঘোরাঘুরি করেনি, আর সোক্রাতেস প্রতিবেশীর তালাটি কী প্রকারে নিঃশব্দে বে-কার করা যায় তাই নিয়ে মদ্যপান করতে করতে শিষ্যদের সঙ্গে কূট যড়যন্ত্রে ত্রিযামা যামিনী যাপন করেনি। অর্থাৎ যে যার বৈদগ্ধ্য, জ্ঞানবুদ্ধি, যাতে তার চিত্তাকর্ষণ, তাই নিয়ে কথাবার্তা কইতে ভালোবাসে। তবে হ্যাঁ, মদ্যপানের মেকদার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আলোচনার বিষয়বস্তু যে ঈষৎ নিম্নস্তরে নেমে যায় সেটা অনেকেই লক্ষ করেছেন। জর্মনির স্টুডেন্টদের বেলায়ও তাই।
আমার ছিল মেজাজমর্জি অত্যন্ত খারাপ। ঠিক সেদিনই খবর পেয়েছি ইংরেজ গোল্ড স্ট্যান্ডার্ডকে তালাক দিয়েছে। তারই ফলে আমার কুল্লে বচ্ছরের খরচার জন্য ব্যাঙ্কে গচ্ছিত টাকার এক-তৃতীয়াংশ (বেশি হতে পারে, কমও হতে পারে, এতকাল পর সঠিক বলা কঠিন) কর্পূর হয়ে গেল। অর্থাৎ এখন যে য়ুনিভার্সিটি রেস্তোরাঁয় সবচেয়ে সস্তা ডিনারটি (সে যুগে দাম ছিল এদেশি পয়সায় কুল্লে বারো আনা) খাব, তারও উপায় রইল না। কাল সন্ধ্যা থেকে রাত্তিরের খাওয়াটা নিজেকেই রাঁধতে হবে। ওদিকে দেশের ইয়াররা ভাবছেন, লেখাপড়ায় আস্ত একটা গর্দভ ওই ছেলে জর্মনি গিয়ে তোপ মজাটা লুটে নিলে, মাইরি!
ইতোমধ্যে এসব ‘পাবে’ শনির সন্ধ্যায় যা-সব হয় সে-সবই হয়ে গেছে। ঠেলায় করে গরম গরম সসেজ এসেছে, দু-চারটে আনাড়ি বাজিয়ে ব্যাঞ্জোর উপর উৎপাত করে যৎসামান্য কামিয়ে গিয়েছে, পিকচার পোস্টকার্ড জুতোর ফিতে বিক্রির ছলে ভিখিরি তার রোদ মেরে গেল।
করে করে রাত একটা বাজল। বিস্ময় বিবোধক চিহ্ন দেবার জন্য ওই চিহ্নেরই বিন্দুটির বিন্দুবৎ প্রয়োজন নেই; শনির রাত্রি জর্মনিতে আরম্ভ হয় বারোটায়– যদ্যপি গ্রিনিজ ফয়তা ঝাড়ে ওই সময়টায় নাকি তার পরের দিন আরম্ভ। কিন্তু রাত একটার পর সাধারণ মদ্যালয় বন্ধ। এরপর করা যায় কী? আমি বিশেষ করে তাদেরই কথা ভাবছি যাদের তখনও তেষ্টা মেটেনি– জর্মনদের বিশ্বাস তারা বিয়ার পান করে তৃষ্ণা নিবারণার্থে। সাধারণ মদ্যালয় যখন বন্ধ তখন খোলা রইল অসাধারণ মদ্যালয়। সেগুলো একটু ইয়ে অর্থাৎ বিশেষ শ্রেণির মহিলায় ভর্তি আর কি। তবে স্টুডেন্টরা দল বেঁধে যখন সেখানে ঢুকে আপন গালগল্পে মত্ত হয় তখন ওই পূর্বোক্ত ‘ইয়েরা’ ওদের জ্বালাতন দূরে থাক্ ডিস্টার্বও করে না। ওদের পকেটে আছেই-বা কী?
ইতোমধ্যে সেই যে আমাদের টেওডর যাকে নিয়ে কাহিনী পত্তন করেছি, তার হঠাৎ পুনরায় শোক উথলে উঠল ওই ডানৎসিগ নগরীর প্রখ্যাত স্বর্ণবারির জন্য। বার বার বলে, ‘দেখলে ব্যাটার কাণ্ডখানা! রাত একটা ত আমাদের বসিয়ে রাখলে একটা সুরালয়ে– যখন কি না প্রত্যেক বাপের প্রত্যেক সু-পুত্তরের কর্তব্য আপন আপন সুনির্মিত স্নেহময় নীড়ে ন্দ্রিাদেবীর শান্ত্যঞ্চলে আশ্রয় নেওয়া।’
কে একজন বললে, ‘এই খানিকক্ষণ আগেই না তুই-ই বললি, পেটারের বাড়িটা আসলে অ্যাডাম এবং ঈভ তৈরি করেছিলেন ঝুরঝুরে থুরথুরে?’
টেওডরের কিন্তু তখন কারও টিপ্পনিতে কান দেবার মতো মরজি নয়– সে তখন মৌজে। হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে, যেন এক নবীন রিলেটিভিটি আবিষ্কার করার উৎসাহ দেখিয়ে বললে, ‘আর পেটার ব্যাটা নিশ্চয়ই আরামসে ঘুমুচ্ছে। চল, ব্যাটাকে গিয়ে জাগানো যাক’।
এস্থলে কারও পক্ষে রণে ভঙ্গ দেওয়া জর্মন-স্টুডেন্ট-মনু-শাস্ত্রে গোমাংস ভক্ষণের চেয়েও গুরুতর পাপ। তুমি তা হলে আস্ত একটা কাপুরুষ। পুলিশকে– অর্থাৎ দুশমনকে– ডরাও। তোমার কলিজা বকরির, তোমার সিনা চিড়িয়ার। অতিষ্ঠ হয়ে আপনি শুধোবেন,’ রাত্রি একটাই হোক, আর তিনটেই হোক’ কেউ কাউকে জাগালে পুলিশের পূর্বতর অধস্তন চতুর্দশ পুরুষের কিবা ক্ষতিক্ষয়, জখম-লোকসান? এদেশে কি রেতে-বেরেতে টেলিগ্রাফ পিয়ন আসে না?’
দাঁড়াও পাঠকবর, জন্ম যদি বঙ্গে, তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এসব ক্রমশ প্রকাশ্য।
বলা বাহুল্য রাত তেরটার সময়– গ্রিনিজ যদিও সেটাকে দিবাভাগ বলেন– আপনি যদি বাড়ির, অবশ্য অন্য বাড়ির, দোস্ত দুশমন– যে-ই হোক কাউকে জাগাবার চেষ্টা করেন, তা সে সিমেন-হালেস্কে-শুকের্টের নব্যতম বিজলি-বেল বাজিয়েই হোক, আর পৌরাণিক যুগীয় ঘণ্টাকর্ণ কানে যে-ঘন্টা ঝুলিয়ে রাখত যাতে করে সে তার জন্মবৈরী শ্রীহরির নাম-কীর্তন শুনতে না পায়– সেই ঘন্টাটিই বাজান, বাড়িউলি দরজা খুলে শনির রাতে ওই জবাকুসুসমঞ্চাশ টেওডরের নয়নযুগল দেখতে পাবে আমরা আর-সবাই না হয় পাশের গলিতে গা-ঢাকা দিয়েই রইলুম– তখন তার কণ্ঠ থেকে– ভুল বললুম, নাভিকুণ্ডলী থেকে যেসব মুরজ মুরলীধ্বনি বেরুবে তার ঈষদাংশ শুনতে পেলে ওই যে খানিকক্ষণ আগে কী-সব ইয়েদের কথা বলছিলুম তারা পর্যন্ত নোকের সামনে নজ্জা পাবে। অতএব ওই কবোষ্ণ অন্ধকারে আমাদের কাছে জাজ্বল্যমান হল যে ফ্রন্টাল এটাকের স্ট্র্যাটেজি বিলকুল ঔট অব ডেট।
আমাদের হস্তে তৎসত্ত্বেও আশার একটি ক্ষীণ প্রদীপ মিদি মিদির করছে। পেটারের কামরাটা দোতলায়, এবং একদম রাস্তার উপরে। অতএব আমরা সেদিক বাগে যেতে যেতে হেথাহোথা ক্ষুদ্রাকারের নুড়ি, কাঁকর, সোডার ছিপি ইত্যাকার মারণাস্ত্র কুড়িয়ে নিয়ে সুসজ্জিত হয়ে পৌঁছলুম পেটারালয়ে– বঙ্কিম সঙ্কীর্ণ পথ দুর্গম নির্জন পেরিয়ে।
পেটার থাকে মাউস ফাডে (সার্থক নাম, বাবা, ‘ইঁদুরের পথ!’)
টেওডরই আমাদের হিন্ডেনবুর্গ বলুন, লুডেনড বলুন, আমাদের রাইষ মার্শাল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, যদিও সে পেটারের ঘরে আসে সপ্তাহে নিদেন দশ দিন, তবু তার জানালা যে ঠিক কোনটা সেটা ঠাহর করতে পারছে না– আশা করি তার কারণ আর বুঝিয়ে বলতে হবে না। অবশেষে হানস্-ই লোকেট করলে জানালাটা। হানস্ বটনির ছাত্র– পেটারের জন্মদিনে তাকে একটা অঙ্গুষ্ঠ-পরিমাণ সাতিশয় বিরল ফণীমনসা উপহার দেয়। একটা জানালার বাইরের চৌকাঠ-পানা ফালি কাঠের উপর হানস্ সেটি আবিষ্কার করলে রাত্রের হিম খাওয়াবার জন্য পেটার সেটি ওই সিল না লেজ কী যেন বলে ইংরেজিতে– তারই উপর রেখে দিয়েছিল। কালিদাসের যুগে দ্বারে আঁকা থাকত ভিন্ন ভিন্ন চিহ্ন যেমন শঙ্খচক্র– হেথায় কেকটাস্।
পয়লা রৌন্ডে টেওডর ছুড়ে মারল সোডার ছিপি। লাগল গিয়ে ডান-পাশের জানালাটায়। আমরা ফিসফিস করে পেটারকে সাবধান করতে কসুর করিনি, কিন্তু কেবা শোনে কার কথা, সে তখন জাঁদরেল জনরৈল সিং, আমরা নিতান্ত ডালভাত দাবাখেলার বড়ে-পেয়াদা। দুসরা রৌন্ডে টেওডর বোধ হয় ফইর করেছিল একটা স্নো-কৌটোর ঢাকনা। এটা ধন্ন্ ন করে গিয়ে লাগল বাঁ-পাশের জানালাটায়। আমরা তাকে কিছু বলতে যেতেই সে ধমক দিয়ে বললে, ‘চোপ! এই হল আর্টিলারির আইন। প্রথম মারবে তাগের চেয়ে দূরে, তার পর তাগের চেয়ে কাছে, শেষটায় ম্যাথম্যাটিকলি মেজার করে ঠিক মধ্যিখানে। হবেও বা। ও তো প্রাশান য়ুংকার ঘরের ছেলে– জানার কথা। এবং আমাদের তুলনায় তার পকেট-শস্ত্রাগার পরিপূর্ণ। কারণ আমরা জর্মনির ধোপদুরস্ত রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছি কীই বা এমন কামান-ট্যাঙ্ক। পক্ষান্তরে যুযুধান টেওডর ঘিনপিৎ উপেক্ষা করে ‘পাবে’র সামনের ‘বিন’ থেকে মেলা অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে এনেছে। তাই এবারে ছুড়লে ছোট্ট একটি মার্কিং ইঙ্কের খালি শিশি। লাগল গিয়ে তেতলার একটা জানালায়, তখন বুঝতে পারলুম জনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে কেন জিততে পারেনি। দ্বিতীয়টা তখনও হয়নি! সে সময় হিটলার যদি আমাকে কসট করত তবে আমি নিশ্চয়ই তাকে বারণ করে দিতুম– বিশেষত এই অভিজ্ঞতার পর।
তার চেয়েও স্পষ্ট বুঝতে পারছি, টেওডর এখন যে অবস্থায় পৌচেছে সেখানে আপন নাক চুলকোতে চাইলে গুত্তা মারবে পিঠে। কিন্তু সে তত্ত্বটি তখন তাকে বলতে গেলে সেই সুপ্রাচীন জর্মন কাহিনীরই পুনরাবৃত্তি হবে মাত্র এক মাতাল রাত চৌদ্দটায় বাড়ি ভুল করে বারবার চেষ্টা করছে চাবি দিয়ে সদর দরজা খোলবার এবং সঙ্গে সঙ্গে কটুকাটব্য। সেই শব্দে শেষটায় দোতলায় একজনের ঘুম ভেঙে গেল। নিচের দিকে মাতালকে দেখে বললে, ‘হেই, তুমি ভুল বাড়ির তালা খোলবার চেষ্টা করছ’। মাতাল উপরের দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে বললে, ‘হে হে হে হে! তুমিই ভুল বাড়িতে ঘুমুচ্ছ।’
এই একতরফা লড়াই– আইনে যাকে বলে ইনআর সনশিয়া– কিংবা বলতে পারেন ড-কুইটের জলযন্ত্র আক্রমণ– আধঘন্টাটাক চলার পর টেওডর ছাড়লে–বলতে গেলে তার প্রায় শেষ সিকস পৌন্ডার– সার্ডিনমাছের খালি একটা টিন! ঝন ঝন করে শব্দ হল। কিন্তু পরে মনে হয়েছিল সে যেন ওস্তাদ এনায়েত খানের সেতার–কারণ সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু ছাপিয়ে কানে গেল পুলিশের ভারি ভারি বুটের শব্দ। এটা হল কী প্রকারে? সচরাচর শানবাঁধানো রাস্তার উপর রোদের পুলিশের বুটের শব্দ সেই নিঝুম নিশীথে অনেক দূরের থেকে শোনা যায়, এবং টেওডর ছাড়া আমাদের আর সক্কলের আধখানা কান খাড়া ছিল তারই আশঙ্কায়। অতএব দে ছুট, দে ছুট! কোন মূর্খ বলে যুদ্ধে পলায়ন কাপুরুষের কর্ম! ইংরেজ আফ্রিদিদের সঙ্গে যুদ্ধে পালালে পর এ দেশের জোয়ানদের বুঝিয়ে বলত, ‘এর নাম বাহাদুরিকে সাথ পিছে হঠনা!’
কিন্তু ছুটতে ছুটতে আমি শুধু ভাবছি, এতগুলো বুটের শব্দ একসঙ্গে হল কী করে, রোঁদে তো বেরোয় প্রতি মহল্লায় হার্টের, sorry, হার্টলেস সিংগলটন! তা সে যা-ই হোক, এখন তো প্রাণটা বাঁচাই।
পূর্বেই বলেছি, পেটারের গলিটার নাম মূষিকমার্গ। আসলে কিন্তু বন্ শহরের আঁকাবাঁকা হাঁসুলি বাঁকের মোড়, পায়ের বেঁকি-গয়নায় প্যাঁচ-খাওয়া আড়াই বিঘৎ চওড়া নিরানব্বইটি ‘রাস্তাকেই’ মূষিকমার্গ বলা যেতে পারে– তার জন্য কল্পনাশক্তিটিকে বহু সুদূরে সম্প্রসারিত করতে হয় না।
কিন্তু একটি তত্ত্ব সর্বজনবিদিত। এই গলিঘুচি, কোথায় যে হঠাৎ বেঁকে গেছে, কোথায় যে রাস্তার আশেপাশে বহু প্রাচীনকালেই পঞ্চত্বপ্রাপ্ত একটি কারখানার অন্ধকার অঙ্গনে অশরীরী হওয়া যায়, অর্থাৎ লুকানো যায় (হংসমিথুনের কথা অবশ্য আলাদা), কোথায় যে একটা গারাজের আংটাতে পা দিয়ে সামান্য তকলিফেই ছাতে ওঠা যায়, এসব তথ্য পুলিশ যতখানি জানে আমরা ঠিক ততখানিই জানি। এমনকি লেটেস্ট খবরও আমরা রাখি: অমুক দেউড়ির ঠিক সামনের রাস্তার বাতিটি বরবাদ হয়ে গিয়েছে, এখনও মেরামত হয়নি, কিংবা অমুক জায়গায় পরশুদিন থেকে এক ভঁইপিপে জুটেছে– পিছনে দিব্য অন্ধকার। অর্থাৎ পুলিশ তার আপন হাতের তেলো যতখানি চেনে, আমরাও আমাদের তেলো ততখানিই চিনি।
মূষিকমার্গ ধরে খানিকটে এগোলেই সেখানে তেরাস্তা। আমাদের স্ট্রাটেজি অতি সনাতন, সুপ্রাচীন। সঙ্গে সঙ্গে আমরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে দু দিকে ছুট লাগালাম। আবার তেরাস্তা পেলে আবার দু ভাগ হব। ধরা যদি পড়িই তবে দলসুদ্ধ ধরা পড়ব কেন? এবং যুদ্ধের নীতিও বটে, ‘আক্রমণের সময় দল বেঁধে; পলায়নে একলা-একলি।’ খুদে বন্ শহরে পুলিশ গিস গিস করে না– আর এই রাত চোদ্দটায় ফাঁড়ি-থানা ক’টাই-বা শেয়ার করতে পারে? কাজেই প্রতি তেরাস্তায় তারা যদি আমাদেরই স্ট্র্যাটেজি অনুসরণ করে তবে যাদের ‘মেন পাওয়ার’ কম বলে, কয়েকটা রাস্তা ফোলো অপ করতে পারবে না বলে শেষ পর্যন্ত হয়তো কেউই ধরা পড়বে না। কিন্তু এই ‘শুপো’ নন্দনগণ ঘড়েল। এবম্প্রকার বহু যুদ্ধে তারা জয়ী এবং পরাজয়ী হয়ে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে সেটা তাদের শেখায় অন্য স্ট্র্যাটেজি।
পাঠক, তুমি কখনও পোষা চিতাবাঘ দিয়ে হরিণ-শিকার দেখেছ? না দেখারই সম্ভাবনা বেশি, কারণ সেই রাজারাজড়াদের আমলেও এ খেলাটি অস্মদেশে ছিল বিরল। আমাকে। দেখিয়েছিলেন বরোদার বুড়ো মহারাজ।
মহারাজার খাস রিজার্ভ ফরেস্টে ছিল বিস্তর হরিণ, তাদের পিছনে লেলিয়ে দেওয়া হত একটা পোষা, ট্রেন চিতেবাঘ। বাঘ দেখা মাত্রই হরিণের পাল দে ছুট দে ছুট। এবং মাচাঙের উপর থেকে স্পষ্ট দেখতে পেলুম, একটা সুবিধা পাওয়া মাত্রই তারা দু ভাগ হয়ে গেল, তার পর আবার দু ভাগ, ফের দু ভাগ– করে করে হরিণের পাল আর পাল রইল না, হয়ে গেল চিত্তিরমিত্তির।
কিন্তু আমাদের নেকড়ে মহাশয়টিও অতিশয় সুবুদ্ধিমান। এভাগ ও ভাগকে খামোখা তাড়া করে সে বর্বরস্য শক্তিক্ষয় করল না। সে প্রথম থেকেই তাগ করে নিয়েছে একটা বিশেষ হরিণ। প্রতিবারে পাল যখন দু ভাগ হয়, তখন সে ওই বিশেষ হরিণটার ভাগেরই পিছন নেয়। পরে চিতার ট্রেনার আমাকে বলেছিল, ‘সবচেয়ে যে হরিণটা ধু’মসো, চিতে সবসময়ই একমাত্র ওইটের পিছু নেয়– এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে শক্তিক্ষয় করে না, কারণ চিতে জানে ওইটেই হাঁপিয়ে পড়বে সকলের পয়লা। ধরতে পারলে পারবে ওইটেকেই সব সময় যে পারে তা-ও নয়।’
বন শহরের শুপো সম্প্রদায় ঠিক তাই করলে। আমাদের মধ্যে যে দুটি ছিল সবচেয়ে হোঁৎকা, ওরা প্রতি দু ভাগ হওয়ার সময় ওদেরই পিছু নিল। শেষটায় ধরতে পেরেছিল অবশ্য একজনকে। সে কিন্তু টেওডর নয়, এবং জসট টু কিপ কম্পানি, ছুঁড়েছিল মাত্র নিতান্ত খুদে দু চারটি কাঁকর। তার কথাই আপনাদের খেদমতে ইতোপূর্ব পেশ করেছি।
আগের জমানায় পুলিশ তাকে দিয়ে দিত য়ুনিভার্সিটির হাতে– সে যেত য়ুনিভার্সিটির জেলে। শুনেছি, এস্তক স্বয়ং প্রিনস আউটো এডওয়ার্ড লেওপোল্ড ফন্ বিসমার্ক অবধি। গেছেন। এবং সে তখন জেলের দেওয়ালের উপর পেন্সিলযোগে আপন জিঘাংসা, কিংবা অনুশোচনা, কিংবা মধ্যিখানে, কিংবা কটুবাক্য– যথা যার অভিরুচি-–কভু গদ্যে কভু ছন্দে, সে-ও কী বিচিত্র, কখনও আলেকজেনড্রিয়ান, কখনও– সে কথা আরেকদিন না হয় হবে– লিখত : আমার আমলে আমাদের যেতে হত শহরের জেলে– একদিনের তরে (সে-ও এক মাসের ভিতর দিনটা বাছাই করে নেওয়া ‘আসামি’র এক্তেয়ারেই ছেড়ে দেওয়া হত, বাইরে থেকে আপন খানা আনানো যেত, এবং যেহেতু যেসব সহযুযুধানবর্গ সে যাত্রায় পালাতে। সক্ষম হয়েছিলেন, তাঁরা নেমকহারাম নন, তাঁরাই চাঁদা তুলে উত্তম লঞ্চ ডিনার বাইরে থেকে পাঠাতেন); কিংবা (ভারতীয় মুদ্রায়) সোয়া তিন টাকা জরিমানা দান– যথা অভিরুচি।
কিন্তু প্রশ্ন, এতগুলো পুলিশ সে রাত্রে হঠাৎ একজোট হল কী করে?
খাঁটি বন্ বাসিন্দারা আমাদের যুদ্ধে নিরপেক্ষ কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট কাঁকর বা সোডার ছিপি যদি তার জানালায় লেগে গিয়ে তার নিদ্রাভঙ্গ করে তবে সে জানালা খুলে কটুবাক্য আরম্ভ করার পূর্বেই আমরা অকুস্থল ত্যাগ করি। কেউ কেউ আবার হঠাৎ এক ঝটকায় জানালা খুলে আমাদের মাথার উপর ঢেলে দেয় এক জাগ হিমশীতল জল। আমরা অবশ্য এ-জাতীয় অহেতুক উদ্ৰবের জন্য সদাই সতর্ক থাকি।
কিন্তু আজ ছিল আমাদের পড়তা খারাপ। টেওডরের সক্কলের পয়লা বুলেট, বা সোডার ছিপি, যাই বলুন, পড়ে একদম পাশের ফ্ল্যাটে এক নবাগত বিদেশির জানালায়– কেন যে বিদেশিগুলো বন-শহরটাকে বিষাক্ত করার জন্য আসে, আল্লায় মালুম– সে কিন্তু জানত, বন্ শহরের খাস বাসিন্দারা এই (মোর দ্যান) হানড্রেড ইয়ার ওয়ারে ভদ্র সুইটজারল্যান্ডের মতো সেই যুদ্ধারম্ভের রাত্রি থেকেই নিরপেক্ষ জোর কটুকাটব্য (অর্থাৎ ডিপ্লোমাটিক প্রটেস্ট)। কিংবা এক জাগ জল। তা সে এমন কীই-বা অপকর্ম? ইউরোপীয়রা তো চান করে একমাত্র যখন জাহাজ-ডুবি হয়। জল ঢেলে সে তো পুণ্যসঞ্চয় করল, ডাক্তারদের শ্রদ্ধাভাজন হল। কিন্তু আজকের এই বিদেশি পাপিষ্ঠটা কটুবাক্য করেনি, জল ঢালেনি, করেছে কী, সে-ফ্ল্যাটে ফোন ছিল বলে চুপিসাড়ে ফাঁড়ি-থানাকে জানিয়ে দিয়েছে। ওদিকে আবার ইয়ার টেওডরের অগুনতি সখা এই শহরে। এবং বছর দুই ধরে সে প্রাগুক্ত পদ্ধতিতে শহরে এ-মহল্লায়, ও-মহল্লায় শনির রাতে– এবং সেটা যত গম্ভীর হয় ততই উমদা– আজ একে, পরের শনিতে অন্য কাউকে জাগাবার চেষ্টা করে যাচ্ছে। পুলিশ বিস্তর গবেষণার পর লক্ষ করল যে সর্বত্রই ওয়ার্কিং মেথড বা মডুস অপেরান্ডি হুবহু এক– বড় বড় ব্যাঙ্ক-ডাকাতরা যে রকম পুলিশের এই জাতীয় গভীর গবেষণার ফলেই শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে। তাই তারা সেই ডেঞ্জরস ক্রিমিনাল টেওডরের প্রতীক্ষাতেই ছিল।
আর আপনাদের সেবক এই অধম? সে কি কখনও ধরা পড়েছিল?
.
০৩.
অধীর পাঠক! শান্ত হও, তোমার মনে কী কুচিন্তা সে আমি জানি; ইতোমধ্যে ওই বাবদে দু খানা চিঠিও পেয়েছি, আমার কিন্তু কিন্তু ভাবটা যাচ্ছে না। আমি জানি, তোমার জ্ঞানতৃষ্ণা প্রবল, তাই জানতে চাও আমি কখনও ধরা পড়ে শ্রীঘরবাস করেছিলুম কি না। আমার সে দুরাবস্থার(৩) বর্ণনা শুনে তোমার হৃদয়মনে কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে সেই নিয়ে আমার দুর্ভাবনা। তা হলে একটি ছোট কাহিনী দিয়ে আমার সঙ্কোচটা বোঝাই।
মাত্র কয়েকদিন আগে, ১৬ অগ্রহায়ণ, আমরা স্বৰ্গত গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুদিন পালন করলুম। এঁর বহু বহু সদ্গুণ ছিল, তার অন্যতম, তিনি নিজে সাহিত্য নাট্য সৃষ্টি করুন আর না-ই করুন, সে যুগের সবাই মেনে নিয়েছিলেন যে তাঁর মতো শাস্ত্রজ্ঞ রসজ্ঞ জন বাংলা দেশে বিরল এবং সুদ্ধমাত্র রসজ্ঞ হিসেবে অদ্বিতীয়। তাই কাঁচা-পাকা সর্ব লেখকই তাঁকে তাদের বই পাঠিয়ে মতামত জানতে চাইতেন। ওদিকে গুরুদাস ছিলেন কর্মব্যস্ত পুরুষ। সেই উঁই আঁই বই পড়ে স্বহস্তে উত্তর লেখার তার সময় কই? তাই একখানা পোস্টকার্ডে যা ছাপিয়ে নিয়েছিলেন তার মোটামুটি মর্ম এই : ‘মহাশয়, আপনার পাঠানো পুস্তকের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই। আমি উহা মনোযোগ সহকারে পড়িয়াছি। সত্য বলিতে কি পড়িতে পড়িতে–’ এখানে এসে থাকত একটা লম্বা লাইন এবং তার উপরে ছাপা থাকত, হাস্য সম্বরণ করিতে পারি নাই এবং লাইনের নিচে ছাপা থাকত, ‘অশ্রু সম্বরণ করিতে পারি নাই।’ তিনি নাকি পাঠানো বইখানা পড়ে যথোপযুক্তভাবে হয় লাইনের উপরে হাস্য সম্বরণ বা নিচের ‘অশ্রু সম্বরণ’ কেটে দিতেন। তিনি ছিলেন অজাতশত্রু, তাই নিশ্চয়ই কোনও বদরসিক কাহিনীটির সঙ্গে আরও জুতে দিত যে, অধিকাংশ স্থলেই তিনি নিজে বইখানি পড়তেন না, তার সেক্রেটারি সেটি পড়ে বা না পড়ে উপরের হাস্য কিংবা নিচের ‘অশ্রু’ কেটে দিত।(৪)
তাই আমার কিন্তু-কিন্তু, তুমি লাইনের উপরের না নিচের, কোন বাক্যটি কাটবে– আমার কাহিনী শুনে। তা সে যাকগে, বলেই ফেলি। কোন দিন আবার দুম করে মরে যাব।
পূর্বেই নিবেদন করেছি, চিতেবাঘ হরিণের পালের গোদাটাকেই সবসময় ধরবার চেষ্টা করে। তারই পিছনে ধাওয়া করে যখন সব কটা এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে পড়ে– শহরের পুলিশও ঠিক সেই রকম আমাদের মতো ‘পিশাচ-সম্প্রদায়ে’র সবচেয়ে হোঁৎকাটাকেই ধরবার চেষ্টা করত, আমরা যখন তাড়া খেয়ে হরিণের টেকনিকই অনুসরণ করে ইদিকের-ওদিকের গলিতে ছড়িয়ে পড়তুম। কিন্তু কিছুদিন পরে আমরা লক্ষ করলুম, একই গোদাকে বারবার শিকার করে পুলিশ যেন আর খাঁটি স্পোর্টসম্যানের নির্দোষানন্দ লাভ করছে না। তখন তারা দুসরা কিংবা তেসরা মোটুকাটাকে ধরবার চেষ্টা করতে লাগল। তাদের ট্রেনিং হচ্ছে, আমোগোরও। কখনও তারা জেতে, কখনও আমরা জিতি। সেই যে গুলিশোর শিকারি বয়ান দিচ্ছিল, ‘তার পর আমি তো ফইর করলুম বন্দুক, আর কুত্তাকেও দিলুম শিকারের দিকে লেলিয়ে। তার পর বন্দুকের গুলি আর কুত্তাতে কী রেস্! কভি কুত্তা কভি গোলি, কভি গোলি কভি কুত্তা!’ আমাদের বেলাও তাই, ‘কভি ইসটুডেন্ট কভি পুলিশ, কভি পুলিশ কভি ইসটুডেন্ট!’ আমার অবশ্য কোনওই ডর ভয় ছিল না। কারণ আমি তখন এমনিতেই ছিলুম বেহ রোগা টিঙটিঙে পাঁচ ফুট সাড়ে ছ ইঞ্চি নিয়ে একশ’ পাঁচ পৌন্ড ওজন অর্থাৎ হোঁৎকা মোটকা জর্মন সহপাঠীদের তুলনায় তো আধটিপ নস্যি! তদুপরি আমি সর্বদাই সুনির্মল বসুর সেই তিরস্কারটি মনে রাখি, ‘বাঙালি হয়েছ, পালাতে শেখনি!’
কিন্তু বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, এই রাত্রে দেখি, পুলিশ অন্য ব্যবস্থা করেছে। এতদিন যেই আমি একা হয়ে যেতুম, পিছনে আর বুটের শব্দ শুনতে পেতুম না। সে রাত্রে দেখি, পুলিশ নিতান্ত আমাকেই ধরবার জন্য যে মনস্থির করেছে তাই নয়, আগের থেকে, বেশ সুচিন্তিত ফাইভ ইয়ারস প্ল্যানিং করে যেন জাল পেতেছে। আমি তাড়া খেয়ে যেদিকেই যাই, পিছনে তো বুটের শব্দ শুনতে পাই-ই, তদুপরি দেখি, ওই দূরে গলির মুখে আরেকটা পুলিশ দাঁড়িয়ে রয়েছে- যেন বিরহজর্জরিত ফিলমের নায়ক প্রোষিতভর্তৃকা নায়িকাকে আলিঙ্গনার্থে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু আমি মহাভারত পড়েছি, জানি, এ আলিঙ্গন হবে ধার্তরাষ্ট্র। অতএব মারি গুত্তা অন্য বাগে।
অনেকক্ষণ ধরে এই খেলা চলল। ইতোমধ্যে আমি কয়েক সেকেন্ডের তরে সব পুলিশের দৃষ্টির বাইরে; এবং সঙ্গে সঙ্গে ঢুকলুম একটা পাবে। ঝটকা মেরে বার থেকে অন্য কারও অর্ডারি এক কাপ কঞ্চি যেন ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে বসলুম, ‘পাব’-এর সুদূরতম প্রান্তে। সঙ্গে সঙ্গে ঢুকল একটা পুলিশ।
খাইছে। এবারে এসে পাকড়াবে। বৈদ্যরাজ চরক বলেন, ‘এ অবস্থায় হরিনামের বটিকা খেয়ে শুয়ে পড়বে!’
সে কিন্তু হাঁপাতে হাঁপাতে প্রথমটায় ‘বার’ কিপারের মুখোমুখি হয়ে আমার দিকে পিছন ফিরে এক গেলাস বিয়ার কিনে একটা অতি দীর্ঘ চুমুক দিলে। আমি বুঝলুম, মাইকেল সত্যই বলেছেন, সীতাদেবীকে রাবণের রাক্ষসী প্রহরিণীরা কোনও গাছতলায় বসিয়ে বেপরোয়া ঘোরাঘুরি করত।
‘হীনপ্রাণা হরিণীরে রাখিয়া বাঘিনী।
নির্ভয় হৃদয়ে যথা ফেরে দূর বনে’
গদ্যময় ইংরেজিতে যাকে বলে নিতান্তই ‘ক্যাট অ্যান্ড মাউস প্লে’। বরঞ্চ রবীন্দ্রনাথেরটাই ভালো, ‘এ যেন পাখি লয়ে বিবিধ ছলে শিকারি বিড়ালের খেলা!’
এবারে সে গেলাস হাতে করে ‘বার’-এর দিকে পিছন ফিরে আমার দিকে মুখ করে তাকাল।
আমিও অলস কৌতূহলে একবার তার দিকে তাকালুম। ‘পাব’-এ নতুন নিরীহ খদ্দের ঢুকলে যেরকম অন্য নিরীহ খদ্দের তার ওপর একবার একটি নজর বুলিয়ে অন্যদিকে চোখ ফেরায়।
আমি যদিও তখন মাথা নিচু করে কাপের দিকে তাকিয়ে আছি– যেন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে বৈজ্ঞানিক অণুপরমাণু পর্যবেক্ষণ করছেন– তবু স্পষ্ট বুঝতে পারলুম, লোকটা কী ভাবছে। তার পর শুনলুম, ‘গুটে নাখট’! আমি মাথা তুলে দেখি পুলিশ তার বিয়ার শেষ করে ‘পাব’ওয়ালাকে ‘গুডনাইট’ জানিয়ে চলে যাচ্ছে। (জর্মনির অলিখিত আইন, ‘বিয়ার খাবে ঢক ঢক করে, ওয়াইন খাবে আস্তে আস্তে!’)।
ঠিক বুঝতে পারলুম না কেন? তবু হাঁপ ছেড়ে বাঁচলুম বলিনি। এদের তো রাবণের গুষ্টি। এবার যিনি আসবেন, তিনি এঁয়ার মতো বাপের সুপুত্তুর না-ও হতে পারে। আবার বাইরে যাবারও উপায় নেই। জাল গুটিয়ে সবাই চলে গেছেন, না ঘাপটি মেরে বসে আছেন, কে জানে?
ঘণ্টাখানেক পর যখন ‘পাব’ নিতান্তই বন্ধ হয়ে গেল, তখন দেখি সব ফাঁকা। তবু সাবধানের মার নেই। অকুস্থলের উল্টো মুখে রওনা দিয়ে অনেকখানি চক্কর খেয়ে বাড়ি ফিরলুম ‘তড়পত হুঁ জৈসে জলবিন মীন হয়ে।’
***
তার দু-তিন দিন পর সকালবেলা যখন পাত্তাড়ি নিয়ে য়ুনি (ভার্সিটি) যাচ্ছি, তখন একজন পুলিশ হঠাৎ সামনে দাঁড়িয়ে বুটের গোড়ালি গোড়ালিতে ক্লিক করে আমাকে সেলুট দিলে। আমি হামেশাই পুলিশের সামনে ভারি সুবিনয়ী– বার তিনেক ‘গুটেন মর্গেন’ ‘গুটেন মর্গেন’ বললুম, যদ্যপি একবারই যথেষ্ট।
কোনও প্রকারে লৌকিকতা না করে সোজা শুধোলে, ‘তুমি ইন্ডিয়ান?’
তালেবর পুলিশ মানতে হবে! বলেছে ‘ইন্ডার’। ‘ইন্ডিয়ানার’ বা রেড ইন্ডিয়ান বলেনি। এদেশের অধিকাংশ শিক্ষিত লোকও সে পার্থক্যটি জানে না। বললুম, ‘হ্যাঁ।’–
শুধোলে, ‘এখান থেকে ইন্ডিয়া কতদূর?’
আমি বললুম, ‘এই হাজার পাঁচেক মাইল হবে। সঠিক জানিনে, তবে জাহাজে যেতে বারো-তেরো দিন লাগে।’
বললে, ‘বাপ-মা এই পাঁচ হাজার মাইল দূরে পাঠিয়েছে বাদরামি শেখবার জন্যে?’
এতক্ষণে আমার কানে জল গেল। বুঝলুম উইথ রেফারেন্স্ টু দি কনটেকসট যে, লোকটা সেই রাত্রের আমাদের দলের দুষ্কর্ম এবং পরবর্তী লুকোচুরির কথা পাড়ছে। আমি তবু নাক-টিপলে-দুধ-বেরোয়-না গোছ হয়ে বললুম, ‘কিসের বাঁদরামি?’
জৰ্মনে ‘ন্যাকা’ শব্দের ঠিক ঠিক প্রতিশব্দ নেই। কিন্তু যে কটি শব্দ পুলিশম্যান প্রয়োগ করলে তার অর্থ ওই দাঁড়ায়। তার পর নামল সম্মুখ সমরে! বললে, ‘সেরাত্রে কয়েক সেকেন্ডের জন্য চোখের আড়াল হয়ে যেতে পেরেছিলে বলে তোমাকে ধরিনি। এবার কিন্তু ছাড়ব না।’
‘অনেক ধন্যবাদ!’ তার পর আমিও রণাঙ্গনে নেমে বেহায়ার মতো বললুম, ‘সে দেখা যাবে।’
যেন একটু দরদী গলায় বললে, ‘কিন্তু কেন, কেন এসব কর?’।
আমি তখন একটু নরম গলায় বললুম, ‘এদেশে কি শুধু য়ুনিতে পড়তেই এসেছি? ওদেশে বসেও তো এ-দেশের বই কিনে পড়া যায়। আমি এসেছি সব শিখতে আর-সব স্টুডেন্টরা যা করে, তাই করি।’
‘সব ছেলে এরকম বাদরামি করে?’
আমাকে বাধ্য হয়ে স্বীকার করতে হল, সবাই করে না।
‘তবে?’
তখন বললুম, ‘ব্রাদার শোনো। এই স্টুডেন্ট বনাম পুলিশ লড়াই সর্বপ্রথম আরম্ভ হয় চতুর্দশ শতাব্দীতে হাইডেলবের্গে। এখানে আরম্ভ হয় ১৭৮৬-তে। তার পর কয়েক বছর মুনি বন্ধ ছিল– কেন, সঠিক জানিনে, বোধ হয় নেপোলিয়ন তার জন্য দায়ী– ফের য়ুনি খোলার সঙ্গে সঙ্গে ১৮১৮ থেকে। এবারে তুমিই কও, বুকে হাত দিয়ে এই আমরা আজ যারা স্টুডেন্ট, আমরা যদি আজ লড়াই ক্ষান্ত দিই তবে ভবিষ্যৎ-বংশীয় স্টুডেন্টরা ইতিহাসে লিখে রাখবে না—‘অতঃপর বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে একদল কাপুরুষ ছাত্র আগমনের ফলে তাহাদের মধ্যে একটা অপদার্থ ইন্ডিয়ানও ছিল সেই সংগ্রাম বন্ধ হইয়া যায় স্টুডেন্টরা পরাজয় স্বীকার করিয়া লইল।’ তার পর ভারতীয় নাটকীয় পদ্ধতিতে ‘হা হতোস্মি করার পর বললুম, ‘এই যে মহাকবি হাইনে, তিনি পর্যন্ত এখানে–’।
এই করলুম ব্যাকরণে ভুল। বাধা দিয়ে শুধোলে, ‘তুমি তার মতো কবিতা লিখতে পারো?’
নিশারণে সে জিতেছিল না আমি জিতেছিলুম, সেটা সমস্যাময়, সেটাকে ‘ড্র’ বললেও বলা যেতে পারে, কিন্তু দিবাভাগে এই তর্ক-যুদ্ধে আমি হার মেনে বললুম, ‘বাকিটা আর একদিন হবে, ব্রাদার। এখন তোমার নামটা বলো। সেই শনির রাত্রে যেখানে আমাদের প্রথম চারি চক্ষুর মিলন হয়েছিল সেখানেই দেখা হবে। আমি ফোন করে ঠিক করে নেব। এখন চলি, আমার ক্লাস আছে।’
সে হেসে যা বললে, সেটাকে বাংলায় বলা চলে, ‘ডুডু খাবে টামাকও ছাড়বে না। ’
***
এবারে ধরতে পারলে ছাড়বে না– সে তো বুঝলুম। ওদিকে এক মাস পরে আমার পরীক্ষা। তিনটে ভাইভা। শনির রাত জেগে তামাম রোববার শুধু মুখস্থ আর মুখস্থ। হাসি পায় যখন এদেশে শুনি, এখানে বড্ড বেশি মুখস্থ করানো হয়, মুখস্থ না করে কে কবে কোন দেশে কোন পরীক্ষা পাশ করেছে! তা সে পেসতালজির দেশেই হোক আর ফ্রোবেলের দেশ, এই জৰ্মনিতেই হোক। তাই আমাকে আর যুদ্ধে না ডেকে আমাদের ফিলড মার্শেল আমাকে রিজার্ভে রাখতেন। মাত্র এক রাত্রে ডাক পড়েছিল, তবে সেটা শহরের অন্য প্রান্তে। আর একদিন, সেই দৈত্যকুলের ‘প্রহ্লাদ-পো’টির সঙ্গে একটা ‘পাব’-এ বসে দু-দণ্ড রসালাপ করেছিলুম, লোকটি সত্যই অমায়িক।
***
এদেশে পরীক্ষার পূর্বে এত সাতান্ন রকমের কাগজপত্র মায় থিসিস্ ডিনের দফতরে জমা দিতে হয় যে, সবাই শরণ নেয় আনকোরা হালের যে দু দিন আগে পাশ বা ফেল করেছে, তারাই শুধু এসব হাবিজাবির লেটেস্ট খবর রাখে। সেরকম দু জনা অনেকক্ষণ ধরে বসে, দফে দফে একাধিক বার মিলিয়ে নিয়ে এক বান্ডিল কাগজ, ফর্ম, সার্টিফিকেট আমাকে দিয়ে বললে, এইবারে যাও বত্স, ডিনের দফতরে। সব মিলিয়ে দিয়েছি। আর, শোন, সব কাগজের নিচে রাখবে একখানা পাঁচ মার্কের (তখনকার কালে পাঁচ টাকার একটু কম) নোট। এটা কেরানির অন্যায্য প্রাপ্য– কিন্তু পূর্ণ শত বৎসরের ঐতিহ্য।
দুরু দুরু বুকে– প্রায় নার্ভাস ব্রেকডাউনের সীমান্তে পৌঁছে– দাঁড়ালুম গিয়ে ডিনের দতরে, কাউন্টারের সামনে। পাঁচ টাকার চেয়ে বেশিই রেখেছিলুম।
যে কেরানি এসে সম্মুখে দাঁড়ালেন তাঁর অ্যাব্বড়া হিন্ডেনবুর্গি গোঁফ, আর বয়েসে বোধ হয় তিনি মুনির সমান। সাতিশয় গম্ভীর কণ্ঠে আমার গুডমর্নিঙের কী একটা বিড়বিড় করে উত্তর দিয়ে দফে দফে কাগজ গুনলেন, টাকাটা কি কায়দায় যে সরালেন ঠিক ঠাহর করতে পারলুম না। কিন্তু মুখে হাসি ফুটল না। বরঞ্চ গম্ভীর কণ্ঠ গম্ভীরতর করে শুধোলেন, ‘অমুক সার্টিফিকেটটা কই?’
আমি তো সেই দুই যোগানদারদের ওপর রেগে টঙ। পই পই করে আমি শুধিয়েছি, ওরা আরও পই পই করে বলেছে, সব কাগজ ঠিকঠাক আছে, এখন এ কী গেরো রে বাবা! বুঝলুম, কী একটা সার্টিফিকেট আনা হয়নি। কিন্তু সে সার্টিফিকেট কিসের, কোনওই অনুমান করতে পারলুম না। যোগানদারদের মুখেও শুনিনি।
ভয়ে ভয়ে শুধালুম, ‘কী বললেন স্যর!’
এবার যেন নাভিকুণ্ডলী থেকে ফৈয়াজখানি কণ্ঠে কী একটা বেরুল।
গুরু-মুর্শিদ, ওস্তাদ-মুরুব্বিদের আশীর্বাদ-দোওয়া আমার ওপর নিশ্চয়ই ছিল; হঠাৎ অর্থটা মাথার ভেতরে যেন বিদ্যুতের মতো ঝিলিক মেরে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে আপন অজান্তে একগাল হেসে বলে ফেলেছি, ‘চেষ্টা তো দিয়েছি, স্যার, দু বচ্ছর ধরে প্রায় প্রতি শনির রাত্রে মাফ করবেন স্যার বলা উচিত রবির ভোরে। তা ওরা ধরতে না পারলে আমি কী করব?–বললে পেত্যয় যাবেন না স্যার–’।
ইতোমধ্যে বুড়ো হঠাৎ ঠাঠা করে হেসে উঠেছেন। যেমন তার গাম্ভীর্য তেমন তার হাসি। বিশেষ করে তার বিরাট গোপজোড়ার একটা দিক নেমে যায় নিচে, তো অন্যটা উঠে যায় উপরের দিকে। সে হাসি আর থামে না। ইতোমধ্যে ছোকরা কেরানিরাও হাসির রগড় দেখে তার চতুর্দিকে এসে দাঁড়িয়েছে। এবারে থেমে বললেন, ‘ধরা দেবার চেষ্টা করলে, আর ওরা ধরতে পারল না, এটা কী রকম কথা?’
আমি বললুম, ‘যে-পুলিশ আরেকটু হলে ধরতে পারত, তাকে সাক্ষী স্বরূপ হাজির করতে পারি যে, আমি চেষ্টার ত্রুটি করিনি, এই জেলে যাবার সার্টিফিকেট যোগাড় করার।’
সংক্ষেপে বললেন, ‘খুলে কও।’
আমি সেই প্রকৃতির লোক যারা নার্ভাস ব্রেকডাউনের ভাঙন থেকে পড়ি-পড়ি করতে করতে বেঁচে গিয়ে হঠাৎ নিষ্কৃতি পেয়ে হয়ে যায় অহেতুক বাঁচাল।
সে-ও আরেক রকমের নার্ভাসনেস্। গড় গড় করে বলে গেলুম, পুলিশের সেই জাল পাতার কাহিনী বিশেষ করে আমার উপকারার্থে—‘পাব’-এর ভিতরকার বয়ান ও সর্বশেষে সেই পুলিশম্যানের সঙ্গে পথিমধ্যে আমার যম-নচিকেতা কথোপকথন। বক্তৃতা শেষ করলুম, দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে, ‘এরপর এই পরীক্ষায় পড়া নিয়ে বড় ব্যস্ত ছিলুম বলে সলিড কিছু করে উঠতে পারিনি, স্যার। শুধু ওই যে, দিন পনেরো আগে হঠাৎ এক সকালে দেখা গেল লর্ড মেয়ারের বিরাট দফতরের উচ্চতম টাওয়ারে একটা ছেঁড়া ছাতা বাঁধা, বাতাসে পৎপৎ করছে, ফায়ার ব্রিগেড পর্যন্ত নামাতে পারেনি, ওই উপলক্ষে অধীন কিঞ্চিৎ, অতি যৎকিঞ্চিৎ সাহায্য করতে—’
একজন ছোকরা কেরানি আঁতকে উঠে বললে, ‘সর্বনাশ! ওটার তালাশি যে এখনও শেষ হয়নি!’
বুড়ো বললেন, ‘আমরা তো কিছু শুনছি না।’
বুড়োর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরুতে গেলে তিনি কাউন্টারের ফ্ল্যাপটা তুলে আমার সঙ্গে দোর পর্যন্ত এলেন– পরে শুনলুম, এ-রকম বিরল সম্মান ইতোপূর্বে নাকি মাত্র দু-একজন বিদেশিই পেয়েছেন। আমি কিছু শুধাবার পূর্বেই তিনি যেন বুঝতে পেরে তাঁর মাথাটি আমার কানের কাছে নিচু করে, এবং সঙ্গে সঙ্গে বুড়ো আঙুলের ডগা বুকে ঠুকে ঠুকে ফিসফিস করে বললেন, ‘আমি তিনবার, আমি তিনবার!’ তার পর অত্যন্ত সিরিয়াসলি শুধোলেন ‘বছর তিনেক পূর্বে এক ডাচ স্টুডেন্ট বললে বুঝতেই পারছ, এ রসিকতাটা আমি শুধু বিদেশি ছাত্রদের সঙ্গেই করে থাকি, সুন্ধুমাত্র জানবার জন্য, তারা কতখানি সত্যকার জর্মন ঐতিহ্যের যুনি ছাত্র হতে পেরেছে। স্টুডেন্টরা নাকি ক্রমেই হারছে!’ কণ্ঠে রীতিমতো আশঙ্কার উৎপীড়ন।
আমি তাঁর প্রসারিত হাত ধরে হ্যান্ডশেক করতে করতে বললুম, ‘তিন বছর পূর্বে, ইয়া। কিন্তু তার পর জানেন তো, আমি আর আপনার মতো মুরুব্বিকে কী বলব, কৃষ্ণতম মেঘেরও রুপালি সীমান্তরেখা থাকে– এল জর্মনিতে অভূতপূর্ব বিরাট বেকার সমস্যা, যেটা এখনও চলছে। ফলে ছেলেরা ম্যাট্রিক পাস করে এদিকে-ওদিকে কাজে ঢুকতে না পেরে বাধ্য হয়ে ঢুকছে য়ুনিতে, আগে যেখানে ঢুকত একজন, এখন ঢেকে দশজন। ওদিকে সরকারের পয়সার অভাবে পুলিশের গুষ্টি না বেড়ে বরঞ্চ কমতির দিকে। আমরা এখন দলে ভারি, বস্তুত আমরা এখন নিশাচরবৃত্তি পরিত্যাগ পূর্বক দিবাভাগেই তাদের সম্মুখসমরে আহ্বান করতে পারি– করি না, শুধু শতাধিক বত্সরের ঐতিহ্য ভঙ্গ হবে বলে।’ তার পর একটু থেমে গম্ভীরতম কণ্ঠে বললুম, আর যদি কখনও সে দুর্দিনের চিহ্ন দেখি, তবে সেই সুদূর ভারত থেকে ফিরে আসব আ-মি। সামনের পরীক্ষায় পাশ করি আর ফেলই মারি, সেই পরাজয় প্রতিরোধ করার জন্য য়ুনিতে ঢুকে ছাত্র হব আবার-আ-মি।
‘আম্মো’।
১।১।৬৬
———-
১. অধীন পারতপক্ষে আপন বইয়ের বরাত দেয় না, কিন্তু এ-স্থলে নিতান্ত বাধ্য হয়ে নিবেদন, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখিত নির্বাসিতের আত্মকথা’র ওপরে মল্লিখিত প্রশস্তি ‘ময়ূরকণ্ঠী’তে পশ্য। তবে অনুরোধ এই, মূল বইখানা প্রথম পড়বেন। তারপর আমার বই পড়ার প্রয়োজন আশা করি আর হবে না।
২. এসব বাবদে জর্মনি-অস্ট্রিয়া একই ধরা হয়। হিটলার নিজে অস্ট্রিয়ান হয়েও জর্মনির ফ্যুরার হয়েছিলেন, এসব তো জানা কথা। উভয় দেশের ভাষাও এক।
৩. এ যুগের ছেলে-ছোকরারা বিদ্যাসাগর পড়ে না। বলতে দোষ নেই যে একদা এক পিতা-পুত্র বিদ্যাসাগর মশায়ের কাছে তাদের দুঃখের কাহিনী শেষ করলে এই বলে, আমাদের দুরাবস্থাটা দেখুন। বিদ্যাসাগর নাকি মুচকি হেসে বললেন, তা সেটা আকার (আ-কার) থেকেই বুঝতে পারছি।
৪. ভিক্টর ঝুগো (Hugo) সম্বন্ধে বলা হয়, একবার এক অখ্যাতনামা কবি যুগোকে তাঁর কবিতার বই পাঠিয়ে তাঁর মতামত জানতে চাইলেন। সঙ্গে সঙ্গে যুগোর সানন্দ অভিনন্দন এসে পৌঁছল সেই কবির হাতে, তাঁর কাব্যসৃষ্টির অজস্র প্রশংসাবাদ করে ঝুগো শেষ করেছেন এই বলে, ‘হে নবীন কবি, আমি তোমাকে সাদর আলিঙ্গন করে ফ্রান্সের কবিচক্রের আমন্ত্রণ জানাই। তিন দিন পরে বুক-পোস্টে পাঠানো কবির সেই কবিতার বই ফেরত এল তার কাছে। উপরের পিঠে পোস্ট অফিসের রবার স্ট্যাম্পে ছাপ, যথেষ্ট টিকিট লাগানো হয়নি বলে গ্রহণকারী বেয়ারিং হারে ফালতো পয়সা দিতে নারাজ, অতএব প্রেরকের কাছে ফেরত পাঠানো হল।’
দর্শনাতীত
ছন্নের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি বিরাট বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডরে। সবে এসেছি ‘দ্যাশ’ থেকে– হাইকোর্টটি দেখিয়ে দেবার মতো কোনও খাটাশকে পাচ্ছিনে। কিন্তু রমণীজাতি দয়াশীলা– বেদরদীরা বলে হরবকৎ শিকার-সন্ধানী–আমার সঙ্গে কথা কইলে নিজের থেকে। আমি তখন বিবর্ণ বিস্বাদ বদখদ কোনও এক মাংস, ততোধিক বিজাতীয় হর্স-ক্যাবেজ (সচরাচর এ বস্তু ঘোড়া ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের দেওয়া হয়) খাবার চেষ্টা করছি, চোখের জলে নাকের জলে। সব শুনে বললে, ‘দর্শন? তা হলে শ্নিটকে মিস করো না; বুড়ার বয়স আশি পেরিয়ে গেছে, কখন যে পটল তুলবে (জর্মনে বলে ‘আপজেগলেন’) ঠিক নেই।’
পোড়ার দেশে লেকচার-রুমে সিট রিজার্ভ করতে হয়। প্রাগুক্ত যুবতীটি ধানীলংকার মতো এফিশেন্ট। সাত দিন পরে প্রথম লেকচারে গিয়ে দেখি, একদম পয়লা কাতারে পাশাপাশি দু-খানা চেয়ার রিজার্ভ করে বসে আছে প্রফেসারের চেয়ার থেকে হাত আষ্টেক দূরে।
অধ্যাপক এলেন ঘণ্টা পড়ার মিনিট পাঁচেক পরে। বয়েস আশি না, মনে হবে সোয়া শো– যেভাবে আস্তে আস্তে পা ফেলে ফেলে ঘরে ঢুকলেন। ইয়া বিরাট লাশ। ফ্রলাইন উজুল লাফ দিয়ে গেলেন তার দিকে। বুড়ো রোষ-কষায়িত লোচনে তার দিকে তাকিয়ে হাত দু খানা অল্প তুলে ধরলেন। উরজুল একদিকের ওভারকোটটা তার দেহ থেকে মুক্ত করার পর তিনি অতি কষ্টে শরীরে একটু মোচড় দিলেন। এই গুহ্যতম তান্ত্রিক মুষ্টিযোগ প্রসাদাৎ তিনি তাঁর ওভারকোটের নাগপাশ থেকে মুক্তিলাভ করলেন। শেষনাগকেও বোধ হয় তাঁর বাৎসরিক খোলস থেকে মুক্ত হতে এতখানি মেহন্নত বরদাস্ত করতে হয় না।
ধীরে ধীরে প্ল্যাটফর্মে উঠে চেয়ারে আসন নিলেন। সচরাচর অধ্যাপকরা প্ল্যাটফর্মের নিকটতম কোণে উঠেই বক্তৃতা ঝাড়তে আরম্ভ করেন। ইনি চুপচাপ বসে রইলেন ঝাড়া পাঁচটি মিনিট। ধবধবে সাদা কলারের উপর হাঁড়িপানা তার বিরাট মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি তাতে অন্তত ডজনখানেক কাটাকুটির দাগ। লেকচার আরম্ভ না হওয়া পর্যন্ত ফিসৃফিস্ করে কথা কইতে বারণ নেই। আমি উরজুলকে শুধালুম, মুখে ওগুলো কিসের দাগ?
‘ফেনসিঙের। সিনেমাতে দেখনি, লম্বা সরু লিকলিকে তলওয়ার দিয়ে একে অন্যের কলিজা ফুটো করার পাঁয়তারা কষে? পষ্ট বোঝা সাচ্ছে, তলওয়ার নাকের কাছে এলেও ইনি পিছু-পা তো হইনি, মাথাটা পর্যন্ত পিছনের দিকে ঠেলে দেননি। প্রত্যেকটি কাটাতে ক’টা স্টিচ লেগেছিল ওঁকে শুধোতে পার।’
আমি বললুম, ‘উনি-না দর্শনের অধ্যাপক!’
‘হ্যাঁ, কিন্তু বাপ-পিতামো ছিলেন কট্টর প্রাশান ঐতিহ্যের পাঁড় জেনারেল গুষ্টি। তাদের বর্মের মতো শক্ত হৃদয় ভেঙে ইনি দর্শনের অধ্যাপক হয়ে গেলেন। কৈশোরে বোধ হয় সে মতলব ছিল না। তাই দুঁদে দুঁদে ফেনসারদের চ্যালেঞ্জ করে এসব অস্ত্র-খেলার কলেকশন আপন মুখে নিয়ে বাকি জীবন দর্শন পড়াচ্ছেন। তাইতে বাপ-দাদার ততোধিক মনস্তাপ যে, এমন পয়লানম্বরি তলওয়ারবাজ হয়ে গেল মেনিমুখো মেস্টার-মেলের একজন।’
আমি বললুম, ‘পেন ইজ মাইটিয়ার দেন সোর্ড!’
‘ছোঃ! ভদ্রলোক জীবনে এক বর্ণ কাগজে কলমে লেখেননি– সাত ভলুমি কেতাব দূরে থাক, এক কলমের প্রবন্ধ পর্যন্ত না। কলমই ওঁর নেই। বোধ হয় টিপসই দিয়ে–’
অধ্যাপক ছাদ-ছোঁয়া গ্যালারির উপর-নিচ ডান-বাঁর উপর চোখ বুলিয়ে আরম্ভ করলেন– ওহ্, সে কী গলা! যেন নাভিকুণ্ডলী থেকে প্রণবনাদ বেরুচ্ছে, ‘মাইনে ডামেন্ উনট হেরেন।’—‘আমার মহিলা ও মহোদয়গণ!’ তার পর গলায় দম নিয়ে বললেন, ‘অন্যবারের মতো এবারেও আমি রেকটরকে’ –তার পর গলা নামিয়ে বিড়বিড় করে বললেও সমস্ত ক্লাসই শুনতে পেল ‘আস্ত একটা গাধা–’
আমার তো আক্কেল গুড়ুম। রেকটর যিনি কি না বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বময় কর্তা, তাঁকে গর্দভ বলে উল্লেখ করা– তা সে বিড়বিড় করেই হোক আর রাসভকণ্ঠেই হোক– এ যে অবিশ্বাস্য!
অধ্যাপক বলে যেতে লাগলেন, ‘রেকটরকে আমি অনুরোধ জানালুম, আমাকে এই টার্ম থেকে নিষ্কৃতি দিতে। অর্বাচীন বলে কি না, আমাকে না হলে তার চলবে না। এ উত্তর আমি ইতোপূর্বেই শুনেছি। তার পূর্বের রেকটর–’ আবার বিড়বিড় করলেন, ‘বলদ, বলদ! স্রেফ বলদ— তাকেও আমি একই অনুরোধ করেছিলুম, এবং একই উত্তর পেয়েছিলুম। তার পূর্বেই রেকটর কিন্তু কাহিনী সম্প্রসারিত করার প্রয়োজন নেই এবং তার পূর্বেরও সবাই একই উত্তর দেয়। বস্তুত, মাইনে ডামেন্ উট হেরেন, গত বাইশটি বৎসর ধরে আমি এই একই উত্তর শুনে আসছি। মনে হচ্ছে, অরিজিনালিটি রেকটর সম্প্রদায়কে এড়িয়ে চলেন। তা সে যাক, তাদের বক্তব্য, আমাকে ছাড়া চলবে না, আমি ইনডেনস্পে্নসিবল!’
এবার তিনি স্বয়ং সিন্ধি বলদের মতো ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘তবে কি সাতিশয় সন্তাপের সঙ্গে স্বীকার করতে হবে, জর্মনি এমনই চরম অবস্থায় পৌঁছেছে যে, এদেশে আর দার্শনিক নেই? কিন্তু এই আমার শেষ টার্ম। আমি মনস্থির করে ফেলেছি।’ তার পর চোখ বন্ধ করে খুব সম্ভব প্রথম বক্তৃতায় প্রথম কী বস্তু দিয়ে আরম্ভ করবেন তার চিন্তা করতে লাগলেন। উরজুল আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন, ‘তাঁর শেষ টার্ম! এ ভয় তিনি নিদেন পঁচিশ বচ্ছর ধরে দেখাচ্ছেন প্রতি টার্মের গোড়ায়।’ বুড়ার চোখ বন্ধ হলে কী হয়, কান দিব্য সজাগ। চোখ খুলে বললেন, ‘নো, আবার নো। এই আমার শেষ টার্ম কেউ ঠেকাতে পারবে না।’
তার পর গ্রিক দর্শন নিয়ে আরম্ভ করলেন। তাঁর পড়াবার পদ্ধতি অনুকরণ করা অসম্ভব। কারণ, তাঁর পড়ানোটা সম্পূর্ণ নির্ভর করত তাঁর স্মৃতিশক্তির ওপর। যে স্মৃতিশক্তি বিধিদত্ত। কোন সালের, কোন বইয়ের, কোন অধ্যায়ে, এমনকি মাঝে মাঝে কোন পাতায় কী তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে সেগুলো বলে যেতে লাগলেন কোনও প্রকারের নোট না দেখে। প্রত্যেকটি সেন্টেন্স স্বয়ংসম্পূর্ণ। ভাষা সরল। এবং মাঝে মাঝে তো, আরিস্তত বোঝাতে গিয়ে হঠাৎ মারেন দু হাজার বছরের ডুব-সাঁতার। এ যুগের কে তার সর্বোত্তম ব্যাখ্যা করেছেন, কোথায়, কোন পরিচ্ছেদে তার সবিশদ বর্ণন। আমি হতভম্ব।
ঘণ্টা পড়তে আস্তে আস্তে উঠলেন। ফ্রলাইন উরজুল তাঁকে পুনরায় ওভারকোট পরিয়ে দিলেন। ধীরে মন্থরে করিডরে নামালেন।
আমি উরজুলকে বললুম, ‘এ কী কাণ্ড! গণ্ডাখানেক রেকটরকে ইনি গাধা-বলদের সঙ্গে–?’
“ওহ্! এরা সবাই এসব জানেন। এঁরা সবাই তার ছাত্র।’
‘ওঁকে ছুটি দেয় না কেন?’
‘সক্কলেরই বিশ্বাস, সঙ্গে সঙ্গে তিনি পটল তুলবেন বলে। মাধ্যাকর্ষণ নয়, দর্শনাকর্ষণ তাকে ইহলোকে আটকে রেখেছে।’
এখানে রোল-কল হয় না। টার্মের গোড়াতে ও শেষে আপন আপন স্টুডেন্টস বুকে অধ্যাপকের নাম দু বার সই করিয়ে নিতে হয়।
গোড়ার দিকে ভিড় ছিল বলে হালকা হলে পর আমি আমার বুক’ নিয়ে পাতলুম। এযাবৎ অন্য কারও সঙ্গে তিনি বাক্যবিনিময় করেননি। আমাকে দেখে চেয়ারে আরামসে হেলান দিয়ে বললেন, “আহ! বাহ্ বাহ্! তার পর? আচ্ছা। বলুন তো আপনি কি জর্মন বেশ বুঝতে পারেন?’
আমি বললুম, ‘অল্প, অল্প।’
‘বেশ, বেশ। তা– তা, আমি কোন দেশ থেকে এসেছেন?’
‘ইন্ডিয়া।’
কেন যে এতখানি তাজ্জব হয়ে তাকালেন বুঝতে পারলুম না। বললেন, ইন্ডিয়া? কিন্তু ইন্ডিয়াই তো দর্শনের দেশ। আপনি এখানে এলেন কেন?’
আমি সবিনয়ে বললুম, ‘নিশ্চয়, কিন্তু আধুনিক দর্শনে জর্মনির সেবা ও দান তো অবহেলার বিষয় নয়।’
কী আনন্দে, কী গর্বে অধ্যাপকের সেই কাটাকুটি-ভরা মুখ যেন প্রসন্ন হাস্যে ভরে গেল, সেটি অবর্ণনীয়। শুধু মাথা দোলান আর বলেন, ‘বস্তুত তাই, প্রকৃতপক্ষে তাই।’
এবারেও যখন তিনি ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করলেন তখন আমি যে ‘তুমি’ শুনতে পেলুম। তার বিরাট সাদা মাথাটা আমার দিকে ঠেলে কাছে এনে বেদনা-ভরা গলায় বললেন, কিন্তু জানো, ভারতীয় দর্শন– অবশ্য সব দর্শনই দর্শন– শেখবার সুযোগ আমি পাইনি। ব্যাপারটা হয়েছে কী, আমার যৌবনে ভারতীয় দর্শনের জর্মন-ইংরেজি অনুবাদ পড়তে গিয়ে দেখি সব পরস্পরবিরোধী বাক্যে পরিপূর্ণ। আমি বললুম, “এ কখনই হতে পারে না। ভারতের জ্ঞানী। ব্যক্তিরা এরকম কথা বলতে পারে না। যারা অনুবাদ করেছেন তাঁরা কতখানি জর্মন জানেন জানিনে, কিন্তু দর্শন জানেন অত্যল্প, এবং ভারতীয় দর্শনে তাদের অপরিচিত যে দৃষ্টিভঙ্গি, দৃষ্টিকোণ সেটা আদৌ বুঝতে পারেননি।” ছেড়ে দিলুম পড়া, বিরক্তিতে। কিন্তু জানো, বছর দশেক পূর্বে আমার ছাত্র–’ তিনি রেকটরের নাম করলেন—‘অমুক ভারি ব্রিলিয়ান্ট ছেলে আমাকে বললেন, এখন নাকি কম্পিটেন্ট অনুবাদ বেরুচ্ছে। কিন্তু ততদিন আমি বড় বুড়িয়ে গিয়েছি। নতুন করে নতুন স্কুলে যাবার শক্তি নেই। বড় দুঃখ রয়ে গেল।’
আমি একটু ভেবে যেন সান্ত্বনা দিয়ে বললুম,’ তার জন্য আর অত ভাবনা কিসের, স্যার? হিন্দুরা পরজন্মে বিশ্বাস করে। আপনি এবারে জন্ম নেবেন কাশীর কোনও দার্শনিকের ঘরে।’
এবার তাঁর যে কী প্রসন্ন অট্টহাস্য! শুধু বললেন, ‘ওই তো! ওই তো! বাহ্ বাহ্! বেশ, বেশ। যাক, শেষ দুশ্চিন্তা গেল।’
তার পর শুধালেন, ‘বক্তৃতা সব বুঝতে পার তো?’
আমি বললুম, ‘আজ্ঞে, জর্মন ভালো জানিনে বলে মাঝে মাঝে বুঝতে অসুবিধে হয়।’
অধ্যাপক বললেন, ‘তখন হাত তুলো; আমি সব ভালো করে বুঝিয়ে বলব।’
আমি কাঁচু-মাঁচু হয়ে বললুম, ‘আমার জর্মন জ্ঞানের অভাববশত সমস্ত ক্লাস সাফার করবে– এটা কেমন যেন–’
গুরু গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললেন– প্রত্যেকটি শব্দ যেন আমার বুকের উপর হাতুড়ি দিয়ে ঠুকে ঠুকে– ‘আমি একশ’জনকে পড়াব, না একজনকে পড়াব, কাকে পড়াব আর কাকে পড়াব না, সেটা স্থির করি একমাত্র আমি।’
***
আমার দুর্ভাগ্য, আমি খুব বেশিদিন তাঁর কাছ থেকে শিক্ষালাভের সুযোগ পাইনি। পরের টার্মেই ওপারে চলে যান।
তার পর প্রায় ৩৫ বৎসর কেটে গিয়েছে। আমার ব্যক্তিগত সংস্কার যে, সৃষ্টিকর্তা মানুষকে পৃথিবী নামক জায়গাটিতে একবারের বেশি দু বার পাঠান না। একই নিষ্ঠুর স্থলে একাধিকবার পাঠিয়ে একই দণ্ড দেওয়ার মধ্যে কোনও বৈদগ্ধ্য (রিফাইনমেন্ট) নেই। তবু যখন কোনও যুবাজনের মুখে ভারতীয় দর্শন সম্বন্ধে আলোচনা শুনে মনে হয়, এ-তরুণ এর কিছুটা গভীরে ঢুকতে পেরেছে, তখন আপন অজান্তে তার চেহারায় জর্মনগুরুর বিরাট কাটাকুটি-ভরা, হাঁড়াপানা চেহারার সাদৃশ্য খুঁজি।
পঞ্চাশ বছর ধরে করেছি সাধনা
প্রথমেই নিবেদন জানাই, আকাশবাণীর বিরুদ্ধে আমার ব্যক্তিগত কোনও ফরিয়াদ নেই। কেন নেই, যখন চৌদ্দআনা পরিমাণ লোকের আছে, এসব তর্কের ভিতর আমি ঢুকতে নারাজ। বিশেষত যখন খুব ভালো করেই জানি, এই বিশ্ব-সংসারটা রিফর্ম করার গুরুভার আল্লা-তালা আমার স্কন্ধে চাপাননি। আমি শুধু আজ আকাশবাণী বাবদে একটি কাহিনী নিবেদন করব। শোনা গল্প। সত্য না-ও হতে পারে। তবে ক্যারেকটিরিস্টিক– অর্থাৎ গল্পটি শুনেই চট করে চোখের সামনে ভেসে ওঠে আকাশবাণীর একটি বিশেষ স্থূলাঙ্গের ছবি।
‘সুনন্দ’ রাগে বিতৃষ্ণায় বিকৃতকণ্ঠে তাঁর জুর্নালে ইন্টারভ্যু নামক প্রতিষ্ঠানটির ব্যঙ্গ করেছেন। হায় রে কপাল! তিনি কখনও ইন্টারভ্যুর রাজার রাজা ‘অডিশনিং’ নামক খাটাশটির দাঁত-ভ্যাংচানি দেখেছেন– ঈভন ফ্রম এ ভেরি লঙ সেফ ডিসটেন্স? তা হলে বুঝতেন ঠ্যালা কারে কয়। আমি স্বয়ং একাধিক ‘অডিশনিং’ বোর্ডের কর্মকর্তা ছিলুম বেশ কিছুকাল ধরে। আমার জানার কথা। কিন্তু আমি এ সুবাদে সম্পূর্ণ অন্য ধরনের একটি কাহিনী কীর্তন করব।
একদা ‘গ্রামে গ্রামে এই বার্তা রটি গেল’ যবে যে, বড় কি ছোট তাবৎ সঙ্গীতকাররা পরীক্ষা (এরই ‘ভদ্র’ নাম অডিশনিং) দিয়ে তবে গান গাইবার প্রোগ্রাম পাবেন, তখন পরীক্ষকদেরই একজন আপত্তি তুলে বললেন, ‘বাজারে যাঁদের গ্রামোফোন-রেকর্ড রয়েছে, এবং/কিংবা স্টুডিয়ো-রেকর্ড রয়েছে তাদের আবার অডিশনিং-এর কী প্রয়োজন?’ যাঁদের নেই তাদের কথা আলাদা, কিন্তু তখনকার দিনের আকাশবাণী রাজাধিরাজ স্বাধিকারমত্ত। মোকা যখন পেয়েছেন তখন ছাড়বেন কেন?
তখন, ধরুন, এই লখনৌ শহরে ছোট-বড় তাবৎ গাওয়াইয়া বাজানেওলারা একজোটে স্থির করলেন, তাঁরা পরীক্ষা দেবেন না। তাঁদের আপত্তি, যারা পরীক্ষা নেবে তারাই-বা সঙ্গীত-জগতের কী এমন বাঘ-সিঙ্গি?
আবার বলছি, এটা গল্প।
অবস্থা যখন চরমে তখন দুনিয়ার হালচাল বাবদে সম্পূর্ণ বেখেয়াল, লখনৌয়ের সবচেয়ে বড় ওস্তাদ একদিন ভোরবেলা শিষ্য-সমাবৃত হয়ে রেওয়াজ করতে করতে হঠাৎ শুধোলেন, ‘হ্যাঁ মিয়া, “আডিশনিং আডিশনিং” চারো তরফ লোগ শোরগোল মচা রহে হৈঁ, সো ক্যা বলা?’ (পাঠক, আমার উর্দুজ্ঞান সঞ্চিত হয়েছে কলকাতার পানওয়ালাদের দোকান থেকে– অপরাধ নিয়ো না, বরায়ে মেহেরবানি!) মোদ্দা কথা, তিনি জানতে চাইলেন, চতুর্দিকে যে এই আডিশনিং আডিশনিং রব উঠেছে, সেটা আবার কী বালাই (আপদ, গেরো)।
শিষ্যেরা প্রাঞ্জল ভাষায় সে ‘বালাইয়ের জন্ম’, বয়োবৃদ্ধি ও বর্তমান পরিস্থিতি গুরুকে বুঝিয়ে দিলেন, এবং তাদের কেউই যে এই অপমানকর প্রতিষ্ঠানের সম্মুখীন হবেন না সেটাও জানিয়ে দিলেন।
গুরু তাজ্জব মেনে বললেন, ‘সে কী? ইমতিহান-পরীক্ষা দিতে তোমাদের কী আপত্তি? ভেবে দেখো আমি যখন বিরাট জলসায় গান ধরি তখন কি শেষ কাতারের পানওয়ালাটা পর্যন্ত আমার পরীক্ষা আরম্ভ করে দিয়ে ভাবে না, আমি রসসৃষ্টি করতে পারব কি না, তার দিল ভিজিয়ে নরম করতে পারব কি না? সোজা কথায় বলতে গেলে, মহফিলের সবাই প্রতিবারেই আমার পরীক্ষা নেয়। হ্যাঁ, আত্তা, তারা না বলে পরীক্ষা নেয়, এরা বলে কয়ে নিচ্ছে। তাতে কীই-বা এমন ফারাক?
শিষ্যেরা অচল অটল।
ওস্তাদ হেসে বললেন, ‘মৈঁ তো জাউংগা জরুর!’
শিষ্যেরা বজ্রাহত। আর্তরব ছেড়ে পাঞ্জাবি, যুক্তপ্রদেশি, বাঙালি, হিন্দু, মুসলমান তাবৎ শাগরেদ আরজ করলে, ‘আমরা যাচ্ছি নে ওই সব পাঁ– দের সামনে পরীক্ষা দিতে, আর আপনি যাবেন হুজুর?’
হুজুর বললেন, ‘য়েকিনান– নিশ্চয়ই।’
শিষ্যেরা তখন ‘ফারাম’ ‘form’-এর ভয় দেখালে। তাতে মেলা অভদ্র প্রশ্ন আছে। ওস্তাদ বললেন, ‘সে তো আদমশুমারির সময়ও আমার বুডঢী বিবিকে শুধিয়েছিল, তিনি অন্য কোনও পন্থায় কিছু আমদানি করেন কি না? ওসব বাদ দাও। ফারাম ভর দো।’
***
অডিশনিং-এর দিন টাঙা চড়ে গুরু চললেন, স্টুডিয়োর দিকে। সঙ্গে মাত্র একটি চেলা। বাকি চেলারা চালাকি করে আকাশবাণীকে জানায়নি যে তাদের ওস্তাদ অডিশনিঙে আসছেন– ওদের শেষ ভরসা এপয়েন্টমেন্ট নেই বলে শেষমেশ যদি সবকুছ বরবাদ-ভণ্ডুল হয়ে যায়। অবশ্য এ-কথাও ঠিক, ওস্তাদ ওদের পরীক্ষা দেবার জন্য হুকুম দেননি। নইলে ওরা নিশ্চয়ই অমান্য করত না।
লখনৌয়ের– কথার কথা বলছি– আকাশবাণী সেদিন কারবালার ময়দানের মতো খা-খা করছে। এমন সময় নামলেন গুরু টাঙা থেকে।
আকাশবাণীর ‘চ্যাংড়া’দের যত দোষ দিন, দিন– প্রাণভরে দিন, কিন্তু একথা কখনও বলবেন না, এরা ওস্তাদদের সম্মান করে না। আমার চোখের সামনে কতবার দেখেছি, প্রোগ্রাম এসিসটেন্ট কুলীনস্য কুলীন ব্রাহ্মণসন্তান কী রকম মুসলমান শুরুর পায়ের কাছে কুমড়ো গড়াগড়ি দিচ্ছে, মুসলমান পীরের ছেলে হিন্দু গুরুর পায়ে ধরে বসে আছে। এঁদের অসম্মান করে অবশ্য সেটা ওদের রুচির অভাব– ওপরওয়ালারা যারা সঙ্গীত বাবতে দীর্ঘকর্ণ।(১) ছোকরা কর্মচারীরা তো তন্মুহূর্তেই ওস্তাদকে তাদের চোখের পাতার উপর তুলে নিয়ে ঢুকিয়ে দিল অডিশনিং রুমে যেখানে ‘পরীক্ষক’রা বেকার উকিলদের মতো অনুপস্থিত মাছি মারছিলেন আর নিষ্ফল আক্রোশে আর্টিফিশেল দাঁতে দাঁতে কিড়মিড় খাচ্ছিলেন।
ওস্তাদকে দেখে তাঁরা স্তম্ভিত! এ কী কাণ্ড! যে-সব আনাড়ি ছোকরা গাওয়াইয়ারা দিনকে দিন বেতারকেন্দ্রের ছারপোকা-ভর্তি বেঞ্চিতে বসে দশ রুপেয়ায় প্রোগ্রামের জন্য ধন্না দেয় তারা পর্যন্ত আসেনি অডিশনিঙে– আর এই ওস্তাদের ওস্তাদ লখনৌয়ের কুবৃমিনার, তানসেনের দশমাবতার তিনি এসে গেছেন– এ যে অবিশ্বাস্য, বিলকুল গয়ের মুমকিন তিলিস্মাৎ।
একথা অনস্বীকার্য তাঁরা ওস্তাদকে প্রচুরাধিক ইজ্জৎ দেখিয়ে ইসতিকবাল (অভ্যর্থনা) জানালেন, সর্বোত্তম তাকিয়াটি তাঁর পিছনে চলন দিলেন। ওস্তাদের মুখ যথারীতি পানে ভর্তি ছিল। একটি ছোকরা ছুটে গিয়ে ওগলদন (পিকদান) নিয়ে সামনে ধরল।
কেউ কিছু বলার পূর্বেই ওস্তাদ বললেন, ‘সব যব জমগয়ে তব কুছ হো জায়–’ অর্থাৎ সঙ্গীতামোদীরা যখন একজোট হয়ে গিয়েছি তখন হোক কিঞ্চিৎ গাওনা-বাজনা! সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। নইলে কে তাঁকে সাহস করে পরীক্ষা দিতে বলত? ওস্তাদ সবিনয় শুধোলেন, কী গাইব?’ তার স্বরে চিৎকার উঠল, ‘সে কী, সে কী? গজব কি বাৎ! আপনার যা খুশি!’ (সাধারণ পরীক্ষার্থী জানে, এদের মামুলি পেশা বিৎকুটে, অচেনা রাগ বৎখৎ তালে গাইবার আদেশ দেওয়া )
ইতোমধ্যে বেতারকেন্দ্রের যে পয়লা-নম্বরি সারেঙ্গিওয়ালা ও ওস্তাদ তবলচি অডিশনিং বয়কট করে কেন্টিনে চা খাচ্ছিল তারা টাটু-ঘোড়ার মতো ছুটে এসেছে সঙ্গত দিতে–কর্তারা এদের অভাবে যে দুটি আকাট যোগাড় করেছিলেন, তারা বহু পূর্বেই গা-ঢাকা দিয়েছে।
ওস্তাদ ধরলেন তোড়ি। আলাপের সময় প্রত্যেকটি ধ্বনি যেন বকুলগাছ থেকে এক একটি ফুল হয়ে এদিক ওদিক ছিটকে পড়তে লাগল। যখন তালে এলেন তখন যেন ফুল নিয়ে সাতলহরা মালা গাঁথতে লাগলেন, প্রিয়ার কুন্তলদামে পরাবেন বলে।
আর সমস্তক্ষণ মুখে কী খুশির ছটা! জানুটা যেন ফুর্তিতে ভরপুর! ক্ষণে সারেঙ্গিলার দিকে মুখ বাড়িয়ে তার বাজনার তারিফ করে বলেন, ক্যা বাৎ, ক্যা বাৎ! ক্ষণে তবলচির দিকে দুই হস্ত প্রসারিত করে হুঙ্কার দেন, শাবাশ, শাবাশ, আফরিন, আফরিন! যেন ওরাই সব জমিয়ে চলছে! ওঁর কোনও কৃতিত্ব নেই।
গান থামল। আনন্দে বিস্ময়ে সবাই এমনই স্তম্ভিত যে পুরো এক মিনিট পরে হর্ষধ্বনি ও সাধুবাদ রব উঠল।
ইতিমধ্যে ‘পরীক্ষক’দের একজন ওস্তাদের সঙ্গী ছোকরা শাকরেদের কাছ থেকে অন্য সকলের অজান্তে সেই ‘ফারাম’খানা চেয়ে নিয়েছে। ওইটেতে পাস না ফেল, কোন হারে দক্ষিণা বেঁধে দিতে হবে সেসব লিখে দিতে হয়।
হঠাৎ তার চোখে পড়ল, সেখানে প্রশ্ন, আপনি কোন রাগ-রাগিণী জানেন? তার উত্তরে লেখা মাত্র একটি শব্দ : ‘তোড়ি’।
বিস্ময়! বিস্ময়!! এ কখনও হয়!!! পরশু দিনের কাঁচা গাওয়াইয়াও তো লিখত ডজন দুই ওস্তাদ জানেন কত শত, এ তো রসজ্ঞদেরও কল্পনার বাইরে।
অতিশয় বতরিবৎ এবং প্রচুর মাফ চেয়ে সেই ‘পরীক্ষক’টি বৃদ্ধ ওস্তাদকে শুধোলেন– অল্প অবিশ্বাসের স্মিতহাসি হেসে, ‘ওস্তাদ, এ কখনও হয় যে, আপনি একমাত্র তোড়ি ছাড়া আর কিছুই জানেন না?’
সকলের মুখেই প্রসন্ন মৃদু হাস্য। সারেঙ্গি-তবলা মাথা নিচু করে জাজিমের দিকে তাকিয়ে।
যে-কোনও বিদ্যাতেই তোমার যদি অভিমান থাকে তবে, পণ্ডিত পাঠক, এই বেলা তুমি কান পেতে শোনো আমার জীবনে তার উত্তরটি নিবিড় ঘন আঁধারে ধ্রুবতারার মতো জ্বলে তিনি কী উত্তর দিলেন।
ঠণ্ডী সাঁস লে কর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ওস্তাদ বললেন, ‘পচাস সালসে তোড়ি গা রহাহুঁ– অভি ঠিক তরহসে নহি নিকলতি।’
অর্থাৎ পঞ্চাশ বছর ধরে তোড়ি গাইছি। এখনও ঠিকমতো বেরোয় না। অন্য রাগ-রাগিণীর কথা কেন বৃথা শুধোও।
১৬।১০।৬৫
———-
১. প্যারিসে একবার একটি উদ্ধৃষ্ট সঙ্গীতানুষ্ঠান কর্তাদের নেকনজর পায়নি শুনে ভলতেয়ার সেই সঙ্গীতস্রষ্টাকে একটি চৌপদী লিখে সান্ত্বনা জানান, হায়, বড়লোকদের যে কানও বড় হয়’ (অর্থাৎ গাধা)। আমি ব্যক্তিগতভাবে একটি উদাহরণ জানি। গুণী, ওস্তাদ রবিশঙ্কর তখন দিল্লি-আকাশবাণীর সঙ্গীতাধিনায়ক। গাঁধীর জন্মদিনে সেক্রেটারি তাকে ডেকে হুকুম দেন, ওই উপলক্ষে তিনি গাঁধীর তাবৎ জীবনী– দক্ষিণ-আফ্রিকা, বরদলৈ, উপবাস, সলট-মার্চ-প্রতিফলিত করে যেন নতুন কিছু ‘কম্পোজ’ করেন। বিহ্বল, প্রায়ান্ধ উদ্ভ্রান্তদৃষ্টি রবিশঙ্কর চলেছেন করিডর দিয়ে আমার সঙ্গে আচমকা কলিশন। সম্বিতে এসে আমাকে দেখে করুণ হাসি হেসে তাবৎ বাৎ বয়ান করে শুধোলেন, এ কখনো হয়?’ আমি বললুম, ‘আপনি যখন বাজান তখন আমার মতো সঙ্গীতে আনাড়িরও মনে হয়, আপনার পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়। তবে কি না- হেঁ হেঁ হেঁ, সেক্রেটারি বোধ হয় বিলিতি সিমফনি, পাস্তোরাল-টাস্তোরাল বই পড়ে (শুনে নয়) আমেজ করছেন, এ দেশেই-বা হবে না কেন?’ রবি শুধোলেন, করি কী?’ আমি সবিনয়ে বললুম, একটা বাবদ আমার মতো আকাটও একটা সাজেশন দিতে পারে।’ ‘কী কী?’ ‘ওই সল্ট-মার্চের জায়গায় এসে আপনি যন্ত্রের তারগুলোতে করকচ-নুন মাখিয়ে নেবেন।’
ফরাইজ
‘বাপের বাড়ি’, শ্বশুরবাড়ি’, ‘পিতৃগৃহ’, ‘পতিগৃহ’, মুখ্যগৃহ’, ‘গৌণ গৃহ’ ইত্যাকার বহু প্রকার ‘গৃহে’র নবীন নামকরণের প্রস্তাব পত্রান্তরে হয়ে যাচ্ছে। এই সুবাদে মুসলমানদের ভেতরে কী রীতি প্রচলিত আছে সেটা উল্লেখ বোধ হয় সম্পূর্ণ অবান্তর হবে না। কারণ হিন্দু এবং মুসলমান ধর্মের লোকাঁচারে, বিষয়-সম্পত্তি বন্টন বাবদে যতই পার্থক্য থাক না কেন, উভয় ধর্মাবলম্বীরই ভাষা বাংলা এবং মুসলমান মেয়ে বলে ‘বাপের বাড়ি’ ‘শ্বশুরবাড়ি’। তবু একটা ব্যাপারে সামান্য তফাত আছে।
অল্প হোক, বিস্তর হোক, পিতার মৃত্যুর পর মুসলমান মেয়ে বাপের সম্পত্তির কিছুটা হিস্যে পায়। অর্থাৎ পৈতৃক ভদ্রাসনেও তার আইনত অংশ বিদ্যমান থাকে। একেই বলে ‘ফরাইজ’।
কার্যত কিন্তু সে এ ফরাইজ দাবি করে না। এমনকি পতিগৃহে তার লোভী স্বামী যদি তাকে ন্যায্য হক্ক পাওয়ার জন্য ক্রমাগত টুইয়ে দিতে থাকে তবু সে সেটার দাবি করে না, মোকদ্দমা করতেও রাজি হয় না– আর স্বামী নিজের থেকে কোনও দাবি-দাওয়া করতে পারে না, কারণ হক্ক তার স্ত্রীর, তার নয়।
বোন কেন মোকদ্দমা করে না, তার একাধিক কারণ আছে। লোকাঁচারে বাধে (এতে হয়তো কিছুটা প্রতিবেশী হিন্দুর প্রভাব আছে), এবং দ্বিতীয় তার অন্য স্বার্থ আছে। সে যদি তার ন্যায্য পাওনা নিয়ে নেয়, তবে সে অর্থ হয়তো খর্চা হয়ে যাবে, এবং স্বামীর মৃত্যুর পর সে যদি কোনও কারণে অসহায় হয়ে যায় দেবর-ভাশুর তাকে অবহেলা করে তবে তার অন্য আশ্রয় থাকে না। পক্ষান্তরে সে যদি ফরাইজ না নেয়, তবে সেই তারই হক্কের জোরে বাপের বাড়িতে এসে আশ্রয় নিতে পারে। এমনকি শ্বশুর ভাশুর স্বামীর জীবিতাবস্থায়ও যদি তার ওপর অত্যধিক চোটপাট হয় তবে সে ফরাইজের হক্কে বাপের বা (বাপ মরে গিয়ে থাকলে) ভাইয়ের বাড়িতে এসে আশ্রয় নিতে পারে।
আরও একটা কারণ আছে। মুসলমান মেয়ে মাত্রই আশা করে, সে যেন বছরে অন্তত একবার তার বাপ-মা, ভাইবোন, ছেলেবেলার পাড়াপ্রতিবেশীকে দেখতে যেতে পায়। এস্থলে স্মরণ করিয়ে দিই, বিয়ের সঙ্গে সঙ্গে মুসলমান মেয়ের নাম-পদবি বদলায় না। মুসলমান বিবাহ অনেকটা সিভিল ম্যারিজের মতো কন্ট্রাক্ট ম্যারিজ– সেক্রেমেন্টাল নয়। অপরাধ যদি
নেন, তবে উল্লেখ করি, আমার পিতার নাম ছিল সৈয়দ সিকন্দর আলী। অথচ আমার মা চিরকালই নাম সই করেছেন, আমতুল মন্নান খাতুন চৌধুরী। মিসেস আলী, মিসেস সৈয়দ বা বেগম আলী এসব হালে ইংরেজের অনুকরণে হয়েছে।
***
এবারে গরিব দুঃখী চাষিবাসীদের একটি উদাহরণ দিই। পূর্ব বাংলার।
মনে করুন চাষা কেরামতুল্লা মারা গেছে। তার মেয়ে জয়নবের বিয়ে হয়েছে বেশ দূরে ভিন গাঁয়ে। জয়নবের বাল্যাবস্থায় তার মা মারা যায় বলে কেরামতুল্লা দুসরা শাদি করেছিল। সে পক্ষের ছেলে আকরম বিধবা মাকে নিয়ে, বিয়ে করে মোটামুটি সুখে-স্বচ্ছন্দেই আছে। সৎ-বোনকে আর স্মরণেই আনে না। তার মা-ও সতীনের মেয়ে জয়নবকে দু চোখে দেখতে পায় না। অতএব জয়নব বেচারি বাপের বাড়ির মুখ দেখতে পায় না। জয়নবের শ্বশুরবাড়ির গায়ের লোকে তাই নিয়ে ঠাট্টা-মস্করা করে। ওদিকে লোভী স্বামীও বলে, ‘ফরাইজ চেয়ে নে।’
জয়নব বেচারি তখন যদি দৈবযোগে বাপের গাঁয়ের কাউকে পেয়ে যায় তখন তাকে দিয়ে ভাইকে খবর পাঠায় তাকে যেন এসে বাপের বাড়িতে কয়েকদিনের জন্য নিয়ে যায়– একেই বলে ‘নাইওর’ যাওয়া। ভাই খবর পেয়েও গা করে না।
আর সৎমা’র তো কথাই নেই। বেচারি জয়নব একাধিকবার খবর পাঠিয়ে হয়রান হয়ে গেল। ওদিকে বাপের গাঁয়ের লোক তো আর তার শ্বশুরের গায়ে নিত্যি নিত্যি আসে না যে নিত্যি নিত্যি খবর পাঠাবে।
তখন সে ধরে অন্য পন্থা। নদীতে জল আনতে গিয়ে সুযোগ পেলেই সময় কাটায় বিস্তর। এবং স্বভাবতই তার গাঁয়ের সব মাঝিদের সে চেনে। তাদের কাউকে দেখতে পেলে পাড়ে বসেই চিৎকার করে আর ফরিয়াদটি জানিয়ে দেয়। সবিস্তারে বলতে হয় না– সবাই সব খবর জানে।
তাতেও যদি ওষুধ না ধরে, তখন সে ধরে রুদ্রমূর্তি।
শাসিয়ে দেয়, তাকে নাইওর না নিয়ে গেলে সে ফরাইজের মোকদ্দমা করবে।
এইবার ভাইয়ের কানে কিঞ্চিৎ জল যায়। তা-ও পুরোমাত্রায় না। ইতোমধ্যে গায়ের মুরুব্বিদের কানেও তাবৎ ফরিয়াদ পৌচেছে– বিশেষত সেই সব বৃদ্ধদের কানে যাঁরা বিয়ের ঘটকালি করেছিলেন। তারা তখন ছোকরাকে বুঝিয়ে বলেন, ‘তোর আছে কুল্লে আড়াই বিঘত জমি– আচ্ছা, তর না হয় কিছুটা গেল; কিন্তু তোর বসতবাড়িতেও যে ছুঁড়ির হিস্যে রয়েছে। সেইটেও তুই লাটে তুলবি নাকি? যা, যা, বোনকে নিয়ে আয়।’
আমি এতক্ষণ যা বললুম, এসব পূর্ব-বাংলার লোকসঙ্গীতেও আছে। তারই একটির শেষ দুই লাইনে আছে,
“থাকো গো বোন, থাকো গো বোন,
কিলগুঁতা খাইয়া,
আষাঢ়(১) মাসে লইয়া যাইমু
পঙ্খীরাজ ওড়াইয়া ॥”
ভাই নৌকা নিয়ে আসার খবর পাওয়া মাত্রই বোন লেগে যায় নানারকম মিষ্টি পিঠে বানাতে। শাশুড়ি গজর গজর করে, কিন্তু জা-রা তো একই গোয়ালের গাই, তারা সাহায্য করে।
নৌকা এল। বোন সগর্বে হাঁড়ি-ভর্তি মিঠে পিঠে নিয়ে নৌকায় চাপলো। গাঁয়ের মেয়েরা এখন আর তাকে খোঁটা দিতে পারবে না। এ তো সতীর নিঃসঙ্গ হিমালয়-যাত্রা নয়।
***
বুদ্ধিমতী মেয়ে বলে বাপের বাড়ি গিয়ে জয়নব পাড়াময় চর্কিবাজি মেরে দিন কাটায় না। অবশ্য সর্বপ্রথম মিঠে পিঠে নিয়ে আত্মীয়-স্বজন, সইটইদের সঙ্গে দেখা করতে যায়, কিন্তু তার পরই লেগে যায় নতুন ধানচাল যা উঠেছে তার দুরুস্ত ব্যবস্থা করতে। অবশ্য একথাও ঠিক, কেউ তা সে যে কোনও স্ত্রী-পুরুষই হোক, যদি সুবো-শাম বেঘোরে ঘুমোয় তবে লোকে প্রবাদটা বলে, ‘দেখো খোদার খাসিটা ঘুমুচ্ছে যেন “নাইওরি-মাগীটার” মতো!’
এই করে করে ‘নাইওর’ বাস যখন শেষ হয়, তখন বাপের বাড়িতে আবার মিঠে পিঠে তৈরি আরম্ভ হয়– এগুলো নিয়ে যাবে শ্বশুরবাড়িতে। ভাই অন্তত একখানা শাড়ি, একটি কুর্তা কিনে দেবে বোনকে– জামা-ফ্রক ভাগ্নিকে।
জয়নব কিন্তু ধান ভানা-কোটাতে এমনই সাহায্য করে যেন ভাই, সত্য ফ্রি চিপ-লেবারের প্রলোভনে তাকে আসছে বছর নিজের থেকেই নাইওর’ নিয়ে আসে– ফরাইজের মোকদ্দমার শাসানি যেন মাঝি-মাল্লা মারফত না পাঠাতে হয়। শ্বশুরবাড়ি ফিরে জয়নব আবার দেমাক করে, আমি মাগনা খাইনে পরিনে। যদ্দিন ওখানে ছিলুম সত্যকে কুটোটি পর্যন্ত কুড়োতে দিইনি!
***
এতক্ষণ যা নিবেদন করলুম এটা হিন্দুদের বেলাও প্রযোজ্য। প্যাটার্ন মোটামুটি একই, তবে তফাৎটা কোথায়?
তফাৎ ওই ফরাইজের হক্ক, ড্যুরেস, ব্ল্যাকমেল (অবশ্য বে-আইনি নয়) দিয়ে সে বাপের বাড়ি যাবার হক্ক আজীবন জিইয়ে রাখে। স্বামীর সঙ্গে না বলে সেই হক্কের জোরে অনির্দিষ্টকালের জন্য বাপের বাড়ি চলে আসে। অবস্থা চরমে পৌঁছলে সেখানে বসে স্বামীর বিরুদ্ধে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ন্যায্য স্ত্রীধনের মোকদ্দমা লাগায়। কিংবা যদি স্বামীর মৃত্যুর পর ভাশুর-দেওর তাকে অসম্মান করে তবে সে চলে আসে বাপের বাড়িতে, ঠুকে দেয় ওদের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা। এগুলোই আসল তত্ত্ব বলে পুনরাবৃত্তি করলুম।
***
এসব সম্ভব বাপের বাড়ির ফরাইজের জোরে।
তাই সেটি সে কখনও হাতছাড়া করে না। লোভী স্বামী যতই চোটপাট করুক না কেন।
হিন্দু মেয়েরা একটু চিন্তা করে দেখবেন।
২৭।১১।৬৫
———-
১. লেখকের মনে ঈষৎ সন্দেহ আছে, এস্থলে ভাই বোধ হয় বোনকে কিঞ্চিৎ ধাক্কা দিচ্ছে। বোনকে সচরাচর নাইওর নেওয়া হয় অঘ্রাণ মাসে ধান কাটার পর। কিন্তু আমি সঠিক বলতে পারব না। কারণ দেশ ছেড়েছি দুই যুগ পূর্বে।
ফের্ডিনান্ট জাওয়ারব্রুখ
বৈদ্যরাজ জাওয়ারব্রুখকে নিয়ে আবার সুইজ-জর্মন কাগজে বাদ-প্রতিবাদ আরম্ভ হয়েছে। প্রথম দলের বক্তব্য, সত্যই বৃদ্ধ বয়সে তার মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটেছিল; অন্য দলের বক্তব্য তিনি পূর্ব-বার্লিনের সোভিয়েত কূটনীতির বলির পাঁঠা হয়েছেন। বার্লিনের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল শারিতে; (charite- চ্যারিটি খয়রাতি) প্রতিষ্ঠানের তিনি অধ্যক্ষ ছিলেন, এবং বার্লিন ভাগাভাগির পর শারিতে পড়েছিল পূর্ব-বার্লিনে, রাশান আওতায়।
এই কলকাতা শহরের অন্তত একজন খ্যাতনামা চিকিৎসককে আমি চিনি, যিনি জাওয়ারব্রুখের শিষ্য। তিনি মুনিকে তাঁর কাছে বুকের যক্ষ্মার অপারেশন শেখেন– জাওয়ারব্রুখ বহু বৎসর মুনিক হাসপাতালেরও বড় কর্তা ছিলেন। এছাড়া তাঁর অন্যান্য শিষ্যও হয়তো কলকাতায় আছেন। অবশ্য বুকের, মাথার ও ক্যানসারের সার্জারি নিয়েই যাদের কারবার তাঁরাই জাওয়ারব্রুখের গবেষণার সঙ্গে অল্পাধিক পরিচিত।
জর্মন সার্জন-সমাজ মনে করেন, পৃথিবীর তিনজন সার্জনের নাম করতে হলে জাওয়াব্রুখের নাম কালানুক্রমে তৃতীয়। অন্য দু জন বোধ হয় হিপপোক্রাতেস ও নেপোলিওনের সার্জন–কিন্তু আমি কি চিকিৎসাশাস্ত্র, কি সে শাস্ত্রের ইতিহাস কোনওটারই বিন্দুবিসর্গ জানিনে বলে হলপ খেয়ে কিছুই বলতে পারব না। তদুপরি এ ধরনের নির্ঘন্ট নির্ণয় সব সময়ই কিঞ্চিৎ উদ্দাম হয়ে থাকে– যেরকম পৃথিবীর সপ্তমাশ্চর্য নির্ণয়ে ভিন্ন লোক ভিন্ন নির্ঘণ্ট দেয়।
অতএব অতিশয় সারবান আপত্তি উঠতে পারে, চিকিৎসা-শাস্ত্রের কিছুই যখন আমি জানিনে, তখন হাতের নাগালের বাইরে যে শল্যরাজ জাওয়ারব্রুখ বিরাজ করছেন, তাঁর প্রতি আমি উদ্বাহু হয়েছি কেন? উত্তর অতি সরল। এই শল্যরাজ মৃত্যুর পূর্বে একখানি নাতিবৃহৎ আত্মজীবনী লেখেন–বস্তৃত পুস্তকখানি প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর পর এবং সেটি আদৌ শল্যরাজ বা বৈদ্য-সম্প্রদায়ের উদ্দেশে রচনা হয়নি; রচনা হয়েছে আপনার-আমার মতো মামুলি জনের জন্য। এমনকি সে পুস্তকে ক্যানসার সম্বন্ধে তাঁর দীর্ঘ জীবনব্যাপী গবেষণার ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ যে প্রবন্ধটি উদ্ধৃত করেছেন, সেটিও সাধারণ জনের উদ্দেশে লিখিত, কারণ তিনি সেটি সর্বসাধারণের উপকারার্থে জর্মন রেডিও থেকে বেতারিত করেন। অতি সরল জর্মনে, সর্বপ্রকারের চিকিৎসাসংক্রান্ত পারিভাষিক শব্দ সযত্নে বর্জন করে তিনি এই বেতার-ভাষণটি নির্মাণ করেছিলেন বলে সেটি জর্মনবালকেও বুঝতে পারে– বাংলায় অনুবাদ করলে বঙ্গবালকও বুঝতে পারবে।(১)
কিন্তু এইটেই সর্বপ্রধান বা সর্বশেষ তত্ত্ব নয়। তাঁর আত্মজীবনীর সাহিত্যিক মূল্য আছে, এবং তার লেখার ভিতর দিয়ে ক্ষণে ক্ষণে তাঁর হাস্যকৌতুকোজ্জ্বল নীল চোখ দুটি প্রকাশ পায়। তার সামান্য একটি উদাহরণ দিই।
ব্যঙ্গরস অতিশয় প্রাচীন রস– করুণ ও বীর রসের সমবয়সী সে। প্রাচীনতম গ্রিক সাহিত্যে তার ভূরি ভূরি নিদর্শন রয়েছে। কিন্তু অসূয়া সে রসের উৎস বলে আমাদের রসপ্রিয় মনও সেটা সব সময় গ্রহণ করতে পারে না। বিশুদ্ধ হাস্যরস যেটা সৃষ্টি করার জন্য কাউকে পীড়া দিতে হয় না, নট অ্যাট দি কসট অব এনি ওয়ান– আপনার আনন্দে উচ্ছল এবং সেটা ব্যঙ্গরসের বহু পরবর্তী যুগের রস। এবং আমার ব্যক্তিগত শাবাসি সেই হাস্যরসের, সেই ব্যঙ্গরসের উদ্দেশে যেখানে রসস্রষ্টা নিজেকে নিয়ে নিজে হাসেন, নিজেকে ব্যঙ্গ করেন, লাফট অ্যাট হিজ ওন কষ্ট। তারই একটি উদাহরণ দিই :
জাওয়ারব্রুখ বলেছেন, তাঁর সময়কার এক বিখ্যাত চিকিৎসাশাস্ত্রের অধ্যাপক ছাত্রদের মৌখিক (ভাইভা) পরীক্ষা নেওয়ার পর প্রতিবারেই অতিশয় গম্ভীর কণ্ঠে বলতেন, ‘এই পৃথিবীতে বিস্তর গর্দভ নিজেদের ডাক্তাররূপে পরিচয় দিয়ে নির্ভয়ে অগুনতি লোক মেরে বেড়াচ্ছে; তার ওপর যদি আরও একটা গর্দভ বাড়ে তাতে করে কণামাত্র ক্ষতি বৃদ্ধি হবে না। তুমি পরীক্ষা পাস করলে।’ জাওয়ারব্রুখও তাই তার যুগের শিক্ষার্থীদের সম্বন্ধে উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন না। কিন্তু অন্তত একবার তাঁর শিক্ষা হয়ে যায় এ বাবদে। জাওয়ারব্রুখ লিখছেন, সকাল দশটায় তিনটি ছেলে আসবে আমার কাছে ভাইভা দিতে। আমি নার্সকে বললুম, ক্যান্ডিডেটরা এলে অমুক রোগীকে পাঠিয়ে দিয়ে তার পেটে ছিল টিউমার। ওরা এলে আমি কাগজপত্র দস্তখত করতে করতে একজনকে বললুম, রুগীকে পরীক্ষা করে বলতে হবে তার কী হয়েছে। আমি কাজে ডুব মারলুম। দশ মিনিট পরে শুধালুম, “কী হল?” ছেলেটা ভয়ে ভয়ে বললে, “কিছুই তো পেলুম না স্যার।” আমি হুঙ্কার দিয়ে বললুম, “গেট আউট”- আর নামে দিলুম ঢ্যারা কেটে। তার পর একই আদেশ দিলুম দু নম্বর ক্যান্ডিডেটকে। একেও যখন শুধালুম, কী পেল সে– সে প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে একই উত্তর দিল। ছাড়লুম আরেক হুঙ্কার, কাটলুম আরেক ঢ্যারা। এবারে তিন নম্বরের পালা। সে-ও যখন ফেল মারলে তখন আমি ছাড়লুম শেষ হঙ্কার। এ ছেলেটি কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে হাওয়া না হয়ে শান্ত কণ্ঠে বললে, “তা হলে আপনি দেখান না স্যার, কী হয়েছে।” কী! এত বড় আস্পদ্দা! দেখাচ্ছি! লম্ফ দিয়ে গেলুম রুগীর কাছে, পেটে দিলুম হাত। ও হরি! কোথায় টিউমার? ভুলে অন্য লোক পাঠিয়েছে নার্স! তখন শুরু হয় আমার আর্তরব। “আরে, আরে, কোথায় গেল সেই দুই ক্যান্ডিডেট। নিয়ে এসে তাদের।” এ স্থলে সে ক্যান্ডিডেট বিশ্ববিখ্যাত জাওয়ারব্রুখকে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিল, তাকে বোধ হয় আর কোনও পরীক্ষাতে না ফেলে সঙ্গে সঙ্গে পয়লা নম্বরি ডিগ্রি দেওয়া উচিত।’
এ রকম আরও বহু মজার মজার কথা আছে এই অসাধারণ পুস্তকে; বস্তুত পুরো বইখানাই হাস্যরসের কুমকুমে কুমকুমে ভর্তি। পাঠকের চটুল হৃদয়ে একটুখানি চাপ পড়লেই আবীরে আবীরে ছয়লাপ। কিন্তু এর ফাঁকে ফাঁকে আবার ট্র্যাজেডির করুণ রসও আসে বলে সে রস যেন জল এনে দেয় চোখের পাতায়, বুক ভরে দেয়, নিবিড়তর ব্যথায়– আরও বেশি।
একবার একটি মহিলা তাঁর কাছে এসে বললেন, তাঁর নিশ্চয়ই ক্যানসার হয়েছে। ডাক্তার তাঁকে পাঠিয়ে দিলেন ভিন্ন ভিন্ন ল্যাবরেটরিতে যেখানে আধুনিকতম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে রোগের জাতগোত্রের বিচার হয়। নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তাঁরা সবাই একবাক্যে সমস্বরে বললেন, ‘ক্যানসার নয়’।
সব শুনে মহিলাটি মাথা নেড়ে বললেন, ‘না, হ্যের প্রফেসর, এটা ক্যানসারই বটে।’
মহিলাটি কয়েক দিন পর আবার এসে ক্যানসারের ফরিয়াদ করলেন। আবার গোড়ার থেকে তাবৎ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হল, আবার নির্ধন্দুনেতিবাচক উত্তর এল। এই করে করে ছ মাস ধরে মহিলাটি আসেন– তাঁর মনে কোনও সন্দেহ নেই, তাঁর উদরবেদনা ক্যানসারজনিত।
শেষটায় জাওয়ারব্রুখ স্থির করলেন, কাটাই যাক পেট। মাদামকে তখন বলতে পারবেন, স্বচক্ষে দেখেছি পেটে কোনও ক্যানসার নেই। কিংবা হয়তো তিনি ভেবেছিলেন, অনেক বর্ষীয়সী মহিলার এই অপারেশন-মেনিয়া থাকে; হয়তো তারা আপন জানা-অজানায় সেন্টার অব অ্যাট্রাকশন বা কৌতূহলের কেন্দ্র হতে চান। তাকে অস্ত্রোপচারের জন্য তৈরি করা হল।
তার পর কবিরাজ জাওয়ারব্রুখ যা বলেছেন তার মোদ্দা কথা : ‘আমরা তো নিশ্চিন্ত মনে পেট খুললুম। সর্বনাশ! এ কী দেখি! পেট-ভর্তি ক্যানসার! এবং এখন যে চরমে পৌঁছেছে সে অবস্থায় অপারেশনের কোনও প্রশ্নই ওঠে না। সন্তপ্তচিত্তে আমরা পেট সেলাই করে দিলুম। মহিলা সম্বিতে ফিরলে আমি তাঁকে বললুম, ‘হ্যাঁ, ক্যানসারই ছিল; আমরা সেটা কেটে সরিয়ে দিয়েছি।’
জাওয়ারব্রুখ তার পর বললেন, ‘মহিলাটি প্রথম যেদিন আমার কাছে এসেছিলেন তার সঙ্গে সঙ্গে যদি অপারেশন করতুম, তবে হয়তো তাকে বাঁচাতে পারতুম। কিন্তু প্রশ্ন, আধুনিকতম বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি যখন নঞর্থক উত্তর দেন, তখন শুধুমাত্র রোগীর অনুমানের ওপর নির্ভর করে পেট কাটা যায় কী প্রকারে?’
জাওয়ারব্রুখ সম্বন্ধে ভবিষ্যতে আপনাদের কাছে আরও নিবেদন করার বাসনা রইল। কিন্তু আমার বিশ্বাস, কোনও বাংলাভাষী সার্জন সেটা করলেই ভালো হয়; আমার মতো আনাড়ি তা হলে অনধিকার প্রবেশ থেকে নিষ্কৃতি পায়।
কলকাতা ও বোম্বাইয়ে যেসব ক্যানসার প্রতিষ্ঠান আছে, তাঁরা মাঝে মাঝে খবরের কাগজে বিবৃতি প্রকাশ করে সাধারণ জনকে সাবধান করে দেন, শরীরে কোনও কোনও আকস্মিক বা মন্দগতিতে বর্ধমান পরিবর্তন দেখলে ক্যানসারের সন্দেহ করতে হয়। এগুলো আমি সর্বদাই শ্রদ্ধা ও মনোযোগ সহকারে পড়ি।
ঠিক ওই একই সুবাদে প্রফেসর ডক্টর গেহাইমরাট জাওয়ারব্রুখ অবতরণিকা হিসেবে কয়েকটি কথা বলেছেন এবং আপন বক্তব্য বোঝাতে গিয়ে এমন একটি অত্যুৎকৃষ্ট বিরল তুলনা দিয়েছেন, যেটি ব্যবহার করতে পারলে যে কোনও যশস্বী সাহিত্যিকও শ্লাঘা অনুভব করবেন। বৈদ্যরাজ যা বলেছেন, তার নির্যাস : অধিকাংশ রোগই কোনও না কোনও সাবধানবাণী, ইঙ্গিত, ওয়ার্নিং দিয়ে আসে। যেমন, সামান্য মাথা ধরল– সেইটে ওয়ার্নিং পরের দিন জ্বর হল। কিন্তু ক্যানসার কোনও ওয়ার্নিং তো দেয়ই না, বরঞ্চ সে নিতান্ত নিরপরাধীর মতো দেখা দেয়। যেমন, আপনার জিভে একটি দানা দেখা দিল। সেটাতে কোনও বেদনা নেই, আপনার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না, আপনি ভাবলেন, এরকম তো কত দানা এখানে-সেখানে দেখা দেয় আবার মিলিয়ে যায়, এটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করার বা চিকিৎসকের কাছে যাবার কোনও প্রয়োজন নেই। তার পর সেটা অতি ধীরে ধীরে বড় হতে লাগল, কিন্তু কোনও বেদনা বা অস্বস্তি নেই বলে আপনি তখনও কোনও প্রতিকার করলেন না। তার পর একদিন ঢোক গিলতে, খাবার গিলতে আপনার অসুবিধা হতে লাগল। আপনি তখন গেলেন ডাক্তারের কাছে, কিন্তু হায়, ততদিনে বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছে, তখন আর অপারেশন করা যায় না। আপনি যদি, দানা যখন ছোট ছিল, তখন আসতেন, তবে সার্জন আপনাকে অনায়াসে ক্যানসারমুক্ত করতে পারতেন– অবশ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর। তাই জাওয়ারব্রুখ বলছেন, ‘দানাটি আদৌ অপরিচিত শত্রুরূপে বেদনা যন্ত্রণা সঙ্গে নিয়ে এল না। ক্যানসার এল যেন আপনার কোনও বন্ধুজনের চেহারার সঙ্গে হবহু মিলিয়ে একটি মুখোশ তৈরি করে সেটা পরে। তার পর কাছে এসে হঠাৎ মুখোশ সরিয়ে ফেলে আপনার বুকে মারল ছোরা!’
এরপরই অধ্যাপক কতকগুলো চিহ্নের উল্লেখ করেছেন– এগুলোকে তিনি ওয়ার্নিং বলেননি বটে, কিন্তু সেগুলো দেখলেই তৎক্ষণাৎ ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত। জিভেতে বা অন্য কোথাও দানা বা ওই-জাতীয় বস্তু বা পরিবর্তন, কণ্ঠস্বর অকারণে কর্কশ হয়ে যাওয়া, আপনার পেটের অসুখ ছিল না– হঠাৎ আরম্ভ হল দিনের পর দিন পেট খারাপ হতে, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এটা আমার অনধিকার প্রবেশ। আপনার উচিত, আমাদের যে কোনও ক্যানসার প্রতিষ্ঠান থেকে তাদের সুলিখিত প্রামাণিক বিবৃতি সংগ্রহ করা! বিবৃতিতে সব ক’টা চিহ্নের পরিপূর্ণ (exhaustive) লিস্ট থাকে। আমি এযাবৎ যা লিখেছি সেটা ভুলে গিয়ে ওই বিবৃতি মন দিয়ে পড়বেন। কারণ, এগুলো আমাদের জন্যই লেখা ডাক্তারদের জন্য নয়—(২)
———-
১. এবং এর অনুবাদ করার বাসনা আমার ছিলও অবশ্য সাবধানের মার নেই বলে ক্যানসার-রোগ-বিশেষজ্ঞ আমার ভ্রাতুস্পুত্রীকে দিয়ে সেটি সেনসর করিয়ে নিতুম। এ বেতার-ভাষণটি এখনো আদৌ গাজীমিয়ার বস্তানীতে আশ্রয় নেয়নি, অর্থাৎ আউট-অব-ডেট হয়ে যায়নি। ওই ভ্রাতুস্পুত্রীর আদেশে আমি সর্বাধুনা প্রকাশিত জর্মন-বিশ্বকোষে সবিস্তর লিখিত ক্যানসার প্রবন্ধটি পড়ি। এবং যদিও সব জিনিস বুঝতে পারিনি (বিশেষ করে কুআন্ট থিয়োরি দিয়ে ক্যানসার রোগের কারণ নির্ণয়ের আধুনিক প্রচেষ্টা!) তবু, এটা লক্ষ করলুম যে ক্যানসারের পূর্বাভাস সম্বন্ধে জাওয়ারব্রুখ অজ্ঞজনকে যেসব দিকে লক্ষ রাখতে বলেছেন, সর্বাধুনিক জর্মন-বিশ্বকোষও তাই বলেছেন। ..উল্লেখযোগ্য যে, ক্যানসার গবেষণা আরম্ভ করার পূর্বে জাওয়ারব্রুথ বার্লিনের ইন্ডলজি ডিপার্টমেন্টে গিয়ে খবর নেন, প্রাচীন ভারতীয় বৈদ্যেরা ক্যানসার সম্বন্ধে কী বলে গিয়েছেন।
২. এ-প্রবন্ধ “দেশে” প্রকাশিত হওয়ার পর আমি চিকিৎসক-অচিকিৎসক একাধিক সজ্জন পাঠকের কাছ থেকে অনুরোধ পেয়েছি, ক্যানসার সম্বন্ধে জাওয়ারব্রুখের প্রাগুক্ত প্রবন্ধটি যেন আমিই অনুবাদ করি। আমি করজোড়ে ক্ষমা ভিক্ষা করছি, কারণ অসুস্থতাবশত আমার দেহে শক্তি মনে উৎসাহ বড়ই হ্রাস পেয়েছে। তবে এটাও নিবেদন, আমৃত্যু দুটি প্রবন্ধ অনুবাদ করতে পারার দুরাশা আমি কখনো সম্পূর্ণ ত্যাগ করব না; ক্যানসার সম্বন্ধে প্রবন্ধটি ও অধ্যাপক ভিন্টারনিত রচিত ক্ষুদ্রাকার রবীন্দ্র-জীবনী।
বাবুর শাহ
এদেশে তিন রকমের ইংরেজ এসেছিল। বড় দলের কাজ ছিল পৃথিবীর সামনে আমাদের হেয় প্রমাণ করে এদেশে শ্বেত (আমি বলি ধবল কুষ্ঠ) রাজতু যুক্তি ও নীতির ওপর খাড়া করা। এককথায় যাকে বলে, ‘হোয়াইট ম্যানস বার্ডেন’ যে কী ভীষণ ভারি এবং ইংরেজ স্বদেশের বেকন-আণ্ডা, ঘোড়দৌড়ের জুয়োখলা, খেঁকশেয়ালি শিকার করা স্বেচ্ছায় বিসর্জন দিয়ে এই নচ্ছার’ দেশে এসে পৃথিবীর ইতিহাসে যে কী অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে, সেটা সপ্রমাণ করা। অতি দৈবেসৈবে দু-একজন তীক্ষ্ণদৃষ্টিসম্পন্ন সহৃদয় মহাজন এ ভণ্ডামি ধরতে পেরেছিলেন। তারই একজন প্রখ্যাত হাস্যরসিক জেরম কে জেরম। তিনি মারাত্মক ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন– পড়ে মনে হয়, তিনি যেন সিকনি ঝাড়ছেন—‘বার্ডেন যদি হেভিই হয় তবে ওটা বইছিস কেন, মাইরি? আমি তো খবর পেয়েছি, ইন্ডিয়ানরা সেই সেবা, সেই হোলি ক্রুসেডের জন্য থ্যাঙ্কুটি পর্যন্ত বলে না। তবে ফেলে আয় না ওই লক্ষ্মীছাড়া বোঝাটা হতভাগাদেরই ঘাড়ে!’
কিন্তু প্রাগুক্ত ওই বড় দলের ইংরেজদের একটি আপ্তবাক্য নিয়ে আজ আমার আলোচনা। এরা মোকা বোকায় বলত, ‘পাঠান-মোগল আদৌ ইতিহাস লিখতে জানত না– শুধু লড়াই আর লড়াই।’
অন্য দল সংখ্যায় নগণ্য। এঁরা এসব কথায় কান না দিয়ে সংস্কৃত, আরবি, ফার্সি শিখতেন, বাংলায় বাইবেল অনুবাদ করতেন, এবং প্রাচ্যভাষায় লিখিত জ্ঞানবিজ্ঞানের বই ইংরেজিতে অনুবাদ করতেন। ফার্সি ইতিহাস যে শুধু ‘লড়াই আর লড়াই’ নয় (আহা! তাই যদি হত আর আমরা তাই পড়ে ক্ষেপে গিয়ে সেই আমলেই ইংরেজকে ঠ্যাঙাতে আরম্ভ করতুম!) সেটার বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ তারা জানিয়েছেন ফার্সি ইতিহাস অনুবাদ করে।
এক তৃতীয় শ্রেণির পিচেশও এদেশে এসেছিল। এরা প্রথম শ্রেণির মতো অশিক্ষিত বর্বর নয়, আবার দ্বিতীয় শ্রেণির মতো নিরপেক্ষ সাধুজনও নয়। এরা অল্পবিস্তর সংস্কৃত আরবি ফার্সি চর্চা করে, অল্পবিদ্যা যে ভয়ঙ্করী সেইটে আপন অজানতে প্রমাণ করে দিত এই বলে, ‘ওসব তাবৎ মাল আমাদের পড়া আছে; সব রাবিশ!’
দুর্ভাগ্যক্রমে এদেশের ইংরেজি ‘শিক্ষিতেরা’ এদেরই বিশ্বাস করে বসলেন।
আমার বক্তব্য, নিজের মুখেই ঝাল চেখে নিতে পারেন। বিশেষত যখন কিছুদিন ধরে ‘শেষ মোগলদের’ সম্বন্ধে ঐতিহাসিক উপন্যাস বেশ কিছুটা জনপ্রিয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে আমি ভারি খুশি হয়েছি, কারণ অনেক স্থলে সাধারণ পাঠক এই করেই উচ্চতর পর্যায়ে উপনীত হয়। আমারই ন্যাওটা একটি ম্যাট্রিক ফেল ছোকরা কিন্তু র্যাপিড-রিডিঙের ফলে সে দিব্য শিলিং-শকার, পেনি-থ্রিলার পড়তে পারত– আমার কাছ থেকে রোম-সাম্রাজ্যের ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘আই ক্লাউডিউস’ পড়ে এমনই ‘ক্ষেপে যায়’ যে, সে তার পর দুনিয়ার যত রোমান ইতিহাস পড়তে আরম্ভ করে, এস্তেক জুলিয়াস সিজারের ‘ব্রিটন বিজয়’ পর্যন্ত।
হালে বাবুর বাদশার আত্মজীবনী বেরিয়েছে বাংলা অনুবাদে। অবশ্য সে অনুবাদ এসেছে তিন ঘাটের জল খেয়ে। বাবুরের মাতৃভাষা ছিল তুর্কি– চুগতাই-তুর্কি অর্থাৎ তুর্কর্মানিস্তানের তুর্কি; টার্কির (যার রাজধানী আঙ্কারা) ভাষা ওসমানলি-তুর্কি। আমার যতদূর জানা আছে, মোগল আমলে যদিও দরবারি ভাষা ছিল ফার্সি, তবু শেষ বাদশা বাহাদুর শাহ পর্যন্ত অন্তঃপুরে তুর্কিতেই কথাবার্তা বলেছেন, উর্দুতে কবিতা লিখেছেন(১)– দিল্লির বিখ্যাত বিখ্যাত মুশায়েরায় (কবি-সম্মেলনে) দূত মারফৎ আপন কবিতা পাঠিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন (সে আমলের প্রখ্যাত কবি ছিলেন উর্দুর সর্বশ্রেষ্ঠ কবি গালিব) এবং রাজকার্য করেছেন ফার্সিতে।
বাবুরের সেই আত্মজীবনী অনূদিত হয় ফার্সিতে, ফার্সি থেকে ইংরেজিতে ও বিবেচনা করি, এই বাংলা অনুবাদ সেই ইংরেজি থেকে। তাতে করে যে খুব মারাত্মক ক্ষতি হবে সে ভয় আমার নেই, কারণ অনুবাদে সবচেয়ে বেশি জখম হয় গীতিরস, এবং বাবুরের সাহিত্যসৃষ্টি গীতিরসপ্রধান নয়। এবং লড়াইয়ের কথা যদিও এটাতে আছে তবু সেইটেই প্রধান কথা নয়। আসল কথা বাবুরের পর্যবেক্ষণশক্তি। ভারতবর্ষ প্রধানত দিল্লি-আগ্রা অঞ্চল– তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছেন এবং অতিশয় নিষ্ঠার সঙ্গে তার বর্ণনা দিয়েছেন। আমি যখন কাবুলে ছিলুম তখন বাবুর-বর্ণিত, কাবুল পাঞ্জশির (পাঞ্জশির অর্থ পঞ্চ-ক্ষীর, সংস্কৃত ‘ক্ষীর’ শব্দ ফার্সিতে ‘শীর’, কিন্তু অর্থ দুধ, আর পাঞ্জ অর্থ পঞ্চ– ওই জায়গায় পাঁচটি নদী বয় : আমাদের পায়েসকে কাবুলিরা বলে শির-বিরঞ্জ (বিরঞ্জ অর্থ চাল)- ইত্যাদি আমি আপন অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছি। বস্তুত বাবুর বর্ণিত কাবুল ও আমার দেখা কাবুলে বিশেষ পার্থক্য ছিল না। হালে যাঁরা কাবুল দেখে ফিরছেন তাঁরা বলেন, গত দশ বৎসরে নাকি কাবুলের চেহারা একদম পালটে গিয়েছে।
কাবুলিরা বাবুরকে ঘৃণা করে। কারণ ইব্রাহিম লোদি ছিলেন আফগানিস্তানের পাঠান। তাঁকে পরাজিত করে হিন্দুস্তানের তখৎ ছিনিয়ে নেন তুর্কমানিস্তানের মোগল বাবুর। আমাকে এক সম্ভ্রান্ত, সুশিক্ষিত, বিশ্বপর্যটক পাঠান কূটনৈতিক বেদনাবিকৃত কণ্ঠে বলেন, আপনি কি কল্পনা করতে পারেন, ডক্টর, এই বর্বর বাবুর কী করেছিল? কল্পনা করতে পারেন, সেই নরদানব ইব্রাহিম লোদির অন্তঃপুরের পূণ্যশীলা অসূর্যস্পশ্যাদের খোলাবাজারে ক্রীতদাসী হিসেবে বিক্রয় করেছিল। এ শুধু বর্বর যাযাবর তুর্কিদের পক্ষেই সম্ভব।’
কাজেই আশ্চর্য হবার কিছু নেই যে, কয়েক বৎসর আগে পর্যন্ত বাবুরের কবরের উপরে না ছিল আচ্ছাদন (একদা নাকি ছিল, কিন্তু সেটা লুট হয়ে কিংবা ভেঙে পড়ে যাওয়ার পর আফগানরা স্বভাবতই সেটা মেরামত করে দেবার কোনও প্রয়োজন অনুভব করেনি), না ছিল কোনও অলঙ্কার-আভরণ; কয়েক ফালি পাথর দিয়ে তৈরি অতিশয় সাদামাটা একটি কবর। হালে নাকি আফগান সরকার বাবুরের ঐতিহাসিক মর্যাদা অনুভব করতে পেরেছেন– জাত্যভিমান কিঞ্চিৎ সংযত করার ফলে– এবং কবরের সুব্যবস্থা করেছেন।
আজকের দিনের বাঙালি ইনফ্লেশন কারে কয়, সেটা চোখের জলে নাকের জলে শিখেছে। রোক্কা একটি টাকার ক্রয়মূল্য আজ কতখানি, সে তা বিলক্ষণ জানে। বাঙালি তাই বাবুরের ইনফ্লেশন-জ্ঞান দেখে আনন্দিত হবেন। দিল্লি জয়ের পর বাবুরের আমীর-ওমরা বিস্তর ধনদৌলত লুট করে বললেন, ‘এবারে চলো কাবুল ফিরে গিয়ে নবাবি করা যাক’। বাবুর তখন তাদের বুঝিয়েছিলেন যে, তাদের সিন্দুকে কড়া কড়া টাকা থাকলেই সঙ্গে সঙ্গে কাবুল উপত্যকার শরাব-কবাবের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে না। যেখানে আণ্ডার দাম আগে এক পয়সা ছিল সেখানে ওদের এখন দিতে হবে আষ্ট গণ্ডা (কিংবা ওই ধরনের কিছু একটা বইখানা আমার হাতের কাছে নেই)। কারণ সেপাই-পেয়াদারাও কিছু কম মাল লুট করেনি, তারাও এখন নিত্যি নিত্যি আণ্ডা খেতে চাইবে।
এরপর যে বইখানা পড়ে বাঙালি পাঠক আনন্দ পাবেন সেটা ফার্সিতে লেখা বাংলার (খুব সম্ভব প্রথম পূর্ণাঙ্গ) ইতিহাস। বাহারিস্তানে গায়েবি(২)– অজানা বসন্তভূমি। লেখক দিল্লি-আগ্রা-বিহারের শুকনো দেশ দেখে দেখে বাংলার দেহলিপ্রান্তে এসে পেলেন, চতুর্দিকে শ্যামল শ্যামল আর নীলিমায় নীল। তাঁর চোখ জুড়িয়ে গেল।
এর কথা আরেক দিন হবে।
———-
১. শুনেছ, রাজা কবিতা লেখে, এ আবার কেমন রাজা!’ এই বলে তখনকার দিনের ইংরেজ বাদশা-হাসলামংকে নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করত। পরবর্তী যুগের এক জহুরি ইংরেজ এই নিয়ে মন্তব্য করে দেখলেন, ওইসব বর্বর ইংরেজ জানত না যে, ওয়ারেন হেস্টিংসও কবিতা লিখতেন, এবং বাহাদুর শা’র তুলনায় অতিশয় নিরেস। ২. বাংলা আজগুবি অর্থ—‘আজ’ মানে ‘হতে’ from; গায়েবি মানে অজানা ‘লুপ্ত’ ‘অদৃশ্য’ ‘বিধিকৃৎ’ অর্থাৎ অজানা থেকে আগত বলে অদ্ভুত।
বিষ্ণুশর্মা
মিশরের পসারি–গন্ধবণিক– যেরকম ভারতের শঙ্খচূর্ণ(১) এবং অগুরু আতর বিক্রি করে, ঠিক তেমনি কাইরোর পুস্তক-বিক্রেতা বিষ্ণুশর্মার ‘পঞ্চতন্ত্র’ ও বুদ্ধজীবনী বিক্রি করে। কিন্তু সে ‘বুদ্ধজীবনী’ কে লিখেছেন, কেউ জানে না।
অবশ্য পঞ্চতন্ত্র সেখানে অন্য নামে পরিচিত। আরবিতে বলে ‘কলীলা ওয়া(২) দিমনা’। এ দুটি–কলীলা ও দিমনা– দুই শৃগালের নাম। সংস্কৃতে করকট ও দমনক। কোনও কোনও পণ্ডিত বলেন, গোড়াতে পঞ্চতন্ত্রের ওই নামই ছিল। পরবর্তী যুগে ওটিকে পাঁচভাগে বিভক্ত করে পঞ্চতন্ত্র নাম দেওয়া হয়। পাঁচ সংখ্যায় কেমন যেন একটা ম্যাজিক আছে কিংবা চোখের সামনে আপন হাতের পাঁচটা আঙুল যেন কোনও ইতস্তত প্রক্ষিপ্ত তথ্য, গল্প, প্রবাদ-সমষ্টিকে পচের কোটায় ফেলতে চায়। বাইবেলের ‘প্রাচীন নিয়মে’ (ওল্ড টেস্টামেন্ট) হয়তো সেই কারণেই ‘পেন্টাটিয়েশ’= পঞ্চগ্রন্থ আছে। ইদানীং আমরা পাঁচ-শালার পরিকল্পনা করি।
তা সে যাই হোক, আমাদের এই তৃতীয়/দ্বিতীয় শতাব্দীতে রচিত পঞ্চতন্ত্র ষষ্ঠ শতাব্দীতে প্রাচীন ইরানে পেলেভি (সংস্কৃতে পহলভি) ভাষাতে অনূদিত হয়। তার একটা বাইরের কারণও ছিল। প্রাচীন ইরানের সঙ্গে প্রাচীন গ্রিস-রোমের সম্পর্ক বহুকালের। কখনও যুদ্ধের মারফতে, কখনও শান্তির। শান্তির সময় উভয়ে একে অন্যের ওপর সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তার করেছে। কিন্তু দ্বিতীয়/তৃতীয় শতাব্দীতে ইরানিরা গ্রিসের ওপর বিরক্ত হয়ে (ফেড় অপ) পুবের দিকে মুখ ফেরালে। ফলে ষষ্ঠ শতাব্দীতে পঞ্চতন্ত্র রাজা খুসরৌ অনুশিরওয়ানের(৩) আমলে পহলভিতে এবং অল্পকালের ভিতরই পহলভি থেকে সিরিয়াকে অনূদিত হল।
এই প্রথম– সর্বপ্রথম কি না বলা কঠিন– একখানা আর্যভাষায় লিখিত পুস্তক আর্যেতর ভাষায় অনূদিত হল(৪), কারণ সিরিয়াক ভাষা হিব্রু, আরাময়িক ও আরবির মত সেমিতি ভাষা। ইরাক সিরিয়া অঞ্চলে প্রচলিত এই সিরিয়াক ভাষা ও সাহিত্য (৩য় থেকে ১৪ শতাব্দী পর্যন্ত এর আয়ু) বরাবরই ইরানের সঙ্গে লেনদেন রাখত বলে পলভিতে কোনও উত্তম গ্রন্থ অনূদিত হলে সেটি সিরিয়াকেও অনূদিত হত। (পঞ্চতন্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে আরেকখানি ভারতীয় ধর্মগ্রন্থ বা গ্রন্থাংশ পহলভি হয়ে সিরিয়াকে অনূদিত হয়, এর পরবর্তী যুগে মধ্যপ্রাচ্য ও ইয়োরোপে পঞ্চতন্ত্রের চেয়ে ঢের বেশি সম্মান পায় তার কথা পরে হবে।)
বিষ্ণুশর্মা রচিত পঞ্চতন্ত্রের কপাল ভালো। পহলভিতে যিনি এ পুস্তক অনুবাদ করেন তিনি ছিলেন রাজ-বৈদ্য, অতএব সুপণ্ডিত। সিরিয়াকে যিনি তস্যানুবাদ করেন তিনিও জ্ঞানীজন, কারণ এ-গ্রন্থ অনুবাদ করার পূর্বেই তিনি কিয়ৎপরিমাণ গ্রিক দর্শন ও কৃতিত্বসহ সিরিয়াকে অনুবাদ করেছিলেন।
পহলভি অনুবাদটি লোপ পেয়েছে। কিন্তু ষষ্ঠ শতাব্দীতে অনূদিত সিরিয়াকে অনুবাদটি (“কলিলগ ও দমনগ”) এখনও পাওয়া যায়।
এর প্রায় দু শো বৎসর পর মোটামুটি হজরৎ মুহম্মদের জন্মের দেড়শো বৎসর পর জনৈক আরব আলঙ্কারিক পঞ্চতন্ত্র আরবিতে অনুবাদ করেন। আরবি সাহিত্যের তখন কৈশোরকাল। এই পুস্তক অনুবাদ করার সময় অনুবাদক আব্দুল্লা ইবন্ অল্-মুকাফফার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তরুণ আরব সাহিত্যিকদের শৈলী বা স্টাইল শেখানো বিশেষ করে যারা ‘ব্যাল-ল্যাৎর’, রম্যরচনায় হাত পাকাতে চান।(৫) পহলভি সিরিয়াক হয়ে আরবিতে পৌঁছতে গিয়ে বিষ্ণুশর্মা নামটি কিন্তু এমনিই রূপান্তরিত হয়ে যায় যে আরবরা ভাবে, ইনি বিদ্যাপতি, এবং সেই অনুসারে তাঁর নাম লেখা হয় বীদবা বীদপা বীদপাই (আরবিতে ‘প’ অক্ষর নেই, কিন্তু মাঝে মাঝে কাছাকাছি অন্য দুই অক্ষর দিয়ে ‘প’ ও ‘চ’ বোঝাবার চেষ্টা করা হয়)। আরবি অনুবাদ হয় অষ্টম শতাব্দীতে এবং তার হিব্রু অনুবাদ দ্বাদশ শতকে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে জনৈক ক্যাথলিক কার্ডিনালের জন্য এটি লাতিনে ডিরেক্টরিয়ুম ভিট্যে হুমান্যে’ (অর্থাৎ মোটামুটি ‘মানবজীবনের জন্য হিতোপদেশ’–‘পঞ্চতন্ত্র’ ও ‘হিতোপদেশ’ যে সংশ্লিষ্ট সে-কথা মধ্যপ্রাচ্যে জানা ছিল) নাম নিয়ে ইয়োরোপে প্রচারিত হয়, এবং এই অনুবাদের ওপর নির্ভর করে পরবর্তীকালে ইয়োরোপের প্রায় তাবৎ অর্বাচীন ভাষাতে ‘বীদপাই-এর নীতিগল্প’ বা ‘কলীলা ও দিমনা’ রূপে অনূদিত হয়ে প্রখ্যাতি লাভ করে।
‘জাতক’, ‘পঞ্চতন্ত্র, ‘হিতোপদেশে’র বিজয়যাত্রা সম্বন্ধে মৌলিক গবেষণা করেছেন স্বর্গত ঈশান ঘোষ। তাঁর অতুলনীয় জাতক অনুবাদের ভূমিকায় তিনি লেখেন, ‘পঞ্চতন্ত্রের কথাগুলি পৃথকভাবে কথিত নহে। এক একটি তন্ত্রে এক একটি কথাকে কেন্দ্রীভূত করিয়া তাহার আশেপাশে অন্য বহু কথা সংযোজিত হইয়াছে। উত্তরকালে অস্মদ্দেশে বেতাল পঞ্চবিংশতি ও হিতোপদেশ প্রভৃতি আরবে নৈশোপাখ্যানমালা এবং য়ুরোপে Decameron, Pentameron, Heptameron, Canterbury Tales প্রভৃতি গ্রন্থের রচনাতেই এই পদ্ধতি অনুসৃত হইয়াছে। পঞ্চতন্ত্রের কথাগুলি উক্তরূপে একসূত্রে নিবদ্ধ না থাকিলে বোধ হয় দেশদেশান্তরে ভ্রমণের সময় ছত্রভঙ্গ হইয়া যাইত।’ এ অনুচ্ছেদ ঈশান ঘোষ শেষ করেছেন এই বলে—‘হিন্দুই হউন, বৌদ্ধই হউন, পঞ্চতন্ত্রকার অতি শুভক্ষণে লেখনী ধারণ করিয়াছিলেন। লোকমুখে বা গ্রন্থাকারে তাঁহার কথাগুলি সভ্য অসভ্য সর্ব দেশে যেরূপভাবে পরিজ্ঞাত হইয়াছে, পৃথিবীতে অন্য কোনও পুস্তকের ভাগ্যে সেরূপ ঘটে নাই।(৬)’
অজহর বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চলে যে পুস্তক-বিক্রেতা আমাকে ‘কলীলা ওয়া দিমনা’ বিক্রি করে, সে ইঙ্গিত দেয়, আরেকখানি ভারতীয় পুস্তক কপ্ট খ্রিস্টানরা (এঁরা নিজেদের ফারাওয়ের বংশধর বলে দাবি করে। কিছুদিন পূর্বে আরবিতে পুনঃপ্রকাশ করেছেন।
তখন কপ্ট বন্ধুদের কাছে অনুসন্ধান করে জানতে পারি, এর আরবি নাম ‘সুৎরহ বার্লাম ওয়া য়ুআসফ’ এ পুস্তকের প্রধান নায়ক দু জন খ্রিস্টধর্মে সেন্টরূপে স্বীকৃত হয়েছেন ক্যাথলিক উভয়কে স্মরণ করেন ২৭ নভেম্বর ও য়ুআসফকে গ্রিক চার্চ স্মরণ করেন অগস্ট (সেন্টস্ ডে)।
তখন অনুসন্ধান করে দেখি, ‘য়ুআসফ’ নাম এসেছে ‘বোধিসত্ত্ব’ থেকে ও ‘বার্লাম’ এসেছে ‘বুদ্ধ ভগবান’-এর ‘ভগবান্’ থেকে!
এ পুস্তকের কাহিনী পঞ্চতন্ত্রের চেয়েও বিস্ময়জনক–
২/8/৬৬
———-
১. এই শঙ্খচূর্ণ নিয়ে কয়েক বৎসর পূর্বে এদেশে একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যায়। যেসব শাঁখারি পূর্ববাংলা থেকে এসে পশ্চিমবাংলায় আশ্রয় নিয়েছে তাদের দরকার শখের। শঙ্খ প্রধানত বিক্রি হয় মাদ্রাজ অঞ্চলে এবং তার অন্যান্য খরিদ্দার আরব দেশ, মিশর ইত্যাদি। তারা শাঁখ গুঁড়ো করে ওষুধ বানায়। আমাদের গরিব শাঁখারিরা যে দাম দিতে প্রস্তুত ছিল (সোজাসুজি, না পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মারফৎ, আমার ঠিক মনে নেই) আরবরা তার কিঞ্চিৎ বেশি দাম দিতে রাজি ছিল বলে মাদ্রাজ তাবৎ শঙ্খ বিক্রি করে দেয় ওদের। ফলে বহু শাঁখারি বেকার হয়ে যায়।
২. কোনো কোনো পণ্ডিতের ধারণা আরবির এই ‘ওয়া’= ‘অ্যান্ড’= এবং থেকে বাংলা ‘ও’ এসেছে।
৩. এই খুসরৌর আমলেই চতুরঙ্গ খেলা ভারত থেকে ইরানে যায়।
৪. তার অর্থ অবশ্য এ নয় যে, এই সর্বপ্রথম সেমিত্রি জগতে ভারতীয় সাহিত্য পরিচিত হল। বস্তুত এর অনেক পূর্বেই জাতকের বহু গল্প কাফেলা ক্যারাভান] ও চট্টির কথকদের স্টরি-টেলার] মারফতে গ্রিস রোম পর্যন্ত চলে গিয়েছে। বৌদ্ধ শ্ৰমণরা খ্রিস্ট-জন্মের পূর্বেই মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। তারও পূর্বে লোহিত সমুদ্রের কূল ধরে ধরে মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যসম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে, এমনকি প্রাচীনতম মোনজোদড়োর সঙ্গে ইরাকের সম্পর্ক ছিল সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু উপস্থিত এগুলো আমাদের আলোচনার বাইরে। এবং বৌদ্ধধর্ম চীনে প্রবেশ করলে যেসব গ্রন্থ অনূদিত হয় সে-ও এ আলোচনার বাইরে।
৫. অধীন এই উদ্দেশ্য নিয়েই বছর ষোল পূর্বে পঞ্চতন্ত্র’ সিরিজ ‘দেশ’ পত্রিকায় আরম্ভ করে। নইলে বিষ্ণুশর্মার অনুকরণ করার মতো দম্ভ আমার কখনও ছিল না। এর অল্প পরেই Indian Council for Cultural Relations-এর সঙ্গে সংযুক্ত থাকাকালীন মরহুম মৌলানা আজাদের নেতৃত্বে আমরা, একখানা আরবি ত্রৈমাসিক (‘সকাফৎ-উল-হিন্দ’ ‘ভারতীয় সংস্কৃতি’) প্রকাশ করি ও ওই সময় মিশরাদি একাধিক দেশ থেকে অনুরোধ আসে যে, যেহেতু অদ্যকার ‘কলীলা ওয়া দিমনা’ ও ‘পঞ্চতন্ত্রে’ প্রচুর তফাৎ, অতএব আমরা যেন একখানি নতুন অনুবাদ প্রকাশ করি। আমরা সে-কাজ। সানন্দে প্রাগুক্ত পত্রিকায় আরম্ভ করি।
৬. ঈশান ঘোষের বাংলা জাতক কি জর্মন, কি ইংরেজি, কি হিন্দি সব জাতকানুবাদের চেয়ে শতগুণে শ্ৰেষ্ঠ। অসাধারণ পরিশ্রম ও অতুলনীয় পাণ্ডিত্যের সঙ্গে ঈশান এই অনুবাদ সম্পন্ন। করে বঙ্গবাসীকে চিরঋণে আবদ্ধ করে গেছেন। এ অনুবাদ প্রকাশিত হলে পর পালিপাণ্ডিত্যে আরেক ধনুর্ধর বিশ্বভারতীর অধ্যক্ষ বিধুশেখর শাস্ত্রী এর সমালোচনা করেন। পরম লজ্জা ও পরিতাপের বিষয় ঈশানের অনুবাদ বহু বৎসর পূর্বে নিঃশেষ হওয়া সত্ত্বেও এর পুনর্মুদ্রণ হয়নি। শুনতে পাই, সাহিত্য আকাঁদেমী স্বর্গত হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলা কোষ পুনর্মুদ্রণ করেছেন। তাঁরা যদি (বিধুশেখরের আলোচনাসহ) এই গ্রন্থের পুনর্মুদ্রণে সহায়তা করেন তবে গৌড়জন তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে।
ভাষা
হাট-বাজার, শাক-সবজি(১), দান-খয়রাত, দুখ-দরদ, ফাঁড়া-গর্দিশ, মান-ইজ্জৎ, লজ্জা-শরম, ভাই-বেরাদর, দেশ-মুল্লুক, ধন-দৌলত, রাজা-বাদশা, ঝড়-তুফান, হাসি-খুশি, মায়া-মহব্বৎ জন্তু-জানোয়ার, সীমা-সরহদ ইত্যাদি ইত্যাদি।
এ-স্থলে লক্ষ করার প্রথম তত্ত্ব এই যে, প্রত্যেক সমাসের প্রথম শব্দটি খাঁটি দিশি ভারতীয় শব্দ; হাট, শাক, দান, দুখ, মান, লজ্জা, দেশ ইত্যাদি এবং দ্বিতীয় শব্দটি যবনিক (আরবি, ফার্সি, তুর্কি, হিব্রু গয়রহ), যেমন বাজার, সবজি, খয়রাৎ, দর্দ ইত্যাদি। এবং দুটি শব্দই প্রায় সমার্থসূচক।
তা হলে প্রশ্ন, এ ‘কুকর্মের’ কী প্রয়োজন?
আমরা যখন সাধারণের কোনও অজানা ভাষা থেকে উদ্ধৃতি দিই, তখন বাংলা অনুবাদটি দিই তার পরে। তাই আমরা যদি ইংরেজি প্রবন্ধে সংস্কৃত বা বাংলা উদ্ধৃতি দিই তবে ইংরেজি অনুবাদটি দিই পরে। অর্থাৎ যাকে বোঝাতে যাচ্ছি, তার ভাষা আসে পরে।
তা হলে মনে করুন, মুসলমানের আগমনের কিছুকাল পরে কোনও হিন্দু (বা নবদীক্ষিত মুসলমানও হতে পারে কারণ হিন্দু ধর্মবর্জন করে মুসলমান হয়ে গেলে রাতারাতি তার আরবি-ফার্সি রপ্ত হয়ে যায় না) গেল মুসলমান শাসনকর্তার কাছে বিচারের আশায়। বললে, ‘ধর্মাবতার’, হুজুর! দেশ–’ বলেই থমকে দাঁড়াল। ভাবলে হুজুর কি “দেশ” শব্দটা জানেন! হুজুর তো হাট-বাজারে ঘোরাঘুরি করে দেশি শব্দ শেখবার ফুসৎ পান না’–(অথচ আমাদের হিন্দুটি পেটের দায়ে, কাজের তাড়ায় বিদেশাগত মুসলমানদের সঙ্গে মেলামেশা করার ফলে কিছু কিছু যাবনিক শব্দ শিখে গিয়েছে। তাই ‘দেশ’ বলে থমকে গিয়ে বললে ‘মুল্লুক’– ওটা হুজুরের যাবনিক শব্দ। অতএব শেষ পর্যন্ত তার নিবেদন দাঁড়াল, ‘দেশ-মুলুক ছারখার হয়ে গেল। রাজা-বাদশা (আবার রাজা বলে থমকে গিয়ে যাবনিক “বাদশা” বললে) আমাদের মতো কাঙাল-গরিবের (গরিব আরবি), দুখ-দরদ (দরদ, দর্দ ফার্সি) কে বুঝবে? আমাদের মান-ইজ্জৎ (ইজ্জৎ আরবি) ধনদৌলত (দৌলত যাবনিক) সব গেল। মেয়েছেলের লজ্জা-শরম (শর্ম যাবনিক)-ও আর বাঁচে না। রাস্তায় বেরোলেই দেখতে পাবেন, কারও মুখে হাসি-খুশি (খুশি ফার্সি) নেই। হুজুর অনুমতি দেন– ভাই-বেরাদর (বেরাদর ফার্সি) নিয়ে মগের মুল্লুকে চলে যাই।’
মনে করুন, কথার কথা কইছি, হুজুর সত্যকার হুজুর ছিলেন। হুঙ্কার দিয়ে প্রতিবিধান করলেন।
আমাদের বঙ্গসন্তানটি বাড়ি ফিরে গৃহিণীকে আনন্দে ডগমগ হয়ে বললে, ‘বুঝলে গিন্নি হুজুর যা আমায় খাতির–’(বলেই থমকে দাঁড়াল : হুজুরের দরবারে ‘খাতির’ কথাটি খুবই চালু, সেইটেই এতক্ষণ ধরে দরবারে সে শুনেছে, তাই দুম্ করে সেটা ব্যবহার করে দুশ্চিন্তায় পড়ল, গিন্নি তোে যাবনিক শব্দটা বুঝবে না, গিন্নি তো হাট-বাজারে গিয়ে যবনের সঙ্গে মেলামেশা করে এসব শব্দ শেখেনি– তাই সঙ্গে সঙ্গে বললে)—’যত্ন– হুজুর যা খাতির-যত্ন করলেন কী বলব। আবার দোকান (ফের মুশকিল– দোকান ফার্সি শব্দ, তাই বললে “হাট” হিট্ট হাট খুলবে, কোনও চিন্তা করো না গিন্নি! নারায়ণ, নারায়ণ।’
এ যুগে আবার ফিরে আসব। কিন্তু তার পরবর্তী যুগে দেখুন, ইংরেজ boss-কে বলছি, ‘স্যার! আমি উকিল (বলে থমকে দাঁড়ালুম, উকিল যদ্যপি আসলে আরবি শব্দ, এদানির ইটি খাঁটি বাংলা, স্যার কি বুঝবেন? তাই হন্তদন্ত হয়ে বললুম) ব্যারিস্টার (উকিল-ব্যারিস্টার) লাগিয়েছিলুম, ঘটি (ওই যযা! স্যার বুঝবেন কি?) গেলাস (glass= এবার স্যার বুঝবেন!) ঘটি-গেলাস বন্ধক দিয়েছি তেনাদের জন্য এরেক (ফের ইংরেজি ‘ব্রান্ডি’) ব্রান্ডি, বিড়ি-সিগারেট (দ্বিতীয়টা ইয়োরোপীয়) যা গেছে সে আর বলে কাজ নেই।’
এইসব বলে-কয়ে তো ছুটি নিয়ে দেশে গেলুম। প্রথমেই ঠাকুরমাকে পেন্নাম।
বললুম,’ ঠাকুমা’ পরে সব গুছিয়ে বলব, এই বেলা শুনে নাও সংক্ষেপে। বড় মাসীর গুণধর ছোটভাইটি নিয়েছেন ফ্ল্যাট (আবার সেই হাঙ্গামা– ঠাকুমা তো ‘ফ্ল্যাট’ বুঝবে না, অতএব বললুম) ফ্ল্যাট-বাড়ি। আমাদের কাউকে না শুনিয়ে করেছেন বিয়ে। কিন্তু ঠাকুমা, মেয়েটি কী সুন্দর। এক্কেবারে ডল (dool–সর্বনাশ, ঠাকুমা তো বুঝবে না, তা হলে ‘পুতুল’ বলি)– পুতুলের মতো। কিন্তু হলে কী হয়! গুরু আছেন, ধম্মো আছেন। ব্যস! এল তেড়ে টাইফয়েড-জ্বর (টাইফয়েড তো জ্বরই বটে– তবু ঠাকুমা যদি না বোঝেন, অতএব ‘জ্বর’টা বলতে হল); তুমি ভাবছ আমরা কিছুই করিনি। ডাক্তার (আবার সেই বিপদ, তাই বলতে হবে) বদ্যি (ডাক্তার-বদ্যি) নিয়ে এলুম। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না।’
তাই আবার নিবেদন করছি, যাকে বোঝাচ্ছি তার বোধ্য শব্দটি আসে পরে।
এটা কিছু নতুন তত্ত্ব, আমাদের দেশের আজগুবি ব্যাপার নয়। ইংলন্ডেও নরমান বিজয়ের পর ইংরেজ যখন বিদেশি হুজুরের কাছে গিয়ে ফরিয়াদ বা রিপোর্ট দিত, তখন বলত, ‘He is very meek and humble (meek to gafaris, fpe humble fast নরমানদের শব্দ), Sir, but it is odd and strange (odd ইংরেজি, strange নরমান), that although we thought it meet & proper (meet ইংরেজি, proper নরমান) that we should search every nook and comer (nook RTS, comer নরমান), our sorrow and grief (sorrow ইংরিজি, grief নরমান) know nobound that we did not find him.’
তফাৎ শুধু এইটুকু যে ইংরেজ তখন দেশি ও বিদেশি শব্দের মাঝখানে and বসিয়েছে– meek and humble, odd and strange; আমরা বাঙালিরা ‘and’ এবং বসাইনিঃ আমরা বলেছি, হাসি-খুশি, মান-ইজ্জৎ, দেশ-মুল্লুক।
পাঠক কিন্তু ভাববেন না, আমাদের সব সমাসই এরকম।
জল-পানি, বাজার-উটকো, মাল-মশলা, ঘটি-বাটি, টোল-চতুষ্পাঠী, মক্তব-মাদ্রাসা, ইস্কুল-কলেজ অন্য ধরনের সমাস।
১২/৩/৬৬
———
১. কিন্তু শাক-ভাত, শাক-পাত, শাক-পাতেড়, শাকান্ন, শাক মাছ অন্য সমস্যার অঙ্গ। স্থানাভাব না হলে সেটিরও আলোচনা করা হবে।
মরহুম ওস্তাদ ফৈয়াজ খান
বিসমিল্লাতেই অতিশয় সবিনয় নিবেদন– আজ রাখি, এ অধম উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের মারপ্যাঁচ বিলকুল বোঝে না, ভরত থেকে আরম্ভ করে ধূর্জটিপ্রসাদত যেসব গুণীজ্ঞানী সঙ্গীতশাস্ত্র নির্মাণ করে গেছেন তাদের প্রতি আমার অগাধ ভক্তি, কিন্তু তাঁদের বর্ণিত রাগরাগিণীর পুত্রকন্যা গোষ্ঠী-কুটুম কে যে-কোন মেলে পড়েন, কিছুতেই মনে রাখতে পারিনে। শুধু তাই নয়, সবচেয়ে মারাত্মক তত্ত্ব, আমি পূর্ণ একটি বছর রেওয়াজ করেও তবলার গভীরে কেন– কানি পর্যন্ত পৌঁছতে না পেরে নিরাশ হয়ে সাধনাটি ছেড়ে দিই, অতি দুঃখে অতি অনিচ্ছায়; অবশ্য নিতান্ত সত্যের অপলাপ হবে–তাই এটাও ক্ষীণ কণ্ঠে বলে রাখি, দ্রুত-এর রেওয়াজ করতে গিয়ে আমার হাতের কড়াতে আর্থরাইটিস হয়।
দ্বিতীয়ত, এ ক্ষুদ্র রচনাটি মজলিস্-রৌশন্ সমঝদারের জন্য নয়, নয়, নয়।
আমি খান সাহেবকে পেয়েছিলুম মানুষ হিসেবে, বন্ধু হিসেবে। তিনি আমাকে মুগ্ধ করেছিলেন, সম্মোহিত করেছিলেন তাঁর মধুর ব্যক্তিত্ব দিয়ে যদিও তিনি খুব ভালো করেই জানতেন, আমি তাঁর জয়-জয়ন্তীতে যত-না রস পাই, তার চেয়ে বেশি পাই তাঁর কাফি হোলিতে।
তাই দয়া করে মেনে নিন, এ লেখাটি সাধারণ পাঁচজনের জন্য, যারা যুগৰ্ষি স্রষ্টাদের দৈনন্দিন জীবন, তাঁদের সুখ-দুঃখ, মান-অভিমান সম্বন্ধে জানতে চায় মাত্র কারণ তারা আমারই মতো সুরকানা, তালকানা হওয়া সত্ত্বেও গান শুনতে ভালোবাসে এবং যেহেতু সঙ্গীতের গভীরে পৌঁছতে পারে না, তাই স্রষ্টাদের জীবনটা, তাঁদের চালচলন, ওঠনবৈঠন নিয়েই সন্তুষ্ট। অশ্বত্থামার সঙ্গে আমাদের তুলনা করুন, আমাদের কোনও আপত্তি নেই।
১৯৩৫ সালে, এই সময়ে, আজ হতে ঠিক ত্রিশ বৎসর আগে এ-অধম বরোদা শহরে চাকরি নিয়ে পৌঁছয় এবং স্টেট গেস্ট হাউসে অতিথিরূপে স্থান পায়। মহারাজা স্বৰ্গত সয়াজিরাওয়ের সঙ্গে দেখা শেষ হওয়ামাত্রই আমার মনে যে অদম্য বাসনা জাগল সেটা নিতান্ত স্বাভাবিক।
ওস্তাদের ওস্তাদ রাজানুগ্রহপ্রাপ্ত শ্রীযুক্ত ফৈয়াজ খান বাস করেন এই বরোদা শহরেই। তাঁর কণ্ঠসঙ্গীত শুনতে না পেলে এই দুনিয়াতে জন্মালুমই-বা কেন, আর এই বরোদা শহরে এলুমই-বা কেন? তার চেয়ে বাঁ-হাতের তেলোতে জল নিয়ে সেটাতে ডুবে আত্মহত্যা করলেই হয়!
খবর নিয়ে শুনতে পেলুম, তাঁর বাড়িতে রোজ সন্ধ্যায় মহফিল-জলসা বসে, আর প্রায় প্রতি সকালে শাগরেদানসহ রেওয়াজ।
ইতোমধ্যে একটি অতিশয় অজানা-অচেনা বঙ্গসন্তানের সঙ্গে আলাপ হল। তার নাম বলব না, কারণ ছেলেটি এখনও বড় লাজুক। তবে সে যদি চিঠি লিখে আপত্তি না জানায়। তবে অন্য সুবাদে তার নাম প্রকাশ করে দেব। উপস্থিত ধরে নিন, তার নাম পরিতোষ। চৌধুরী। ওস্তাদের শিষ্য– অবশ্য নসিকে পাকা কথা বলতে হলে, ওস্তাদের বড় ভাইয়ের কাছেই সে রেওয়াজ করে বেশি। কারণ একাধিক সমঝদার আমাকে বলেছেন– আমার টুঁটি চেপে ধরবেন না! যে যদিও দাদাটি নিজের সভাস্থলে গাইতেন না, তবু সঙ্গীতশাস্ত্র তিনি জানতেন ওস্তাদ ফৈয়াজের চেয়ে বেশি। তাঁরাই বলেছেন, ওস্তাদ তাই শাগরেদদের কণ্ঠস্বর সুললিত গম্ভীর মধুর করার ভার নিতেন নিজে– অন্য ‘কাজের’ জন্য ভিড়িয়ে দিতেন দাদার কাছে, বিশেষ করে অচলিত, প্রায়-লুপ্ত রাগরাগিণীতে যাদের দিলচসপি-শখ অত্যধিক।
চৌধুরী তার গুরু খান সাহেবকে কী বলেছিল জানিনে, এক রবিবার সকালে তিনি সশরীরে আমার ডেরায় এসে উপস্থিত! আমি হতভম্ব। কোথায় তাঁকে বসাব, কী আপ্যায়ন করব, আমার মাথায় কিছুই খেলছে না। মহারাজ সয়াজিরাও এলেও আমি অতখানি গর্ব এবং নিজেকে এত অসহায় অনুভব করতুম না।
আর ওস্তাদ– বিশ্বাস করবেন না– বার বার শুধু আমার হাত দু খানা ধরে নিজের বুকে চেপে ধরেন। তিনি আমার চেয়েও বে-এক্তেয়ার! আর বার বার দরবারি (কানাড়া নয়!) কায়দায় আমাকে কুর্নিশ করেন।
বহুদিন ধরে সে বেইমান পাষণ্ডকে খুঁজেছি যে আমায় দুশমনি করে তাঁকে বলেছিল, আমি গুরুঘরের ছেলে এবং মুসলিম-বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞান কেন্দ্রভূমি কাইরোতে অ্যাসান্ মুসলিমশাস্ত্র অধ্যয়ন করেছি যে স্বয়ং মহারাজা আমাকে সেখান থেকে বরোদা রাজ্যে নিয়ে এসেছেন।
আমি আদৌ অস্বীকার করছিনে আমি গুরুবংশের ছেলে, এ ভারতে সে রকম শতলক্ষ আছে। কিন্তু তার চেয়ে আমার গুরুতর আপত্তি, আমার ক’ পুরুষ পূর্বে কে যে শেষ-গুরু হয়ে গেছেন, সেটাও প্রত্নতত্ত্বের বিষয়। এবং আমার সর্বাপেক্ষা মারাত্মক আপত্তি : কাইরোতে আমি যেটুকু আরবি শিখেছি সেটি আমি আপনাকে ছ মাসে শিখিয়ে দিতে পারি।
এ বিষয়টা আমি উল্লেখ করলুম কেন? এই যে গানের রাজার রাজা, এই ফৈয়াজ খান কী অদ্ভুত সরল ছিলেন সেটা বোঝাবার জন্য। পরে আমি চিন্তা করে বুঝেছি, তিনি সঙ্গীতের সর্বোচ্চ শিখরে উঠে গিয়েছিলেন বলে সরল বিশ্বাসে ভাবতেন, সয়াজিরাও যখন আমাকে খাতির করেন তখন আমিও নিশ্চয়ই আমার শাস্ত্রের সর্বোচ্চ শিখরে। তাঁর সঙ্গীতজ্ঞানের জন্য তিনি যখন রাজবল্লভ হয়েছেন, তখন আমিও তাই। একই লজিক!
এরপর কতবার আমাদের দেখাশোনা হয়েছে– গানের মজলিস-মহফিলের তো কথাই নেই। আমি প্রতিবার তাকে বোঝাবার চেষ্টা করেছি,’ দেখুন, ওস্তাদ! কত রাজা আসবে যাবে, কত শমস্ উ্ল-উলিমা (মহামহোপাধ্যায়) কত পাণ্ডিত্য দেখিয়ে যাবেন– এমনকি এই যে আমাদের বরোদার দেওয়ান সাহেব, যার হাম্বাই-তাম্বাইয়ের অন্ত নেই– তিনিও চলে যাবেন। এবং সঙ্গে সঙ্গে আরেক দেওয়ান এসে উপস্থিত হবেন, কিন্তু আপনার মতো লোক আবার কবে আসবে কে জানে? আমি বেঁচে থাকলে আরও রাজা দেখব, আরও দেওয়ান দেখব, কিন্তু আপনার মতো কাকে পাব?’
আর কী সুদর্শন পুরুষ ছিলেন তিনি! চেহারা রঙ গোপ সব মিলিয়ে তিনি যেন তারই গানের ‘(বন্দে) নন্দকুমারম’–শুধু নন্দকুমার ছিলেন শ্যাম, আর ইনি গোরাচাঁদ।
আমাকে শুধোলেন ‘কবে এসে একটু গান—’
আমি বাধা দিয়ে বললুম, ‘তওবা, তওবা! আপনি আসবেন এখানে! আমি যাব যে কোনও সন্ধ্যায়, আপনার ইজাজৎ পেলেই।’
তিনি কিছুতেই রাজি হলেন না।
কতবার তিনি সন্ধে সাতটায় এসে ভোর পাঁচটায় উঠেছেন। আমাকে কতবার তিনি বেহেশত দেখিয়েছেন। তাঁর ওফাতের (মৃত্যুর পর আর কেউ দেখায়নি।
বিশ্বাস করবেন না, আমি নন্দকুমার গানটি ভালোবাসি জেনে একদিন তিনি আমাকে আবার বলছি আমার মতো অতি-সাধারণ শ্রোতাকে– পুরো দেড় ঘণ্টা ধরে ওই গানটি শুনিয়েছিলেন।
কিন্তু কত লিখব! আমার স্মৃতির কত বড় অংশ জুড়ে এখনও তিনি বিরাজ করছেন!
তাই একটি ছোট্ট ঘটনার উল্লেখ করে শেষ করি।
একটি বরোদাগত বাঙালি মহিলার অনুরোধে আমার বাড়িতে মহফিল বসেছে। ওস্তাদ সেদিন বড় মৌজে।
দুপুরে বরোদায় ১১৪ ডিগ্রি গরম পড়েছিল। রাতদুপুরেও অসহ্য গরম, বর্ষা নামতে তখনও দু মাস বাকি। ওস্তাদ অনেক কিছু গাওয়ার পর শুধোলেন, ‘আদেশ করুন, কী গাইব।’ সেই মহিলাটি অনেক চাপাচাপির পর ক্ষীণ কণ্ঠে অনুরোধ জানালেন, ‘মেঘমল্লার।’
ওস্তাদ সঙ্গে সঙ্গে গান ধরলেন।
যেন তিনি তাঁর সমস্ত সাধনা, সমস্ত ঘরানা (হয়তো ভুল হল, কারণ ‘রঙিলা’ ঘরানা মেঘমল্লারের প্রতি কোনও বিশেষ দিলচসপি ধরেন কি না আমার জানা নেই), সমস্ত সৃজনীশক্তি, বিধিদত্ত গুরুদত্ত সর্বকলাকৌশল সেই সঙ্গীত সম্মোহন ইন্দ্রজালে ঢেলে দিলেন। আমরা নির্বাক নিস্পন্দ হয়ে যেন সর্ব লোমকূপ দিয়ে সে মাধুরী শোষণ করছি।
এমন সময় বাইরে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি।
মহফিলে হুলস্থুল পড়ে গেল। কে কী ভাবে ওস্তাদকে অভিনন্দন জানিয়েছিল, কে সুদ্ধমাত্র কুমড়ো-গড়াগড়ি দিয়েছিল, কে ওস্তাদের দিকে নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল মাত্র এ সবের বর্ণনা দেওয়ার শক্তি আমার নেই। অলৌকিক ঘটনার বর্ণনা তো শুধু তিনিই দিতে পারেন যার লেখনীতে অলৌকিক শক্তি আছে।
অন্যদিন ওস্তাদ আমাদের অভিনন্দন, প্রশংসাবাদ, মরহাবা যতখানি ঝুঁকে ঝুঁকে সেলাম জানিয়ে গ্রহণ করতেন, আজ তিনি সেরকম করলেন না। দু-একবার সেলাম জানিয়ে গালে হাত দিয়ে চুপ করে বসে রইলেন। আমার একটু আশ্চর্য লাগল।
অবশ্য তার পরও তিনি গেয়েছিলেন তোর অবধি।
শেষ ভৈরবী গেয়ে তিনি আমার কাছ থেকে বিদায় নিতে এলেন। আমি বললুম, ‘ওস্তাদ, বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন; একটু বিশ্রাম নেবার জন্য বসুন।’
অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পর যে কী বিষণ্ণতা মুখে মেখে আমার দিকে তাকালেন তার অর্থ আমি কিছুই বুঝতে পারলুম না। করুণ কণ্ঠে বললেন, আচ্ছা, সৈয়দ সাহেব, লোকে আমাকে এরকম লজ্জা দেয় কেন বলুন তো? আমি কি গান গেয়ে বৃষ্টি নামাতে পারি?
আমি ক্ষণমাত্র চিন্তা না করে বললুম, ‘সে জানেন আল্লা। আমি শুধু জানি, অন্তত আজ রাত্রে তিনি আপনার সম্মান রাখতে চেয়েছিলেন।’
৯।১০।৬৫
মা-মেরির রিস্টওয়াচ
একদা রম্য রচনা কী রীতিতে উত্তমরূপে লেখা যায়, এই বাসনা নিয়ে কলেজের ছেলের বয়সীরা আমাকে প্রশ্ন শুধাত; অধুনা শুধোয়, ঐতিহাসিক উপন্যাস কী প্রকারে লেখা যায়? আমি বাঙালি, কাজেই বাঙালির স্বভাব খানিকটে জানি– পাঁচু, ভূতো আর পাঁচজন যে ব্যবসা করেন– যথা পাবলিশিং হাউস কিংবা লন্ড্রি– পয়সা কামিয়েছে, সে সেইটেই করতে চায়, নতুন ব্যবসায় ঝুঁকি নিতে সে নারাজ। অতএব হাল-বাজারে যখন ঐতিহাসিক উপন্যাস ছেড়ে দিয়ে কালোবাজারের চেয়েও সাদা-বাজারে লাভ বেশি, তবে চল ওই লালকেল্লা ফতেহ করতে; মা-মেরিতে বিশ্বাস রাখলে কড়ি দিয়েও কিনতে হবে না, সায়েবের মুনশিও ওই আশ্বাস দিয়েছেন।
যারা পণ্ডিত লোক, ইতিহাস জানেন ও উপন্যাস লেখার কায়দাটাও যাঁদের রপ্ত আছে, তাঁরাই ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখতে পারেন। আমি ও আমার মতো আর পাঁচজন পারে না, আমরা পণ্ডিত নই। কিন্তু পণ্ডিত না হয়েও দিব্য বুঝতে পারি, ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখতে যাওয়ার বিপদটা কী?–পাখির মতো উড়তে না জেনেও চমৎকার বুঝতে পারি মনুমেন্টের উপর থেকে লাফ দিয়ে পাখির মতো ওড়বার চেষ্টা করলে হালটা মোটামুটি কী হবে।
এই তো হালে একটি সাপ্তাহিক পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে অলস নয়নে পড়লুম, ‘তুমি ওমরাহ নও।’
সর্বনাশ! এটা কী প্রকার হল? ‘ওমরাহ’ তো আমিরের সাদামাটা বহুবচন- সে রকম ‘গরিব’ থেকে ‘গুরবাহ’; তাই বলি ‘গরিব-গুরব’। সেই আইনেই বলি ‘আমির-ওমরাহ’ (‘আমির-ওমরো’ও শুনেছি; আকারান্ত শব্দ বাংলায়, ‘এ’ ‘ও’-তে আকছারই পরিবর্তিত হয়, যেমন ‘ফিতে’ ‘জুতো’– এর কোনও পাকা নিয়ম নেই। আরবি বা ফার্সি শব্দের একবচন এবং বহুবচন পাশাপাশি বসিয়ে আমরা অনেক সময় বাংলায় কালেকটিভ নাউন তৈরি করি– যেমন ‘আমির-ওমরাহ’ অর্থাৎ’ আমির সম্প্রদায়’ কিংবা ‘গরিব-গুরবো’ ‘দীনসম্প্রদায়’ ‘দীনজন’। তা সে যাই হোক, ‘ওমরাহ’ কথাটা বরহক বহুবচনেই আছে। কাজেই যে রকম আপনি ‘আমির সম্প্রদায় নন’ ব্যাকরণে ভুল, ‘তুমি ওমরাহ নও’ ভুল।
(ঠিক সেইরকম ‘আলিম’ পণ্ডিতের বহুবচন ‘উলেমা’– জমিয়া-ই-উলাম-ই-হিন্দ; অনেকেই না জেনে ইংরেজিতে লেখেন ulemas)
কাজেই প্রথম চোরাবালি শব্দ নিয়ে। ঠিক ঠিক অর্থ না জানলে আমাদের মতো অপণ্ডিত জন খায় মার। ঠিক সেইরকম গুপ্তযুগের উপন্যাস লিখতে গিয়ে না ভেবে ফুটিয়ে দিলুম রজনীগন্ধা, কৃষ্ণচূড়া– শব্দ দুটো থেকে বিশেষ করে যখন সংস্কৃতের সুগন্ধ বেরিয়েছে– অথচ দুটো ফুলই এদেশে এসেছে অতি হাল আমলে। এবং শুধু শব্দার্থ জানলেই হল না– রূঢ়ার্থে তার ব্যবহার জানতে হয়। তসবি(১)-খানা কথাটির দুটো শব্দ আমরা চিনি–যে ঘরে বসে বাদশা তসবিমালা জপ করেন। মোগল আমলে কিন্তু ওই ঘর ছিল অতিশয় গোপন (top secret) মন্ত্রণালয়।
কেউ যদি লেখেন ‘অতঃপর সম্রাট ঔরঙ্গজেব সমস্যা সমাধানের জন্য সমস্ত রাত কুরান শরীফ ঘেঁটেও কোনও হদীস পেলেন না’, তবে বাঙালি পাঠক এ-বাক্যে কোনও দোষ পাবেন না। কারণ হদীস বা হদিশ বলতে বাঙালি পাঠক প্রিন্সিডেন্স বা পূর্ব উদাহরণ বোঝে। আমি কুরানে হদীস খোঁজা আর বেদে মনুসংহিতা খোঁজা একই রকমের ভুল। কুরানে আছে পয়গম্বরের কাছে প্রেরিত ঐশী বাণী–আপ্তবাক্য। আর হদীসে আছে পয়গম্বর কীভাবে জীবনযাপন করতেন, কাকে কখন কী করতে আদেশ বা উপদেশ দিয়েছিলেন ইত্যাদি (এগুলোও অতিশয় মূল্যবান কিন্তু আপ্তবাক্য নয়)। কাজেই এগুলোর (হদীসের সন্ধান কুরানে পাওয়া যাবে কী করে? বস্তুত কোনও অর্বাচীন সমস্যা ও তার সমাধান কুরানে না পেলে আমরা হদীসে (শাস্ত্রে ‘স্মৃতি’র সঙ্গে তুলনীয়) যাই। যেখানে না পেলে ইজমাতে এবং সর্বশেষে কিয়াসে। কিন্তু শেষের দুটো স্মৃতিশাস্ত্রের গভীরে ঐতিহাসিক উপন্যাসে প্রতিবিম্বিত হওয়ার সম্ভাবনা অত্যল্প। তা সে যাই হোক, মুসলমান ধর্ম সম্বন্ধে যে কিছুটা জ্ঞান বাঞ্ছনীয় সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
কিন্তু তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন, মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে পরিচয়। ঐতিহাসিক উপন্যাসে সেটা প্রধানত বিস্ময়বোধক বাক্যে। তুলনা দিয়ে বলতে পারি, ফরাসি উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদে ‘মঁ দিয়ো’ ‘পার ব্ল্য’, ‘ভাঁত্র ব্ল্য’-গুলো ইংরেজ ফরাসিতেই রেখে দেয়; জর্মন উপন্যাসের অনুবাদে ‘মাইন গট’ ‘হ্যার গট’ ‘ডনার ভেটার’ মূলের মতো রেখে দেয়; এগুলোর অনুবাদ সম্পূর্ণ অসম্ভব নয়। অবশ্য স্মরণ রাখা উচিত, মঁ দিয়ো, মাইন গট এবং মাই গড একই জিনিস, একই বাক্য হলেও ইংরেজের পক্ষে মাই গড’ বলা নিন্দনীয়; নিতান্ত বিপাকে না পড়লে ইংরেজ ‘মাই গড’ বলে না। পক্ষান্তরে ফরাসি জর্মন কথায় কথায় ‘মঁ দিয়ো’ ‘মাইন গট’ বলে থাকে। তাই ইংরেজি অনুবাদের সময় মূলের আবহাওয়া রাখবার জন্য অনুবাদক এগুলো অনুবাদ করেন না।
আলহামদুলিল্লা, ইয়া আল্লা, তওবা তওবা, বিসমিল্লা এগুলো অবস্থাভেদে ব্যবহৃত হয়। আপনার ছেলে এম-এ পাস করেছে? তওবা তওবা!’ (বা তোবা তোবা!) বললে যে ভুল হয় সেটা সাধারণ জনও বোঝে। তাই এসব বাক্য সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা না থাকলে অনেকটা কারও প্রথম বংশধর জন্মালে আপনি যদি উচ্চকণ্ঠে বল হরি, হরিবোল’ বলে ওঠেন তা হলে যেরকম হয়! এসব ভুলে সাধারণ সামাজিক উপন্যাস পাঠক শুধু একটুখানি মুচকি হাসে, কিন্তু ঐতিহাসিক উপন্যাস যিনি লেখেন তার কাছ থেকে পাঠক একটু বেশি প্রত্যাশা করে।
‘শার্ঙ্গদেবে’র মতো উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের গভীরে যাঁরা গিয়েছেন তাঁরাই জানেন, পাঠান-মোগল যুগের সঙ্গীত তথা এদের আগমনের পূর্বে ভারতীয় সঙ্গীতের প্রকৃত স্বরূপ কী ছিল; এ নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন তাঁদের কতখানি ফার্সি ভাষার সঙ্গে পরিচিত হবার। প্রয়োজন। ঐতিহাসিক ঔপন্যাসিকের অতখানি ফার্সি জানার প্রয়োজন নেই, কিন্তু তিনি যদি রানি রিজিয়ার দরবারে সেতার বাজাতে আরম্ভ করেন তবে বোধ হয় সঙ্গীতজ্ঞদের অনেকেই আপত্তি জানাবেন। আমি বিশেষজ্ঞ নই, তাই পণ্ডিতেরা যখন কিছু বলেন তখন সেটা মনে রাখবার চেষ্টা করি। মৌলানা আজাদ আমাকে বলেন, ‘সেতার তৈরি করেন আমির খুসরো। এটা বীণার অনুকরণে তৈরি, কিন্তু বীণার চেয়ে সহজ।’
আমি উত্তরে বললুম, ‘আমি আরেক পণ্ডিতের কাছে শুনেছি বাদ্যযন্ত্র-নির্মাতার পক্ষে সেতার-নির্মাণ বীণার চেয়ে কঠিনতর। কিন্তু বাজানেওয়ালার পক্ষে সেতার বাজানো সহজতর। ওই পণ্ডিত আমাকে বলেন, ‘অনেক সময় যে জটিল বাদ্যযন্ত্র নির্মাণ করা হয় সেটা বাজানেওলার পক্ষে বাজানো সহজ করে দেবার জন্য”।’ (শার্ঙ্গদেব হয়তো খাঁটি খবর রাখেন।)
এসব ঝামেলার মাঝখানে পাঠান বা মোগল দরবারের গানের মজলিস বর্ণনা করা যে বিপদসঙ্কুল, সে কথা পাঠকমাত্রেই বুঝতে পারবেন।
ঠিক তেমনি মোগল আমলের ফিস্টির বর্ণনা। কোরমা, কালিমা, কোফতা, কবাব (শিক্ কবাব প্রাক-মুসলিম যুগেও ছিল–শূল্যপক্ব মাংস– কিন্তু সেটা আঁকাবাঁকা শিকের ভেতর ঢুকিয়ে করা হত, না শূলের ডগায় ঝুলিয়ে ঝলসানো হত, তা জানিনে) যে সব কটাই যাবনিক খাদ্য তা জানি, কিন্তু মোগল ফিস্টিতে বাঁধাকপির পাতার ভিতর কিমা দিয়ে যে দোলমা তৈরি হয়, সেটা কি চলবে? কপি-জাতীয় জিনিস এদেশে এল কবে? এমনকি যে সিম জিনিসটা ঘরোয়া বলে মনে হয় সে সম্বন্ধেও একখানি চিরকুটে দেখি ঋষিতুল্য দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন শাস্ত্রীকে শুধোচ্ছেন, ‘সংস্কৃতে আপনি সিম জিনিসটার উল্লেখ পেয়েছেন কি?’
মোগল ছবিতে তাদের জামাকাপড় গয়নাগাঁটি পরিষ্কার দেখতে পাই। কিন্তু সব কটার নাম তো জানিনে। মা-দুর্গার নাকের নথ দেখে দ্বিজেন্দ্রনাথ চিত্রকরকে শুধান, ‘নথ কি মুসলমান আগমনের পূর্বে ছিল?’
কিন্তু আপত্তি কী? গদাযুদ্ধে নামার সময় ভীমের পকেটে যদি ফাউন্টেনপেন দেখা যায়, তবে কী আপত্তি! জেরুজালেমের এক মেরি মূর্তির বাঁ-কব্জিতে দেখি ছোট্ট দামি একটি রিস্টওয়াচ! ভক্তের চোখে মা-মেরির বাঁ-হাতখানা বড্ড ন্যাড়া ন্যাড়া দেখাচ্ছিল, তাই। জানিনে, বারোয়ারি দুর্গাপুজোয় মা-দুর্গা নাইলন পরতে আরম্ভ করেছেন কি না!
———-
(১) কত না হস্ত চুমিলাম আমি
তসবিমালার মত,
কেউ খুলিল না কিস্মতে ছিল
আমার গ্রন্থি যত!
অর্থাৎ তসবিমালা জপ করে এক সাধু অন্য সাধুর হাতে তুলে দেন, কিন্তু কেউই দয়া করে মালার সুতোটি কেটে মুক্তোগুলোকে মুক্তি দেন না।
মিজোর হেপাজতি
নেফা অঞ্চল বাদ দিলে আসামে যে কটি পার্বত্য অঞ্চল গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য ধারণ করে, তার ভেতর পড়ে খাসিয়া, গারো, নাগা ও লুসাই। এর সঙ্গে ত্রিপুরার কুকি অঞ্চলেরও নাম করতে হয়, কিন্তু নানা কারণে সেখানকার কুকিরা এযাবৎ কোনও সমস্যার সৃষ্টি করেনি এবং যেহেতু ত্রিপুরা আসামের অংশরূপে গণ্য হয়নি, তাই সে-দেশ এ প্রবন্ধের আলোচনা নয়। কিন্তু মণিপুর সম্বন্ধে এস্থলে কিছু না বললে তাদের ও গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম তথা বাঙালি-ধর্মপ্রচারকদের প্রতি অবিচার করা হয়।
আসামের অন্যান্য পার্বত্য জাতির মতো মণিপুর অনুন্নত নয়। মহাভারতের অর্জুন-চিত্রাঙ্গদার মণিপুর ও বর্তমান মণিপুর একই কি না সে নিয়ে তর্কাতর্কি করার শাস্রাধিকার আমার নেই এবং যেহেতু মণিপুর অধীনের জন্মভূমির প্রত্যন্ত ভূমিতে অবস্থিত, সে তার প্রতিবেশীকে অহেতুক ক্ষুব্ধ করতে চায় না, কিন্তু এ কথা সত্য যে, যদ্যপি সাধারণ মণিপুরিদের চেহারার ছাপ মঙ্গোলীয়, ওদের ভেতর হঠাৎ বিশুদ্ধ আর্য টাইপও পাওয়া যায় এবং যেহেতু পার্শ্ববর্তী আর্য বাংলা-ভাষাভাষী সিলেট কাছাড়ে এ টাইপ দুর্লভ, তা হলেই প্রশ্ন উঠবে, কান্যকুজ অঞ্চলের এই আর্য টাইপ হঠাৎ মণিপুরে আবির্ভূত হল কী প্রকারে? পশ্চিমবাংলার সঙ্গে মণিপুরের সরাসরি যোগসূত্র না থাকা সত্ত্বেও বাঙালি আজ মণিপুরি নৃত্যের কথা ও সে নৃত্য যে রাধাকৃষ্ণকে কেন্দ্র করে জন্ম ও শ্রীবৃদ্ধি লাভ করেছে, সে-কথা জানে– বস্তুত ভারতবর্ষে অধুনা যে চার রকমের শাস্ত্রীয় নৃত্য-পদ্ধতি স্বীকৃত হয়, এ নৃত্য তারই অন্যতম কিন্তু বৈষ্ণবধর্ম মণিপুরে প্রচার ও প্রসার লাভ করে অষ্টাদশ শতাব্দীতে, অতএব এ নৃত্যকে আড়াই হাজার বছরের ঐতিহ্য দিয়ে মহাভারতের সঙ্গে সংযুক্ত করা কঠিন।(১)
কিন্তু এহ বাহ্য। আসল প্রশ্ন এই : ১৭০৫ খ্রিস্টাব্দে রাজাদেশে মণিপুর যে বৈষ্ণবধর্ম ‘রাষ্ট্রধর্ম’-রূপে গ্রহণ করল সেটা সম্ভব হল কী প্রকারে? আসামের আর পাঁচটা পার্বত্য জাতি যে রকম আর্য জনপদ থেকে দূরে হাজার হাজার বত্সর ধরে আপন আপন প্যাটার্ন অব কালচার বুনে যাচ্ছিল মণিপুরও করছিল তাই। তাদের মাঝখানে একমাত্র মণিপুরই বৈষ্ণব হয়ে গেল কেন? এ কথা সত্য যে শিলচর থেকে মণিপুর পৌঁছানো সহজতর। কিন্তু মৈমনসিং থেকে গারো পাহাড় যাওয়াও তো কঠিনতর নয়, গারোরা অতিশয় শান্তিপ্রিয় এবং দু-একটি গারো মুসলমানের সঙ্গেও আমার আলাপ-পরিচয় হয়েছে। পক্ষান্তরে নেফার অধিবাসীদের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করা কঠিনতর; অথচ লোকমুখে শোনা; সেখানকার কোনও কোনও উপজাতি সর্বাবদে অ-হিন্দু হয়েও মাথার এক দিকের খানিকটা চুল কামায় ও চিহ্নস্বরূপ দেখিয়ে বলে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ নাকি তাদের অর্ধ-হিন্দুরূপে পরিণত করে বলেন যে, তিনি আবার এসে তাদের পূর্ণ-হিন্দু করে দেবেন তারা এখনও সেই প্রতীক্ষায় আছে। তা সে যাই হোক, মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের বাঙালি শিষ্যেরাই যে মণিপুরে বৈষ্ণবধর্ম প্রচার করেন সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। মণিপুরি ভাষা বাংলা অক্ষরে লেখা হয়; পক্ষান্তরে পরবর্তী যুগে খ্রিস্টান মিশনারিরা পার্বত্যবাসীদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার পর তাদের ভাষা রোমান বা অদ্যকার দিনের ইংরেজি অক্ষরে লেখেন।(২)
কিন্তু সবচেয়ে বড় তত্ত্বকথা, মণিপুরবাসী বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করতে (এবং পরবর্তী যুগে কাছাড়ে আশ্রয়গ্রহণকারী কিছু মণিপুরি ইসলাম গ্রহণ করাতে) কোনও সভ্যতা-সংস্কৃতিগত বা অর্থনৈতিক সমস্যা সৃষ্ট হয়নি। রাজনৈতিক সমস্যার কোনও প্রশ্নই ওঠে না, কারণ বাঙালি মিশনারিরা মণিপুরের সিংহাসনে কোনও বাঙালিকে বসাতে চাননি। অর্থনীতির দিক দিয়ে দেখতে গেলে মণিপুরবাসী ও পার্শ্ববর্তী কাছাড়বাসীর মধ্যে দ্রব্য বিনিময়ের ফলে উভয়েই উপকৃত হন। এই অর্থনীতিক দিকটা পাঠক বিশেষভাবে মনে রাখবেন। আমার মনে হয়, নাগা এবং মিজোদের অর্থনৈতিক সমস্যাটা কেউ সবিশেষ চিন্তা করে দেখেননি।
আমার বাল্যকালে সিলেট জেলার একাধিক জায়গায় নিয়ত বর্ধিষ্ণু খ্রিস্টান মিশন ছিল এবং সে যুগে ভারতের তাবৎ প্রটেস্টান মিশনারিদের ভিতর দক্ষিণ-শ্রীহট্টে কর্মরত ওয়েলশ মিশনের (এখনও মিজোদের ভিতর এই মিশনই সর্বপ্রধান এবং যে ক’জন মিশনারির খবর অধুনা পাওয়া যাচ্ছিল না তারা খুব সম্ভব এই মিশনেরই।) রেভারেন্ড পিগোয়ন জোন্স্ তার অসাধারণ বাগিতা– বাংলা, ইংরেজি, ওয়েলশ তিন ভাষাতেই চরিত্রবল ও ধর্মানুরাগের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। আমি পাঠশালা যাবার সময় থেকেই তার গির্জা ও সানডে স্কুলের রীতিমতো অনুরাগী অংশগ্রহণকারী ছিলুম বলে প্রায়ই টিলার উপরে অবস্থিত তাঁর ছিমছাম বাংলোতেও যেতুম। মিশনে বাস করত আরো বিস্তর ছেলেমেয়ে প্রধানত চা-বাগিচার সাহেব ও দিশি রমণীর মিলনজাত পুত্রকন্যা এবং কিছু কিছু খাসিয়া, গারো, নাগা ও লুসাই (মিজো) খ্রিস্টান। খাস বাঙালি প্রায় চোখেই পড়েনি। আমি বিশেষ করে এই পার্বত্য খ্রিস্টানদের সম্বন্ধেই কৌতূহলী ছিলুম এবং হাইস্কুলে ঢোকার সময় একটি লুসাই ছেলের সঙ্গে হৃদ্যতা হয়। সে সময় লুসাই ভাষা শিখতে গিয়ে যদিও শেখা হয়নি– আবিষ্কার করি যে, অন্তত লুসাই ভাষাতে বাংলার বহু বহু শব্দের কোনও প্রতিশব্দ নেই (পরে জানতে পারি, অলিখিত ভাষা মাত্রেরই সাধারণত এই হাল)।
জোনস্ সায়েব থাকতেন ছিমছাম বাংলোয়, জানালায় পর্দা টানানো। সায়েব-মেম খানা খেতেন ছুরি কাঁটা দিয়ে, ধবধবে সাদা টেবিলক্লথে ঢাকা খানা-টেবিলের পাশে। আমার বয়স তখন তেরো; কিন্তু তখনই মনে হয়েছিল, ধর্মযাজকের এতখানি বিলাস ভালো না– বিশেষ করে তিনি যখন মিশনের আর সবাইকে তাঁর মতো ‘বিলাসে’ রাখতে পারেন না। (পরবর্তী যুগে ইংলন্ড এবং কন্টিনেন্ট ঘুরে বুঝতে পারলুম, জোনস্ সায়েব তাঁর দেশের পাদ্রি-ভাইদের তুলনায় কতখানি আত্মত্যাগ করে ওই বিদেশ-বিভূঁইয়ে কতখানি সরল অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন; তাঁর আত্মাকে স্মরণ করে আজ ক্ষমা ভিক্ষা করি)।
আমার এবং আমার হিন্দু-মুসলমান বন্ধুদের মনে পাদ্রি সায়েবের ছিমছাম বাড়ি, আসবাবপত্র কোনও প্রলোভনের উদ্রেক করত না। আমরা যেন কিছুটা বুঝে কিছুটা না বুঝে মনে মনে যুক্তি করতুম, খ্রিস্টান হলে এসব পাওয়া যায়; কিন্তু আমরা তো ধর্ম বেচতে চাইনে। তাই বোধ হয় জোস্ সায়েব তাঁর জোরদার বাগ্মিতা-শক্তি দ্বারাও কোনও বাঙালি হিন্দু-মুসলমানকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করতে পারেননি করে থাকলেও অত্যন্ত দুস্থ দূর গ্রামাঞ্চলের তথাকথিত নিম্নতম শ্রেণির মধ্যে। আমরা কখনও তার খবর পাইনি।
আমার কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগত, মিশনের এই খাসি লুসাইরা কি জোনস্ সায়েবের মতো ফিটফাট বাড়িতে থাকতে চায় না?
মণিপুরে যেসব বৈষ্ণব ‘মিশনারিরা’ গিয়েছিলেন তাঁরা নিশ্চয়ই সেখানে কোনও উচ্চতর মানের জীবনযাপন করেননি। বস্তৃত আজও মণিপুরে গ্রামবাসী সুরমা উপত্যকার চাষার চেয়ে অনেক সচ্ছল। কাজেই এ নিয়ে কোনও দ্বন্দ্ব সেখানে উপস্থিত হয়নি।
কিন্তু নাগা-লুসাইদের মধ্যে কী হল?
যারা লেখাপড়ায় সামান্য ভালো– এ কথা মানতেই হবে, খ্রিস্টান মিশনারিরা তাঁদের সামর্থ্যে যতখানি কুলোয় ততখানি অর্থ শিক্ষার জন্য পাহাড়ে পাহাড়ে ঢেলে দিয়েছিলেন এবং একদা সেখানে সাক্ষরের সংখ্যা বাংলার তুলনায় ছিল বেশি তারা কোহিমা-আইজলে পড়তে এল, পরে শিলঙে এবং কেউ কেউ কলকাতা পর্যন্ত। এবং যারা আপন গ্রাম থেকে বেরুল না; তারা, অন্তত পাদ্রি সায়েবের বাড়ি, তাঁর তৈজসপত্র দেখেছে। শিলঙে, যে দু-চারজন চাকরি নিয়ে থেকে গেল তাদের কথা আলাদা, কিন্তু যারা বাড়ির টানে গায়ে ফিরে গেল, এবং যারা গায়েই ছিল এদের অনেকেই কি তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নততর করে পাদ্রি সায়েবের মানের কাছে আসতে চাইল না?
এ তো আমাদের চোখের সামনে নিত্য নিত্য ঘটছে। আমাদেরই গ্রামের ছেলে শহরে এসে আর গ্রামে ফিরে গিয়ে নিম্নমানের জীবনযাপন করতে চায় না। বস্তুত ফ্রান্স, জর্মনি সর্বত্রই ক্রন্দনরব উঠছে, গ্রামের বুদ্ধিমান কর্মঠ ছেলে মাত্রই আর গ্রামে ফিরে যেতে চান না। পড়ে থাকে নিষ্কর্মাগুলো। দি ভিলেজেস আর বিইং ড্রেনড অব দেয়ার ব্রেনস– শহর ঝেঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে গ্রামের প্রতিভাকে। বিশ্বব্যাপী এই যে একতরফা ভাঁটা, এরই ফলে যে গ্রামোন্নয়ন করা যাচ্ছে না এ সম্বন্ধে ‘উনেস্কো’ বহুকাল ধরে সচেতন, বিস্তর গবেষণা করেছে, দাওয়াই খুঁজে পাচ্ছে না।
কিন্তু এই সমস্যা নিয়ে আমাদের মধ্যে মারামারি খুনোখুনি হয় না, কারণ, যে গ্রামের ছেলে শহরে থাকতে চায় তার জন্য আশেপাশে বিস্তর ছোট-বড় শহর আছে– বোলপুর, সিউড়ি, বর্ধমান, শেষটায় যদি তাতেও প্রাণ না ভরে, তবে কলকাতা। রেলের চাকরি করে ভাগলপুর, পাটনা হয়ে কত কী?
কিন্তু মিজো-লুসাইবাসী যাবে কোথায়? আইজল, লুঙলে তাদের কী দিতে পারে? তার পর শতাধিক মাইলের ধাক্কা পেরিয়ে শিলচর– সে আমাদের সিউড়ি-বর্ধমানের তুলনায় কসমপলিটান শহর বটে–কিন্তু তারই-বা মুরদ কতটুকু? তার নিজেরই দুঃখের অবধি নেই। আসাম সরকার তাকে– যাক আবার না আরেকটা বাঙাল খ্যাদানো আরম্ভ হয়ে যায় (ভালো তো কারও করতেই পারিনে, মন্দটা না-ই-বা করলুম।), আর কেন্দ্রীয় সরকার? কতবার বুঝিয়েছি, এই শিলচরে বেতারের কেন্দ্র বানিয়ে নাগা-লুসাইদের কন্ট্রোল করো– কে বা শোনে কার কথা (এস্থলে বলে রাখা ভালো আমার জন্মভূমি কাছাড় নয়)! থাক সে কথা। মিজো যদি বা শিলচর পেরুতে চায় তবে সামনে যে খাঁড়া পাঁচিল হিল সেকশন– তার পর সেই সুদূর গৌহাটি। এখানে খাসিয়াদের সঙ্গে তুলনা করলেই দেখা যাবে, একে তাদের চাষের পদ্ধতি উন্নত, শিলঙ গৌহাটির ভাষা তারা মোটামুটি জানে, জিনিসপত্র সেখানে বেচতে পারে, চাকরিনোকরি মিস্ত্রিগিরি করে পয়সা কামাতে পারে। আর শিক্ষিত সম্পদশালী বহু খাসিয়া শিলঙ শহরের পাদ্রির বাঙলোর চেয়েও ফিটফাট বাংলোয় বাস করেন। তাই স্বভাবতই খাসিয়ারা অনেকখানি সন্তুষ্ট এবং তাই শান্ত।
কিন্তু মিজো যায় কোথায়?
১৯১০/১৯১১ থেকে তাদের ভিতর আরম্ভ হয় খ্রিস্টধর্ম প্রচার এবং ১৯৩১ নাগাদ অর্ধেক লুসাইবাসী হয়ে গেছে খ্রিস্টান। তার পর কী হয়েছে জানিনে। নিশ্চয়ই বেড়েছে। কারণ মিশনারিদের কাজ বন্ধ হয়নি। আদম-শুমারির হিসাব দেখে লাভ নেই। ওই সময় থেকেই আরম্ভ হয়, পরের সেনসাসে কার স্বার্থ অনুযায়ী কী দেখাতে হবে তাই নিয়ে ছিনিমিনি, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘কুকিং’।
পার্বত্যাঞ্চলবাসী অনেক সময় আমাদের হিসেবে নিষ্ঠুর, কিন্তু তারা সরল। সরল বিশ্বাসে তারা মনে আশা পোষণ করেছিল, যারা তাদের খ্রিস্টান করেছে তাদেরই জাতভাই ইংরেজ সরকার একদিন তাদের বাসনা-কামনা পূর্ণ করে দেবে। ‘জুম’ খেত করে যে তার পয়সায় পাদ্রির বাঙলো বানানো যায় না সেটা তারা বোঝে না। আমার মনে হয়, ইংরেজ-রাজ থাকলেও আজ না হোক কাল বা পরশু মিজোদের রুদ্ধ আক্রোশ ইংরেজকেই আক্রমণ করত। তবে ইংরেজ ধাপ্পা মারতে ওস্তাদ– বাঙালির মতো চালাক জাতকেও কতবারই না একটা কুমিরছানাকে বারোটা করে দেখিয়েছে! কবিগুরুর মতো বিচক্ষণ জন এবং তাঁর চেয়েও দুঁদে বহু পলিটিসিয়ান ‘ব্রিটিশ জস্টিসে’ বহুকাল ধরে বিশ্বাস রেখে আশা করতেন, সময় এলে আমরা ইংরেজের কাছ থেকে জস্টিস– সুবিচার পাব।
অবশ্য একথাও স্বীকার করি– যারা আমার সঙ্গে একমত নন তাঁদের কাছে মাফ চাইছি যে, দেশ-শাসন-ব্যাপারে ইংরেজের অনেকগুলো সদ্গুণ আছে এবং সেই অনুপাতেই আসাম সরকার– থাক, আবার কেন? তবে আসাম সরকার না হয়ে কেন্দ্রীয় সরকার মিজোদের ভার নিলেই যে মুশকিল আসান হয়ে যেত সেটা আমি বিশ্বাস করিনে। যাই বলুন, যাই কন, আসাম সরকার বাস করেন শিলঙে খাসিয়াদের মধ্যিখানে। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার উত্তরে নেফা অঞ্চলেও রয়েছে আরো গণ্ডায় গণ্ডায় উপজাতি। তাদের অনেকেই প্রতি হাটবারে নেমে আসে সমতলে, ক্ষেতের জিনিস, এটা-সেটা (তখনকার দিনের চামর, মৃগনাভি, হাতির এবং গণ্ডারের দাঁত ভয়ঙ্কর মূল্যবান জিনিস, মধ্যপ্রাচ্যে ‘হারেম’ পোষণের জন্য মৃতসঞ্জীবনীর ন্যায় নিত্যকাম্য এফরডিসিয়াক ইত্যাদি) বিক্রি করে প্রধানত নুন, কেরোসিন(৩) (সর্বনাশ! আমাদেরই যা হাল, ওদের হচ্ছে কী? তবে হ্যাঁ, ডিগবয় ওদের অতি কাছে) কিনে নিয়ে যাবার জন্য। ব্রহ্মপুত্র-উপত্যকাবাসী আসামিদের অনেকেই তাদের চেনেন। কাছাড়বাসী ক’জন সদস্য আসাম মন্ত্রিমণ্ডলীতে আছেন সঠিক জানিনে; যে ক জন আছেন একমাত্র তারাই ব্ৰহ্মপুত্র উপত্যকাবাসীদের তুলনায় নাগা-মিজোদের বিলক্ষণ চেনেন, সদুপদেশ দিতে পারবেন, অবশ্য শর্ত, যদি কেউ চায়। এঁদের তুলনায় নাগা-মিজোদের সম্বন্ধে কেন্দ্রীয় সরকারের জ্ঞান সীমাবদ্ধ– এ বিষয়টি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমাকে বুঝিয়েছিলেন নাগাদের প্রথম গ্র্যাজুয়েট, সে সময় আপন মাতৃভূমি নাগা পাহাড়েই এসডিও শ্রীযুক্ত কে ভি চুসা, ট্রেনে শিয়ালদা থেকে সিলেটের কুলাউড়া পর্যন্ত দিল্লি থেকে মুককচঙ ফেরার পথে। সুযোগ পেলে সে কাহিনী আরেক দিন হবে। শ্রীচুসা অর্থনৈতিক দিকটাও উল্লেখ করেন।
মিজোরা সরল বিশ্বাসে ভাবছে, আমার– তা সে কেন্দ্রীয় সরকারই হোক, আর আসাম সরকারই হোক– বিধর্মী (নাগারাও কড়া সুরে বলে, ‘যারা আমাদের সঙ্গে আমাদের গির্জায় গিয়ে উপাসনা করে না তারা আমাদের ঘৃণা করে।’ সেটা না হয় করা গেল, কিন্তু খেতেও হবে তাদের সঙ্গে এবং স্বর্গস্থ প্রভু জানেন, একমাত্র চারপাই ছাড়া সব চতুষ্পদই তারা খায়! সঙ্গে সঙ্গে পান করতে হবে শুকনো লাউয়ের পাত্রে ভর্তি ভাত পচিয়ে তৈরি লিটার লিটার বিয়ার! কোহিমার ছোকরা ইংরেজ শাসনকর্তা এ-তিনটির প্রথমটি করে পুণ্যসঞ্চয় করতেন, বাকি দুই বাবদেও তেনারা সমগোত্রীয়, এমনকি প্রয়োজন হলে village belle-কেও তারা নিরাশ করতেন না– কারণ ব্যাচেলার ভিন্ন অন্য কাউকে সেখানে সচরাচর পাঠানো হত না। এবং যেহেতু আমরা বিধর্মী তাই আমরা তাদের ন্যায্য পাওনা দিচ্ছি না। আমরা সরে গেলেই তাদের সর্ব বাসনা কামনা পূর্ণ হয়ে যাবে। মোস্ট প্রিমিটিভ জুম চাষ করে যে এবসার্ড জীবনমান উচ্চ পর্যায়ে তোলা যায় না সেটা বোঝাবে কে?
অবশ্য মিজোদের অসন্তোষের অন্যান্য কারণও আছে। শুধু একটা কারণ দেখালুম– অন্তত মার্কসিস্টরা খুশি হবেন– তাঁদের অনেকেরই মতো এইটেই একমাত্র কারণ। একমাত্র কারণই হোক আর প্রধানতম কারণই হোক, অর্থনৈতিক কারণটা সন্ধান নেওয়া সর্বক্ষেত্রেই বাঞ্ছনীয়। লেনিনের সমসাময়িক ভিয়েনার অর্থডক্স অর্থনীতি পণ্ডিত শুমপেটার এবং তাঁরই মতো কট্টর বার্লিনের জমবার্ট কেউই এই দৃষ্টিবিন্দুটি অবহেলা করেননি।
স্বীকার করে নিচ্ছি, আমার এ বিশ্লেষণ ভুল হতে পারে, কিন্তু তথ্যগুলো সঞ্চিত হয়েছে বিশ্বস্তজনের কাছ থেকে।(৪)
১৬/৪/৬৬
———
১. দক্ষিণ ভারতের ভরতনাট্যম নিয়ে যতখানি গবেষণা এই উত্তর ভারতেই হয়েছে, এই উত্তর ভারতের ঘনিষ্ঠতর মণিপুরি নৃত্য নিয়ে তার এক-দশমাংশও হয়নি। এ নৃত্য সত্যই রহস্যময়। মূল নৃত্য শান্ত ও লাস্যরসাশ্রিত কিন্তু প্রারম্ভিক অবতরণ নৃত্য (এর টেকনিকাল নামটি আমি ভুলে গিয়েছি) অত্যন্ত প্রাণবন্ত, দুর্দান্ত তাণ্ডব নৃত্যের কাছাকাছি এবং পার্শ্ববর্তী অনুন্নত অঞ্চলের সগ্রাম-নৃত্যের সঙ্গে সাদৃশ্য ধরে। হয়তো বৈষ্ণব হয়ে যাওয়ার পরও মণিপুরিরা তাদের প্রাচীন ঐতিহ্যগত পার্বত্য নৃত্য ত্যাগ করতে চায়নি বলে অর দ্য সুর’ রূপে প্রস্তাবন রূপে সেটিকে রক্ষা করেছে।
২. এ যুগে মণিপুরে যে রকম হঠাৎ বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে হিন্দুধর্ম প্রচারিত হয়, সেরকম উদাহরণ কি অদূর অতীত কি বর্তমানে আমি অন্য কোথাও পাইনি। মালকানা রাজপুতদের অল্পসংখ্যক লোকই বিংশ শতাব্দীতে আর্য-সমাজে’ দীক্ষা নেয়। শিলং শহর প্রায় শত বৎসর ধরে হিন্দুপ্রধান। সেখানে ব্রাহ্ম ও ইসলাম মিশন স্থাপিত হয় কিন্তু শেষ পর্যন্ত খ্রিস্টান মিশনারিই সবচেয়ে বেশি সাফল্য অর্জন করেন। এখনো আসামের সর্ব পার্বত্য অঞ্চলে খ্রিস্টান মিশনারিই অগ্রগামী এবং কোনও কোনও লাগোয়া সমতল ভূমিতেও।
৩. এক সিলেটি মুসলমান ডাক্তার বহু বৎসর আইজল-লুঙলেতে কাটিয়ে এসে আমায় বলেন, মিজোরা দু-দিন তিন-দিনের পাহাড়ের চড়াই-ওত্রাই পথ পেরিয়ে লুঙলে আসত কেরোসিন কিনতে। সে কেরোসিন আসত শিলচর থেকে, বেশিরভাগ পথ মানুষের কাঁধে, বাঁকে করে। একবার একজন বাহকের কলেরা হয় নির্জন পথিমধ্যে। বাঁশের স্ট্রেচার বানিয়ে অন্য চারজন বেহারা রোগীকে নিয়ে লুঙলে পানে রওনা দেয়– দশ টিন কেরোসিন পায়ে চলার পথের উপর রেখে দিয়ে! গণ্ডায় গণ্ডায় কেরোসিনকামী খ্রিস্টান অখ্রিস্টান চলেছে লুঙলের দিকে, কিন্তু তাদের ধর্মবোধ এমনই প্রবল যে তারা কেরোসিনের দিকে ফিরেও তাকালে না। বেহারারা লুঙলে থেকে ফিরে এসে সমুচা সব কটা টিন যথাস্থানে পায় তারাও জানত, লোপাট হবে না, তাই লুকিয়ে রাখার প্রয়োজনও বোধ করেনি। সেই মিজোরাই এখন লুঙলেতে লুটতরাজ করল!
৪. (ক) মিজো প্রবন্ধটি লিখে ‘দেশ’ দপ্তরে পাঠিয়ে দেবার পর দুটি তাৎপর্যপূর্ণ খবর বেরিয়েছে। প্রথমটিতে মাদ্রাজের প্রাক্তন গভর্নর শ্রীযুক্ত বিষ্ণুরাম মেধী বলেছেন—‘যাতে করে মাল চলাচল জাম্ না হয়ে যায় (“transport bottleneck”) মিজো, নাগা এবং অন্যান্য পার্বত্য অঞ্চলের সঙ্গে রেললাইন বসানো উচিত’। তিনি General council meeting of the All-India Railwaymen’s Federation-এতে এ বিবৃতিটি দেন ও ২৭-৩-৬৬-র কাগজে এটি বেরোয়। মিজোনাগারা যে রেলের অভাবে বাদবাকি ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন, সে-কথা আমি প্রবন্ধে নিবেদন করেছি।
(খ) পার্বত্য-অঞ্চল সম্বন্ধে ব্যাপক রিপোর্ট দেবার জন্য যে পাটকর কমিশন নিযুক্ত হয়েছিল তার রিপোর্টের কয়েকটি প্রধান সুপারিশ ৩১ মার্চ বেরিয়েছে। সম্পূর্ণ রিপোর্ট না পড়ে কিছু বলার উপায় নেই, কিন্তু যেটুকু বেরিয়েছে তার থেকে মনে হল আধুনিক ঘটনার আলোকে রিপোর্টটি আউট অব ডেট– তামাদি হলেও বর্তমানের প্রশ্নবাণ সইতে পারবে না।
মূর্খের উপাসনা অপেক্ষা পণ্ডিতের নিদ্রা শ্রেয়ঃ
আমাকে অনেকেই প্রশ্ন শুধান, হিন্দুধর্ম, হিন্দুশাস্ত্র নিয়ে যে অফুরন্ত কাহিনী কিংবদন্তি আছে– যেরকম যমদূত একবার ভুল করে মৃত্যুর নির্ধারিত দিবসের পূর্বে এক নায়েবকে নরকে নিয়ে যাওয়ার ফলে কীরকম তুমুলকাণ্ড ঘটেছিল– মুসলমানদের ভিতরও তেমনি আছে কি না। আছে, কিন্তু সেগুলো প্রধানত লোকশিক্ষার জন্য এবং অনেকগুলোতেই প্রচুর হাস্যরসও আছে। এসব গল্পের প্রাচুর্য ইরানেই বেশি, এবং তুর্কিতে খুবই কম। তুর্কিরা নাকি বড্ড বেশি সিরিয়াস। অতএব গোঁড়া। অতএব রসকষহীন।
আমার একটি গল্প মনে পড়ল এবং সেটা সকলেরই কৌতূহল জাগাবে। কারণ কি হিন্দু, কি মুসলমান, কি ইহুদি, কি খ্রিস্টান সকলেই জানতে চায় মহাপ্রলয় (আরবিতে কিয়াম) কবে আসবে? সর্বধর্মের শাস্ত্রগ্রন্থেই তার কিছু কিছু ইঙ্গিত আছে, কিন্তু পাকাপাকি কোনও-কিছু জানার উপায় নেই। একদা নাকি খ্রিস্টানদের বিশ্বাস ছিল, খ্রিস্টজন্মের ১০০০ বৎসর পূর্ণ হলে মহাপ্রলয় আসবে। শুনতে পাই, অনেক লোকেই নাকি তার কিছুদিন পূর্বে সর্বস্ব বিক্রয় করে দানখয়রাতে উড়িয়ে দেয়।
১০০০ খ্রিস্টাব্দ পূর্ণ হওয়ার দিনে শেষটায় যখন মহাপ্রলয় হল না তখন এরা পস্তিয়ে ছিলেন কি না জানিনে, তবে ভবিষ্যতের জন্য সাবধান হওয়া ভালো। এখন ১৯৬৬। যদি রটে যে, ২০০০-এ মহাপ্রলয় তবে এখন যারা যুবা এবং বালক তারা যেন ওই সময়টায় একটু ভেবেচিন্তে দান-খয়রাৎ করেন।
মহাপ্রলয় কবে আসবে, সে-সম্বন্ধে আরবদের ভিতর একটি কাহিনী প্রচলিত আছে।
আল্লা-পাক নাকি একদিন প্রধান ফিরিশতা (বাংলায় ফেরেস্তা লেখা হয়: অর্থ এঞ্জেল, দেবদূত) জিব্রাইলকে (ইংরেজিতে গেব্রিয়েল) ডেকে আদেশ দেবেন, যাও তো, মানুষের ছদ্মবেশ ধরে পৃথিবীতে। যে-কোনও একজন মানুষকে শুধোও, জিব্রাইল এই মুহূর্তে কোথায় আছেন? জিব্রাইল পৃথিবীতে নেমে একজন মর্তবাসীকে সেই প্রশ্ন শুধোলেন। লোকটা কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে বলল, ‘এরকম বেফায়দা প্রশ্ন করে লাভটা তোমার কী? আমার এসব জিনিসে কোনও কৌতূহল নেই, তবে যখন নিতান্তই শুধোলে তবে দাঁড়াও, বলছি।’ লোকটি দুই লহমা চিন্তা করে বলল, ‘হুঁ, ঠিক বলতে পারব না– তবে এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, সে (আরবিতে ইংরেজির মতো he-র সম্মানার্থে কোনও ‘তিনি’ শব্দ নেই) এখন পৃথিবীতে। বেহেশতে নয়।’ জিব্রাইল স্বর্গে ফিরে আল্লাকে উত্তরটা জানালে তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে।’ তার পর কেটে যাবে আরও বহু সহস্র বৎসর। তার পর আবার আল্লা-পাক ওই একই প্রশ্ন একইভাবে শুধোবার জন্য জিব্রাইলকে পৃথিবীতে পাঠাবেন। এবারে যে মর্তবাসীকে শুধোনো হল, সে বিরক্ত হল আরও বেশি। বললে, ‘কী আশ্চর্য! এখনও মানুষ এরকম সম্পূর্ণ বাজে বেকার প্রশ্ন করে! হিসাব কষলে যে এরকম প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায় না তা নয়, তবে দেখো, এসব ব্যাপারে আমার কোনও উৎসাহ নেই। আচ্ছা…’ এক সেকেন্ড চিন্তা করে লোকটা বললে, ‘স্বর্গে তো নয়, স্পষ্ট বোঝা আছে…,’ ফের দু সেকেন্ড চিন্তা করে বললে, ‘পৃথিবীতেই যখন, দাঁড়াও, হ্যাঁ, কাছেপিঠেই কোথাও আমি চললুম।’ জিব্রাইল বেহেশতে ফিরে এসে আল্লাকে সবকিছু বয়ান করলেন। আল্লা বললেন, ‘ঠিক আছে।’ তার পর কেটে যাবে আরও কয়েক হাজার কিংবা কয়েক লক্ষ বৎসর। আবার জিব্রাইল সেই হুকুম নিয়ে ধরাভূমিতে আসবেন। এবার যাকে শুধালেন সে তো রীতিমতো চটে গেল—‘এসব বাজে বাজে প্রশ্ন… ইত্যাদি।’ জিব্রাইল বেশ কিছুটা কাকুতি-মিনতি করাতে সে নরম হয়ে বলল, ‘তা হলে দেখি! হুঃ, স্বর্গে নয়, পৃথিবীতে।’ তার পর আরেক সেকেন্ড চিন্তা করে বললে, ‘কাছে-পিঠে কোথাও।’ তার পর আরও দু সেকেন্ড চিন্তা করে তাজ্জব মেনে বলবে, ‘কী আশ্চর্য যে এরকম মস্করা করো। তুমিই তো জিব্রাইল– তবে শুধাচ্ছ কেন?’ এবার জিব্রাইল সব খবর দিলে আল্লা-পাক হুকুম দেবেন মহাপ্রলয়ের শিঙা বাজাতে।
কথিকাটির তাৎপর্য কী?
প্রথমত, মানুষ তখন জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করে করে এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছবে যে স্বর্গের খবর পর্যন্ত তার কাছে আর অজানা থাকবে না।
দ্বিতীয়ত, কিন্তু, তার তাবৎ জ্ঞান-বিজ্ঞান বিদ্যাচর্চার একমাত্র উদ্দেশ্য হবে সাংসারিক, বৈষয়িক, প্র্যাকটিকাল জিনিস নিয়ে।(১) ইহলোক ভিন্ন পরলোক, পাপপুণ্যের বিচার, সে স্বর্গে যাবে, না নরকে জ্বলে পুড়ে খাক হবে– এ সম্বন্ধে তার কোনও কৌতূহল থাকবে না, কারণ স্বয়ং জিব্রাইলকে হাতের কাছে পেয়েও সে এসবের কোনও অনুসন্ধান করল না। এমনকি সৃষ্টিকর্তা আল্লা–দীন দুনিয়ার মালিক। যাঁকে পাবার জন্য কোটি কোটি বৎসর ধরে শত শত কোটি মর্তের মানুষ স্বর্গের দেবদূত আমৃত্যু দেবদুর্লভ সাধনা করেছে, তার প্রতিও সে উদাসীন।
তৃতীয়ত, যেহেতু সে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব, তাঁর ইচ্ছা-অনিচ্ছা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন অতএব কল্পনা করা কঠিন নয় যে, সে তখন বিশ্বভুবন তার খেয়ালখুশি মর্জি-মাফিক নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টায় লেগে যাবে। ফলে হয়তো বেরুবে শত শত আইষমান কোটি কোটি ঈশ্বরসৃষ্ট জীবকে বিনাশ করতে।
***
ভরসা হচ্ছে, বিশ্ববিবর্তনে যদ্যপি সেই চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি অর্থাৎ মানুষ ক্রমেই সত্যসুন্দরের (অল-হক অল্-জমিল) সাধনার পথ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে, তবু এখনও বোধ হয় পরিপূর্ণ জড়বাদে পৌঁছতে কিঞ্চিৎ বিলম্ব আছে। পক্ষান্তরে ইসলাম একথাও বলেন, কিয়ামৎ যে-কোনও মুহূর্তে আসতে পারে। তার অর্থ, মানুষ হয়তো হঠাৎ এক লফে জড়বাদে পৌঁছে যেতে পারে।
পয়গম্বর বলেছেন, “আল্লার থেকে মানুষকে দূরে নিয়ে যায় শয়তান।” সেই শয়তান জড়বাদের প্রতিভূ এবং প্রতীক। অতএব সত্য-জ্ঞানান্বেষীর প্রধান কর্তব্য জড়বাদ অর্থাৎ শয়তানের কীর্তিকলাপ কী প্রকারে বাহ্যজগতে স্বপ্রকাশ হয় সে-সম্বন্ধে সচেতন থাকা তথা শয়তান প্রলোভন নিয়ে উপস্থিত হলে আত্মহারা হয়ে জ্ঞানদৃষ্টি দ্বারা তার স্বরূপ চিনতে পারা। শুধুমাত্র আচার-অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে সরল জীবনযাপনই যথেষ্ট নয় : জ্ঞানানুসন্ধান নিত্যপ্রয়োজনীয় অবশ্যকর্তব্য। এই মর্মে আরেকটি কাহিনী আছে :–
একদা শয়তানের রাজা, ধাড়ি শয়তান এক বাচ্চা শয়তানকে তালিম দিচ্ছিল, সৎপথগামীদের কোন কোন পদ্ধতিতে বিপথগামী করা যায়। ধাড়ি শয়তান অতিশয় ধুরন্ধর গুরু এবং বিশ্বপর্যটক (জাহানদিদা) রূপে অপর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে সম্যক অবগত আছে, কোন প্রকারের মানুষ কোন পদ্ধতিতে চলে, কাকে সমঝে চলতে হয়, আর কেই-বা অগা আহাম্মুখ। ওই অনুচ্ছেদে এসে ধাড়ি বললে, ‘কিন্তু বৎস, হুঁশিয়ার! আচারনিষ্ঠ সাধুজনকে বরঞ্চ আমাদের পথে (মানবীয় ভাষায় কুপথে) নিয়ে যাবার চেষ্টা করো কিন্তু জ্ঞানী পণ্ডিতকে সমঝে-বুঝে চলো। ওরা বড়ই ভীষণ প্রাণী। সৃষ্টির আদিমকাল থেকে ওরাই আমাদের আদিম দুশমন।’
শাগরেদ ক্ষুদে শয়তান আশ্চর্য হয়ে বললে, ‘সে কী কথা! আচারনিষ্ঠ জন তো সদাই জপতপ নিয়ে ব্যস্ত থাকে; আমার কথা ভাববার তার ফুরসৎ কই? আর পণ্ডিতদের কথা যখন বললেনই, প্রভু, তবে নিবেদন করি, আজকের দিনে তাদের অবস্থাটা একটু পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে দেখুন। খেতে পায় না, পরতে পায় না আর আকাট-মূর্খ নিষ্কর্মারা বড় বড় চাকরির পদবি নিয়ে ওদের মাথায় ডাণ্ডা বোলায়। নিজে মেস্টার, ওদিকে ছেলেটাকে কলেজে পাঠাতে পারে না। এসব হাভাতেদের লোভ দেখিয়ে পথ ভোলাতে কতক্ষণ?’
ধেড়ে হেসে বলল, ‘খুব তো মুখে মুখে হাই-জাম্প লঙ-জাম্প দেখালি। কাজের বেলা কী হয় সেটা বোঝা যাবে পরশুদিন প্র্যাকটিকাল ক্লাসে।’
পরশু দিনের দিন প্র্যাকটিকাল। সে বড় কঠিন তালিম। তাবৎ হপ্তার এলেম হাতেনাতে বালাতে হয়। আমাদের ইস্টুডেন্টরা টুকলি-নকল করলে আমরা যেরকম সেটাকে শয়তানি’ নাম দিয়ে চোটপাট করি, এখানে তেমনি সাধু সরল পন্থায় কর্ম উদ্ধার করতে গেলে সেটাকে
সাধমী’ বলে গুরু কান মলে দেয় শিষ্যের।
ধেড়ে আদেশ দিলেন, ‘ওই যে হোথা একটি সরল সাধু জপ করছে ওকে আমাদের পথে নিয়ে আসার ডিমন্স্ট্রেশনটি করো তো, বৎস।’
বাচ্চা শয়তান প্রমাদ গুনল। এই সৌম্যদর্শন, কৃচ্ছসাধনজনিতপার তথাপি মধুরবদন সাধুকে ধর্মপথ থেকে বিচলিত করা কি তার মতো চ্যাংড়া শাগরেদের কর্ম! না জানি, আজ কপালে কী আছে!
ক্লাসে যে নোট দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো সে দফে দফে স্মরণে আনল। তার পরে বিলজব, ইলিস, ডিয়াবলুস, শয়তান-উসশয়াতিন সবাইকে মনে মনে হাজার হাজার আদাব-বন্দেগি জানিয়ে গেল বেশ ধারণ করতে।
আহা! সে কী চিত্তহারিণী ভূষা! ধেড়ে, আণ্ডা, সব শয়তানকে লড়তে হয় ফিরিশতা অর্থাৎ দেবদূতের সঙ্গে– তাই ওঁদের চালচলন বেশভূষা তারা খুব ভালো করেই চেনে। এ-যুগে হিটলার পোলান্ড আক্রমণ করার পূর্বে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কিছু জর্মনদের পরিয়ে দেন পোলিশ সৈন্যের উর্দি। সেই উর্দি পরে তারা ‘আক্রমণ’ করে একটি জর্মন বেতারকেন্দ্র– পোলিশ-জর্মন সীমান্তে। সেই ‘আক্রমণে’র ও ‘আক্রমণে নিহত পোলিশ সৈন্যে’র ছবি হিটলার বিশ্বময় প্রকাশ করে সপ্রমাণ করেন যে পোলরাই প্রথম জর্মনি আক্রমণ করে!
হিটলার, হিমলার, আইষমান, হ্যোস এঁরা তো খাস শয়তানের তুলনায় শিশু।(২) ছদ্মবেশ ধারণে এনারা এমন আর কী ‘কৈশল’ দেখাবেন!
বাচ্চা শয়তান ধারণ করল দেবদূত– ফিরিশতার বেশ।
অঙ্গ থেকে বেরুচ্ছে দিব্যজ্যোতি এবং নন্দনকাননমন্দারসৌরভ; তার প্রতি পদক্ষেপে ঝংকৃত হচ্ছে অহ্মরাবিনিন্দিত সঙ্গীত-নিক্বণ– সঙ্গে এসেছে বসন্ত পবনের মৃদু হিল্লোল মলয়ানিল-বিলোলানন্দোল্লাস!
বাচ্চা শয়তান সম্মুখীন হল সাধুর। বললে, ‘তোমার তপশ্চর্যায় পরিতুষ্ট হয়ে আল্লা-তালা আমাকে পাঠিয়েছেন তোমাকে সশরীরে স্বর্গে নিয়ে যাবার জন্য। তুমি আমার স্কন্ধে আরোহণ করো।’
বলা মাত্রই সে বুরাকের বেশ ধারণ করল।
বুরা অনেকটা পক্ষীরাজের মতো। সর্বাঙ্গ অত্যুত্তম অন্যায় এবং উভয় স্কন্ধে দুটি পক্ষ।(৩)
কিন্তু বাচ্চা শয়তান ক্লাসের থিয়োরেটিকাল সর্ব আদেশ মেনে চলতে চলতে ভয়ে বেপথু-কম্প্রমান, এই সামান্য ফাঁদটা সাধু না ধরে ফেলেন!
কিন্তু ধেড়ে শয়তান দূর থেকে নিশ্চিন্ত মনে সবকিছু দেখছে। সে বিলক্ষণ জানে, এসব আচারনিষ্ঠ জন বড় দম্ভী হয়। এরা ভাবে, সংসারের সর্বভোগ যখন ত্যাগ করেছি, তখন আর স্বর্গের সর্বসুখ আমি পাব না কেন?
এই দম্ভই তাদের সর্বনাশ আনে, সে তত্ত্ব শয়তান দেখেছে, যুগ যুগ ধরে।(৪)
তপস্বী সাধু ক্ষণমাত্র চিন্তা না করে চেপে বসলেন সেই ভেজাল বুরাকের স্কন্ধে।
তার পর কী হল, সেটা বর্ণনা করতে আমার বাধে। কারণ সেটাতে আছে বীভৎস রস। সংক্ষেপে বলি, সাধুর যখন জ্ঞান হল তখন তিনি বিষ্ঠাকুণ্ডে। বাচ্চা শয়তান একবার তাঁকে কাঁধে পেয়ে পেয়েছে বাগে। ক্লাসের নোট-মাফিক তাঁকে সর্বন্ত্রণা দিয়ে অজ্ঞানাবস্থায় ফেলে দিয়ে গেল পুরীষ-গহ্বরে।
সুশীল পাঠক। তুমি বলবে, আচারনিষ্ঠ সজ্জনের এই অসদগতি হল কেন? আমিও গল্পের এই পর্যায়ে কাহিনী-কীর্তনিয়া মৌলানাকে ওই একই প্রশ্ন শুধধাই।
তিনি শান্তকণ্ঠে বললেন, ‘পুচ্ছাংশ দেখিয়াই সর্বাঙ্গ বিচার করা যায় না। অবহিত চিত্তে সর্বাঙ্গসুন্দর কাহিনীটি প্রণিধান করহ।’
এবারে ধেড়ে শয়তান বাচ্চাকে বললে, ‘ওই যে দেখা যাচ্ছে দূরে এক আলিম। এবারে বাবাজি, সাবধান।’
বাচ্চা কিন্তু ভয় পাওয়ার মতো কিছুই দেখল না। পণ্ডিত বটে লোকটি, কিন্তু নামাজ রোজায় যে তাঁর মাঝে মাঝে ত্রুটি হয়ে যায়, সে তো জানা কথা। বইয়ের নেশায় তাঁর কাটে অষ্টপ্রহর। এটাকে বাগে আনতে আর কতক্ষণ?
পূর্ববৎ দেবদূত বেশ ধারণ করে বাচ্চা শয়তান পণ্ডিতের সামনে এসে দাঁড়াল। পূর্ববৎ তাঁকে স্বর্গে নিয়ে যাবার প্রস্তাব জানাল।
পণ্ডিত তখন রকে বসে বদনা থেকে জল ঢেলে মুখ ধুচ্ছিলেন।
ভুললে চলবে না, ইনি পণ্ডিত। সশরীরে স্বর্গে যাওয়ার প্রস্তাব শুনেই তার চড়াকসে মনে পড়ে গেল ইতোপূর্বে কে কে আল্লার সমীপবর্তী হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছেন। মুসা (Moses), ঈসা (যিশু), হজরৎ পয়গম্বর– ব্যস্।
তাই পণ্ডিত উত্তমরূপেই জানতেন, তিনি এমন কিছু পুণ্যশীল মহাপুরুষ ‘প্যাকম্বর’ নন যে আল্লা তাঁকে স্বর্গে যাবার জন্য ডেকে পাঠাবেন।
‘বটে রে, ব্যাটা!’ মনে মনে বললেন পণ্ডিত। ‘মস্করা করার জায়গা পাও না! আজ তোমারই একদিন, আর আমারই একদিন।’
সুহাস্য-আস্যে মৌলবি বললেন, ‘কী আনন্দ, কী আনন্দ! স্বর্গে যাবার জন্য তো আমি হামেহাল তৈরি। কিন্তু, দ্র, এ যুগে বড় ভেজাল চলছে। কী করে জানব, তুমি সত্যই দেবদূত। শুনেছি, দেবদূতেরা মুআজিজা কেরামৎ (miracle) দেখাতে পারেন। তুমি কিছু একটা দেখাতে পারলেই আমি তোমার সঙ্গে যেতে প্রস্তুত।’
বাচ্চা শয়তান বলল, ‘আপনি কী মিরাকল দেখতে চান, বলুন।’ তার মনে বড় আনন্দ, অর্ধেক কেল্লা ফতেহ্ করে ফেলেছে!
পণ্ডিত বললেন, ‘শুনেছি, দেবদূত অনায়াসে ক্ষুদ্র, বৃহৎ, সর্ব আকার গ্রহণ করতে পারেন। তুমি পারো?’
‘নিশ্চয়!’
‘তা হলে তুমি ক্ষীণ কলেবর গ্রহণ করে আমার এই বদনার নালি দিয়ে ভেতরে ঢুকতে পারো?’
বাচ্চা শয়তান উল্লাসে মনে মনে নৃত্য করছে, পণ্ডিত এর চেয়ে অন্য কঠিন কর্ম করতে ইচ্ছা জানাননি বলে। তাকে তো অনায়াসে তিনি আরবিস্তানের বিরাট মরুভূমি, কিংবা ইউফ্রাতেস নদী, কিংবা আকাশের সূর্য বা দিবাভাগে পূর্ণচন্দ্র হতে বলতে পারতেন।
পাছে তিনি মত পরিবর্তন করে ফেলেন, তাই সে তন্মুহূর্তেই পণ্ডিতের বদনার নালির ভিতর দিয়ে ঢুকে পড়ল।
যেই না ঢোকা, পণ্ডিতের আর কোনও সন্দেহ রইল না, ব্যাটা বদমাশ। তিনি ভালো করেই জানেন, আল্লার আপন দূত একটা বদনাতে ঢুকতে যান না। তিনি বহুবিধ শাস্ত্র পড়েছেন, তাতে এমন মিরাকল, কেরামতের উল্লেখ নেই।
সঙ্গে সঙ্গে তিনি পাশের পিঁড়িটা বদনার উপর চেপে তার উপর আরও ভালো করে চেপে নিজে বসে পড়লেন এবং বদনার নালিতে ঢুকিয়ে দিলেন একটা খেজুর। বেশ মোলায়েম ফল; টায়ে টায়ে বদনায় সেঁটে যায়।
এবং চিৎকার :
‘গিন্নি, গিন্নি! নিয়ে এসো তাড়াতাড়ি উনুনটা। ব্যাটাকে আজ সেদ্ধ করে হালুয়া বানাব। ব্যাটা আমার সঙ্গে মস্করা করতে এসেছে! শা–,হা– জা,বা–। (৫)
হৈহৈ রৈরৈ কাণ্ড। বুড়ো শয়তান দূর থেকেই বুঝেছে ব্যাপারটা সঙিন।
সঙ্গে সঙ্গে পণ্ডিত-মৌলবির পায়ে এসে পড়ল।
বাচ্চাটাকে বাঁচাবার জন্য সন্ধি-আপস করতে চায়।
সন্ধির শর্ত হল, শয়তান এবং তস্য গোষ্ঠী ওই মৌলবি-পণ্ডিত গোষ্ঠীর কাউকে প্রলোভিত করতে পারবে না।
***
প্রথম গল্পের সঙ্গে এ গল্পের কী সম্পর্ক?
যতক্ষণ অবধি পণ্ডিত-মৌলবি-মৌলানা-রাব্বি-ফাদার-দস্তুর সুদ্ধমাত্র প্র্যাকটিকাল বিষয়ে মত্ত হবেন না, ততদিন মহাপ্রলয় আসবে না।
***
কিন্তু পাঠক, তোমার মস্তিষ্কে, হৃদয়ে যে প্রশ্ন আমারও তাই। কী দরকার সেই মহা-মহাপ্রলয় ঠেকিয়ে? যেখানে পৌঁছেছি, চাল নেই, তেল নেই, মাছ নেই—
২।১০।৬৫
———-
১. ইমাম গজালি মুসলিম জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কেউ কেউ বলেন সর্বশ্রেষ্ঠ মনীষী। তিনি একাধারে দার্শনিক, শাস্ত্রী ও সুফি (রহস্যবাদী ভক্ত) ছিলেন। আরব্যোপন্যাস যুগের বিখ্যাত বাগদাদ নগরীর বিশ্ববিদ্যালয় সে-যুগের মধ্যপ্রাচ্যের সর্বোত্তম জ্ঞানকেন্দ্র ছিল। ইমাম গজালি তার রেক্টর (শেখ) ছিলেন। অধুনা তাঁর একখানা বইয়ে দেখি, তিনি মনস্তাপ করছেন যে, তাঁর কালের (মৃত্যু ১১১১ খ্রিস্টাব্দে) লোক শুধু প্র্যাকটিক্যাল বিদ্যা শেখে। আমি ভরসা পেলুম।
২. অনেকে মনে করেন এ অধম নাৎসি দলের নির্ভেজাল দুশমন। তাই বলতে বাধ্য হচ্ছি, যুদ্ধের গোড়ার দিকে হিটলার যে ইংরেজকে বেধড়ক চড় কষায় সেটা এ অধমের চিত্তে সাতিশয় বিমলানন্দ দিয়েছিল। আমার মতে হিটলারের সবচেয়ে মারাত্মক ভুল হয়, তিনি ফ্রান্সের পতনের পর যখন ইংলভ আক্রমণ করলেন না। না-হয় তিনি নিষ্ফলকাম হতেন। তাতেই-বা কী! মহৎ কর্ম করতে গিয়ে নিষ্ফল হওয়া অপকর্মে (রুশ আক্রমণ) সফল হওয়ার চেয়ে শ্রেয়ঃ!
৩. মুসলমানি ও পার্সি রেস্তোরাঁতে নাতুন্নাসিক হিন্দু পাঠকও এই ছবি দেখে থাকবেন। পয়গম্বর হজরৎ মুহম্মদ সাহেব এই বুরাকে চড়েই সৃষ্টিকর্তা সন্নিধানে যান। বিরুদ্ধ পক্ষ বলেন, তিনি সশরীরে যাননি; তার রুহ, অর্থাৎ আত্মা গিয়েছিল। অর্থাৎ বুরাক ইত্যাদি রূপকার্থে নিতে হবে।
৪. কবি রবীন্দ্রনাথ কৃসাধনে দম্ভ দেখে সর্বত্যাগী ভৈরব-শঙ্করকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন
‘আমাকে চেনে না তব শ্মশানের বৈরাগ্যবিলাসী
দারিদ্রের উগ্র দর্পে খলখল ওঠে অট্টহাসি
দেখে মোর সাজ।’
সর্বত্যাগী শঙ্কর হিন্দুর উপাস্য। কিন্তু তাঁর সর্ব ত্যাগের অন্ধানুকরণ ও তৎসহ তাই নিয়ে দম্ভ, সেই ত্যাগের luxury, যেমন মূর্খ চেলারা করেন, কবি সেইটে এই কবিতায় বুঝিয়েছেন।
৫. পণ্ডিত মাত্রই কি ভারত, কি আরব সর্বত্র আমাদের আজকের দিনের বিচারে বড় অশ্লীল গালাগাল দেন। ‘তোমার সঙ্গে আলোচনা বন্ধ্যাগমন’ আমাকে একাধিক পণ্ডিত বলেছেন। আমি তখন শান্তিপুরে নব্যন্যায় শিক্ষার ‘বন্ধ্যাগমন’ করছি। দোষ আমারই, তাঁদের নয়। কাইরোতেও একই অবস্থা!
রবি-মোহন-এনড্রুজ
কয়েকদিন পূর্বে একখানা চটিবইয়ে রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মাজি ও এনড্রুজ সম্বন্ধে একটি বিবরণীতে দেখি আর সবই আছে, নেই শুধু একটি কথা :–এনড্রুজের পরলোকগমনের পর তার স্মৃতিরক্ষা সম্বন্ধে সচেতন হলেন কে, এবং সেই মহৎ চিন্তা মৃন্ময়রূপে দেবার জন্য সর্বপ্রথম উদ্যোগী হলেন কে, এবং এনড্রুজ ফান্ডের আজও সামান্য যেটুকু অবশিষ্ট আছে–যদি আদৌ থাকে তার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাব কাকে?
অসহযোগ আন্দোলন আরম্ভ(১) হয় যে সময়, তখন রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমে। শুনেছি, সে-সময় তিনি নাকি সে-আন্দোলনের প্রশংসাই করেছিলেন। ফেরার সময় বোম্বাইয়ে নেমে তাঁর মত পরিবর্তন হয়, এবং আন্দোলনের বিরুদ্ধে স্পষ্ট ভাষায় একাধিক প্রবন্ধে আপন মতামত ব্যক্ত করেন (দ্বিজেন্দ্রনাথ কিন্তু বরাবরই গাঁধীকে উৎসাহ-হিম্মৎ যুগিয়ে যান)। এনড্রুজ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও গাঁধী উভয়েরই অতিশয় অন্তরঙ্গ বন্ধু– (এবং দ্বিজেন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা সহকর্মী বিধুশেখর বা ক্ষিতিমোহনের মতো তো ছিল বটেই, বেশি বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না। তাই অনেকেই তাঁকে শান্তিনিকেতন-সাবরমতী-সেতু নাম ধরে উল্লেখ করতেন।
এনড্রুজের ধর্ম ছিল দীননারায়ণের সেবা। ধর্মসঙ্গত রাজনৈতিক আন্দোলন-বিবর্তন সর্বদা দীনের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত হয়; তাই সাক্ষাৎ রাজনীতি এড়িয়ে চললেও এনড্রুজ গাঁধী-আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। তাই এই মহান আন্দোলনের ব্যাপারে ভারতবর্ষের দুই মনীষীর মধ্যে মতানৈক্য যে সর্বপ্রকারের ক্ষতিসাধন করতে পারে, সে বিষয়ে। তিনি সচেতন হন; তিনি মন স্থির করলেন, পত্র-পত্রিকার মারফৎ উভয়ের মধ্যে যে বাদানুবাদ হচ্ছে, তার চেয়ে অনেক ভালো হয়, উভয়ে একসঙ্গে মিলিত হয়ে যদি ভাবের আদান-প্রদান করেন। বলা বাহুল্য গাঁধী-রবীন্দ্রনাথের সৌহার্দ্য জন্মায়, যখন গাঁধী এর কয়েক বৎসর পূর্বে রবীন্দ্রনাথের সহৃদয় আমন্ত্রণে আফ্রিকা ত্যাগ করে সদলবলে শান্তিনিকেতন আশ্রমে যোগ দেন ও স্কুলের প্রধান শিক্ষকরূপে সেখানে ছয় মাস থাকেন (তখন কলেজ-বিভাগ বা বিশ্বভারতীর জন্ম হয়নি)। এ আলোচনা হয় কলকাতায়, এবং এক এনড্রুজ ছাড়া সেখানে। চতুর্থ ব্যক্তি ছিলেন না।
কিন্তু কবির মতো চিত্রকরও শুধু যে নব নব সৃজন-কর্মে লিপ্ত থাকেন তাই নয়, নব নব গোপন তত্ত্ব, সৌন্দর্য আবিষ্কার করে রসিকজনের সম্মুখে রাখতে চান। কবি রবির ভ্রাতুস্পুত্র ছবি-রবি’ অবন ঠাকুর তাই মনে মনে ভাবলেন, রবীন্দ্রনাথ ও গাঁধীর মতো মনীষী এ দেশে নিত্যি জন্মায় না, নিভৃতে এ দোঁহার মিলনের অত্যন্ত সামান্য কিছুটাও যদি না দেখতে পেলুম, তবে এ জীবনে দেখলুমটা কী? কথাটা ঠিক; হিমালয়-আলপসে মিলন হয় না,– কিন্তু এ মিলন তো তারও বড়ো।
উপযুক্ত তাবৎ কাহিনী আমি অন্যত্র সবিস্তর দিয়েছি বলে এস্থলে সংক্ষেপে সারি, কারণ অদ্যকার কীর্তন ভিন্ন। ‘অবন ঠাকুর’ চুপসে দরজার চাবির ফুটো দিয়ে এক লহমায় তাঁর স্থিরদৃষ্টিতে দেখে নিলেন ভিতরকার ছবিটি। সেইটেই তিনি একে পাঠিয়ে দিলেন শান্তিনিকেতনের কলাভবনে– যেখানে ওই তিনজনের দু জনা, অর্থাৎ কবি ও এনড্রুজ স্থায়ীভাবে বাস করেন।
কিন্তু মূল কথায় ফিরে যাই– এটুকু সুদ্ধমাত্র এ-তিন মহাপুরুষের অন্তরঙ্গতা বোঝাবার জন্য পটভূমি নির্মাণ।
***
১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে (খুব সম্ভব) গ্রীষ্মকালে অকস্মাৎ মহাত্মাজি অবতীর্ণ হলেন বোম্বাইয়ের জুহুবিচে। যুদ্ধ এবং জনরবে ভারতবর্ষ তথা তাবৎ পৃথিবী তখন গমগম করছে। প্রায় সম্পূর্ণ পূর্ব ও উত্তর ইয়োরোপ জয় করার পর হিটলার তখন সদর্পে ককেশাসের তেল পানে ধাওয়া করবেন বা করেছেন এমন সময় টলটলায়মান ইংরেজের চরম দুরবস্থার সুযোগ নিয়ে ডমিনিয়ন বিয়ন্ড দি সিজ-এর অন্যতম ভারতবর্ষ আরেকটা স্বাধীনতা আন্দোলন আরম্ভ করবে কি? এই ছিল তখন দেশবিদেশে সর্বমুখে একমাত্র প্রশ্ন।
এমন সময় গাঁধী নামলেন জুহুবিচে। এবং তার চেয়েও বিস্ময়জনক ব্যাপার যে গাধীকে আপাতদৃষ্টিতে সরল, ভালোমানুষ বলে মনে হয়, তিনি যে সাংবাদিকদের এড়াবার জন্য কত হনুর-হেকমৎ রপ্ত করে বসে আছেন সে তত্ত্বটি হাড়ে হাড়ে বিলক্ষণ জানে ভুক্তভোগী সাংবাদিকরা– সেই গাঁধীই ডেকে পাঠিয়েছেন, নিজে যেচে, প্রেস কনফারেনস! তিনি নাকি সর্বপ্রশ্নের উত্তর দেবেন।
এদিকে তিনি জুহুবিচে নেমেই খবর পাঠিয়েছেন বোম্বাইয়ের আশ্রমিক সঙ্কে। তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনবেন।
বোম্বাইয়ে বিস্তর শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী আছে– তাঁদের প্রায় সবাই গুরুদেবের দু দশটা গান গাইতে পারে, আর মহারাষ্ট্রবাসী হলে তো কথাই নেই, তাঁরা গুরুদেবের কালোয়াতি গান পর্যন্ত গাইতে পারে, দু-একজন নিধুবাবু ঢঙে গুরুদেবের টপ্পা তক দখল করে বসে আছে। কিন্তু সবসময় সবাই তো আর বোম্বায়ে থাকে না। তবু ছিলেন সর্বাধিকারী স্বৰ্গত বচুভাই শুক্ল; ইনি শান্তিনিকেতনে প্রচলিত– অর্থাৎ সেখানে দৈনন্দিন এবং পালপরবে গীত– সব কটার এবং আরো প্রচুর অচলিত সুর আপন বিরাট দিলরুবাতে বাজাতে পারতেন। তার পর ছিলেন পিনাকিন ত্রিবেদী, গোবর্ধন মপারা, সুশীলা আসর ইত্যাদি। আমিও ছিলুম বচুভাইয়ের অতিথিরূপে। কিন্তু সেটা ধর্তব্যের মধ্যে নয়। কারণ আমার মতো ‘বেতালাকে’ কাবু করতে পারেন এমন বেতাল-সিদ্ধ এখনও জন্মাননি!
আশ্রমিক সঙ্ এবং অধিনায়করূপে বচুভাই পড়লেন দুশ্চিন্তায়। গাঁধীজি কোন কোন গান শুনতে চাইবেন, বা কেউ গাইলে শুনতে ভালোবাসবেন সে সম্বন্ধে কারওরই কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা বা আপন ধারণা নেই– বস্তৃত শান্তিনিকেতনে বাসকালীন এবং বিশেষ করে সে-স্থল ছাড়ার এত যুগ পরেও যে, তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি অনুরাগ রয়েছে সে তত্ত্ব প্রাক্তন ছাত্রদের প্রায় কেউই জানত না। অবশ্য অনেকেই জানত ‘জীবন যখন শুকায়ে যায়–’ গানটি তাঁর বড়ই প্রিয় (এবং সেই কারণেই নিউমেনের ‘লিড কাইনডলি লাইট এমিডস্ট দি এনসারক্লিং গ্লুম’)।
আমি বললুম, ‘এটা তো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, গাঁধীজি যে সময়টা আশ্রমে কাটান, ঠিক সেই সময়ে রচিত রবীন্দ্রসঙ্গীতই পাবে পয়লা নম্বর–বা ফার্স্ট প্রেফারেন্স, তার পর নিশ্চয়ই স্বদেশী গান (এখন যাকে গাল-ভরা নামে ডাকা হয় দেশাত্মমূলক সঙ্গীত), তার পর মন্দিরে উপাসনার সময় যে কটি ব্রহ্মসঙ্গীত গাওয়া হয়। এর পরও আছে– কিন্তু অদ্দূর আমার এলেম যায় না, যেমন মনে করো গুরুদেব তার আপন পছন্দের যে-সব গান বাছাই করে তাকে শুনিয়েছেন তার হদিস পাব কোথায়! সবাই একবাক্যে আমার বক্তব্য স্বীকার করে বললে, ‘এই তিন দফেতে যেসব গান পড়ে তারই সব কটা এত অল্প সময়ে কোরাসে তৈরি করা প্রায় অসম্ভব। অতএব এই নিয়েই উপস্থিত সন্তুষ্ট থাকা যাক।’ আমি তখন স্কেল, টি-স্কোয়ার-সেট-স্কোয়ারসহ– কথার কথা কইছি– লেগে গেলুম জরিপ করতে, মহাত্মাজি যে সময়টায় শান্তিনিকেতনে ছিলেন ঠিক সেই সময়ে গুরুদেব কোন কোন গান রচেছিলেন (এ-স্থলে একটি ফরিয়াদ জানিয়ে রাখি : যাঁরাই গুরুদেব নিয়ে কোনও কাজ করতে চান, তাঁরাই চান, গুরুদেবের কবিতা যে রকম কালানুক্রমিক পাওয়া যায়, গানের বেলাও ঠিক সেইরকম হওয়া উচিত, বরঞ্চ বেশি উচিত। আমার এক মিত্র ‘রবীন্দ্রনাথের ধর্ম’ নিয়ে প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে এরই অভাবে দিশেহারা হয়ে এগুতে পারছেন না। তাঁর মূল প্রশ্ন, একটা বিশেষ সময়ের পর মোটামুটি ১৯১৮- রবীন্দ্রনাথ কি একেবারেই আর কোনও ধর্মসঙ্গীত রচনা করেননি? করে থাকলে কটি?)? অবশেষে কষ্টেসৃষ্টে মোটামুটি একটি ফিরিস্তি তৈরি হল। বেশিরভাগ গায়কই গুজরাতি; তাদের পছন্দের ধর্মসঙ্গীত– যেগুলো কারও না কারও ভালো করে জানা ছিল সেগুলোও কোরাসে লিখে নেওয়া হল। সক্কলেরই এক ভরসা গাঁধীজির সুরজ্ঞান খুব একটা টনটনে নয়, মহারাষ্ট্রের মতো গাঁধীর জন্মভূমি কাঠিওয়াড়-গুজরাতে গান-বাজনার প্রাচীন সর্বব্যাপী কোনও ঐতিহ্য নেই।
“শেষের সেদিন ভয়ঙ্কর” শেষটায় এল। ওরা ধরে নিয়েছিল আমি সঙ্গে যাব। আমার এক কথা ‘ক্ষেপেছ! আমি না পারি গাইতে, না জানি বাজাতে। আমাদ্বারা কোনওপ্রকারের শোভাবর্ধনই হবে না– “শোভা” জিনিসটা গাঁধীজি আদৌ পছন্দ করেন না।’
***
মহাত্মাজি বললেন, ‘গাও!’
ওরা কাঁচুমাচু হয়ে বললে, ‘কী গান…?’
‘তোমাদের যা জানা আছে।’
এসব আমার শোনা কথা। তার ওপর ইতোমধ্যে দীর্ঘকাল কেটে গিয়েছে। সঠিক মনে নেই, প্রাক্তন দল সক্কলের পয়লাই রঙের টেক্কা, অর্থাৎ ‘জীবন যখন শুকায়ে যায়’–মেরেছিল, না সেটাকে তাঁর আদেশের জন্য জীইয়ে রেখেছিল। কিন্তু মোদ্দা, তারা এক একটা গান শেষ হলে যখন থামে, তখন তিনি মাথা নেড়ে সম্মতি জানান এবং আরও গাইবার ইঙ্গিত করেন। তারা দু-একবার চেষ্টা দিয়েছিল গাঁধীজির আপন পছন্দ জানাবার জন্য– ফলোদয় হয়নি।
সর্বশেষে মহাত্মাজি দু-একটি প্রশ্ন শুধোন। কেউ উত্তর দিতে পারেনি। মারাঠি মপারা বাড়ি ফিরে তো আমাকে এই মারে কি তেই মারে। আমি থাকলে নাকি চটপট উত্তর দিয়ে দিতুম। আমি বললুম, ‘এগুলোর উত্তর তো বচুভাইও জানে, তদুপরি সে ওয়াডওয়ান অর্থাৎ গাঁধীজির মতোই কাঠিওয়াড়ের লোক– গুজরাতি– না, খাস কাঠিওয়াড়িতেই উত্তর দিয়ে তার জান ঠাণ্ডা করে দিতে পারত! সে নাকি নার্ভাস হয়ে গিয়েছিল। আমি হতুম না, কী করে জানলে! ওই সিংগির সামনে!’
কিন্তু এহ বাহ্য!
আসলে পূর্বোল্লিখিত প্রেস-কনফারেন্স্ গাঁধীজি ডাকিয়েছিলেন ওই দিনই, ওই সময়ই, ওই স্থলেই।
এখন আমি যা নিবেদন করব সেটা ওই সময়কার খবরের কাগজ নিয়ে চেক্ অপ্ করে সন্দেহ-পিচেশ তথা গবেষক-পাঠক ধরে ফেলতে পারবেন, আমি কী “দারুণ” “গুলমগীর”। অলঙ্কারিকার্থে কিন্তু আমি “যদু” পতি বা “রাখাল” রাজা হওয়ার মতো তাদের লক্ষাংশের একাংশ শক্তি ধরিনে বলে আমি নাচার; বেচারার পক্ষে শুল্ মারাই একমাত্র চারাহ।
যতদূর মনে পড়ে সেই এভেমন্ডে বিজড়িত ভারতের সর্বজাতের সাংবাদিকগণই সেদিন রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনবার সৌভাগ্য লাভ করেছিল।
গান শেষ হলে মহাত্মাজি ওঁদের বললেন, ‘তোমাদের কী কী প্রশ্ন আছে, শুধোও!’ আর যায় কোথায়! দুনিয়ার যত রকম প্রশ্ন; আবার নতুন করে অসহযোগ আন্দোলন আরম্ভ হবে কি, এই কি তার জন্য উৎকৃষ্টতম মোকা নয়–মিত্রপক্ষ চতুর্দিকে বেধড়ক মার খাচ্ছে, আরম্ভ হলে কী প্রকারে হবে, ট্যাক্স বন্ধ করে না নয়া কোনও টেকনিকে, ১৯২০-এর মতো ছাত্রদের ডাকা হবে কি না, ইত্যাদি ইত্যাদি।
গাঁধীজি তাঁর চিরাচরিত ধৈর্যসহ উত্তর দিয়ে যেতে লাগলেন–যদ্যপি আমার মনের ওপর তখনকার, অর্থাৎ পরের দিনের খবরের কাগজ পড়ার পর যে দাগ পড়েছিল সেটা বোধ হয় এই যে মোক্ষম প্রশ্নগুলো মহাত্মাজি এড়িয়ে গিয়েছিলেন। অবশ্য ওই সময়ে ভবিষ্যতে তাবৎ প্ল্যান ফাঁস করে দেওয়া যে সদ্বুদ্ধির কর্ম হত না, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
হঠাৎ মহাত্মাজি দু হাত তুলে প্রশ্নধারা নিরুদ্ধ করে বললেন, ‘আমি বেনে। বেনে কাউকে কোনও জিনিস মুফতে দেয় না। আমিও খয়রাৎ করার জন্য তোমাদের ডাকিনি। রবীন্দ্রসঙ্গীত তো শুনলে। এবার আমার কথা শোনো। পোয়েট গত হওয়ার পূর্বে (তখনও বোধ হয় এক বছর পূর্ণ হয়নি। আমাকে আদেশ করেন, আমাদের উভয়ের বন্ধু এনড্রুজের স্মৃতিরক্ষার্থে যা কর্তব্য তা যেন আমি আপন কাঁধে তুলে নিই। এখন দেখতে পারছি, আসন্ন ভবিষ্যৎ বড়ই অনিশ্চিত। তাই আজই আমি “এনড্রুজ মেমোরিয়াল ফান্ড”-এর জন্য অর্থসঞ্চয় আরম্ভ করলুম। দাও।’
মপারা রিপোর্ট দিতে গিয়ে আমায় বলেছিল, ‘গাঁধীজি অনেকক্ষণ ধরে এনড্রুজ সম্বন্ধে বলেছিলেন, in a very touching manner। আর তার পর মহাত্মাজির সামনে পড়তে লাগল, টাকা, পুরো মনিব্যাগ, গয়না, রিস্টওয়াচ, আংটি, কত কী! যেন বানের জলে ভেসে আসছে দুনিয়ার কুল্লে মূল্যবান জিনিস। অনেকে এমনই যথাসর্বস্ব দিয়ে ফেলেছিলেন যে, বোম্বায়ে ফেরার জন্য টিকিট কাটার পয়সা পর্যন্ত তাদের কাছে অবশিষ্ট ছিল না। কিন্তু জানেন। তো, রেলও এখন আর পুরোপুরি ইংরেজের নয়। ভিলেপার্লে থেকে চার্চ গেট স্টেশন– সবাই জানে, কেন এদের টিকিট নেই।’
ফান্ডের টাকা যখন জমে উঠছে, তখন কে একজন বললে, ‘মহাত্মাজি, এখন এসব কেন? স্বরাজ পাওয়ার পর এসব কাজ তো রাতারাতি হয়ে যাবে।’
আজ সত্যই আমার হাসিকান্নায় মেশানো চোখের জল নেমে আসে– এই ব্যক্তিটির ওই মন্তব্যটির স্মরণে। তারই মতো আমরা সবাই তখন ভাবতুম, ইংরেজই সর্ব নষ্টের মূল। বিহারে ভূমিকম্প হলে ইংরেজই দায়ী, মেদিনীপুরে সাগর জাগলে ওটা ওই ইংরেজেরই দুষ্কর্ম! ইংরেজকে খেদিয়ে দিয়ে স্বাধীন হওয়া মাত্রই–
When we shall have attained liberty, all those will be mere trifles!
গাঁধীজি সঙ্গে সঙ্গে মোক্ষম গরম কড়া গলায় জবাব দেন, ‘But Tagore did not wait to be born till India attained her liberty.’
পরাধীন ভারতে যদি কবি জন্ম নেন, তবে তাঁর সখার স্মৃতিরক্ষার ভার পরাধীন ভারতের স্কন্ধেই।
তাই বলছিলুম, হাসি পায় কান্নাও পায়– তখন আমরা কী naif (প্রায় ‘ন্যাকার’ মতো)-ই না ছিলুম, যে বিশ্বাস করতুম– স্বরাজ পাওয়ার পরই ‘পাঁচ আঙুল ঘিয়ে’ আর ‘ডেগ-এর ভিতর গর্দান ঢুকিয়ে ভোজন’!
তাই কি রবীন্দ্রনাথ সাবধানবাণী বলেছিলেন, (উদ্ধতিতে ভুল থাকলে ক্ষমা চাইছি) ‘একদিন (স্বরাজ লাভের পর) যেন না বলতে হয়, ইংরেজই ছিল ভালো!’
কিন্তু কোথায় গেল সেই ‘এনড্রুজ ফান্ড’ যার মোটা টাকাটা তুলেছিলেন গাঁধীজি?
তা সেটা যেখানে যাক, যাক! দুঃখ এই সেই চটিবইয়ে এবং অন্যত্র ‘এনড্রুজ ফান্ডের’ কথা উঠলে কেউ আর গাঁধীকে স্মরণ করে না, তিনি যে সেই সুদূর বোম্বায়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনিয়ে ফান্ডের গোড়াপত্তন করেছিলেন সেটা সবাই ভুলে গেছে!!
৫/২/৬৬
———- ১. গুরুচণ্ডালী নিয়ে আলোচনা একাধিক স্থলে দেখেছি। চলতি ভাষা আরম্ভ হওয়ার পূর্বে এটাকে অমার্জনীয় অপরাধের অনুশাসনরূপে সম্মান করা হত– যদিও যে দ্বিজেন্দ্রনাথকে কবি রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষায় সর্বশ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞরূপে সশ্রদ্ধ সম্মান জানাতেন, তিনি স্বয়ং সে অনুশাসন তাঁর কঠিনতম সংস্কৃত শব্দে পরিপূর্ণ বাংলা দর্শগ্রন্থে পদে পদে লঙ্ঘন করতেন, এবং সকলকেই সে উপদেশ দিতেন। চলতিভাষা চালু হওয়ার পর, পরলোকগমনের মাত্র কয়েক বৎসর পূর্বে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও লেখেন, গুরুচণ্ডালী এখন আর অপরাধ নয় (বাংলা-অলঙ্কারের পিনাল-কোড থেকে গুরুচণ্ডালী সরিয়ে দেওয়া হল– ধরনের অভিব্যক্তি)। অধীন দ্বিজেন্দ্রনাথের আদেশ বাল্যাবস্থা থেকেই মেনে নিয়েছে, যদ্যপি সে সদাই ‘লড়াই শুরু হল’ এবং ‘যুদ্ধ আরম্ভ হল’ তথা ‘মোকদ্দমা শুরু হল’ এবং তর্কবিতর্ক আরম্ভ হল এ’দুয়ে পার্থক্য মেনে চলেছে।
রাসপুতিন
এক-একটা দুঃখ মানুষ আমৃত্যু বয়ে চলে। আমরা নিজের কথা যদি বলার অনুমতি দেন, তবে নিবেদন করি, অধ্যাপক বদানফের আমাকে বলা তাঁর নিজের জীবনের কিছু কিছু অভিজ্ঞতা আমি যে কেন তখনই লিখে রাখিনি সেই নিয়ে আমার শোক, এ-শোক আমার কখনও যাবে না। তারই একটি ১৯১৭-র কম্যুনিস্ট বিপ্লব। তিনি অকুস্থলে উপস্থিত ছিলেন এবং সমস্ত ঘটনাটি বর্ণনা করতে তাঁর লেগেছিল পুরো ন টি ঘণ্টা। শান্তিনিকেতনে আশ্রমের ইস্কুলের শোবার ঘণ্টা পড়ে রাত নটার সময়; আমি কলেজে পড়তুম বলে অধ্যাপকের ঘরে ওই সময়ে যেতে কোনও বাধা ছিল না। পরপর তিন রাত্রি ধরে রাত বারোটা-একটা অবধি তিনি আমাকে সে ইতিহাস বলে যান। অবশ্য অনেকেই বলতে পারেন, ওই যুগপরিবর্তনকারী আন্দোলন সম্বন্ধে বিস্তর প্রামাণিক পুস্তক লেখা হয়ে গিয়েছে এবং অধ্যাপক বদানফের পাঠটা খোয়া গিয়ে থাকলে এমন কীই-বা ক্ষতি। হয়তো সেটা সত্য, কিন্তু ওই বিষয়ে আমি যে কটি সামান্য বই পড়েছি তার সব কটাই বড়ই পাণ্ডিত্যপূর্ণ, বৈজ্ঞানিক। বদানফ তার কাহিনী বলেছিলেন একটি ষোল বছরের ছোকরাকে ঘটনার মাত্র চার-পাঁচ বৎসর পরে এবং সেটি তিনি তাই করেছিলেন সেই অনুযায়ী রসময়, অর্থাৎ সাহিত্যরসে পরিপূর্ণ। এস্থলে বলে রাখা প্রয়োজন মনে করি, অধ্যাপকের বর্ণনভঙ্গিটি ছিল অসাধারণ, তাই পরবর্তী যুগে তার ইরান ও আফগানিস্তান (এ দুটি দেশে তিনি দীর্ঘকাল বাস করেন) সম্বন্ধে লিখিত গবেষণামূলক পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রবন্ধরাজি পণ্ডিতমণ্ডলীতে সাহিত্যিক খ্যাতিও পায়। মাতৃভাষা রাশানে তিনি লিখেছেন কমই– তাঁর পাণ্ডিত্যপ্রকাশ-যুগে রাশাতে এ ধরনের গবেষণার কোনওই মূল্য ছিল না বলে সেগুলো সেখানে ছাপানোই ছিল অসম্ভব। তিনি প্রধানত লেখেন ফরাসি, ইংরেজি ও ফার্সির মাধ্যমে। এবং সবচেয়ে বেশি সম্মান পান ফার্সি পণ্ডিতজন মধ্যে।(১)
তিনি যে দ্বিতীয় কাহিনী বলেন, সেটি রাসপুতিন সম্বন্ধে। প্রথমটির তুলনায় এটি অনেক হ্রস্ব। রাসপুতিনকে নিহত করা হয়, পুরনো ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১৬ ডিসেম্বর, নতুন ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৩০ ডিসেম্বর ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে। এর প্রায় কুড়ি বৎসর পর রাসপুতিনকে নিয়ে আমেরিকায় একটি ফিলম্ তৈরি হয় (এবং আমার যতদূর মনে পড়ে লায়োনেল বেরিয়োর রাসপুতিনের অংশ কৃতিত্বের সঙ্গে অভিনয় করেন) এবং ওই সময় রাসপুতিন-হন্তা রাশার শেষ জারের নিকটাত্মীয় গ্র্যান্ড ডিউক ইউসুপ (আরবি হিব্রুতে ইউসুফ, ইংরেজিতে জোসেফ) ইয়োরোপে। ১৯১৭-র রুশ বিপ্লবের মধ্যে তিনি ও তার স্ত্রী সেই সব ভাগ্যবানদের দু জনা, যারা প্রাণ নিয়ে রাশা থেকে পালাতে সক্ষম হন। তিনি লন্ডন আদালতে মোকদ্দমা করেন ফিনির্মাতাদের (বোধ হয় MGM) বিরুদ্ধে যে, তারা যে ফিমের ইঙ্গিত দিয়েছেন, রাসপুতিন তার অর্থাৎ ইউসুপফের স্ত্রীকে পর্যন্ত তাঁর কামানলের দিকে আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। তিনি মোকদ্দমাটি হেরে যান বটে, কিন্তু ওই মোকদ্দমাটি তখন এমনই cause celebre কজ্ব সেহ্রে রূপে যেমন আমাদের ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মোকদ্দমা প্রখ্যাতি লাভ করে যে তার অল্প দু-এক বৎসর পর ওই মোকদ্দমায় প্রধান অংশগ্রহণকারী একজন উকিল মোকদ্দমাটি সম্বন্ধে একটি প্রামাণিক এবং আমি বলব– সাহিত্যিক উচ্চপর্যায়ের প্রবন্ধ লেখেন। তিনি যদিও ইউসুপফের বিরুদ্ধ পক্ষের উকিল ছিলেন, তবু আদালতে ইউসুফ দম্পতির খানদানি সৌম্য আচরণের অকৃপণ প্রশংসা করেন। তার পর হয়তো আরো অনেক কিছু ঘটেছিল। কিন্তু তার খবর আমার কাছে পৌঁছয়নি। হঠাৎ গত মাসের ‘আনন্দবাজারে’র এক ইস্যুতে দেখি, ইউসুপফ ফের মোকদ্দমা করেছেন– এবার কিন্তু আমেরিকায়, কলাম্বিয়া বেতার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে রাসপুতিন ও তাঁর জীবন নিয়ে নাট্যপ্রচার করার জন্য এবং আবার মোকদ্দমা হেরেছেন। সেই সুবাদে আমার মনটা চলে গেল ১৯২১-২২ খ্রিস্টাব্দে, যখন অধ্যাপক বদান রাসপুতিন-কাহিনী আমাকে ঘণ্টা তিনেক ধরে শোনান।
পরবর্তী যুগে ফিলম বেরুল, তার পর লন্ডনের উকিল তার বক্তব্য বললেন, এবং ‘আনন্দবাজার’ বিদেশ থেকে যে সংবাদ পেয়েছেন, তাই প্রকাশ করেছেন। এদের ভিতর পরস্পরবিরোধ তো রয়েইছে, কিন্তু আমার পক্ষ থেকে এ-স্থলে আসল বক্তব্য এই যে, বদানফ বলেছিলেন, সম্পূর্ণ না হোক, অনেকখানি ভিন্ন কাহিনী। আমি আদৌ বলতে চাইনে, তার বিবরণী, জবানি বা ভার্সন– যাই বলুন– সেইটেই নির্ভুল আপ্তবাক্য; বস্তুত তিনি নিজেই আমাকে বারবার বলেছিলেন, ‘মাই বয়! সেন্ট পেটেরসবুর্গে তখন এত হাজারও রকমের গুজব নিত্য নিত্য ডিউক সম্প্রদায় থেকে আস্তাবলের ছোকরাটা পর্যন্ত গরমাগরম এ-মুখ থেকে ও-মুখ হয়ে রাশার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে যে আমারটাই যে অভ্রান্ত সেই-বা বলি কোন সাহসে? তবে এটা সত্য আমার জীবনের সর্বপ্রধান কাজ “টেস্ট ক্রিটিসিজ্ম্” তখনও ছিল, এখনও আছে অর্থাৎ কোনও পুস্তকের পেলুম তিনখানি পাণ্ডুলিপি, তাতে একাধিক জায়গায় লেখক বলেছেন পরস্পর-বিরোধী তিনরকম কথা। আমার কাজ, যাচাই করে সত্য নিরূপণ করা, কিংবা সত্যের যতদূর কাছে যাওয়া যায় তারই চেষ্টা দেওয়া। অতএব, বুঝতেই পারছ, রাসপুতিন সম্বন্ধে গুজবগুলো আমি সরলচিত্তে গোগ্রাসে গিলিনি, আমার বুদ্ধিবিবেচনা প্রয়োগ করে যেটা সর্বাপেক্ষা সত্যের নিকটতম সেইটেই বলছি।’
অধ্যাপক রাসপুতিনের প্রথম জীবনাংশ সংক্ষেপে সারেন। ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে এই চাষি পরিবারের ছেলে রাসপুতিনের জন্য সাইবেরিয়াতে। ‘রাসপুতিন’ তাঁর আসল নাম নয়– সেটা পরে অন্য লোকে তাঁর উচ্ছৃঙ্খল আচরণ বিশেষ করে কামাদি ব্যাপারে জানতে পেরে তাঁর ওপর চাপায়। লেখাপড়ার চেষ্টা তিনি ছেলেবেলায় কিছুটা দিয়েছিলেন সত্য, কিন্তু সেদিকে ছিলেন, ক্লাসের মামুলি চাষার ছেলেরও অনেক নিকৃষ্ট। এরপর তিনি তাঁর সমাজের দ্রঘরেই বিয়ে করেন– আর পাঁচটা ছেলের মতো। কিন্তু তার কিছুকাল পরেই হঠাৎ তাঁর ঝোঁক গেল ধর্মের দিকে, কিন্তু প্রচলিতার্থে আমরা ধর্মাচরণ বলতে যা বুঝি সেদিকে নয়। হিন্দুধর্মে যে-রকম একাধিক মতবাদ, শাখা-প্রশাখা– রুশের প্রচলিত (অর্থডক্স) সনাতন খ্রিস্টধর্মেও তাই। তারই একটার দিকে আকৃষ্ট হলেন গ্রেগরি (রাসপুতিন)। এস্থলে উল্লেখ প্রয়োজন বলে মনে করি, অধ্যাপক বগদানফ ছিলেন অতিশয় ‘গোঁড়া’–আমি সজ্ঞানে শব্দটি ব্যবহার করছি– রাশার সরকারি ধর্ম গ্রিক অর্থডক্স চার্চে বিশ্বাসী এবং আচারনিষ্ঠ খ্রিস্টান। শান্তিনিকেতনে তাঁর কামরায় (তখনকার দিনের অতিথিশালা, এবং বোধ হয় দর্শন-ভবন) দেয়ালে ছিল ইকন এবং তার নিচে অষ্টপ্রহর জ্বলত মঙ্গলপ্রদীপ এবং তারই নিচে তিনি অহরহ দাঁড়িয়ে স্বদেহে আঙুল দিয়ে ক্রশচিহ্ন অঙ্কিত করতে করতে–ঠিক আমাদের বুড়িদের মতো বিড়বিড় করে দ্রুতগতিতে মন্ত্রোচ্চারণ করতেন। বলা বাহুল্য রাসপুতিন যে খলিসতি (Khlisti) সম্প্রদায়ে প্রবেশ করলেন সেটাকে অধ্যাপক অপছন্দ করতেন। এ সম্প্রদায় উন্মত্ত নৃত্য, সঙ্গীত (এবং লোকে বলে যৌনাভিচার) ইত্যাদির মাধ্যমে পরমাত্মাকে মানবাত্মায় অবতীর্ণ করিয়ে স্বয়ং পরমাত্মায় পরিবর্তিত হওয়ার চেষ্টা করে। এ মার্গ বিশ্বসংসারে কিছু আজগুবি নতুন চিজ নয়। তবে এরা বলতে কসুর করতেন না যে, স্ত্রী-পুরুষের যৌনসম্পর্ক সম্বন্ধে এঁরা উদাসীন, অর্থাৎ এ বাবদে কে কী করে সেটা ধর্তব্যের মধ্যে নয়। রাসপুতিন এটাকে নিয়ে গেলেন তার চরমে। তিনি প্রচার করতে লাগলেন, ‘পাপ না করলে ভগবানের ক্ষমা পাবে কী করে? অতএব পাপ করো!’ এছাড়া তাঁর আরেকটি বক্তব্য ছিল, তিনি পরমাত্মার অংশাবতার, এবং তার সঙ্গে দেহে মনে আত্মায় আত্মায় যে কেউ সম্মিলিত হবে তারই চরম মোক্ষ তদ্দণ্ডেই। তার শিষ্যাগণের সঙ্গে তার সেই সম্মিলিত হওয়াটা কোন পদ্ধতিতে হত সেটা বলতে শ্লীলতায় বাধে, এবং একথা প্রায় সর্বাদিসম্মত যে তিনি তার শিষ্য-শিষ্যাগণকে নিয়ে একই কামরায় যেসব ‘সম্মিলন’ ঘটাতেন সেটা শুধু তিনি নিজেতেই সীমাবদ্ধ রাখতেন না, শিষ্য-শিষ্যাগণ নিজেদের মধ্যেও সম্মিলিত হতেন। ইংরেজিতে একেই ‘অর্জি’ ‘সেটারনেলিয়া’ ইত্যাদি বলে থাকে।
এটা সত্য, রাসপুতিনের কথা আমিই উত্থাপন করেছিলুম এবং অধ্যাপকও রাসপুতিন সম্বন্ধে তাঁর যা জানা ছিল সেটি সবিস্তর বলেছিলেন, কিন্তু তিনি রাসপুতিনের ধর্মসম্প্রদায় সম্বন্ধে বলতে গিয়ে তার পূর্ণ বক্তব্যের প্রায় অর্ধাংশ ব্যয় করেন ওই সম্প্রদায় নিয়ে, এবং বিশ্বের অন্যান্য ধর্মে কোথায় কোথায় এ প্রকারের অর্জি স্বীকৃত এবং কার্যে পরিণত হয়েছে তাই নিয়ে। এ বাবদে তার শেষ বক্তব্য আজও আমার স্পষ্ট মনে আছে; ধর্মের নামে এ ধরনের অনাচার কেন যুগে যুগে হঠাৎ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, কিংবা গোপনে গোপনে বিশেষ কয়েকটি পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে প্রাচীন ধারাটি অক্ষুণ্ণ রাখে, এ তত্ত্বটি সাতিশয় গুরুত্ব ধারণ করে এবং এর অধ্যয়ন প্রচলিত ভিন্ন ভিন্ন ধর্মশাস্ত্রীয় পুস্তক অধ্যয়ন করে হয় না, এর জন্য প্রথমত প্রয়োজন নৃতত্ত্ব এবং পরে সমাজতত্ত্বের গভীর অধ্যয়ন (এর পূর্বে Anthropology ও Sociology এ দুটো শব্দ আমি কখনও শুনিইনি।)
আমি তখন বুঝতে পারিনি, পরে পারি যে আর পাঁচজনের মতো তিনিও রাসপুতিনের রগরগে কাহিনী কীর্তন করতে প্রস্তুত ছিলেন বটে, কিন্তু তার আসল উদ্দেশ্য ছিল এরই মাধ্যমে– ফাঁকি দিয়ে শটকে শেখানোর মতো– আমাকে সাধারণ ভারতীয় ছাত্রের পাঠ্যবস্তুর গণ্ডি থেকে বের করে পুরাতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে প্রথম পরিচয় করিয়ে দেওয়া। বলা বাহুল্য, এসব আমার সম্বন্ধে নিছক ব্যক্তিগত কথা হলে আমি এগুলো উল্লেখ করতুম না, আমার অন্যতম উদ্দেশ্য, এই সুবাদে তখনকার দিনের স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ-চালিত বিশ্বভারতীয় (স্কুল ও কলেজ– যথাক্রমে ‘পূর্ব’ ও ‘উত্তর’ বিভাগ) অধ্যাপকগণ কী প্রকৃতি ধারণ করতেন তারই যৎকিঞ্চিৎ বর্ণনা।
অধ্যাপক বলেছিলেন, এ ধরনের উচ্ছৃঙ্খল আচরণ অবাধে করা যাচ্ছে এবং তদুপরি সেটা ধর্ম নামে প্রচারিত হচ্ছে, এটা যে জনপ্রিয় হবে– অন্তত জনগণের অংশবিশেষে সেটা তো অতিশয় স্বাভাবিক। কিন্তু এই যে এক অজানা-অচেনা অর্ধলুপ্ত ধূলিসৃতি সম্প্রদায় হঠাৎ নবজীবন লাভ করে খুদ জারের প্রাসাদ পর্যন্ত পৌঁছে গেল, এটা তো আর একটা আকস্মিক অকারণ কর্তাবিহীন কর্ম নয়। এরকম একটা নব আন্দোলন আনয়নকারী পুরুষের কোনও না-কোনও অসাধারণ গুণ, আকর্ষণ বা সম্মোহনশক্তি থাকা নিশ্চয়ই প্রয়োজন।
পূর্বেই বলেছি, অধ্যাপক ছিলেন কট্টর ‘অর্থডকস গ্রিক চার্চ’-এর অন্ধ ভক্ত। কিন্তু এস্থলে এসে তিনিও স্বীকার করলেন, রাসপুতিন একাধিক অলৌকিক শক্তি ধারণ করতেন। তিনি যে কঠিন দুরারোগ্য রোগ কোনও প্রকারের ঔষধ প্রয়োগ না করে প্রশম করতে পারতেন সেটারও উল্লেখ করলেন। কী প্রকারে? কেউ জানে না।
ইতোমধ্যে জার-প্রাসাদের ওপর মৃত্যু যেন তার করাল ছায়া বিস্তার করেছে। হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে বালক যুবরাজ আহত হন। তাঁর রক্তক্ষরণ আর কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না। ভিয়েনা-বার্লিন থেকে বড় বড় চিকিৎসক এসেছেন। আমি অধ্যাপককে শুধিয়েছিলুম, ‘চিকিৎসাশাস্ত্রে কি রাশা তখনও এতই পশ্চাৎপদ?’ তিনি বলেছিলেন, ‘বলা শক্ত, তবে সাহিত্যের বেলা চেখফ যা বলেছেন এস্থলেও হয়তো সেটা প্রযোজ্য: তোমার প্রিয় লেখক চেখফ বলেছেন, ‘হ্যাঁ, আলবৎ আমরা রুশি সাহিত্য পড়ি। কিন্তু সেটা ওই যে রকম আমরা কুটিরশিল্পকে মেহেরবানি করে সাহায্য করি। আসলে মালের জন্য যাই ফরাসি সাহিত্যে।’ হয়তো চিকিৎসার বেলাও তখন তাই ছিল।’
.
দাসী না ডাচেস– সমাজের দুই প্রান্তের দু জনা– কে প্রথম রাসপুতিনকে নিয়ে গেল জারের রাজপ্রাসাদে?
সে কে? যুবরাজ মৃত্যুশয্যায়, আপন ‘কটেজ ইনডাসট্রি’র রাশান ডাক্তাররা তো হার মেনেছেনই, ভিয়েনা-বার্লিনের রাজবৈদ্যরাও, যারা কি না কাইজারের, এমপেরার ফ্রানৎস যোসেফের প্রাসাদের গণ্যমান্যদের চিকিৎসা করে করে বিশ্ববিখ্যাত হয়েছেন তারা পর্যন্ত রাশা ছেড়ে পালাতে পারলে বাঁচেন। কারণ রুশ যুবরাজের যে রোগ হয়েছে সেটার নাম হ্যামোফিলিয়া– আমরা গরিবদের, না জানি কোন পুণ্যের ফলে, আমাদের হয় না– ব্যামোটা শব্দার্থেই রাজসিক, শুধু রাজা-রাজড়াদের ভেতরেই সীমাবদ্ধ। পূর্বে ছিল এই বিশ্বাস; পরে দেখা গেল, গরিবদেরও হয়। আমরা বললুম, সেই কথাই কও! ভগবান যে হঠাৎ খামোখা এহেন দুরারোগ্য ব্যাধি শুধু বড়লোকদের জন্যই রিজার্ভ করে রেখে দেবেন, এটা তো অকল্পনীয়। ব্যামোগুলো তো আমাদের মতন গরিবদের জন্যই তৈরি হয়েছে। ভগবান স্বয়ং তো রাজাদের দলে। কিংডম অব দি হেভেন বা স্বর্গরাজ্যে যাঁরা বাস করে, তিনি তো ফেভার করবেন তাঁর জাতভাই তাঁদেরই, যাঁদের কিংডম্ অব দি আর্থ বা পৃথ্বীরাজ্য আছে।(২) তাই যদি হয়, তবে স্বর্গরাজ্যই হোক, আর ভূস্বর্গই হোক, ভিয়েনা-বার্লিনের অশ্বিনীকুমারদ্বয় যেখানে রুগীকে হরিনামের গুলি দিয়ে তাড়াতাড়ি কেটে পড়ার তালে, সেখানে দাসী ‘ফার্সি’ পড়বে? হয়তো ঠিক সেইখানেই, কিন্তু অন্য কারণও আছে।
আমরা এ দেশে যত কুসংস্কারাচ্ছন্নই হই-না কেন, একাধিক বাবদে অন্তত সে যুগে, অর্থাৎ শতাব্দীর প্রারম্ভে জারের রাশা আমাদের অনায়াসে হার মানাতে পারত। সে রাশার গ্রিক অর্থডকস চার্চ ছিল শব্দার্থেই অর্থডক্স্ গোঁড়া, কট্টর কুসংস্কারাচ্ছন্ন। আর চাষাভুষোদের তো কথাই নেই। তন্ত্রমন্ত্র, জড়িবড়ি, মাদুলি-কবচ থেকে আরম্ভ করে নিরপরাধ ‘প্রভু যিশুর হত্যাকারী ইহুদিদের সুযোগ পেলেই বেধড়ক মার, এবং সেখানেই শেষ নয়– আপন রক্তের আপন ধর্মের জাতভাই যারা এসব কুসংস্কার থেকে একটুখানি মুক্ত হয়ে, অঙ্গুষ্ঠ পরিমাণ স্বাধীনভাবে প্রভু যিশুর বাণী জীবন দিয়ে গ্রহণ করার চেষ্টা করত যেমন ‘দুখবর’, ‘স্তান্দিন্ত’ সম্প্রদায়– তাদের ওপর কী বীভৎস অত্যাচার।(৩) এবং চাষাভুষোদের এই অত্যাচার-ইন্ধনে কাষ্ঠ সরবরাহ করতেন জার-সম্প্রদায় এবং তাঁদের অনুগ্রহে লালিত-পালিত বিলাসব্যসনে গোপন পাপাচারে আকণ্ঠ নিমগ্ন অর্থডক্স চার্চ তার আপন ‘পোপ’–হোলি সিনডকে নিয়ে। যে ইউসুপফ এর কয়েক বত্সর পর রাসপুতিনের ভবলীলা সাঙ্গ করেন, তিনি বা তাঁর ভাই, আরেজ গ্রান্ড ডিউক প্রকাশ্য ‘ডুমা’ বা মন্ত্রণা-সভায় প্রস্তাব করেন এবং বহু বিনিদ্র যামিনী যাপন করে স্বহস্তে নির্মিত পরিকল্পনা সঙ্গে সঙ্গে পেশ করেন, ইহুদিদের সবংশে বিনাশ করার জন্য কী প্রকারে, স্তরে স্তরে শল্য প্রয়োগ দ্বারা তাদের পুরুষদের সন্তান-প্রজনন ক্ষমতা হরণ করা যায়? বগদান সাহেব বলেছিলেন, মাই বয়, হি সাবৃমিটেড় ইট ইন অল সিরিয়াসনেস্! অবশ্য তৎসত্ত্বেও মার্জিত রুচিসম্পন্ন ভদ্রসন্তান অধ্যাপক বগদানফ ইহুদিদের। ঘৃণা করতেন– হৃদয়ের অন্তস্তল থেকে, ওই-জাতীয় আর পাঁচটি বর্বর রুশের মতো। বিশ্বভারতীতে তখন একটি সুন্দরী, বিদেশিনী, ইহুদি অধ্যাপিকা ছিলেন; কী প্রসঙ্গে তাঁর কথা উঠতে বগদানফ তিক্ত অবজ্ঞায় মুখ বিকৃত করে বললেন, ‘আই উফ নট টাচ হার উইথ এ পেয়ার অব টংস!’– সাঁড়াশি দিয়েও তিনি তাঁকে স্পর্শ করতে রাজি হবেন না!
এ কথা সবাই বলেছেন, রাজধানী সেন্ট পেটেরসবুর্গে (তখন অবশ্য রাশা জর্মনির সঙ্গে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে লিপ্ত বলে তাদের সভ্যতায় জর্মনদের যে শতকরা আশি ভাগ অবদান, মায় তাদের ভাষায় প্রবেশপ্রাপ্ত জর্মন শব্দ, যেমন সেন্ট পেটেরসবর্গের জর্মন অংশ ‘বুর্গ’– ‘প্রাসাদ’, ‘কাসল’–সমূলে উৎপাটিত করে নামকরণ করেছে ‘পেত্রোগ্রাদ’। সর্বশেষে এর নামকরণ হয় ‘লেনিনগ্রাদ’, কিন্তু ততদিনে রাজধানী চলে গেছে মস্কোতে। জারের ‘উইন্টার পেলেস’ প্রাসাদে বিরাজ করত কেমন যেন এক অদ্ভুত রহস্যময় (প্রধানত ধার্মিক– mysticism) বাতাবরণ। সম্রাজ্ঞী—জারিনা– ছিলেন অতিশয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন, আচার-অনুষ্ঠানে সদালিপ্ত, প্রতি মুহূর্তে পুত্রের পুনর্বার রক্তক্ষরণ রোগে আক্রান্ত হবার ভয়ে উদয়াস্ত সশঙ্কিত; বিশেষ করে যখন হৃদয়ঙ্গম করলেন যে, প্রচলিত চিকিৎসাপদ্ধতি এই কঠিন পীড়ার সম্মুখে সম্পূর্ণ পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছে, তখন যে তিনি পাগলিনীর মতো রাজ্যের যত প্রকারের টোটকামোটকা, তাবিজমাদুলির সন্ধানে লেগে যাবেন সেটা অবাঞ্ছনীয় হলেও অবোধ্য নয়– এমনকি কট্টর বৈজ্ঞানিকও সেখানে সহানুভূতি দেখাবে। একেই তো শীত-প্রাসাদে বিরাজ করত রহস্যময় বাতাবরণ, যেন সেখানে যে কোনও মুহূর্তে যে কোনও প্রকারের অলৌকিক কাণ্ড ঘটে যেতে পারে, তদুপরি নানাশ্রেণির কুটিল ভাগ্যান্বেষী সেই প্রাসাদে কোনও প্রকারের চতুরতা দ্বারা অর্থ সঞ্চয়ের জন্য গমনাগমন করছে, সেখানে যদি নিত্যসঙ্গিনী দাসীটিও বলে যে, সে একজন ‘হোলিম্যান’, ‘সাধুতপস্বী’কে চেনে যাঁর হৃদয়ে প্রভু যিশুর সামান্যাংশ প্রবেশ করার ফলে (‘সেই শাশ্বত সত্তার একটি কণা আমাতে অবতাররূপে অবতীর্ণ হয়েছে’- রাসপুতিনের আপন ভাষায়) তিনি প্রভুরই মতো বহু দুরারোগ্য ব্যাধি, কোনও ঔষধ প্রয়োগ না করে অবলীলাক্রমে আরোগ্য করতে পারেন, তবে মহারানি যে নিমজ্জমানার ন্যায় সেই তৃণখণ্ডকেও দৃঢ়-হস্তে ধারণ করবেন সেটা তো তেমন-কিছু অসম্ভব আচরণ নয়।
অন্যপক্ষ বলেন, দাসী নয় ডিউক।
রাসপুতিন দিগ্বিজয় করতে করতে পেত্রোগ্রাদ– সম্ভব হলে রাজপ্রাসাদ– জয় করবেন বলে মনস্থির করেছেন। এদিকে সেখানকার যাজক সম্প্রদায়ের কেউ-বা তাঁর জনপ্রিয়তার সংবাদ শুনে, কেউ-বা তাঁর ধর্মের নবজাগরণ প্রচেষ্টার খ্যাতি শুনে, কেউ-বা তাঁর অলৌকিক কর্মক্ষমতার জনরবে আকৃষ্ট হয়ে সেটা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করার জন্য, এক কথায় অনেকেই। অনেক কারণে তার সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করতে উদগ্রীব। রাসপুতিন সশিষ্য-শিষ্যা পেত্রোগ্রাদে প্রবেশ করে সে প্রবেশ প্রায় খ্রিস্টের পূতপবিত্র জেরুজালেমের পুণ্যভূমিতে প্রবেশ করার সমতুল– সাড়ম্বরে প্রতিষ্ঠিত হলেন এক প্রভাবশালী শিষ্যের গৃহে। শীঘই যোগসূত্র স্থাপিত হল পেত্রোগ্রাদের সর্বোৎকৃষ্ট ধর্মশিক্ষাশালার সুপণ্ডিত অধ্যক্ষের সঙ্গে। ইনি আবার মহারানির আপন ব্যক্তিগত পুরোহিত অর্থাৎ এরই সামনে মহারানি প্রতি সপ্তাহে একবার ‘কনফেস’ করেন, ওই সপ্তাহে তিনি যেসব পাপচিন্তা করেছেন, কর্মে সত্যপথ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন, সেগুলো স্বীকার করে শাস্ত্ৰাদেশ অনুযায়ী প্রায়শ্চিত্তাদেশ গ্রহণ করেন প্রায়শ্চিত্ত সাধারণত উপবাস ও মালাজপের গণ্ডিতেই আবদ্ধ থাকে। এই কনফেশন গ্রহণ করে যে পুরোহিত প্রায়শ্চিত্তাদেশ প্রদান করেন তার পদটি স্বভাবতই সাতিশয় গাম্ভীর্য ও গুরুত্ব ধারণ করে। তিনি সম্রাজ্ঞী-হৃদয় কন্দরের অন্তরতম রহস্য জানেন বলে– এমনকি স্বীকারোক্তির সময় তিনি প্রশ্ন জিজ্ঞাসার অধিকারও ধরেন– তাকে থাকতে হয় অতি সাবধানে।
তাঁর প্রধান কৌতূহল রাসপুতিন কোন কোন কারণে কীভাবে হৃদয়ে ভগবানের প্রত্যাদেশ পেয়ে সমস্ত জীবনধারা পরিবর্তিত করে ‘নবজন্ম’ পেলেন। গ্রিক অর্থড চার্চ, ক্যাথলিক তথা অন্যান্য সম্প্রদায়ের ইতিহাসে এই নব-জীবন লাভ, গৃহী খ্রিস্টানের সন্ন্যাস-গ্রহণের জন্য এই কনভার্সনের উপ-ইতিহাস এক বিরাট অংশ গ্রহণ করে আছে। খ্রিস্ট সাধু মাত্রই এটি মনোযোগ সহকারে বারবার পাঠ করে তার থেকে প্রতিদিন নবীন উৎসাহ, তেজস্বী অনুপ্রেরণা সংগ্রহ করেন। মহারানির আপন যাজক ধর্ম-একাডেমির অধ্যক্ষরূপে এই উপ-ইতিহাসের অতিশয় অনুরক্ত ছিলেন, সেই পুস্তক তাঁরা শিষ্যমণ্ডলীর সম্মুখে সটীকা প্রতিদিন পড়িয়ে শোনাতেন এবং স্বভাবতই সেই পুস্তকের ভিন্ন ভিন্ন সাধুসন্তদের নিয়ে গভীর এবং সূক্ষ্ম আলোচনা করতেন। কিন্তু কোনও পাপাত্মা কীভাবে অকস্মাৎ দৈবাদেশ পেয়ে সর্বস্ব ত্যাগ করে ধর্মসংঘে প্রবেশ করে, কিংবা জনসেবায় আত্মনিয়োগ করে, অথবা পাণ্ডিত্য থাকলে সংঘে প্রবেশ করে নির্জনে নিভৃতে বাইবেল বা অন্য কোনও ধর্মগ্রন্থের এক নবীন টীকা নির্মাণে বাকি জীবন কাটিয়ে দেয় এ সম্বন্ধে তার কোনও ব্যক্তিগত অব্যবহিত অভিজ্ঞতা ছিল না, এবং অতি সহজেই অনুমান করা যায় যে, এরকম একটা আকস্মিক কনভার্সনের নায়ক যদি তার আপন কর্মস্থলে হঠাৎ এসে পৌঁছন তবে তিনি তৎক্ষণাৎ তার সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনা করবেন। পূর্বেই বলেছি, রাসপুতিনের ভিতর কেমন যেন একটা বৈদ্যুতিক আকর্ষণ শক্তি ছিল, তার স্বাভাবিক অবস্থায়ও তিনি সাধারণ কেন, অসাধারণ জনকেও মন্ত্রমুগ্ধবৎ মোহাচ্ছন্ন করতে পারতেন। খ্রিস্ট ধর্মশাস্ত্রে তাঁর শিক্ষাদীক্ষা জ্ঞান-প্রজ্ঞা ছিল অতিশয় সীমিত, কিন্তু প্রভু যিশুর যে কটি সরল উপদেশ তিনি বহু কষ্টে কণ্ঠস্থ করতে পেরেছিলেন সেগুলো তিনি অতিশয় দৃঢ় বিশ্বাসের বীর্যশীল সরলতায় প্রকাশ করতে পারতেন। সঙ্গে সঙ্গে এ সত্যটিও নিবেদন করা উচিত যে, রাশায়, ধর্মশিক্ষার সর্বশ্রেষ্ঠ কেন্দ্রে যে পণ্ডিতকুলমান্য সর্বোত্তম শাস্ত্রজ্ঞ অধ্যয়ন অধ্যাপনা করেন তিনি এই অশিক্ষিত হলধরসন্তানের কাছে আসবেন না শাস্ত্রের টীকাটিপ্পনী শ্রবণার্থে। তিনি আসবেন অন্য উদ্দেশ্য নিয়ে। এস্থলেও প্রভু যিশুর সঙ্গে রাসপুতিনের সাদৃশ্য আছে। ইসরায়েলের স্মার্ত পণ্ডিতরা যখন প্রভু যিশুর সঙ্গে তর্কযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত তখন তিনি যেন তাচ্ছিল্যভরে বলেছিলেন আমি শাস্ত্রকে কার্যে পরিপূর্ণভাবে দেখাব।
এসব কারণ অনুসন্ধান অপ্রয়োজনীয়। যা বাস্তবে ঘটে সেটা সর্ব তর্কের অবসান এনে দেয়। পণ্ডিতের পণ্ডিত রাসপুতিনকে দেখে, তাঁর আচার-ব্যবহার, তাঁর প্রতি শিষ্য-শিষ্যাদের সহজ ভক্তি ও সুদৃঢ় বিশ্বাস ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করে বিস্মিত হলেন, কিন্তু মুগ্ধ হলেন যখন রাসপুতিনের কাছ থেকে শুনলেন, তার আবেগভরা কণ্ঠে তিনি বলে যেতে লাগলেন, কীভাবে এক দৈবজ্যোতি তার সম্মুখে আবির্ভূত হল আর তিনি ক্ষণমাত্র চিন্তা না করে স্বর্গীয় প্রভুর পদপ্রান্তে আত্মসমর্পণ করলেন।
এ প্রকারের আকস্মিক পরিবর্তন ইতিহাস শাস্ত্রজ্ঞ অধ্যক্ষ পড়েছেন, পড়িয়েছেন প্রচুর কিন্তু এ-জাতীয় পরিবর্তনের একটি সরল সজীব দৃষ্টান্ত স্বচক্ষে দেখা, স্বকর্ণে শোনা সে যে এক সম্পূর্ণ ভিন্ন, অভিনব, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। যে কোনও অধ্যাপক, যে কোনও শিক্ষক এ প্রকারের অভিজ্ঞতাকে অসীম মূল্য দেন, কারণ পরের দিন থেকেই ছাত্রমণ্ডলীতে বেষ্টিতাবস্থায় তিনি অর্ধবিশ্বাসী তর্কবাগীশদের উদ্দেশে সবল, আত্মপ্রত্যয়জাত সুদৃঢ় কণ্ঠে বলতে পারেন, ‘পবিত্র রুশ দেশের পবিত্রতর সন্তদের যে অলৌকিক পরিবর্তনের কথা তোমরা পড়ছ, সেগুলো কাহিনী নয়, ইতিহাস, এবং শুষ্ক পত্রে লিখিত জীর্ণ ইতিহাস নয়, নিত্যদিনের বাস্তব প্রত্যক্ষ সত্য; সে জিনিস ভাগ্যবান চক্ষুম্মান দেখতে পায়!’ অস্মদেশীয় প্রচলিত নীতিবাক্য আছে :
“অদ্যাপিও সেই লীলা খেলে গোরা যায়।
মধ্যে মধ্যে ভাগ্যবানে দেখিবার পায় ॥”
এবং তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলেন, এই সাধুপুরুষকে তিনি রাজপ্রাসাদে নিয়ে গিয়ে উদভ্রান্ত সম্রাজ্ঞীর সম্মুখীন করবেন। সর্ব ধর্মের সর্ব ইতিহাস বলে, সাধুজনের পক্ষে অসম্ভব কিছু। নেই। সম্রাজ্ঞীকে এই সাধু তাঁর অলৌকিক শক্তি প্রয়োগ করে এনে দেবেন সান্ত্বনা, আত্মপ্রত্যয় এবং ধর্মবিশ্বাস স্থাপন করবেন দৃঢ়তর ভূমিতে।
অতি সহজেই তিনি রাসপুতিনের গুণমুগ্ধ রাজপরিবারের একাধিক নিকটতম আত্মীয়-আত্মীয়ার সহানুভূতি ও সহযোগ পেলেন। রাসপুতিন রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করলেন।
কেউ কেউ বলেন, সেটা ছিল আকস্মিক যোগাযোগ। অধিকতর বিশ্বাসীরা বলেন, ‘না, যুবরাজের কঠিনতম সঙ্কটময় অবস্থান, যখন রাজবৈদ্যগণ তার জীবন রক্ষা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ হতাশ্বাস, তখন রাসপুতিন তাঁকে অনুরোধ করার পূর্বেই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে শিষ্যগণকে প্রত্যয় দেন, তিনি যুবরাজকে সম্পূর্ণ নিরাময় করতে পারবেন।’
এ তো কোনও হাস্যকর আত্মপ্রত্যয় নয়। অভিজ্ঞতর প্রবীণ চিকিৎসকও বারবার মস্তকান্দোলন করে স্বীকার করেন, কত অগুণিত রোগী যমদূতের দক্ষিণহস্ত ধরে যখন পরপারে যাত্রার জন্য প্রথম পদক্ষেপ করেছে, রূঢ় সরল ভাষায় ওইসব রোগীদের সম্বন্ধে যখন বহু পূর্বেই সর্ব বিশেষজ্ঞ একই বাক্যে আপন দৃঢ় নৈরাশ্য প্রকাশ করেছেন, ঠিক সেই সময় হঠাৎ অকারণে, চিকিৎসকের কোনও প্রকারের সাহায্য না নিয়ে সেই জীবন্ত ব্যক্তি শুশান-সঙ্কট উত্তীর্ণ হয়ে ধীরে ধীরে পুনরায় লুপ্ত স্বাস্থ্য ফিরে পায়।
***
সম্রাট এবং মহিষী উভয়েই নাকি সাধুর প্রথম দর্শন লাভ করার সঙ্গে সঙ্গে মুগ্ধ হয়ে যান। বিশেষ করে রাজমহিষী।
অধ্যাপক বগদানফের মতে, অর্থাৎ তিনি যে জনরব সর্বাপেক্ষা নির্ভরশীল বলে গ্রহণ করেছিলেন সেই অনুযায়ী রাসপুতিন নাকি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে মহারানিকে আশ্বাস দেন, যুবরাজ রোগমুক্ত হবেন, এবং তিনিই তাঁকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসবেন। রাজমহিষী স্বয়ং তাঁকে নিয়ে রোগীর কক্ষের দিকে অগ্রসর হলেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ উচ্চকণ্ঠে, তারস্বরে প্রতিবাদ জানালেন। যে-ব্যক্তিকে সম্রাজ্ঞী নিয়ে যাচ্ছেন সে ব্যক্তি যে চিকিৎসাশাস্ত্রে সম্পূর্ণ অজ্ঞ এবং অনভিজ্ঞ সে কথা সে-ই একাধিকবার স্বীকার করছে, এমতাবস্থায় যখন তারা আশা করছেন যে, যে কোনও মানুষ বা ইতর প্রাণীর ন্যায় যুবরাজও প্রকৃতিদত্ত শক্তিবলে যে শক্তি সর্বজনের অলক্ষিতে জীবদেহে বেঁচে থাকার জন্য সর্বব্যাধির বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম দ্বারা আপন কর্তব্য করে যায়– হয়তো নিরাময় হয়ে যেতে পারেন; সেই সঙ্কটজনক অবস্থায় এই নবাগত হয়তো আপন অজ্ঞতাবশত সেই শক্তির প্রতিবন্ধক হয়ে তার কর্মক্ষমতা নষ্ট করে দিতে পারে।
তত্সত্ত্বেও মহারানি রাসপুতিনকে রোগীর কক্ষে নিয়ে গেলেন।
চিকিৎসকরাও সঙ্গে সঙ্গে প্রবেশ করলেন। রাসপুতিন বললেন, তিনি কোনও তৃতীয় ব্যক্তির সম্মুখে চিকিৎসা করবেন না। তৃতীয় বলতে সম্রাজ্ঞীকেও বোঝায়; তিনি নিঃশঙ্কচিত্ত দৃঢ় পদক্ষেপে দেহলিপ্রান্ত উত্তীর্ণ হলেন।
অতি অল্পক্ষণ পরেই রাসপুতিন দোর খুলে রানির দিকে সহাস্য ইঙ্গিত করলেন। রানিমা কক্ষে প্রবেশ করে স্তম্ভিত। যেন কত যুগ পরে তিনি দেখলেন রাসপুতিনের দেওয়া কী যেন একটা জিনিস হাতে নিয়ে যে কোনও সুস্থ বালকের মতো যুবরাজ খেলা করছেন।
রাসপুতিন প্রকৃতই যুবরাজকে তাঁর রক্তমোক্ষণ রোগ থেকে নিরাময় করেছিলেন কি না সে বিষয়ে মতানৈক্য আছে। তবে এটাও স্মরণে আনা কর্তব্য বিবেচনা করি যে, এই শতাব্দীর প্রথম ভাগে গবেষণা, পাণ্ডিত্য, সত্যানুসন্ধান বললেই বোঝাত। অবিশ্বাস। এই মূলমন্ত্র ওই সময়ে সুদূরপ্রসারী হয় যে, তৎকালীন লিখিত পুস্তক, এনসাইক্লোপিডিয়াতে একাধিক যশস্বী লেখক স্বয়ং বুদ্ধ, মহাবীর, এমনকি তাদের আপন খ্রিস্টের অস্তিত্ব পর্যন্ত সন্দেহাতীতরূপে সপ্রমাণ না হওয়ায় (দু হাজার, আড়াই হাজার বৎসরের পরের একতরফা বা একস্পার্টি তদন্তে!) তাঁদের জীবনী এবং বাণীকে কাল্পনিক কিংবদন্তি আখ্যা দিয়েছেন, এবং কেউ কেউ তাদের অস্তিত্ব পর্যন্ত সম্পূর্ণ অবিশ্বাস করেছেন। অতএব সে যুগের পুস্তক যে রাসপুতিনের মতো চিকিৎসানভিজ্ঞজন যুবরাজকে রোগমুক্ত করেছেন সে কথা হয় অস্বীকার করে, কিংবা নীরব থাকে। তবে এ কথা সকলেই স্বীকার করেছেন, রাসপুতিনের প্রাসাদ গমনাগমনের পর থেকেই যুবরাজের স্বাস্থ্যোন্নতি দিনে দিনে সুস্পষ্টরূপে লক্ষিত হয়।
আর সে যুগে সম্রাজ্ঞীদের ভিতর ধনে-ঐশ্বর্যে খ্যাতি-প্রতিপত্তিতে নিঃসন্দেহে সর্বাগ্রগণ্যা না হলেও যাকে ইয়োরোপের রাজন্যবর্গ রাজপরিবার সর্বাপেক্ষা সম্ভমের চক্ষে দেখতেন সেই জারিনা? তিনি তো কৃতজ্ঞতার প্রতিদানস্বরূপ রাসপুতিনের পদপ্রান্তে কী যে রাখবেন তার সন্ধানই পাচ্ছেন না, কারণ সাধারণজনের মতো ভবন-যানবাহন রজতকাঞ্চনে তার লোভ ছিল না– তাঁর আসক্তি কিসে তার পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন– ওদিকে জারিনা আবার জাতমিস্টিক, অলৌকিক ক্রিয়াকর্মে তিনি বিশ্বাস করেন এবং যাদের এসব মিরাকল দেখাবার শক্তি আছে বলে তিনি বিশ্বাস করেন তাঁদের কাছে তিনি তাঁর দেহ-মন-আত্মা সর্বস্ব নিয়ে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ করতে প্রস্তুত।
জিতেন্দ্রিয় পরোপকারী সাধুসজ্জনদেরই-না কত প্রকারে কুৎসা রটে দু হাজার বৎসর হয়ে গেল এখনও খ্রিস্টবৈরীরা বলে, তিনি নাকি অসচ্চরিত্রা যুবতীদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন ও মদ্যপানে তাঁর আসক্তি ছিল ঈষৎ মাত্রাধিক– সেস্থলে রাসপুতিন! যিনি কি না তাঁর কামানল নির্বাপিত করার চেষ্টা তো করেনই না, তদুপরি ওই বিশেষ রিপুর চরিতার্থ তাকে তুলে ধরেছেন সর্বোচ্চ ধর্মের পর্যায়ে এবং ফলে শিষ্যশিষ্যাগণসহ বহুবিধ অনাচারে লিপ্ত হন– এসব অর্জি ‘সেটারনেলিয়া’র উল্লেখ আমরা পূর্বেই করেছি– তাঁর পূর্ববর্তী মফঃস্বল জীবনের তুলনায় রাজধানীতে তার বর্তমান কেলেঙ্কারির বিবরণ তথা পল্লবিত জনরব চতুর্দিকে যে অধিকতর ছড়িয়ে পড়বে তাতে আর কী সন্দেহ! কিন্তু ক্রমে ক্রমে মোক্ষমতর মারাত্মক কলঙ্ককাহিনী রটতে আরম্ভ করল চতুর্দিকে; এসব দলবদ্ধভাবে কৃত দুষ্কর্মের ‘অর্জি’ এখন নাকি রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে এবং সেখানে তো সবকিছুই নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়– পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। সম্ৰান্ততম ডিউক ডাচেস, অর্থাৎ সম্রাটের নিকটতম আত্মীয়-আত্মীয়ারাও নাকি এইসব অনাচারে অংশ নিচ্ছেন। এবং সর্বশেষে যে কলঙ্ককাহিনী পেত্রোগ্রাদে জন্মলাভ করে সর্ব রুশের সর্ব সমাজের উচ্চতম থেকে অধস্তন। শ্রেণি পর্যন্ত প্রচারিত হয়ে আপামর জনসাধারণকে দিল রূঢ়তম পদাঘাত সেটি আর কিছু নয়, স্বয়ং জারিনা তার দেহ সমর্পণ করেছেন রাসপুতিনকে। অন্যান্য সম্ভ্রান্ত মহিলাদের তো কথাই নেই।
গ্রান্ড ডিউক ইউসুপফের দুটি মোকদ্দমাই ছিল এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে। এইসব কলঙ্ককাহিনীর সঙ্গে তাঁর স্ত্রীকে জড়িয়ে প্রথমে ফিল্ম তৈরি করা হয়েছে, পরে টেলিভিশনে দেখানো হয়েছে, অথচ তাঁর মতে, তাঁর সতী-সাধ্বী স্ত্রী পূর্বোল্লিখিত পাপানুষ্ঠানের সঙ্গে মোটেই বিজড়িত ছিলেন না। সে কথা পরে হবে।
আমি এতক্ষণ আপ্রাণ চেষ্টা দিয়ে রুশ রাজনীতি এড়িয়ে গিয়েছি কিন্তু এখন থেকে আর সেটা সম্ভবপর হবে না, কারণ এই সময়েই কুটরাজনৈতিক ব্যাপারে সম্পূর্ণ অজ্ঞ হলধর-সন্তান রাসপুতিন হিস্যে নিতে আরম্ভ করেছেন দেশবিদেশের গুরুত্বপূর্ণ কঠিন কঠিন সঙ্কটসমস্যায়। ইতোমধ্যে যেসব সরল ধর্মযাজকগণ তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন তাঁরা ধীরে ধীরে বিশ্বস্ততম সূত্রে তাঁর ‘কীর্তিকলাপে’র সম্পূর্ণ বিবরণ অবগত হয়ে তার সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলেছেন। কিন্তু স্বয়ং জারিনা এবং রাশার ‘পোপ’ হোলি সিনড যতক্ষণ তাঁর সম্মোহন-ক্ষমতায় অর্ধচেতন ততক্ষণ তাকে তো মুহূর্তের তরে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। পাঠক, স্মরণ করুন সেই সুপ্রাচীন আরবি প্রবাদ : কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করে, কিন্তু কাফেলা (ক্যারাভান) চলে এগিয়ে। রাসপুতিন এই কুকুরগুলোর ঘেউ ঘেউকে থোড়াই পরোয়া করেন।
কিন্তু রাসপুতিন কী করে এরকম নির্বিকারচিত্তে উপেক্ষা করলেন রুশ দেশের জনগণের রাজনৈতিক নবজাগরণকে! জার দ্বিতীয় নিকোলাস যত-না রক্ষণশীল সম্রাটের সার্বভৌমিকতু সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন, তার চেয়ে শতগুণ স্থবির জড়ভরত ছিলেন তাঁর আমির-ওমরাহ। ওদিকে রুশ-সিংহ যখন সদম্ভে মূষিক জাপানের সঙ্গে সংগ্রাম করতে গিয়ে তার কাছে অপ্রত্যাশিতভাবে নির্মমরূপে পরাজিত হল, তখন আর ‘হোলি’ রাশার অন্তঃসারশূন্যতা গোপন রাখা সম্ভব হল না। জনমত নির্ভয়কণ্ঠে জারের স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে স্বায়ত্তশাসন দাবি করল। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে যে বত্সর রাসপুতিন সন্ন্যাস গ্রহণ করেছেন, ঠিক সেই বৎসরেই জার প্রথম বিধানসভা (এরই নাম পূর্বোল্লিখিত ‘ডুমা’) নির্মাণের অনুমতি দিলেন। সে এক সত্যকার সার্কাস- নইলে তার কোনও সম্মানিত সদস্য সেখানে অস্ত্রোপচার দ্বারা ইহুদিকুলকে শিখণ্ডীরূপে পরিণত করার প্রস্তাব গুরুত্বপূর্ণ গাম্ভীর্যমণ্ডিত পদ্ধতিতে পেশ করতে পারেন?
কিন্তু ‘ডুমা’ প্রতিষ্ঠান বন্ধ্যা হয়ে রইল কি না রইল সে তত্ত্ব রাসপুতিন-জীবনকে স্পর্শ করতে পারেনি যতদিন-না রাজপ্রাসাদচক্রের দু-একজন ধুরন্ধর অতিশয় রক্ষণশীল রাজনৈতিক মনস্থির করলেন যে, রাসপুতিনকে দিয়ে তারা এমন সব রাজকর্মচারী নিযুক্ত করিয়ে নেবেন, যারা ডুমার প্রতি পদক্ষেপের পথে লৌহপ্রাচীরবৎ দণ্ডায়মান হয়ে থাকবে। কূটনীতিতে আনাড়ি রাসপুতিনের হাত দিয়ে তামাক খাওয়াটা কিছুমাত্র দুঃসাধ্য হল না, কিন্তু এসব অপদার্থ নিয়োগের পশ্চাতে কে, সে তথ্যটিও গোপন রইল না। বস্তুত স্বয়ং রাসপুতিন প্রত্যেক পার্টিতে জালা জালা মদ আর প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড সুমিষ্ট কেখণ্ড (তাঁর জন্য বিশেষ করে কেকে তিন ডবল চিনি দেওয়া হত– এ বাবদে হিটলারের সঙ্গে তার সম্পূর্ণ মিল) চাষাড়ে পদ্ধতিতে প্রচুর শব্দ আর বিরাট আস্যব্যাদানসহ চিবুতে চিবুতে দম্ভ করতেন, ‘এই যে দেখছ স্কার্ফখানা, এটি আপন হাতে বুনেছেন স্বয়ং জারিনা’, (কিংবা হয়তো তাঁর আদরের ডাকনাম সোহাগভরে উল্লেখ করতেন– আমার যেন মনে পড়ছে, তাই), কিংবা ‘জানো হে, ভরনাভাকে পাঠালুম তবলস্কের বিশপ করে।’ প্রভু রাসপুতিনের অন্ধভক্ত, অত্যধিক মদ্যপানবশত অর্ধমত্ত শিষ্যেরাও নাকি দ্বিতীয় সংবাদটি শুনে অচৈতন্য হবার উপক্রম! কারণ প্রভুর নিত্যসঙ্গী ওই ভরনাভা যে একেবারে আকাট নিরক্ষর! সে হবে বিশপ!
মরিয়া হয়ে অন্যতম প্রধান পাদ্রি নিযুক্ত করলেন গুপ্তঘাতক। রাসপুতিন শুধু যে অনায়াসে সঙ্কট অতিক্রম করলেন তাই নয়, এ সুবাদে রাজপ্রাসাদে তাঁর প্রভাব এমনই নিরঙ্কুশ হয়ে গেল যে, স্বয়ং জার পর্যন্ত আর এখন উচ্চবাচ্য করেন না। অবশ্য সমস্ত ইয়োরোপই বিলক্ষণ অবগত ছিল যে, জার অতিশয় দুর্বল চরিত্রের ‘যাকগে, যেতে দাও না’– ধরনের নিবীর্য ‘শাসক’। কার্যত তাঁকে শাসন করেন জারিনা। এবং তাঁর সম্মুখে রাসপুতিনের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করার মতো সাহস তখন কারও ছিল না।
রাসপুতিনকে হত্যা করার চেষ্টা নিষ্ফল হওয়ার পরই তিনি জারিনাকে সর্বজনসমক্ষে গম্ভীর প্যাকম্বরীকণ্ঠে ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেন (বা শাসান), ‘আমার মৃত্যুর এক বৎসরের মধ্যে গোষ্ঠীসুদ্ধ রমানৃষ্ণ পরিবার (অর্থাৎ সপরিবারে তখনকার জার) নিহত হবে।’ নিহত তাঁরা হয়েছিলেন, এবং অতিশয় নিষ্ঠুর পদ্ধতিতেই, কিন্তু সেটা ঠিক এক বৎসরের ভিতরই কি না বলতে পারব না, দু বৎসরও হতে পারে।
কিন্তু জারিনা? তাঁর শোচনীয় অবস্থা তখন দেখে কে? কুসংস্কারাচ্ছন্ন অতিপ্রাকৃতে অন্ধবিশ্বাসী এই মূঢ় রমণীর যত দোষই থাক, একটা কথা অতিশয় সত্য, তিনি তাঁর পুত্রকন্যাকে বুকে চেপে ধরে রেখেছিলেন পাগলিনীপারা। উদয়াস্ত তাঁর আর্ত সশঙ্ক দৃষ্টি, না জানি কোন অজানা অন্ধকার অন্তরাল থেকে কোন অজানা এক নতুন সঙ্কট অকস্মাৎ এসে উপস্থিত হবে, তাঁর কোনও একটি বসকে ছিনিয়ে নেবার জন্য!
অতএব প্রাণপণ প্রহরা দাও রাসপুতিনের চতুর্দিকে। তিনি একমাত্র মুশকিল্-আসান। এই ‘হোলিম্যান’ আততায়ীর হস্তে নিহত হলে সর্বলোকে সর্বনাশ!
কিন্তু বিশ্বসংসারের সকলেই রাসপুতিনের সাবধানবাণী বা শাসানোতে বিশ্বাস করেননি এবং ভয়ও পাননি। বিশেষ করে রাজপ্রাসাদের সর্বোচ্চস্তরের রাজরক্তধারী একাধিক ব্যক্তি। এরা ক্রমাগত জার-জারিনাকে রাসপুতিন সম্বন্ধে সাবধান হতে বলেছেন, এবং ফলে তাঁদের প্রতি বর্ষিত অপমানসূচক কটুবাক্য মাত্রায় বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিদিন। রাজপ্রাসাদে এঁরা হচ্ছেন। অপমানিত অথচ রাসপুতিনের ‘শুভাগমনে’র পূর্বে এঁরাই ছিলেন সেখানে প্রধান মন্ত্রণাদাতা। এখন তাদের এমনই অবস্থা যে, বাইরের সমাজে তাঁরা আর মুখ দেখাতে পারেন না। তাঁদের পদমর্যাদা, অভিজাত রক্ত প্রকাশ্য ব্যঙ্গপি থেকে তাঁদের বাঁচিয়ে রেখেছে সত্য, কিন্তু ভেতরে বাইরে, ফুট-অস্ফুট নিত্যদিনের এ অপমান আর কাহাতক সহ্য করা যায়! ওদিকে ‘হোলি রাশা’ যে কোন জাহান্নমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন কে জানে!
অপমানিত সর্বোচ্চ অভিজাতবংশজাত তিনজন বসলেন মন্ত্রণাসভায়।
স্থির হল, ইউসুপফই হত্যা করবেন রাসপুতিনকে। তাই আজও লোকে বলে, ‘তোমার স্ত্রীকে রাসপুতিন ধর্ষণ করেছিল বলেই তো তুমি প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলে, নইলে রাশাতে কি আর অন্য লোক ছিল না?’ ইউসুপফ এটা অস্বীকার করেন। আবার কেউ কেউ বলেন, প্রধানদের আদেশানুযায়ীই তিনি ওই কর্মে লিপ্ত হন, আবার কেউ কেউ বলেন, তিনি সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় নিজেকে ভলন্টিয়ার করেন যদিও তাঁর স্ত্রী ধর্ষিতা হননি। এ সম্বন্ধে ইউসুপফের আপন জবানি পাঠক বিশ্বাস করতে পারেন, না-ও করতে পারেন; আমি শুধু বগদানফ সাহেবের জবানিটি পেশ করছি। না হয় সেটা ভ্রান্তই হল, তাতেই-বা কী? তদুপরি আমার স্মৃতিশক্তি আমার কলম নিয়ে কী যে খেলছে, জানব কী করে?
এবং আশ্চর্য! হত্যা করবেন আপন বাড়িতেই তাঁকে সসম্মান নিমন্ত্রণ করে! পুলিশকে ভয় করতেন এঁরা থোড়াই। কিন্তু জারিনা? তিনি যে শেষ পর্যন্ত হত্যাকারী কে, সে খবরটা প্রায় নিশ্চয়ই জেনে যাবেন, এবং তার ফলাফল কী হতে পারে, না পারে, সে নিয়েও বিস্তর আলোচনা হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল এছাড়া গত্যন্তর নেই–নান্য পন্থা বিদ্যতে।
ইউসুপফ-পক্ষ যে রাসপুতিনের শত্রু, তিনি এটা জেনেশুনেও ইউসুপফের বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে এলেন কেন? কেউ বলে, ইউসুপফের সুন্দরী স্ত্রী ইরেনে তাকে ‘বিশেষ’ প্রলোভন দেখিয়ে ফাঁদে ফেলেন, কেউ বলে, রাসপুতিন সত্যই আশা করেছিলেন, মুখোমুখি আলাপ আলোচনার ফলে হয়তো প্রাসাদের এই শত্রুপক্ষের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপিত হতে পারে, কেউ বলে রাসপুতিন প্রাসাদ জয় করেছিলেন বটে কিন্তু ইউসুপফের মতো অভিজাতবংশের কেউ কখনও তাকে নিমন্ত্রণ করা দূরে থাক, বাড়িতে পর্যন্ত ঢুকতে দিতেন না। ইউসুপফ-জয় অর্থই প্ৰেত্রোগ্রাদ-অভিজাতকুল জয়। তার অর্থ, নতুন শিষ্য, নতুন… একটা সম্পূর্ণ নতুন ভাণ্ডার।
প্রায় সবাই বলেছেন, মদে দেওয়া হয়েছিল প্রচুর পটাসিয়াম সায়েনাইড, কিন্তু অধ্যাপক বলেছিলেন, মধুভরা বিরাট কেকের সঙ্গে মিশিয়ে। আমার মনে হয় দ্বিতীয় পন্থাতেই আততায়ীর ধরা পড়ার সম্ভাবনা কম। মহামান্য অতিথি রাসপুতিনকে অবশ্যই দিতে হত বংশানুক্রমে সযত্নে রক্ষিত অত্যুকৃষ্ট খানদানি মদ্য; এবং ভদ্রতা রক্ষার জন্য অতিথি সেবককেও নিতে হত সেই বোতল থেকেই। এইটেই সাধারণ রীতি। পার্টিতে সবাই তো আর কে কিন্তু খায় না– তা-ও আবার তিন-ডবল মধুভর্তি স্পেশাল রাসপুতিন কে’ তদুপরি বিরাট কেকের দু আধা দুই পদ্ধতিতে নির্মাণ করে জোড়া দেওয়া অতি সহজ।
তা সে কেকই হোক আর খানদানি মদই হোক– রাসপুতিন তার বীভৎস অভ্যাসমতো সে-বস্তু খেয়ে গেলেন প্রচুরতম পরিমাণে, এবং তাজ্জব কী বাৎ! তার কিছুই হল না। চোখের পাতাটি পর্যন্ত নড়ল না। আমার সুস্পষ্ট মনে আছে এস্থলে অধ্যাপকও আপন বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘মাই বয়! দেয়ার উয়োজ ইনাফ পয়জন টু নক অফ সিকস্ বুলজ’। অর্থাৎ ওই বিষে ছ’টা আস্ত বলদ ঘায়েল হয়! কিন্তু রাসপুতিন নির্বিকার! ইউসুপফরা জানতেন না, রাসপুতিনকে ইতোপূর্বে একাধিকবার বিষপ্রয়োগে হত্যা করার চেষ্টা নিষ্ফল হয়। ম্যাজিশিয়ানরা যে রকম ব্লেড খায়, রাসপুতিন ঠিক সেইরকম হরেক জাতের বিষ খেতে তো পারতেনই, হজমও করতেন অক্লেশে।
ষড়যন্ত্রকারীরা পড়লেন মহা ধন্দে। তাঁদের সব প্ল্যান ভণ্ডুল।
তখন ইউসুপফ অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারীদের ফিসফিস করে বললেন, ‘এ রকম সুযোগ আর পাওয়া যাবে না। আমি ওকে গুলি করে মারব’।
পিছন থেকে ঠিক ঘাড়ের উপর, অর্থাৎ সবচেয়ে মারাত্মক জায়গায়, এক্কেবারে কাছে এসে ইউসুপ গুলি ছুড়লেন। রাসপুতিন রক্তাক্ত দেহে অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন।
সে তো হল। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা এখন সম্মুখীন হলেন এক সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত নতুন সমস্যার। জখমহীন মৃতদেহ যত সহজে হস্তান্তর করা যায়, রক্তাক্ত দেহ নিয়ে কর্মটা তো অত সহজ নয়। এখন কী করা কর্তব্য সেটা স্থির করার জন্য দলের আর যারা সন্দেহ না জাগাবার জন্য পার্টিতে যোগ না দিয়ে উপরের তলায় অপেক্ষা করছিলেন তাঁদের সঙ্গে ইউসুপফাদি যোগ দিলেন। তার পূর্বে তিনি লাশটা টেনে টেনে সেলারে (মাটির নিচে কয়লা এবং আর পাঁচটা বাজে জিনিস রাখার গুদোম) রেখে এলেন। পাছে হঠাৎ কেউ ডাইনিংরুমে ঢুকে লাশটা আবিষ্কার করে ফেলে।
স্থির হল, রাসপুতিনের লাশ ইউসুপফের বাড়ির কাছে নেভা নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হবে। সেটা ডিসেম্বর মাস।(৫) নেভার উপরকার জল জমে বরফ হয়ে গিয়েছে। সেইটে ভেঙে লাশ ভেতরে ঢুকিয়ে গায়েব করে দেওয়া কঠিন কর্ম নয়।
এইবার সবাই হলেন যাকে বলে বজ্রাহত! এবং ভুলবেন না, এদের অধিকাংশই ফৌজের আপিসার।(৬) এঁদের কাউকে হকচকাতে হলে রীতিমতো কস্ত করতে হয়, আর মৃত্যুভয়? ছোঃ!
তা নয়! সবাই সেলারে ঢুকে দেখেন, রাসপুতিনের লাশ উধাও! ঘাড়ের সবচেয়ে মারাত্মক জায়গায় গুলি খেয়ে যে-লোকটা পড়ে গিয়ে মরল, সে যে শুধু আবার বেঁচে উঠল তাই নয়, আপন পায়ে হেঁটে বাড়ি ছেড়ে উধাও হয়ে গেল!
অবশ্য এ-কথা ঠিক, ইউসুপ সেলারের দরজা বাইরের থেকে তালাবদ্ধ করেননি, এবং খামোকা বেশি লোক যাতে না জানতে পারে তাই সে রাত্রে অধিকাংশ চাকর-বাকরকে ছুটি দিয়ে রেখেছিলেন।
রাসপুতিন যদি এখন কোনও গতিকে জারিনার কাছে পৌঁছে সব বর্ণনা দেন এবং নিশ্চয়ই তিনি করবেন বলে ইউসুপফের অবস্থাটা কী?
কিন্তু তিনি অতশত ভাবেননি– অন্যদের জবানি তাই। তাঁরা বলেন, তিনি পাগলের মতো পিস্তল হাতে নির্জন রাস্তায় ছুটতে ছুটতে হঠাৎ দেখেন, চতুর্দিকের সেই শুভ্র শুভ্রতাময় বরফের ভিতর দিয়ে টলতে টলতে রাসপুতিন এগিয়ে যাচ্ছেন। রক্তক্ষরণও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এবার ইউসুপ আর কোনও চান নিলেন না। পিস্তলে যে কটা গুলি ছিল সবকটা ছুড়লেন তার ঘাড়ের উপর। তার পর সবাই মিলে তাঁকে টেনে নিয়ে নেভা নদীর উপরকার জমে যাওয়া বরফ ভেঙে লাশটা ঢুকিয়ে ঠেলে দিলেন ভাটির দিকে।
কিন্তু জারিনা সে দেহ উদ্ধার করতে সমর্থ হয়েছিলেন। চার্চেরই মতো একটি বিশেষ উপাসনাগারসহ নির্মিত চেপলে তার দেহ সযত্নে গোর দেওয়া হল একটি রমণীয় পার্কের ভিতর। মহারানি প্রতি রাতে যেতেন সেই গোরের পাশে, নীরবে অঝোরে অশ্রুবর্ষণ করার জন্য, রাসপুতিনের আত্মার সদগতি কামনা করে।
২২।১।৬৬
———-
১. এ’র উল্লেখ শ্রীযুক্ত প্রভাত মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘রবীন্দ্র জীবনী’তে করেছেন; আমিও ‘দেশে-বিদেশে’ বইয়ে অল্পবিস্তর আলোচনা করেছি।
২. স্বয়ং স্বামীজী নাকি বলেছেন, “যে ভগবান আমাকে এ দুনিয়ায় একমুঠো ভাত দেয় না, সে নাকি মৃত্যুর পর আমাকে স্বর্গরাজ্য দেবে—Why, even an imbecile would not believe it; much less I!” তবে এটা প্রক্ষিপ্তও হতে পারে। তবু এ কথা অতিশয় সত্য, তিনি এই পৃথিবীতেই স্বর্গরাজ্য স্থাপনা করতে চেয়েছিলেন। বঙ্কিম নাকি বলতেন, মানুষকে ভগবান হতে হবে, আর তিনি নাকি বলতেন, মানুষকে মানুষ হতে হবে।
৩. সে অত্যাচার-সংবাদে কাতর হয়ে তলস্তয় ‘রেসারেকশন’ বই লিখে, টাকা তুলে এদের অনেককে কানাডা পাঠিয়ে দেন।
৪. এই কনফেশন বা পদস্খলন স্বীকারোক্তি একাধিক ধর্মে প্রচলিত আছে। এদেশে জৈনদের ভিতর সেটি নিষ্ঠা সহকারে মানা হয়, এবং এরই নাম পর্যষণ। তবে আমাদের যতদূর জানা, পর্যষণ বৎসরে মাত্র একবার হয় এবং সম্প্রদায়ের সকলেই সেটা একই সময়ে করেন বলে বর্ষার শেষে সেটা পৰ্বদিবস রূপে সাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হয়। বৌদ্ধ শ্রমণরাও বর্ষাকালে পর্যটন নিষিদ্ধ বলে কোনো সংঘে আশ্রয় নিয়ে বর্ষাযাপন-শেষে পাপ স্বীকারোক্তি করে পুনরায় পর্যটনে নেমে পড়েন। মুসলমানরা হজের সময় করে থাকেন, এবং মৃত্যু আসন্ন হলে তওবা করেন। তওবা’ শব্দার্থে ‘প্রত্যাবর্তন’। অর্থাৎ তওবাকারী আপন পাপ সম্বন্ধে অনুশোচনা করে ধর্মমার্গে প্রত্যাবর্তন করল।
৫. রাসপুতিনের মৃত্যুদিবস ১৫।১৬ ডিসেম্বর ১৯১৬ বলা হয়, আবার ৩০ ডিসেম্বরও বলা হয়। তার কারণ অর্থডক্স রুশ ক্যালেন্ডার ও কন্টিনেন্টের প্রাচীন ক্যালেন্ডারে ১৩১৪ দিনের পার্থক্য।
৬. অধ্যাপক আমাকে গল্পচ্ছলে একদা বলেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে রাশান অফিসারদের সবচেয়ে প্রিয় খেলা (প্যাস্টাইম) ছিল প্রচুর মদ্যপানের পর লটারিযোগে দু জন অফিসারের নাম স্থির করা। তারপর একজন একটা ঘরে ঢুকে সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থান বেছে নিয়ে ঘরের সব আলো নিভিয়ে দেবে। সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকবে অন্য অফিসার, হাতে সবচেয়ে ছোট সাইজের পিস্তল নিয়ে। প্রথম অফিসার আশ্রয়স্থল থেকে কোকিলের মতো ডাক ছাড়বে, “ক”; অন্যজন সঙ্গে সঙ্গে সেই অন্ধকারে সুদ্ধমাত্র ধ্বনির ওপর নির্ভর করে পিস্তল মারবে। তখন সেই অন্ধকারে ‘শিকার জায়গা বদলাবে, কিন্তু “কু” ডাক না ছাড়া পর্যন্ত পিস্তল মারা বারণ। কতক্ষণ পরে দু জনের পার্ট বদলায়, আমার মনে নেই।
সাবিত্রী
দক্ষিণ ভারতের একটি সানাটরিয়ামে আমার এক বন্ধুকে নিয়ে যেতে হয়েছিল। ব্যামো গোড়াতেই ধরা পড়েছিল বলে কে খারাপ হতে পায়নি। আমাকেও তাই কোনও প্রকারের সেবা-শুশ্রূষা করতে হত না। হাতে মেলা সময়। তাই কটেজে কটেজে– এসব কটেজে থাকে অপেক্ষাকৃত বিত্তশালীরা, আর বিরাট বিরাট লাটের একাধিক জেনারেল ওয়ার্ড তো আছেই– ডাক্তাররা সকালবেলাকার রোগী-পরীক্ষার রোদ সেরে বেরিয়ে যাবার পরই আমি বেরুতাম আমার রোদে। বেচারাদের অধিকাংশকেই দিনের পর দিন একা একা শুয়ে শুয়ে কাটাতে হয় বলে কেউ তাদের দেখতে এলে সঙ্গে সঙ্গে তাদের মুখ যে কীরকম খুশিতে উজ্জ্বল এবং যে-ক’টি ফোঁটা রক্ত গায়ে আছে, সব কটি মুখে এসে যেত বলে রাঙা হয়ে যেত, সেটা সত্যই অবর্ণনীয়।
করে করে প্রায় সব্বাইকেই আমি চিনে গিয়েছিলুম— তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীই বেশি।
একটি কটেজে আমি কখখনো যাইনি, ডাক্তার ভিন্ন আর কাউকে কখনও যেতেও দেখিনি। রোগীর পাশে সর্বক্ষণ দেখা যেত একটি যুবতী– বরঞ্চ তরুণী-ঘেঁষা যুবতী বললেই ঠিক হয় মোড়ার উপর বসে উলের কাজ করে যাচ্ছেন; তাই বোধ হয় কেউ তাঁদের বিরক্ত করতে চাইত না।
একদা রোঁদ শেষে, পথিমধ্যে হঠাৎ আচমকা বৃষ্টি। উঠলুম সেই কটেজটাতেই।
যুবতীটি ধীরে ধীরে মোড়া ছেড়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে অতি ক্ষীণ ম্লান হাসি হেসে বললেন, ‘আসুন, বসুন। কী ভাগ্য বৃষ্টিটা নেমেছিল। নইলে আপনি হয়তো কোনওদিনই এ-কটেজে পায়ের ধূলি দিতেন না।’
কী মিষ্টি গলা! আর সৌন্দর্যে ইনি রাজরানি হওয়ার উপযুক্ত। কিন্তু সে কী শান্ত সৌন্দর্য। গভীর রাত্রে, ক্ষীণ চন্দ্রালোকে, আমি নিস্তব্ধ, নিস্তরঙ্গ সমুদ্রে দেখেছি এই শান্ত ভাব– দিক্-দিগন্ত জুড়ে। আমরা প্রাচীন যুগের বাঙালি। চট করে অপরিচিতার মুখের দিকে তাকাতে বাধোবাধো ঠেকে। এঁর দিকে তাকানো যায় অসঙ্কোচে।
রোগীও সুপুরুষ, এবং এই পরিবেশে খাটে শুয়ে না থাকলে বলতুম, রীতিমতো স্বাস্থ্যবান। শুধু মুখটি অস্বাভাবিক লালচে যেন গোরা অফিসারের মুখের লাল।
স্ত্রীর কথায় সায় দিয়ে হেসে বললেন– গলাটা কিন্তু রোগীর– ‘রোজ চারবেলা দেখি আপনাকে এ-পথ দিয়ে আসতে-যেতে। পাশের কটেজে শুনি আপনার উচ্চহাস্য। শুধু আমরাই ছিলুম অস্পৃশ্য! অথচ দেখুন, আমি মুখুজ্যে বামুন–’
আমি গল্প জমাবার জন্য বললুম, ‘কোন মেল? আমার হাতে বাঁড়ুজ্যে ফুলের মেল একটি মেয়ে আছে।’
এবারে দু জনার আনন্দ অবিমিশ্র। এ লোকটা তা হলে পরকে ‘আপনাতে’ জানে! তিমুহূর্তে জমে গেল।
খানিকক্ষণ পরে আমি বললুম, ‘আপনারা দু জনাই বড় খাঁটি বাংলা বলেন, কিন্তু একটু যেন পুরনো পুরনো।’
মুখুজ্যে বললেন, ‘আমি ডাক্তার অবশ্য এখন অবস্থা “কবরাজ! ঠেকাও আপন যমরাজ।” তা সে যাকগে! আসলে কি জানেন, আমরা দুজনাই প্রবাসী বাঙালি। তিনপুরুষ ধরে লক্ষ্ণৌয়ে। আমার মা কাশীর, ঠাকুরমা ভট্টপল্লীর। সেই ঠাকুরমার কাছে শিখেছি বাংলা– শাস্ত্রীঘরের সংস্কৃতঘেঁষা বাংলা। সেইটে বুনিয়াদ। সবিতা আমাদের প্রতিবেশী। আমার ঠাকুরমার ছাত্রী। আমরা দু জনা হুবহু একই বাংলা পড়েছি, শিখেছি, বলেছি। তবে ম্যাট্রিক পর্যন্ত উর্দু শিখেছি বলে মাঝে মাঝে দু-একটি উর্দু শব্দ এসে যায় আমার ভাষাতে, সবিতার না। আপনার খারাপ লাগে?’
আমি প্রতিবাদ করে বললুম, ‘তওবা, তওবা! আমি বাঙালি মুসলমান; আমরা ইঁওহী দু-চারটে ফালতো আরবি-ফার্সি শব্দ ব্যবহার করি।’
পাশ ফিরে, আপন দুই বাহু আমার দিকে প্রসারিত করে দিলেন। আমি আমার হাত দিলুম। দু হাত চেপে ধরে, চোখ বন্ধ করে, গভীর আত্মপ্রসাদের দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘বাঁচালেন। আপনি মুসলমান?’
আমি একটু দিশেহারা হয়ে চুপ করে রইলুম।
জিগ্যেস করলেন, ‘আপনি যত্রতত্র খান এখানে? ডাক্তার হিসেবে বলছি, সেটা কিন্তু উচিত নয়।’
আমি বললুম, ‘আমি যত্রতত্র যা-তা খাই, এবং ভবিষ্যতেও খাব। অপরাধ নেবেন না।’
‘বাঁচালেন!’ এবারে আমি আরও দিশেহারা। আমি তার পরামর্শ অমান্য করছি দেখে তিনি খুশি!
‘বাঁচালেন! জানেন, প্রথম দিনই আপনার চেহারা দেখে, অদ্ভুত সাদৃশ্য লক্ষ করলুম আমার এক মুসলমান বন্ধুর সঙ্গে।’
স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমায় বলিনি, সবিতা?’
সবিতা এতক্ষণ ধরে শুধু উল বুনে যাচ্ছিলেন। মাথা তুলে সম্মতি জানিয়ে বললেন, ‘এমনকি, চলার ধরনটি, গলার সুরও!’
মুখুজ্যে বললেন, ‘সেই বন্ধুটি যদি আজ এ-লোকে থাকত, তবে আজ আমার এ-দুর্দশা হত না! সে কথা থাক। মূল বক্তব্য এই : ঠাকুরমা প্লাস তামাম পরিবার, প্লাস সেই সখার পরিবার সবাইকে লুকিয়ে, বিস্তর ছলনা-জাল বিস্তার করে আমি ছেলেবেলা থেকে খেয়েছি ওর মায়ের তৈরি মুরগি-মটন। সে খেত আমাদের বাড়িতে নিশ্চিন্ত মনে। আপনি বোধ হয় জানেন না’।
‘বিলক্ষণ জানি, স্বর্গত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী– আপনার ঠাকুরমার পাড়ার লোক বাড়িতে দিশি-বিদেশি সবাইকে খাওয়াতেন। তার ছেলে, স্বর্গত বিনয়তোষ তিনিও নিষ্ঠাচারী ছিলেন। ঝাড়া আটটি বছর প্রতি রোববার, তাঁর সামনে বসে, তাঁর সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজন করেছি আমি, মুসলমান।’
ডাক্তার বললেন, ‘তার পর ঠাকুরমা মা আর সবাই গত হলেন। রইল ওই দোস্ত-ইয়ার-সখা বেদার-বখশ। একই বছরে দু জনায় ডাক্তারি পাস করলুম। ইতোমধ্যে আমার বিয়ে হয়েছে। সবিতা রাধে ভালো, কিন্তু তার মা তাকে বলে দিয়েছিলেন, অন্তত রান্নার ব্যাপারে বাপের বাড়ির ঐতিহ্য ভুলে গিয়ে, স্বামী যেভাবে খেতে চায় ঠিক সেইভাবে খাওয়াবি।’ তাই সবিতা বেদারের মায়ের কাছ থেকে শিখল বিরিয়ানি থেকে ফালুদা, বুরহানি থেকে আওয়ান রুটি। অতএব স্যার, কাল দ্বিপ্রহরে এখানে একটু হবিষ্যান্ন করবেন–’ হেসে বললেন, ‘অবশ্যই, মোগলাই! আসলে কি জানেন, এই যে চোখের সামনে সবিতা উদয়াস্ত উল বোনে, এটা, It gets on my nerves! আর সবিতা একটি পারফেকট আর্টিস্ট। রন্ধনে। তার অনুশীলন নেই, রেওয়াজ নেই। আপনার শোক হয় না? আমার তো ওসব খাওয়া বারণ। নিজের জন্য–’
আমি সবিতার দিকে তাকিয়ে আমার মাকে দেখতে পেলুম; বাড়িতে কেউ না থাকলে মা হাঁড়ি পর্যন্ত চড়াত না। তেল-মুড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ত। আর এই সবিতা নাকি বিস্বাদ বিবর্ণ মাছসে, কপিসে, পাতলাসে পাতলা যেন কড়াই-ধোয়া-জল সুপ নামে পরিচিত গব্বযন্ত্রণা স্বামীকে খেতে দিয়ে নিজে গণ্ডার-গ্রাসে খাবে বিরিয়ানি, বুরহানি কাবাব-মুসল্লম!
আমি বললুম, ‘ফিনসে তওবা! তা-ও কখনও হয়! কিন্তু আমি একা-একা খাব? –কেমন যেন?’
আর্তনাদ করে বললেন, ‘আপনি বিশ্বাস করতে পারেন না, রান্নাঘর থেকে সবিতার রেওয়াজের গন্ধ আমার নাকে আসবে– আচ্ছা, আপনি না-হয় আড়ালেই খাবেন, শুধু আমি পদগুলো কম্পোজ করে দেব। আপনাকে এ-নিমন্ত্রণ সাহস করে জানালুম, আপনি যত্রতত্র খান শুনে। নইলে–’
আমি বললুম, ‘ডাক্তার, আমি জানি আপনাদের অনেকক্ষণ ধরে কথা বলা বারণ। কাল সকালের রোদ সেরেই আসব। দুপুরে খাব।’
সবিতা রাস্তা অবধি নেমে এসে বললেন–মাথা নিচু করে, প্রায় হাতজোড় করে, ‘এই দু বছর ধরে আমরা এখানে আছি। এই প্রথমবার তিনি পুরো আধঘণ্টা ধরে খুশিতে আনন্দে সময় কাটালেন। আপনি দয়া করে আসতে ভুলবেন না। বড় ডাক্তার বলেছে, উনি ফুর্তিতে থাকলে তাড়াতাড়ি সেরে উঠবেন। আমি ওঁকে বাঁচাতে চাই। আপনি আমার প্রতি দয়া করুন–’
হঠাৎ ধপ করে রাস্তার পাশে হাঁটু গেড়ে আমার পায়ের উপর তার মাথা ঠুকে দিল। এত দুঃখের ভিতরও আমি দেখলুম, বন্যার জলের মতো একমাথা গোছা গোছা গাদা গাদা কালো চুল ঘোমটার বাঁধ সরিয়ে আমার দুই গোড়ালির হাড় পেরিয়ে, মাঝ-হাঁটু অবধি ছাপিয়ে দিল। এ-চুল আমি দেখেছি, অতিশয় শৈশবে, আজ মনে হয়, যেন আধাস্বপ্নে, যেন কুয়াশার ভিতর দিয়ে, আমার মায়ের মাথায়।
সতীসাধ্বী যুবতীকে স্পর্শ করা গুনাহ্। জাহান্নামে যাক গুনাহ্!
দু-হাত দিয়ে তাকে তুলে ধরলুম। বললুম, ‘মা! ঈশ্বরে বিশ্বাস রেখো।’
সীমন্তিনী বললে, ‘আমি আল্লাকে ইয়াদ করি’।
১৩/১১/৬৫
হিডজিভাই পি মরিস
একদা ‘স্ট্র্যানড’ পত্রিকা একটি নতুন ধরনের অনুসন্ধানের সূত্রপাত করে সাহিত্যের মহা মহা মহারথীদের শুধোয়, তাঁরা সর্বজন-সম্মানিত, সর্বশিক্ষিতজনের অবশ্যপাঠ্য কোন কোন পুস্তক যে কোনও কারণেই হোক, পড়ে উঠতে পারেননি। উত্তরে এমন সব তথ্য আবিষ্কৃত হল যাকে ‘মোহনে’র ভাষায় লোমহর্ষক বলা যেতে পারে; যেমন, কথার কথা কইছি– বার্নার্ড শ পড়েননি অলিভার টুইস্ট, কিংবা মনে করুন–রবীন্দ্রনাথ পড়েননি ‘একেই কি বলে সভ্যতা’?
কাজেই বিখ্যাত সাহিত্যিকদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যে এই অখ্যাত সাহিত্যসেবক তাঁরা যেন তড়িঘড়ি শ্রীযুক্ত বিশী মহাশয়ের শান্তিনিকেতন সম্বন্ধে বইখানা পড়ে নেন।
এই পুস্তকে ‘কাব্যের উপেক্ষিত’ জাতীয় দু-চারটি চরিত্রের উল্লেখ করে বিশী মহাশয় বহু প্রাক্তন শান্তিনিকেতনবাসীদের সাধুবাদ পেয়েছেন। তাঁদেরই একজন হিডজিভাই মরিস্।
তাঁর পুরো নাম হিডজিভাই পেস্তনজি মরিসওয়ালা। গুজরাতিদের প্রায় সকলেরই পারিবারিক নাম থাকে; যেমন গাঁধী, জিন্না (আসলে ঝিঁড়া ভাই), হটিসিং ইত্যাদি। পার্সিদের অনেকেরই ছিল না বলে কেউ কেউ তাঁদের ব্যবসার নাম পারিবারিক নামরূপে গ্রহণ করতেন। যেমন ইঞ্জিনিয়ার, কন্ট্রাক্টর ইত্যাদি। এই নিয়ে পার্সিরা ঠাট্টা করে একটি চরম দৃষ্টান্ত দেন– সোডা-ওয়াটারবটলওপনারয়ালা!
বোম্বাইয়ের পতিত পরিবার বিখ্যাত। এঁরা ফরাসি ‘পতি’ (Petit) ফার্মে কাজ করতেন বলে প্রথমে পতিতওয়ালা ও পরে পতিত্ নামে পরিচিত হন। ঠিক সেইরকম মরিস কোম্পানিতে কাজ করে আমাদের অধ্যাপক মরিসওয়ালা পরে শুধু মরিস নামে বোম্বাই অঞ্চলে নাম করেন।
অত্যুত্তম ফরাসি ও লাতিন শেখার পর না জানি কোন যোগাযোগে তিনি শান্তিনিকেতন পৌঁছে সেখানে অধ্যাপনা আরম্ভ করেন।
দুটো বিষয়ে তিনি ছিলেন খাঁটি বাঙালি– সেন্টিমেন্টাল এবং আদর্শবাদী। আমার আশ্চর্য লাগত, কারণ অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে যেসব গুজরাতি ছেলেরা এবং পাঠিকারা অপরাধ নেবেন না, মেয়েরাও শান্তিনিকেতন আসে, তারা পর্যন্ত টাকা আনা পাই হিসাব করত; শুনেছি, ছাত্রেরা আকছারই আদর্শবাদী হয়। (নইলে অত নিঃস্বার্থ ট্রাম-বাস পোড়ানোর সকর্মটা করে কে? কিন্তু এ সম্বন্ধে আর কথা নয়। হক কথা কইলে পুলিশ ধরবে।) তাই গুজরাতি মরিস সাহেবের আদর্শবাদ আমাকে বিস্মিত করেছিল।
সামান্য বাংলা শেখার পরই মরিস সাহেবের প্রেম উপচে পড়ল রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি এবং তিনি সম্মোহিত হলেন,
“তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার
নামাতে পারি যদি মনোভার” শুনে।
অন্যত্র আলোচনা করেছি, ভারতের বাইরে কোনও ভাষাই ‘ত’ এবং ‘ট’-র উচ্চারণে পার্থক্য করে না; এমনকি ভারতীয়দের ভিতর যাদের গায়ে প্রচুর বিদেশি রক্ত তাঁরাও এ দুটোতে গুবলেট করেন। উদাহরণস্থলে, গুজরাতের বোরা সম্প্রদায় এখানকার রাধাবাজারে এদের ব্যবসা আছে–ব্রহ্ম উপত্যকার আসামবাসী ও পার্সি সম্প্রদায়।
তাই মরিস সাহেবের উচ্চারণে ছত্র দুটি বেরুতো;
“টাহাটে এ জগটে ক্ষটি কার
নামাটে পারি যডি মনোভার।”
আমরা আর কী করে ওঁকে বোঝাই যে ‘ত’ ‘দ’-এর অনুপ্রাস ছাড়াও গুরুদেবের গান আছে।
মরিস সাহেব নতুন বাংলা শেখার সময় যে না বুঝে বিশীদাকে ‘বেটা ভূত’ বলেছিলেন, তার চেয়েও আরও মারাত্মকতম উদাহরণ আমি শুনেছি। তিনি আমাদের ফরাসি শেখাতেন এবং শ্রদ্ধেয় বিধুশেখর, ক্ষিতিমোহন এবং আরও কিছু অধ্যাপকও তাঁর ক্লাসে যেতেন। আমার হাসি পেত তখন গুরু মরিস ছাত্র বিধুশেখরকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতেন ও ছাত্র বিধুশেখর তাঁকে ‘তুমি’ বলে। একদিন হয়েছে, ফরাসি ব্যাকরণের কী একটা কঠিন প্রশ্নের উত্তর দিয়ে ফেলেছেন অধ্যক্ষ বিধুশেখর। মরিস সাহেব বললেন, ‘চমৎকার! শাস্ট্রী মশায়, সট্যি, আপনি একটি আস্টো ঘুঘু।’
শাস্ত্রী মশাইয়ের তো চক্ষুস্থির! একটু চুপ করে থাকার পর গুরু, গুরু– যদ্যপি ছাত্র, তথাপি গুরু-কণ্ঠে শুধালেন, ‘মরিস, এটা তোমাকে শেখালে কে?’
নিরীহ মরিস বোধ হয় কণ্ঠনিনাদ থেকে বিষয়টার গুরুত্ব খানিকটে আমেজ করতে পেরে বললেন, ‘ডিনডা (দিনদা, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর)। উনি বলেছেন ওটার অর্ট “অসাডারণ বুডডিমান।” টবে কি ওটা ভুল?’
শাস্ত্রী মশাই শুধু ঈষৎ কঠিন কণ্ঠে বললেন, ‘আচ্ছা, আমি দিনেন্দ্রনাথকে বোঝাব।’
দিনুবাবু নাকি বিদেশিকে ভাষা শেখাবার সময় কর্তব্যবোধহীন চপলতার জন্য বেশ কিছুটা ভালোমন্দ শুনেছিলেন শাস্ত্রী মশাইয়ের কাছ থেকে।
ওই সময় প্যারিস থেকে অধ্যাপক সিলভাঁ লেভি সস্ত্রীক শান্তিনিকেতনে আসেন। উভয়েই একাধিকবার বলেন, মরিস সাহেব উল্লেখ না করা পর্যন্ত তারা কখনও বিশ্বাস করতে পারেননি, ফ্রান্স না গিয়ে মানুষ কী করে এরকম বিশুদ্ধ ফরাসি শিখতে পারে। আমি ব্যক্তিগতভাবে তার কাছে বড়ই কৃতজ্ঞ যে তিনি আমাকে রলাঁর ‘যিশুজীবনী’ পড়ান।
এ বই আমার মহদুপকার করেছে এবং করছে।
বলা বাহুল্য এই সরল সজ্জন যুবা পণ্ডিতটি সকলেরই হৃদয়ে স্থান পেয়েছিলেন। গুরুদেবের তো কথাই নেই, মরিস সাহেব ঋষিতুল্য দ্বিজেন্দ্রনাথেরও অশেষ স্নেহ পেয়েছিলেন। বড়বাবু বিদেশি পণ্ডিতদের সঙ্গে বাক্যালাপ কালক্ষয় বলে মনে করতেন; বলতেন, ‘এরা সব তো জানে কোন শতাব্দীতে প্রজ্ঞাপারমিতা কিংবা একাক্ষরপারমিতা প্রথম লেখা হয়, প্রথম ছাপা হয়। ওসব জেনে আমার কী হবে? তার চেয়ে নিয়ে আস না ওদের। কোনও একজন, যে কান্টের দর্শন সমর্থন করতে পারে, আর আমি নেব বিরুদ্ধ মতবাদ, কিংবা সে নেবে বিরুদ্ধ মতবাদ, আমি নেব কান্টপক্ষ–তার যেটা খুশি’; মরিস সাহেব তাঁকে তখন অনুনয়-বিনয় করে সম্মত করাতেন বিদেশি পণ্ডিতকে দর্শন দিতে। অবশ্য দু-মিনিট যেতে না যেতেই বড়বাবু সব ভুলে গিয়ে কোনও কিছু অন্য তত্ত্ব নিয়ে আলোচনায় তন্ময় হয়ে যেতেন। আমাদের মতন ছেলে-ছোকরাদের কিন্তু তাঁর কাছে ছিল অবাধ গমন। আমার মনে পড়ত খ্রিস্টের কথা; তিনি যেহোভার মন্দির থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন বিস্তর তথাকথিত কুলাঙ্গার ভিআইপি-কে, এবং আদেশ দিতেন ‘লেট দি চিলড্রেন কাম্ আনটু মি’!
বস সাহেব প্রথমটায় সম্মত ছিলেন না; আর সকলের চাপাচাপিতে তিনি প্যারিসের সরবনে গিয়ে ডক্টরেটের জন্য প্রস্তুত হতে রাজি হলেন।
প্যারিসের ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে তার সঙ্গে আমার অপ্রত্যাশিতভাবে দেখা। আমাকে আপনি বলে সম্বোধন করাতে আমি দুঃখ প্রকাশ করলুম। তিনি বললেন, ‘তুমি এখন বড় হয়েছ; জর্মনিতে ডক্টরেট করবে। আমিও এখানে তাই করছি। আমরা এখন এক-বয়েসি।’ আমার বয়েস তখন চব্বিশ, তাঁর বত্রিশ। তার পর আমাকে রেস্তোরাঁয় উত্তমরূপে খানদানি ডিনার খাওয়ালেন। বিনয় এবং সঙ্কোচের সঙ্গে পরের দিন বললেন, ‘তোমাকে ভালো করে এন্টারটেন করতে পারলুম না। তোমাকে বলতে লজ্জা নেই, আমার এ মাসের টাকাটা এখনও দেশ থেকে আসেনি।’ আমি তারস্বরে প্রতিবাদ জানালুম। বহু বৎসর পরে ওই সময়কার এক প্যারিসবাসী ভারতীয়ের কাছে শুনতে পাই মরিস সাহেব অন্যান্য দুস্থ ভারতীয় ছাত্রদের টাকা ‘ধার’ দিয়ে মাসের বেশিরভাগ দেউলে হওয়ার গহ্বর-প্রান্তে পড়ি পড়ি করে বেঁচে থাকতেন। আসলে তাঁর পরিবার বিত্তশালী ছিল।… তাঁর সঙ্গে এই আমার শেষ দেখা। কিন্তু এখনও তার সেই শান্ত সংযত প্রসন্ন বদনটি আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
কিন্তু তার পূর্বের একটি ঘটনা চিরকাল ধরে আমার ও আমার সতীর্থদের চিত্তে কৌতুকরস এনে দেবে, প্রতিবার সেটার স্মরণে।
গুরুদেব শারদোৎসবের মোহড়া নিচ্ছেন। তিনি স্বয়ং, দিনুবাবু– এমনকি জগদানন্দবাবুর মতো রাশভারী লোক– অজিন ঠাকুর এঁরা সব অভিনয় করবেন। এক প্রান্তে বসে আছেন শুষ্কাস্য বিবদন মরিস সাহেব। আমি হোমটাসক না করলে তাঁর মুখে যে বিষণ্ণতা আসত তিনি যেন তারই গোটাদশেক ‘হেলপিং’ নিয়েছেন। মোহড়ার শেষে দিনুবাবু কাঁচুমাচু হয়ে গুরুদেবকে অনুরোধ জানালেন, মরিস সাহেবকে ড্রামাতে একটা পার্ট দিতে।
গুরুদেবের ওষ্ঠাধর প্রান্তের মৃদুহাস্য সবসময় ঠাহর করা যেত না। এবারে গেল। কিন্তু ইতোমধ্যে সব পার্টেরই বিলিব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে। গুরুদেব বললেন, ‘ঠিক আছে। একে শ্রেষ্ঠীর পার্ট দিচ্ছি।’ হয় মূল নাটকে শ্ৰেষ্ঠীর পার্ট আদৌ ছিল না, ওইটে মরিস সাহেবের জন্য ‘ইসপিসিলি’ তৈরি হয় কিংবা হয়তো তখন মাত্র বড় বড় পার্টগুলোর বণ্টনব্যবস্থা আছে।
তা সে যা-ই হোক, শ্রেষ্ঠীর অভিনয় করবেন ‘নটরাজ’ মরিস– শাস্ত্রী মশাই তাঁর নাম দিয়েছিলেন মরীচি (ব্রহ্মার পুত্র, কশ্যপের পিতা ও তিনি সূর্যকিরণও বটেন)––মরিসও সগর্বে কাঁচা-হাতে সেই নামই সই করতেন। এবারে শুনুন, পার্টটি কী?
রাজা : ওগো শ্ৰেষ্ঠী!
শ্ৰেষ্ঠী : আদেশ করুন, মহারাজ!
রাজা : এই লোকটিকে হাজার কার্যাপণ গুনে দাও।
শ্ৰেষ্ঠী : যে আদেশ!
ব্যস্! ওইটুকু! আমার শব্দগুলো ঠিক ঠিক মনে নেই, কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে মরিসকে ওই পাঁচটি শব্দ বলতে হবে, গুরুদেব সায়েবের বাংলা উচ্চারণ সম্বন্ধে বিলক্ষণ ওকিবহাল ছিলেন বলে। কিন্তু মরিস সাহেব বেজায় খুশ, জান্ তররর — ড্যামগ্ন্যাডে– হোক না পার্ট ছোট, তাতেই-বা কী? বলেননি স্বয়ং গুরুদেব, ‘The rose which is single need not envy the thorns which are many?’ কিন্তু এইবারে শুরু হল ট্রবল। গুরুদেবের ভাষাতেই বলি, মরিসকে শুতে হল কন্টকশয্যায়, গোলাপ-পাপড়ির আচ্ছাদিত পুষ্পশয্যায় নয়– যদিও থর্ন মাত্র একটি। গুরুদেব যতই বলেন ‘আদেশ করুন, মহারাজ’ মরিস বলেন, ‘আডেস করুন, মহারাজ।’ মহা মুশকিল! মরিস আপন মরীচ-তাপে ঘর্মাক্তবদন। শেষটায় গুরুদেব বরাত দিলেন দিনুবাবুকে, তিনি যেন সাহেবের ‘ত টর জট ছাড়িয়ে দেন। আফটার অল– তিনিই তো খাল কেটে কুমির এনেছেন; বিপদ, এক্সকিউজ মি– বিপডটা টাঁরই টৈরি।
মরিস সাহেব ছন্নের মতো হয়ে গেলেন। সেই প্রফেট জরথুস্ত্রের আমল থেকে কোন পার্সি-সন্তান এই ‘তো’ ‘ট’য়ের গর্দিশ মোকাবেলা করেছে– এই আড়াই হাজার বছর ধরে যে আজ এই নিরীহ, হাড্ডিসার মরিস বিদেশ-বিভুঁইয়ে একা একা এই’ ত’য়ের তাবৎ ‘দ’য়ের দানব আই মিন ডানব, টাবড ডানবের সঙ্গে লড়াই দেবে?’
মরিস ছন্নের মতো আশ্রমময় ঘুরে বেড়ান দৃষ্টি কখনও হেথায় কখনও হোথায়, আর ঠোঁট দুটি বিড়বিড় করে কী যেন বলছে। আমি বললুম, ‘নমস্কার, স্যার।’ সম্বিতে এসে বললেন, ‘আ! সায়েড (সৈয়দ))’ ও হরি! এখনও ‘সায়েড’! তবে তো আডেশ এখনও মোকামে কায়েম আছে, রাজাদেশেরই মতো– ‘শোনো টো ঠিক হচ্ছে কি না “আডেশ করুন, মহারাজ”।’ আমি সন্তপ্ত চিত্তে চুপ করে রইলুম। বার দশেক আডেশ আডেশ করে বিদায় সম্ভাষণ না জানিয়ে এগিয়ে গেলেন।
একটা ডরমিটরি-ঘরের কোণ ঘুরতেই হঠাৎ সমুখে মরিস– বিড়বিড় করছেন ‘আডেশ আডে’। রেললাইনের কাছে নির্জনে ‘আডেশ–!’ দূর অতি দূর খোয়াইয়ের নালা থেকে মাথা উঠছে সায়েবের, আবার অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। চন্দ্রালোকে, খেলার মাঠে মরিস, আসন্ন উষার প্রদোষে শ্মশানপ্রান্তে কার ওই ছায়ামূর্তি? মরিস। হিন্দি কবি সত্যি বলেছেন, গুরু তো লাখে লাখে, উত্তম চেলা কই। আশ্রমের ছেলেবুড়ো এখন সবাই সায়েবের শুরু।
এস্তেক শিশু-বিভাগের কানাই, সাগার কেউ বাদ পড়েনি। পড়ে থাকলে তাদের দোষ। সবাইকে টেস্ট করতে অনুরোধ করেন তার আডেশ আডেশানুযায়ী হচ্ছে কি না। ইতোমধ্যে এক সন্ধ্যায় মোহড়া শেষে দিনুবাবু গুরুদেবকে ভয়ে ভয়ে অনুরোধ জানালেন, আদেশের বদলে অন্য কোনও শব্দ দিতে, যেটাতে “ত” “দ” নেই। গুরুদেব বললেন, না; মরিসকে “ত” “দ” শিখতেই হবে।’
এরপর দ্বিতীয় পর্ব। হঠাৎ সক্কলের সামনে একদিন বেরিয়ে গেল “আদেশ” অত্যুত্তম ‘দ’ সহ। আমি ‘ইয়াল্লা’ বলে লম্ফ দিলুম। কেউ ‘সাধু সাধু’, কেউ-বা কনগ্রাচুলেশন বললেন, কিন্তু হা অদৃষ্ট! আমরা বন থেকে বেরুবার পূর্বেই হর্ষধ্বনি করে ফেলেছি! সায়েব পরক্ষণে আডেশ-এ ল্যাপস করেছেন। তার পর তাঁর ক্ষণে আসে ‘দ’ ক্ষণে ‘ড’। কলকাতার বাজারে মাছ ওঠা-না-ওঠার মতো বেটিঙের ব্যাপার। এই করে করে চলল দিন সাতেক। সম্মুখে আশার আলো।
এরপর তৃতীয় পর্ব। দ্বিতীয় পর্বের মতো এটাও অপ্রত্যাশিত। সায়েব এখন চাঁচাছোলা, ভোরবেলার নিষ্পাপ নিষ্কলঙ্ক শিশিরবিন্দুর ন্যায় ‘দ’ বলতে পারেন। পয়গম্বর জরথুস্ত্র এবং তাঁর প্রভু আহুর মজদাকে অশেষ ধন্যবাদ!
আমরাও আমাদের সঙ্কটটা ভুলে গেলুম। মোহড়ায় প্রতিবার ঋষি মরীচি বৈদিক পদ্ধতিতে ‘দ’ উচ্চারণ করেন।
মরিস সাহেব স্টেজে নামলেন পার্সি দস্তুর বা যাজকের বেশ পরে। সবকিছু ধবধবে সাদা। শুধু মাথার টুপিটি দাদাভাই নোরজি স্টাইলের লেটার বস্ প্যাটার্নের কালোর উপর সফেদ বুট্টাদার। গুরুদেব এই বেশই চেয়ে বলেছিলেন, ‘তোমরা পার্সিরা বাপু এ দেশের শ্রেষ্ঠী। তোমরা যা পরবে তাই শ্ৰেষ্ঠীর বেশ।’
নাট্যশালা গম গম করছে। ওহ, সে কী অভিনয়! শুরুদেবকে দেখাচ্ছে দেবদূতের মতো। অজিনের চেহারা এমনিতেই খাপসুরত, এমন দেখাচ্ছে রাজপুত্রের মতো। গুরুমশাই জগদানন্দ রায়ের কী বেত্রাস্ফালন! আশ্রমে বেতের বেসাতি বিলকুল বে-আইনি। এ মোকায় জগদানন্দবাবু যেন হৃতোপবীত-দ্বিজ লুণ্ঠিত যজ্ঞোপবীত ফিরে পেয়েছেন। তাঁর কঠিনদর্শন মুখচ্ছবি ঈষৎ স্নিগ্ধতা ধরেছে।
মরিস সাহেব প্রবেশ করলেন রঙ্গমঞ্চে।
রাজা দিলেন ডাক।
মরিস সাহেব– হে ইন্দ্র, তোমার বজ্র কেন তৎপূর্বেই অবতীর্ণ হল না?
উৎকণ্ঠা, উত্তেজনায় মরিস বলে ফেলেছেন, ‘আ ডে শ।’
অট্টহাস্যে ছাদ যেন ভেঙে পড়ে। তিনি কিন্তু ওই একই উত্তেজনার নাগপাশে বন্ধ বলে সে অট্টহাস্য শুনতে পাননি।
সে সন্ধ্যার অভিনয়ের জন্য অধ্যাপক হিডজিভাই মরিসই পেয়েছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনন্দন। আমাদের বিবেকবুদ্ধি সেই আদেশই দিয়েছিল– খুব সম্ভব আডেশই।(১)
———- ১. মরিস সর্বদাই ঈষৎ বিষণ্ণ বদন ধারণ করতেন– খুব সম্ভব এটাকেই বলে ‘মেলানকলিয়া’। প্যারিস থেকে ফেরার পথে তিনি জাহাজ থেকে অন্তর্ধান করেন। আমার মতো আর পাঁচজন তার কারণ জানে না। শুনেছি, তিনি উইল করে তাঁর সর্ব বিশ্বভারতাঁকে দিয়ে যান।
‘আধুনিক’ কবিতা
‘সুশীল পাঠক—’
ছেলেবেলায় এ ধরনের সম্বোধন পড়ে হৃদয়ে বড় আনন্দ হত। মনে হত, কত মহান লেখক এই কালীপ্রসন্ন সিঙি, যিনি কি না মহাভারতের মতো বিরাট গ্রন্থ অনুবাদ করেছেন, তিনি আমাকেই সম্বোধন করে বলেছেন! এটা যে নিছক সাহিত্যিক ঢং, বলার একটা আড়, সেটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারতুম না। বিশেষ করে যখন আমার ধারণা হল– সেটা হয়তো। ভুল– যে দরদ-ভরা-কথা কয়ে যখন তিনি আমার সহানুভূতি আকর্ষণ করতে চান, তখনই ‘পাঠক’ বলে সম্বোধন করেন। এবং আরও বেশি করে ‘সহৃদয় পাঠক’ বলে সম্বোধন করতেন সিঙি মশাইয়ের মতো দরদী লেখককুল যখন তারা এমন কোনও অভিজ্ঞতার বর্ণনা করতে যেতেন, যেটার মোক্ষম মার বেশিরভাগ পাঠকই খেয়েছে। এ অধম প্রাচীনপন্থী। সে এখনও পাঁচকড়ি দে গোপনে পড়ে। এবং বটতলাতে কিছুক্ষণ হল একখানা ‘সচিত্র প্রেমপত্র’ কিনে সে বড় ভরসা পেয়েছে। যৌবনে ভাষার ওপর দখল ছিল না– এখনই-বা হল কই?– মরমিয়া প্রেমপত্র লিখতে পারত না বলে রায়ের ভাষায়, উনিশটি বার প্রেমেতে সে ঘায়েল করে থামল শেষে। আর ভয় নেই। এখন এই অমূল্য গ্রন্থ থেকে নকল করে ফিলিমস্টার থেকে মেয়ে-পুলিশ সকলেরই ‘সজল নয়নে হৃদয়-দুয়ারে ঘা’ দেওয়া যাবে। বইখানার প্রথম চার লাইন পড়লেই বুঝতে পারবেন, মাইকেল রবীন্দ্রনাথ এর থেকে কতখানি পিছিয়ে আছেন;
‘প্রিয়তমা চারুশীলা পিতৃগৃহে গিয়ে
আছে তো সুখেতে তুমি গোষ্ঠিজন নিয়ে?
তুমি মোর জীবনের সর্বোকৃষ্ট ধন।
তুমি মোর হৃদয়ের শান্তিনিকেতন।’
জানি, জানি– বাধা দেবেন না, জানি আপনারা বলবেন, এই মডার্ন যুগে এসব পণ্য অচল। কিন্তু আপনারা কি এ তত্ত্বটাও জানেন না যে, ফ্যাশন হর-হামেশা বদলায় এবং আকছারই প্রাচীন যুগে ফিরে যায়? পিকাসসো ফিরে গেছেন প্রাগৈতিহাসিক গুহাবাসীর দেয়াল-ছবিতে, অবনঠাকুর মোগলযুগে, নন্দলাল অজন্তায়, যামিনী রায় কালীঘাটের পটে। কাব্যে দেখুন, দুর্বোধ্য মালার্মে-র্যাঁবো যখন অনুবাদের মারফৎ ইংলন্ডও জয় করে বসে আছেন, তখন হাউসম্যান লিখলেন সরল প্রাঞ্জল ‘শ্ৰপশার ল্যাড’। বলা হয়, ইংলন্ডে কবির জীবিতাবস্থায় তাঁর একখানা বইয়ের এত বিক্রির অন্য উদাহরণ নেই। কোনও ভয় নেই। বাংলা দেশের মডার্ন কবিতাও একদিন ‘পাখি সব করে রবে’র অনবদ্য শাশ্বত ভঙ্গিতে লেখা হবে।
আমি মডার্ন কবিতা পছন্দ করিনে, তাই বলে মডার্ন কবিতার কোনও ‘রোজোঁ দেত্রর’ রিজন ফর এগজিসটেনস্ অর্থাৎ পুচ্ছটি তার উচ্চে তুলে নাচাবার ‘রোজোঁ রিজন’, ন্যায্যহকক নেই এ কথা কে বলবে।
প্রথমেই নিন মিলের অত্যাচার। এবং এই মিলটা আমাদের খাঁটি দিশি জিনিস নয়। সংস্কৃতের উত্তম উত্তম মহাকাব্যে, কাব্যে মিল নেই। যদিস্যাৎ থাকে, তবে সেটা আকস্মিক দুর্ঘটনা, প্রায় কবির অনিচ্ছায় ঘটেছে, সংস্কৃতে প্রথমে মিল পাই– আমার জানা মতে মোহমুগরে। এবং তিনিও সেটা বহিরাগত ভাষা থেকে নিয়েছিলেন, এমত সন্দেহ আছে। সংস্কৃতের সহোদরা ভাষা গ্রিক-লাতিনে কি মিল আছে? এ দেশেই দেখুন উর্দু তার জননী সংস্কৃত ভাষা থেকে বহু দূরে চলে গিয়েছে, জোব্বাজাব্বা পরে প্রায় মুসলমান হয়েছে (প্রায় বললুম কারণ এখনও বহু হিন্দুর মাতৃভাষা উর্দু; উর্দু কবি সম্মেলনে তারা সম্মানিত সক্রিয় অংশীদার। কিন্তু, পণ্ডিত নেহরু, তেজবাহাদুর সপ্র ইত্যাদির মাতৃভাষা ছিল উর্দু), তথাপি আজও উর্দুতে বিনা মিলে দোঁহা রচনা করা হয়, সংস্কৃত সুভাষিতের অনুকরণে। ‘মিল’ শব্দটা কি শুদ্ধ সংস্কৃত? সংস্কৃতে একে বলে ‘অন্ত্যানুপ্রাস্’-স্পষ্ট বোঝা যায়, বিপদে পড়ে মাথায় গামছা বেঁধে ম্যানুফেকচার্ড এরজাৎস মাল। অতএব যদি মডার্ন কবিরা সে বস্তু এড়িয়ে চলেন তবে পাঠক তুমি গোসসা কর ক্যান? ওঁরা তো মাইকেলেরই মতো আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য পুনর্জীবিত করছেন। এই যাবনিক ম্লেচ্ছাচারের যুগে সেটি কি চাট্টিখানি কথা!
তার পর ছন্দ? ছন্দহীন কবিতা হয় না, আপনাকে বলেছেন কোন অলঙ্কার-শাস্ত্রের গোসাই? উপনিষদ পড়েছেন? তার ছন্দটি কান পেতে শুনেছেন? ছন্দে-বাঁধা কবিতা আসতে পারে তার কাছে? বস্তুত বেদমন্ত্রে ছন্দ মেনে মেনে হয়রান হয়ে ঋষিকবি উপনিষদে পৌঁছে কি যুগপৎ তার আধ্যাত্মিক ও কাব্যিক মোক্ষ লাভ করলেন না? এ অধম অশিক্ষিত তথাপি গুণীজনের কাছে শোনা উপনিষদের একটি সামান্য সাদামাটা প্রশ্ন নিন:
‘সূর্য অস্ত গেছে, চন্দ্রও অস্ত গেছে, অগ্নি নির্বাপিত (অর্থাৎ আগুন জ্বালিয়ে যে একে অন্যকে দেখব তার উপায় নেই), কথাও বন্ধ (অর্থাৎ চিৎকার করে ডাকবারও উপায় নেই)। তখন কোন জ্যোতি নিয়ে মানুষ (বেঁচে) থাকে, বলুন তো যাজ্ঞবল্ক্য?’
এবার সংস্কৃতটা শুনুন :
‘অস্তমিতি আদিত্যে, যাজ্ঞবল্ক্য, চন্দ্রমস্যস্তমিতে, শান্তেহগ্নৌ, শান্তায়াং বাচি, কিংজ্যোতিরেবায়ং পুরুষঃ?’
প্রচলিত মন্দাক্রান্তা বা শার্দুলবিক্রীড়িত ছন্দে এই অতুলনীয় সঙ্গীত-মন্দ্রিত-স্পন্দিত ছত্র বেঁধে দিলে কি প্রভু যিশুর ভাষায়, লিলিফুলের উপর তুলি নিয়ে রঙ বোলানো হত না?
এতেও যদি আপনাদের মন না ভরে তবে পড়ুন ইংরেজি অনুবাদে বাইবেল– রাজা দায়ুদের গান, সুলেমান বাদশার গীতি (সং অব সংজ, সং অব সলোমন)। সে তো গদ্যে এবং স্বয়ং বার্নার্ড শ বলেছেন, ওই সলোমনের গীতটি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রেমের কবিতা।
আবার আপনি যদি মুসলমান হন তা হলে তো কথাই নেই। আপনি জানেন প্রাক-পয়গম্বর যুগেও আরবদের ছিল বহু বিচিত্র ছন্দে, মিলের কঠোরতম আইনে বাঁধা অত্যুকৃষ্ট কাব্যসৃষ্টি। গদ্য ছিল না, কিংবা প্রায় না থাকারই মতো। তথাপি আল্লা-তালা। পয়গম্বরকে যে কুরানের বাণী পাঠালেন সে তো গদ্যে। অথচ আরবি-ভাষা নিয়ে যারা সামান্যতম চর্চা করেছেন তারাই শপথ করে বললেন, এঁর ছন্দোময় গদ্য যে কোনও বাধা কাব্যকে হার মানায়। পয়গম্বরকে যখনই তাঁর বিরুদ্ধপক্ষ কোনও মিরাকল (অলৌকিক কীর্তি) দেখাতে আহ্বান করত তখনই তিনি সবিনয়ে বলতেন, ‘আমি নিরক্ষর আরব। তৎসত্ত্বেও আল্লা-তালা আমার কণ্ঠ দিয়ে যে কুরান পাঠালেন তার কাছে কি আসতে পারে তোমাদের শ্রেষ্ঠতম কাব্য? এইটেই হল সবচেয়ে বড় মিরাকল।’
অতএব মডার্ন কবিরা যদি ছন্দ অস্বীকার করেন তবে আপনি চটেন ক্যান?
তৎসত্ত্বেও মডার্ন কবিতার দুশমনরা হয়তো বলবেন, তারা সুন্দর সুন্দর জিনিসের সঙ্গে বিকুটে সব জিনিসের তুলনা দেয়– যেমন তালগাছের ডগায় চাঁদ দেখে লিখলে, এ যেন আকাশের সুচিক্কণ সুমসৃণ তাল! কিংবা প্রিয়ার বিনুনি দেখে কবির মনে এল পানউলির দোকানে ঝোলানো অগ্নিমুখ নারকোলের পাকানো দড়ি– যার ডগায় লাগিয়ে আমি আকছারই বিড়ি ধরাই। সেই দড়ি হাওয়ায় দুলে কবির কুর্তা পুড়িয়ে দিয়ে পিঠে ছ্যাঁকা দিয়েছে, ঠিক তেমনি প্রিয়ার বিনুনি দেখা মাত্রই তাঁর বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে।
এটা পড়ে তাজ্জব মানছেন কেন?
রাজা শূদ্রকের ‘মৃৎ-শকটিকা’ পড়েননি? জর্মনরা সংস্কৃতের সমজদার এস্তেক গ্যোটে হাইনে সংস্কৃত না জেনেও ভারতীয় নাট্যের স্মরণে উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করতেন। শূদ্রকের এই নাটকটি জর্মন ভাষাতে ক’বার যে ভিন্ন ভিন্ন রসিকজন দ্বারা অনূদিত হয়েছে বলা কঠিন, ক’বার যে জর্মনিতে মঞ্চস্থ হয়েছে সেটা বলা তার চেয়েও কঠিন। সেটা নাট্যে আছে, ক্ষুধিত সূত্রধার বাড়ি ফেরার সময় গভীর দুশ্চিন্তায় মগ্ন–বাড়িতে তো চালডাল কিছুই নেই, গৃহিণী কি আদৌ রন্ধন করতে পেরেছেন? বাড়ি ঢুকেই সূত্ৰধার সানন্দে সবিস্ময়ে দেখেন, সাদা মাটির উপর লম্বা লম্বা কালো কালো আঁজি আঁজি দাগ–কালিমাখা হাঁড়ি মাটিতে ঘষে ঘষে গৃহিণী সাফসুৎরো করেছেন। অতএব ধূম দেখলে যে রকম বহ্নির উপস্থিতি স্বীকার করতেই হয়, হাঁড়ি পরিষ্কার করা হয়ে থাকলে রান্নাও যে হয়েছে সে বিষয়ে কী সন্দেহ? সূত্রধার তখন সোল্লাসে উপমা দিয়ে বললেন, ওহো! সাদা মাটির উপর এই কালো কালো আঁজি যেন তুষারধবলা গৌরীর ললাটে কৃষ্ণাঞ্জনতিলক!
কী মারাত্মক গদাময় হাঁড়িকুঁড়ি, মাটিতে সেগুলো ঘষার ফলে নোংরা কালো আঁজির সঙ্গে শিবানী গৌরীর অসিত তিলকের তুলনা! এ যে রীতিমতো হেরেসি, এ হেন তুলনা চার্বাকের বেদ-নিন্দার চেয়েও ধর্মঘ্ন কটু-ভাষণ।
এরপরও আপনি আপত্তি করে বলবেন মডার্ন কবিতা ন দেবায় ন ধর্মায়?
বুদ্ধিমান তথা না-ছোড়-বান্দা পাঠক, আমি বিলক্ষণ জানি, আপনার প্রধান আপত্তি কোনখানে ছোটখাটোগুলো উপস্থিত না হয় বাদই দিলুম। আপনি বলবেন ওদের কবিতা পড়ে মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারিনে। আমো পারিনে– ধাপ্পা না মেরে হক্ক কথাই কই। সে তো আপনার দোষ, আমার দোষ। আপনি আমি পয়সাওয়ালার ছেলে হয়ে জন্মালে সত্যকার অপটুডেট chic, dernier cri, লেটেস্ট মডেলের হাইয়ার এডুকেশন পেতুম; আপনি, আমি, আমরা নিদেন যদি অধ্যাপক হতুম, তারও নিদেন যদি আমরা তাদের শিষ্য হবার সুযোগ পেতুম, তবে তো আজ এ প্রশ্ন তুলতুম না। কিন্তু এহ বাহ্য।
‘বুঝতে পারিনে’ কথাটার অর্থ কী? আপনি ভৈরবী বা পূরবী শুনে যদি রস না পান তবে কি গায়ককে প্রশ্ন শুধান, ‘ভৈরবীর অর্থ আমায় বুঝিয়ে দাও?’ আরও সহজ দৃষ্টান্ত দিই। পদ্মাবক্ষে আপনি সূর্যোদয় দেখে মুগ্ধ হলেন, মাঝি হল না। সে যদি আপনার তন্ময় ভাব দেখে শুধোয়, ‘কত্তা, সূযযি তো উঠলেন, কিন্তু আপনি এমন বে-এক্তেয়ার হলেন কেন? এ সূযজি ওঠাতে কী আছে আমাকে বুঝিয়ে দেন’ তা হলে আপনি কী বোঝাবেন? তাজমহল দেখে হাকসলি মুগ্ধ হননি, কিন্তু তিনি তো গাইডকে এ প্রশ্ন শুধোননি,’ তাজমহলের অর্থ আমায় বুঝিয়ে বল’। কিংবা ভরতনাট্যম দেখে আপনি যদি ‘অর্থ’ বুঝতে চান, তবে হয়তো অভিনয়াংশের অর্থ আপনাকে বোঝানো যাবে কিন্তু বিশুদ্ধ নাট্যরসের (যেমন যন্ত্রসঙ্গীতের) অর্থই-বা কী, আর বোঝাবেই-বা কে? চিত্রে একদা লোকে কোনও বস্তুর সঙ্গে তার সাদৃশ্য দেখে কিছুটা অর্থ পেত কিন্তু এখন কুবিজ, দাদাইজমে কেউ সাদৃশ্য খোঁজে না, অর্থও খোঁজে না। কাঠের একটা গুঁড়ি নিয়ে বিখ্যাত ভাস্কর ছ মাস ধরে প্রাণপণ খাটলেন; প্রদর্শনীর মধ্যকক্ষে সেটি স্থাপিত করে তলায় নাম লিখলেন কাঠের একটা খুঁড়ি। কাঠের গুঁড়ি, কাঠের গুঁড়ি; ভৈরবী, ভৈরবী। তার আবার অর্থ কী?
মনে হচ্ছে আপনি তন্ত্রের কিছুই জানেন না। তন্ত্রে নিগূঢ়তম মন্ত্রের অর্থ শোধান না গুরুকে। যদি তিনি প্রকৃত শুরু হন তবে আপনার হাড় ক’খানা আর আস্ত থাকবে না। আর অত গভীরে যাবার কী প্রয়োজন? এই যে পৃথিবীর কোটি কোটি নর-নারী উপাসনা করে ভিন্ন। ভিন্ন ভাষায়, তার কটা ভাষা লোকে বোঝে? আপনি উত্তরে হয়তো বলবেন, আমরা রস নিয়ে বিচার করছি। তা হলে স্মরণে আনুন, সেই বুড়ি দাড়িওয়ালা কথকঠাকুরের কথকতা শুনে হাউহাউ করে কেঁদেছিল– কথকতার এক বর্ণ না বুঝেও। তার স্মরণে কী এসেছিল সেটা অবান্তর। তার কান্নাটা সত্য। তার রসবোধটা সত্য।
অলঙ্কার-শাস্ত্র অধ্যয়ন করে তলিয়ে দেখুন, অর্থ বোঝামাত্রই রসোৎপন্ন হয় না– অর্থ পেরিয়ে যে ব্যঞ্জনা যে ধ্বনি যে অনির্বচনীয়তার সৃষ্টি হয়, রস সেই গভীর গুহায়। উপনিষদে আছে সত্য (এবং সত্যই অনুভূতির ক্ষেত্রে রস–কারণ সৎ আনন্দ এবং চিৎ নিয়ে সচ্চিদানন্দ) আছেন সোনার পাত্রে লুকানো। সাধারণ জন সোনার পাত্র দেখেই মুগ্ধ, ভেতরে তাকিয়ে দেখে না। কাব্যে, সঙ্গীতে সর্বত্রই অর্থ জিনিসটা সুবর্ণ পাত্র, তাই দেখে লোক মুগ্ধ। রস কিন্তু ভেতরে। তার সঙ্গে পাত্রের কী সম্পর্ক? পাত্রস্থিত অমৃতরসের সঙ্গে যে ধাতু (অর্থ) দিয়ে পাত্র নির্মিত হয়েছে তার কী সম্পর্ক কিছুই না। তাই, এসব বুঝেই কবি দ্বিজেন্দ্রলাল গেয়েছিলেন,
‘জননী বঙ্গভাষা, এ জীবনে চাহি না অর্থ!’