আবার আরম্ভ হল চুম্বন আর আদর-সোহাগ।
নিঃশব্দ নিশীথে, গভীর নিদ্ৰায় মগ্ন থাকা সত্ত্বেও গুদামঘরের চালার ভিতর বুড়ো কেরানি শুনতে পাচ্ছিল ক্ষণে মৃদু আলাপের গুঞ্জন, ক্ষণে চাপা হাসির ইঙ্গিত– যেন কতকগুলি দুবৃত্ত বালক কোনও নির্বীর্য বৃদ্ধকে নিয়ে নিদারুণতম ঘৃণ্য ব্যঙ্গ করার জন্যে ষড়যন্ত্র করছে ক্ষণে আনন্দের উচ্চহাস্য কলরোল– যেমন সরোবরের পরীরা কাউকে নির্মমভাবে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। এ-সবের উৎস কাতেরিনা। চাঁদের আলোতে সে যেন সাঁতার কাটছে, নরম কম্বলের উপর গড়াগড়ি দিচ্ছে আর রসকেলি করছে তার স্বামীর ছোকরা কেরানির সঙ্গে। কুসুমাচ্ছাদিত আপেলবৃক্ষের কোমল ফুলদল তাদের উপর ক্ষণে ক্ষণে বর্ষিত হচ্ছিল– অবশেষে সে বর্ষণও ক্ষান্ত হল। ইতোমধ্যে নাতিদীর্ঘ নিদাঘ রজনী প্রবহমান চন্দ্রমা উচ্চ ভাণ্ডারগৃহের চূড়ান্তরালে লুক্কায়িত থেকে পাণ্ড হতে পারতর নয়নে ধরণীর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করছিল। হঠাৎ রান্নাঘরের ছাতের উপর দুটো বেড়ালের কানফাটানো দ্বৈতকণ্ঠ শোনা গেল। তার পর আরম্ভ হল খামচাখামচি, দাঁত মুখ খিঁচিয়ে তীক্ষ্ণ গোঙরানোর শব্দ এবং সর্বশেষে পা হড়কে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল ছাদের সঙ্গে ঠেকনা দেওয়া তক্তার ডাই পিছলে গোটা দু-ত্তিন বেড়াল।
চল শুতে যাই–অতিশয় ক্লান্তির আবেশে রাগ ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল কাতেরিনা। শায়িত অবস্থায় সেই সামান্য শেমিজ আর সাদা সায়া তার পরনে ছিল, সেই বেশেই গণ্যমান্য সদাগর-বাড়ির আঙিনার উপর দিয়ে সে চলল। সেখানে তখন মরা-বাড়ির নিশ্চলতা আর নৈস্তব্ধ। সেরগেই রাগ, আর কাতেরিনার খেলা-ভরে ছুঁড়ে-ফেলে-দেওয়া ব্লাউজ নিয়ে পিছনে পিছনে চলল।
.
০৭.
কাপড়-জামার শেষ রত্তিটুকু ছেড়ে ফেলে, মোমবাতি নিভিয়ে দিয়ে পালকের তুলতুলে বিছানাতে শুতে না শুতে কাতেরিনা সুষুপ্তি-গহ্বরে সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেল। দিনভর ক্রীড়াকৌতুক আর উল্লাসরস এতই আকণ্ঠ পান করেছিল যে, সে এখন এমনই গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন হল যে তার পা যেন ঘুমিয়ে পড়ল, হাতও যেন ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু ঘুমের ভিতর দিয়েও সে পরিষ্কার দরজা খোলার শব্দ শুনতে পেল এবং সেই আগের দিনের চেনা বেড়ালটা দুম্ করে তার বিছানায় পড়ল।
বেড়ালটার এখানে আগমনের ব্যাপারটা আসলে তবে কী?– ক্লান্ত কাতেরিনা আপন মনে যুক্তিতর্ক করতে লাগল। আমি দোরের চাবি নিজেই লাগিয়েছি– বেশ ভেবে-চিন্তে বিবেচনা করেই আর জানালাটাও বন্ধ। তবু দেখি সেটা আবার এসে জুটেছে। দাঁড়াও, আমি ওটাকে এই মুহূর্তেই বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেব। কাতেরিনা উঠতে যাচ্ছিল কিন্তু তার হাত-পা যেন তার বশে নেই; ইতোমধ্যে বেড়ালটা তার শরীরের উপর দিয়ে সর্বত্র হাঁটাহাঁটি লাগিয়ে দিয়েছে। এবং তার গলার গরুর গরু, এমনই আশ্চর্য রকমের যে, সে যেন মানুষের গলায় কথা কইছিল। কাতেরিনার মনে হচ্ছিল যেন একপাল ক্ষুদে ক্ষুদে পিঁপড়ে তার সর্বশরীরের উপর দিয়ে ছুটোছুটি লাগিয়েছে।
কাতেরিনা মনস্থির করে বলল, নাহ, কালই আমাকে বিছানার উপর মঙ্গলজল ছিটোতে হবে– এছাড়া আর কোনও গতি নেই যেভাবে বেড়ালটা ভূতের মতো আমার পিছনে লেগেছে তার থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এটা তাজ্জব ধরনের বেড়াল।
ওদিকে বেড়ালটার সোহাগের গরুর গরুর একদম তার কান পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে। বোচা নাকটা তার শরীরের উপর চেপে দিয়ে বেড়ালটা বলে উঠল, আচ্ছা, আমি কোন ধরনের বেড়াল সেই কথাটা ভাবছ না? কিন্তু এ সন্দেহে তুমি এলে কিসের থেকে? সত্যি, তুমি কী অসম্ভব চালাক মেয়ে, কাতেরিনা ভ; ঠিক ঠিক ধরে ফেলেছ আমি আদপেই বেড়াল নই, কারণ আমি আসলে আর কেউ না, আমি হচ্ছি সেই বিখ্যাত সম্মানিত সদাগর বরিস। তিমোতেই। অবশ্য এটা হক কথা যে, ঠিক এই মুহূর্তেই আমি খুব বহাল তবিয়তে নেই– কারণ আমার ছেলের বউ আমাকে যেসব খাসা খানা খাইয়ে আমার সেবা করেছে তারই চোটে আমার নাড়িভুড়ি ফেটে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে। তাই হয়েছে কী–বেড়ালটা সোহাগের গরুর গরুর করে যেতে লাগল– আমি বড় কুঁকড়ে-সুকড়ে গিয়ে এখন শুধু হুলো বেড়াল হয়ে, যারা আমাকে সত্যি সত্যি জানে আমি কে, তাদের সামনেই আত্মপ্রকাশ করতে পারি। তা যেন হল; আচ্ছা, আপনি এখন আপন বাড়িতে কীরকম আছেন, কী করছেন, কাতেরিনা লভভূনা? আপ্তবাক্যের সবকটি বিধি*[* অন্যতম বিধি ব্যভিচার করবে না।] আপনি কি ভক্তিভরে পালন করে যাচ্ছেন? আমি সুচিন্তিত উদ্দেশ্য নিয়েই গোরস্তান থেকে এখানে এসেছি সুদ্ধমাত্র দেখতে আপনি আর সেরগেই ফিলিপি আপনার স্বামীর বিছানাটাতে কীরকম ওঁম লাগাচ্ছেন। কিন্তু এখন তো আমি আর কিছু দেখতে পারিনে। আপনি খামোখা অত ভরাচ্ছেন কেন; ব্যাপারটা হয়েছে কী, আপনি যে আমায় ফিস্টিটা খাইয়ে জান্তর করে দিয়েছিলেন তারই ঠেলায় আমার আদরের পুতুল চোখ দুটি কোটর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে গেছে। আমার চোখদুটোর দিকে সোজাসুজি তাকাও, পরান আমার ভয় পেও না, মাইরি!
কাতেরিনা সত্য সত্যই তাকিয়েছিল– আর সঙ্গে সঙ্গে তারস্বরে চিৎকার করে উঠল। হুলো বেড়ালটা ফের তার আর সেরগেইয়ের মাঝখানে শুয়ে পড়েছে, আর তার মাথাটার জায়গায় বরিস তিমোতেইচের মাথা। ঠিক তারই মাথার মতো বিরাট আকারের মাথা। আর দুটি কোটরে চোখের বদলে আগুনের দুটো চাকা ঘুরছে আর পাক খাচ্ছে, পাক খাচ্ছে আর ঘুরছে– যেদিকে যেমন খুশি!