- বইয়ের নামঃ পঞ্চতন্ত্র – ২য় পর্ব
- লেখকের নামঃ সৈয়দ মুজতবা আলী
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
অদ্যাপিও সেই খেলা খেলে গোরা রায় মধ্যে মধ্যে ভাগ্যবানে দেখিবার পায়
এই ‘দেশ’ পত্রিকাতেই আমার এক সতীর্থ কিছুদিন পূর্বে ‘ফরেন ডিগ্রি’-ধারীর দম্ভের প্রতি ক্ষণতরে ঈষৎ ভ্রুকুটিকুটিল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মর্মঘাতী আপন মূল বক্তব্যে চলে যান। হয়তো সে স্থলে এ বিষয় নিয়ে সবিস্তর আলোচনা করার অবকাশ ছিল না, অর্থাৎ তিনি শেখ চিল্লির মতো মূল বক্তব্যের লাভ এবং ঈষৎ অবান্তর বক্তব্যের ফাউ দুটোই হারাতে চাননি।
ওহ! গল্পটি বোধ হয় আপনি জানেন না, কারণ শেখ শ্রীযুক্ত চিল্লি জাতে খোট্টা এবং বাংলা দেশে কখনও পদার্পণ করেননি। যদ্যপি শ্ৰীযুক্তা সীতা এবং শান্তা এবং খুব সম্ভব তাদের অগ্রজও মিয়া শেখ চিল্লির সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেবার চেষ্টা করেছেন উপকথার মারফতে– স্বর্গত রামানন্দের পরিবার যে খোট্টাই দেশে বাল্যকাল কাটিয়েছেন সে কথা আগে জানা না থাকলেও তার শতবার্ষিকী উপলক্ষে লিখিত প্রবন্ধাদি পড়ে বহু বাঙালিই জেনে গিয়েছে। কিন্তু এ স্থলে আমার যে গল্পটি স্মরণে এল সেটি বোধ হয় তারা ইতোপূর্বে সবিস্তর বয়ান করে আমাকে পরবর্তী যুগের ‘চোর’ প্রতিপন্ন করার সুব্যবস্থা করে যাননি– এই ভরসাতেই সেটি উল্লেখ করছি। করে গেলেও ঝুটমুট ‘ঝেপবার ভয় নেই কারণ গল্পটি ক্লাসিক পর্যায়ের, অর্থাৎ এর বিষয়বস্তু সর্বসাধারণের কার্যকলাপে নিত্য নিত্য সপ্রকাশ হয় বলে এটি নিত্যদিনের ব্যবহার্য গল্প।
মা সরস্বতীর বর পাওয়ার পূর্বে কালিদাস যে আক্কেল-বুদ্ধি ধারণ করতেন, হিন্দি-উর্দু ভাষীদের শেখ চিল্লিও সেই রকম আস্ত একটি ‘পন্টক’ (‘কণ্টক’ থেকে ‘কাঁটা’, সেই সূত্রানুযায়ী ‘পন্টক’ থেকে কী উৎপন্ন হয় সে তত্ত্ব সুচতুর পাঠককে বুঝিয়ে বলতে হবে না; আসলে এই গূঢ় তত্ত্বটি আবিষ্কার করার ফলেই শ্রীযুক্ত সুনীতি চট্টো অস্মদ্দেশীয় শব্দতাত্ত্বিকদের পঙক্তিতে আপন তখৎ-ই-তাউসে গ্যাঁট হয়ে বসবার হকক কব্জা করেন।)
সেই শেখ চিল্লিকে তাঁর মা হাতে একটি বোতল আর পয়সা দিয়ে বাজার থেকে তেল কিনে আনবার আদেশ দিলেন এবং পুত্রের পেটে কী পরিমাণ এলেম গজগজ করছে সেটা জানতেন বলে পইপই করে স্মরণ করিয়ে দিলেন, আসল তেলটা পাওয়ার পর সে যেন ফাউ আনতে না ভোলে। শেখ চিল্লি একগাল হেসে বললেন, ‘তা-ও কখনও হয়!’
আমি জানি, আজকের দিনের পাঠক কিছুতেই বিশ্বাস করবেন না যে, কোনও জিনিসের দাম বাজারে কস্মিনকালে কখনও কমে। কিন্তু কমতেই হবে, এই হালের সুকুমার রায়ের যুগেও ‘বাড়তি’ ‘কমতি’ ছিল– এমনকি বয়সের বেলাও। আমি যে যুগের বয়ান দিচ্ছি সেটা তারও বহু পূর্বেকার। তাই মিয়া চিল্লির আম্মাজানের অজানতেই বাজারে তেলের দর হঠাৎ কমে গিয়েছিল! হয়তো কোনও ‘রাধা’কে নাচাবার জন্য নবাব সাহেবের ‘ন মণ তেলে’র প্রয়োজন হওয়াতে তিনিও শায়েস্তা খানের মতো তেলের দর সস্তায় বেঁধে দিয়ে বাজার শায়েস্তা করেছিলেন। সেটা এ যুগের ‘সন্দেশ’ শায়েস্তা করতে গিয়ে স্বহস্তে স্বপৃষ্ঠে ভূতের কিল খাওয়া নয়।
তা সে যা-ই হোক, তেল সস্তা হয়ে যাওয়ার দরুন মূল তেলেই বোতল কানায় কানায় ভরে গেল। শেখ চিল্লির ঘটে বুদ্ধি কম ছিল সত্য কিন্তু তার স্মৃতিশক্তিটি আমাদের ‘দাদখানি তেল, মসুরির বেল’-এর মতো ছিল না। তিনি দোকানিকে বললেন, ‘ফাউ?’
দোকানি বললে, ‘কী আপদ, বোতলে জায়গা কোথায়?’
শেখ বললেন, ‘বট্যে! চালাকি পেয়েছ? এই তো জায়গা।’ বলে তিনি বোতলটি উপুড় করে বোতলের তলার গর্তটি দেখিয়ে দিলেন। মেরি মাগডেলেন যে খ্রিস্টের পদদ্বয় তৈলাক্ত করেছিলেন সেটাকেও হার মানালেন শেখ– অবশ্য স্বহস্তে। দোকানি মুচকি হেসে সেই গর্তটি এক কাচ্চা তেল নিয়ে ভরে দিয়ে শেখের ফাউয়ের খাইও ভরে দিল।
বোতলটি অত সন্তর্পণে ‘স্টাটুস কুয়ো’ বজায় রেখে ধরে ধরে শেখ বাড়ি পৌঁছে মাকে বললেন, ‘এই নাও আম্মা, তোমার ফাউ।’ তার পর বোতলটি উল্টে খাড়া করে ধরে বললেন, ‘আর ভেতরে তোমার আসল।’
আম্মা-জানের পদদ্বয় অবশ্য খ্রিস্টের তুলনায় অল্পই অভিষিক্ত হল।
***
দেশ থেকে যে বোতলটি নিয়ে এ-দেশের ছাত্র বিদেশে বিদ্যার তেল–না ভুল বললুম, ডিগ্রির তেল কিনতে যায়, সেটি নিয়ে সে কোনও শেখ চিল্লির মতো কী বেসাতি করে সে তত্ত্বটি অনেকেরই জানা নেই। না জানারই কথা, কারণ ইংরেজ আমলের পূর্বে এ-দেশে কখনও এই ‘ফরেন’ ভূতের উপদ্রব হয়নি। মুসলমান আমলে কী হয়েছিল সেটা পরের কথা। তার পূর্বে কোনও ভারত-সন্তান ফরেন ডিগ্রির জন্য কামচাটকা থেকে কাসাব্লাঙ্কা কোথাও গিয়েছে বলে শুনিনি। তবে জাতক পড়লে পাই, ওই যুগে তক্ষশিলা ছিল বৌদ্ধজ্ঞানবিজ্ঞানচর্চার কেন্দ্র এবং বারাণসী ছিল সনাতন ধর্ম-জ্ঞানবিজ্ঞান-চর্চার জন্য সর্বপ্রসিদ্ধ তীর্থ। তাই জাতকের একাধিক গল্পে পাই, বৌদ্ধ কিংবা বৌদ্ধভাবাপন্না বারাণসী গৃহী পুত্রকে তক্ষশিলায় বিদ্যার্জনের জন্য পাঠাতেন। তদ্রূপ কাশী সর্বকালেই সনাতন ধর্ম ও জ্ঞানবিজ্ঞানের কেন্দ্রভূমি থাকা সত্ত্বেও হয়তো বিক্রমাদিত্যের যুগে সারা-ভারতের কোনও কোনও অঞ্চল থেকে কিছু ছাত্র উজ্জয়িনীতে বিদ্যাভ্যাস করতে গিয়েছে।