এই জপক্রিয়া কেন করা হয় জিজ্ঞাসা করেছিলাম দয়াল খ্যাপাকেই।
বললেন, কাম-বীজ ও কাম-গায়ত্রী জপে সাধক-সাধিকার শরীর রাধাকৃষ্ণ হয়ে যায়।
জিজ্ঞাসা করলাম, কী এই মন্ত্র?
বললেন, কাম বীজ ক্লীং। ক্লীং কামদেবায় বিদ্যুহে পুষ্পবাণায় ধীমহি তন্নো কৃষ্ণ প্রচোদ্দয়াৎ।
-এগুলো কী?
—এগুলো সব কৃষ্ণবীজ। শরীরে কৃষ্ণ জাগানো। কৃষ্ণই চৈতন্য। তার বীজমন্ত্র হল : ক্লীং কৃষ্ণচৈতন্যায় নমঃ। রাধা হতে হয় সাধিকাকে। সেই ভাবাশ্রয়ের জন্য তাকে আবার রাধার বীজমন্ত্র জপতে হয়।
—কী এই মন্ত্র?
বললেন, ওঁ শ্রীং হ্রীং রীং রাধিকায়ে স্বাহা। আর রাধিকারও গায়ত্রী মন্ত্র আছে। তা হল : স্লীং রাধিকায়ৈ বিস্মহে প্রেমরূপায় ধীমহি তন্নো রাধে প্রচোদয়াৎ।
বললাম, এইসব মন্ত্র জপের অর্থ কী?
—সারাৎসার একটাই রক্ষা পাওয়া।
—কীসের থেকে রক্ষা?
—কামের থেকে। বীজমন্ত্র জপে করণক্রিয়ায় সাধকের বস্তুবীজ রক্ষা যেমন কাজ, তেমনই সাধিকার কাজও একই।
জিজ্ঞাসা করলাম, সাধিকা তো আর বস্তু ধরেন না?
-ধরবেন না কেন?
–ধরেন!
-হ্যাঁ তারও যে রাধাবিন্দু আছে। ধরতে হবে না তাকে? তিনি তো সেই রজবস্তুকে সহস্ৰারে আটকে রাখেন না। নামিয়ে আনেন মূলধারে। যোনিতে।
বললাম, তাহলে আর সাধিকা বিন্দু ধরলেন কই। বাউলনির বস্তুরক্ষা হল আর কই!
বললেন, হল না? বলেন কী!
-কীভাবে হল শুনি?
—এ যে একেবারে পরিষ্কার। রজবস্তুর স্থিরতা ধরছেন সঙ্গিনী। সেই স্থিরতা তিনি রাখতে পারছেন বলেই তো সাধক সেই নদী বা সরোবরে উলটা স্রোতে নৌকা বাইতে পারছেন। অটল হচ্ছেন তিনি।
—আর সাধিকা?
-তিনিও অটল। রজবস্তুকে স্থির করে দিয়ে। এই স্থিরতা এলেই তো উলটা স্রোতে নৌকা বেয়ে সাধক আর সঙ্গিনী দুজনেই জেন্তে মরা হয়ে ওঠেন। এই মরণেই তো জীবন আসে। সহজ মানুষের জীবন।
সেই জীবনের জন্য বিন্দুধারণের ব্যাবহারিক শিক্ষাটাই জানতে আমি বহু আখড়া ও আশ্রম ঘুরেছি। শিক্ষান্তে সাধকের অনুভূতিও কেউ কেউ আমাকে বলেছেন বিক্ষিপ্তভাবে। তবে তারই ভেতর প্রথম সাধক থেকে সিদ্ধ স্তরে ওঠা তুষার খ্যাপার মুগ্ধ অমৃতের সেই আত্মার সঙ্গে বিশ্বের নিগুঢ় সত্যের এক কুলপ্লাবী বাচনভঙ্গি, অনুভূতিশৈলী আমাকে সবথেকে মুগ্ধ করেছে। এক নৈসর্গিক পরিবেশের ভেতর দাঁড়িয়ে খ্যাপা আমায় সে সব জানিয়েছিলেন—যা আমার বোধ ও ব্যাপ্তিকে নাড়িয়ে তুলেছিল বেশ অনেকখানি। সেই স্মৃতিকথাতেই আমি এবার ফিরে যেতে চাই।
.
অজয়ের বুকে ভারী হাওয়া উঠছিল সেদিন বিকেলবেলা। জয়দেবের গমগম তখন আর নেই। ভাঙা মেলার স্মারক চারিদিকে ছড়িয়ে। তারই ভেতর নেশার প্রথম আবেশ পড়েছে তুষার খ্যাপার মনে। আমার হাতে কলকে ধরিয়ে দিয়ে খ্যাপা তখন বোধহয় আমারই জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজে চলছে। আমি বেশ বুঝতে পারছি। খ্যাপা অতলে ডুব দিচ্ছে আর গাঁজার জটা থেকে বীজ ছাড়িয়ে আরও
একপ্রস্থ নেশার প্রস্তুতিটাও সেরে রাখছে। একতারা তখন তার সঙ্গিনী হয়ে বালিতটের ওপর বসে। তুষার খ্যাপার পাশেই স্থান হয়েছে তার। দু-টান হয়ে গেছে আমার। বাউল আমাকে পেয়েছে তখন সহচরের ভূমিকায়। সে আমাকে বলছে, খ্যাপা নিকটজনের কাছেই তো নিকটকথা বলা যায়। আর এ অতি গুহ্যকথা। যত্রতত্র কওয়াও যায় না। তার ওপর গুরুর বারণ। তা তোমারে তো খ্যাপা কওয়া যায়। জানবারও তোমার অমন আগ্রহ। বহুবার বহুভাবে তুমি জানতে-বুঝতে চেয়েছ। বলিনি। এড়িয়ে গেছি আমি। একদিন গুরুই কইলেন, তুষার তুমি খ্যাপারে কইতে পারো। ও এ লাইনের আপনার জন। মনের মানুষ। তা খ্যাপা, মনের মনিষ্যিরে মনের কথা কইবারও তো পরিবেশ লাগে। আজ সেই উত্তম পরিবেশ। মেলার হাঁ নেই। গিলে নেবারও কেউ নেই। শুধু আমি আর আমার সামনে আমাদের মনের মানুষ।
বললাম, তোমার গুরুপাট নিয়ে বলো তুষার।
-বলব খ্যাপা, আজ সবই বলব আমি তোমারে। এতে যদি তোমার নেকার উপকার হয়।
-তোমার সাধনগুরু কীভাবে খুঁজে পেলে তুষার? আর সাধনসঙ্গিনী? তার সঙ্গেও তো তোমার একযুগ হয়ে গেল সাধনার। নাকি?
-হ্যাঁ খ্যাপা। বারোটা বছর আমরা একসাথে। মেলায়-আখড়ায়-আশ্রমে আমাদের তফাত নেই। এই যে এখন সারদা নেই পাশে, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন ও বসি রয়েছে। দেখেন খ্যাপা, একতারাখানা কেমন চুড়ো করে সুতলি বাঁধা রয়েছে। দেখি মনে হচ্ছে সারদা যেন চুল ছাড়ি বসি রয়িছে।
—তা সারদার দেখা কি তোমার স্মরণজিৎ খ্যাপার আশ্রমেই?
–গুরু আমার ছিল মাধব গোঁসাই। পাটুলির বড়ো আশ্রমের মাধব গোঁসাই।
–তাহলে তুমি প্রথমে বৈষ্ণব মতে ছিলে?
–হ্যাঁ খ্যাপা। অগ্রদ্বীপে গিয়ে গানপাগল হলাম আমি। শুরুর আখড়া হয় ওখানে প্রতি বছর। বার দুই গেছি। গুরু আমার গানে যেন শরীরখানা কাপায়ে দিতেন। বলতেন, শরীরখান তৈয়ারি করে নে। সময় থাকতে সাধন কর। তা এই গুরুর সন্ধানে গেলাম নৈহাটি। সাহেব কলোনিতেই তার মস্ত আশ্রম। দালানকোঠা। তোমায় আর বলছি কী এ কথা। তুমি তো জানো সব সেখানকার শ্ৰী।
-তোমার সঙ্গে সারদার তো ওখানেই আলাপ তুষার।
-তা গুরুর আশ্রমে যাতায়াত শুরু করলাম। গান শিখতে লাগলাম আমি। একদিন গুরুই বললেন, শুধু শিখলে হবে! সাধনে আয় তুই। তোর লক্ষণ ভালো।
দরাজ গলায় আরও সুর খেলবে যদি দম ধরতে পারিস। শাসের খেলা দমের খেলা না জানলে বাউল হবি ক্যামনে?