- বইয়ের নামঃ বড়বাবু
- লেখকের নামঃ সৈয়দ মুজতবা আলী
- প্রকাশনাঃ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
অপর্ণার পারণা বা স্যালাড
বাসনা ছিল দু-একটি গাল-গল্প বলার পর যখন আর খানিকটা ওম পেয়েছে তখন এই লেখাটিতে হাত দেব কিন্তু হিসাব করে দেখি সে আর হয় না। স্যালাড পাতা বাজারে ফুরিয়ে যাওয়ার পর এ লেখা বেরুলে কে আর সেটি ন মাস বাঁচিয়ে রাখবে? এমনকি মনে হচ্ছে এমনিতেই বোধহয় কিঞ্চিৎ দেরি হয়ে গেল। অবশ্য কলকাতা এবং হিলস্টেশনে যারা থাকেন তাদের কথা আলাদা।
স্যালাড শব্দের মূল অর্থ নোন কিন্তু এখন শব্দটি অন্য নানা অর্থে ব্যবহার হয়। প্রধানত কাঁচা পাতা খাওয়ার অর্থে। তাই আমি যখন কোনও ইয়োরোপীয়কে পান দিই, তখন বলি, যা সাম নেটিভ স্যালাড। অবশ্য তারা পান বলতে সেটাকে স্যালাডের ভিতর ধরেনি।
স্যালাড বললে দেশে-বিদেশে প্রধানত লেটিস (ইংরেজিতে বানান lettuce কিন্তু উচ্চারণ লেটিস) স্যালাডই বোঝায়। তার নানা জাত-বর্ণ আছে কিন্তু এদেশে প্রধানত হেড় এবং লিফ এই ধরনেরই রেওয়াজ বেশি। হেড অর্থাৎ মাথা– এ লেটিস দেখতে অনেকটা বাঁধাকপির মতো। আর লিস্ স্যালাডে থাকে শুধু পাতা। দুটোরই বাইরের দিকের পাতাগুলো পুরু এবং তেতো বলে সেগুলো ছিঁড়ে ফেলে ভেতরের নরম-বস্তু কাজে লাগাতে হয়। আর যদি আপন বাগানে লিফু ফলিয়ে থাকেন তবে সূর্য ওঠবার সময় আগে হলে আরও ভালো প্রয়োজনমতো যে-কটি পাতা দরকার সেগুলো ভিন্ন ভিন্ন লেটিসের ভিতরকার দিক থেকে ছিঁড়ে তুলে নেবেন (ন্নি ভিন্ন লেটিসে সেসব জায়গায় আবার নতুন কচি পাতা গজাবে, বাইরের দিকে যে পাতাগুলো হেঁড়েননি সেগুলোর নিরাপদ আশ্রয়ে)। কেউ কেউ বলেন স্যালাড তৈরি করা পর্যন্ত পাতাগুলো ভিজিয়ে রাখতে, আমি বলি ভিজে ন্যাকড়া দিয়ে জড়িয়ে রাখতে।
অমলেট, মাছভাজা যেমন বেশি আগে তৈরি করে রাখা হয় না, স্যালাডও তেমনি খেতে বসার যত অল্পক্ষণ আগে করা যায় ততই ভালো না হলে পাতাগুলো নেতিয়ে একাকার হয়ে যায়।
সবচেয়ে ঘরোয়া আটপৌরে স্যালাড কী করে বানাতে হয় তারই বর্ণনা দিচ্ছি। এটা বানাতে যেসব মাল-মসলা লাগে সেগুলো আপনার ভাঁড়ারে আর সবজির ঝুড়িতেই আছে– আপনাকে শুধু কিছু লেটিস পাতা কিনে আনতে হবে। আপনার যদি স্যালাড সম্বন্ধে অল্পবিস্তর জ্ঞানগম্যি থাকে তবে আপনি এখানেই তীব্র কণ্ঠে আপত্তি জানিয়ে বলবেন, কিন্তু অলিভ ওয়েল? সে তো আমাদের ভাঁড়ারে থাকে না! দাঁড়ান বলছি, ওটা বড় আক্রা জিনিস এমনকি খাজা ভেজালটাও কম আক্ৰা নয়। সেকথা পরে আসছে।
বাজার কিংবা বাগান থেকে লেটিস পাতা এনে তার বাইরের পাতাগুলো ছিঁড়ে ফেলে দেবেন। প্রশ্ন উঠতে পারে, বাইরের কটা পাতা? যত বেশি ফেলবেন, ভেতরের কচি পাতার গুণে স্যালাড তত সুস্বাদু হবে, কিন্তু তা হলে তো পরিমাণ এত কমে যাবে যে খরচায় পোষাবে না। অতএব আপনাকেই চিন্তা করে স্থির করতে হবে, বাইরের কটা পাতা ফেলে দেবেন। এ ব্যাপারে পাক্কা গিন্নির মতো বড় বেশি কঞ্জুসি করবেন না, কারণ লেটিস অতিশয় সস্তা জিনিস।
ভিতরের যে পাতাগুলো বাছাই করে নিলেন সেগুলো অতি সযত্নে ধুয়ে নেবেন। ধোয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য ওগুলো থেকে ধুলোবালি ছাড়ানো আর কিছু নয়। তার পর পাতাগুলো হাত দিয়ে টুকরো টুকরো ছিঁড়ে নেবেন, এই মনে করুন, টুকরোগুলো যেন তিন ইঞ্চির মতো লম্বা হয়। কিন্তু সাবধান! বঁটি দিয়ে কাটবেন না। যে জিনিস কাঁচা খাওয়া হয় সেগুলো লোহা দিয়ে কাটা উচিত নয়- এ তো জানা কথা। স্টেনলেস স্টিলের ছুরি অবশ্য ব্যবহার করতে পারেন অথবা যাকে বলা হয় ফ্রট নাইফ বা ফল কাটার ছুরি। কিংবা ঝিনুক, কিংবা বাশের ছিলকে দিয়ে। কাঁচা আম মা-মাসিরা যে পদ্ধতিতে কাটেন –বাংলা কথা। কিন্তু লেটিসের পাতা ছিঁড়বেন হাত দিয়েই। এগুলো দরকার হবে পরের জিনিসগুলো কাটবার জন্য।
এইবারে ছেঁড়া পাতাগুলো চিনেমাটির কিংবা শুধু মাটির চ্যাপ্টা থালাতে রাখুন। কাসা বা পেতল সম্পূর্ণ বর্জনীয়। কারণ এতে নেবুর রস আসবে। সবচেয়ে ভালো হয়, ময়দা আঁকার ছাকনির উপর রাখলে। তা হলে পাতার গায়ের জল ঝরে পড়ে পাতাগুলো ফের শুকনো হয়ে যায়।
তার পর মোটা সাদা পেঁয়াজ চাকতি চাকতি করে কাটুন। টমাটো, শসাও চাকতি চাকতি করুন। ঘোট ঘোট নরম লাল মুলো কিংবা খুব নরম সাধারণ মুলোও চাকতি চাকতি করে দিতে পারেন। কাঁচালঙ্কা কুচি কুচি করে দেবেন, যদি বাড়ির লোক কাঁচালঙ্কার ঝাল পছন্দ করেন।
এইবারে সবকিছু- অর্থাৎ লেটিসের ছেঁড়া পাতা ও এগুলো একসঙ্গে রাখুন। তার উপর সরষের তেল ঢালুন। যা, যা, সরষের তেল, যে তেল দিয়ে আমরা তেল-মুড়ি খাই। আপনি বলবেন, অলিভ তেলের কী হল? উত্তরে নিবেদন, স্যালাড বানাবার সময় মার্কিন-ইয়োরোপীয় বিশেষ করে ফরাসিরা মাস্টার্ড পাউডার অর্থাৎ সরষেওঁড়ো অলিভওয়েলের সঙ্গে মিশিয়ে নেয়, কিংবা আগেভাগে সরষেওঁড়ো জলের সঙ্গে খুব পাতলা করে মিশিয়ে তার সঙ্গে লেটিস পাতা মাখিয়ে নেয়। অলিভওয়েলের আপন গন্ধ ও স্বাদ খুব কম। তার সঙ্গে সরষেওঁড়ো মেশালে ফলে তো সর্ষের তেলই দাঁড়াল অবশ্য আমাদের সরষের তেলের ঝাজ এবং ধক তাতে থাকবে না। অবাঙালি সর্ষের তেলের ঝাজ সইতে পারে না বলেই অলিভ ওয়েল করে। আমরা যখন ওইটেই পছন্দ করি তবে সরষের তেল দিয়ে স্যালাড বানাব না কেন? আমি নিজে তো পুরনো আচারের মজা-সরষের তেলই ব্যবহার করি।