–শ্রীকৃষ্ণকে মানেন আপনারা?
—আমাদের মানা জাগতিক। সকলের মানাই আসলে তাই।
বললাম, বলাই তো হয় ভগবান জগন্ময়।
–যাঁরা কৃষ্ণরে দেবতা বলেন, দেখবেন যে তারাও শাস্ত্র মানেন। চৈতন্যচরিতামৃত আওড়ান।
-সেটা তো স্বাভাবিকই। বৈষ্ণবীয় আকরই তো ওটা।
–ওখানেই যে বাবা স্পষ্ট লেখা কৃষ্ণ মনুষ্যশরীর।
বিস্মিত হয়েই এবার বললাম, কোথায়! কীভাবে!
দয়াল খ্যাপা বললেন, ভালো করে খেয়াল করবেন বাবা। সেখানে স্পষ্ট বলা রয়েছে, কৃষ্ণের যতেক লীলা, সর্বোত্তম নরলীলা, নরবপু কৃষ্ণের স্বভাব। তাহলে কী দাঁড়াল বাবা, কৃষ্ণ মনুষ্যময়। বাউল সেই মনুষ্যরে মানে।
বললাম, বাউল কৃষ্ণ হলে সঙ্গিনী রাধা।
—তাই তো হয়। রাধাকৃষ্ণ তো আসলে যুগলতত্ত্ব। যে তত্ত্ব স্পষ্ট বলে সাধন করো কিন্তু সাধনে কাম বাদ দাও। কামকে বাদ দিতেই তো পঞ্চবাণের ছিলা। রাধা বলে, আমি প্রেমময়ী। বাউল সেই প্রেমকে বিশ্বাস করে যুগল সাধনে মনের মানুষকে পেতে চায়।
–বাউল কি একা পায় তা?
–একা কেন পাবে! যুগল না হলে মনের মানুষ পাবে কেমনে! কৃষ্ণরাধা তাই সাধন প্রতীক। বাউল তাই মানে। সেজন্য সে রাধার কাম নাশ করে। শুরু সাধককে কৃষ্ণ করেন। সাধক কৃষ্ণ হয়ে সাধিকারে রাধা করে নেয়। সঙ্গিনী তখনই প্রেমময়ী রাধা হয়। তার কোনো সন্তান নেই। কাম নেই। আছে কেবল প্রেমতত্ত্ব। আর এই প্রেমতত্ত্বে যেতে হলে পঞ্চবাণের ছিলা কেটেই যেতে হবে বাবা। না হলে সেখানে যাওয়ার আর কোনো উপায় নেই।
পঞ্চবাণের প্রথম যেটি মদন, বাউল বলেন সেটি কামরতির প্রথম সিঁড়ি। এই সিঁড়ি তিনি টপকে যান কীভাবে? অমাবস্যায় প্রথম মিলনে সঙ্গিনীর দেহের
স্পর্শকাতর প্রত্যঙ্গগুলোকে তিনি স্পর্শ করে সঙ্গিনীর শরীরের কামের বাণকে আরও শানিয়ে নেন। উত্তেজনা বৃদ্ধি করে দেন সঙ্গিনীর শরীরে। এই স্পর্শ হয় করনখে, পদনখে, গলায়, অধরে, জিহ্বায় আর ললাটে। বাউল বলেন সাড়ে চব্বিশ চন্দ্ৰস্পৰ্শর কথা। করনখে দশ, পদনখে দশ, দুই গলায় দুই, অধরে এক, জিহ্বায় এক, ললাটে দেড়। এই হল গিয়ে সাড়ে চব্বিশ চন্দ্ৰস্পৰ্শর প্রত্যঙ্গ-হদিস। মূলত দৃষ্টিস্পর্শর কথা তারা বলে থাকেন। কীভাবে হয়ে থাকে এই চক্ষুস্পর্শ। আমাদের শরীরস্থ সুষুম্ন নাড়ি মূলাধার চক্র থেকে উৎপন্ন হয়ে নাভিমণ্ডলের যে ডিম্বাকৃতি নাড়িচক্র আছে, তার ঠিক মাঝখান দিয়ে উঠে গিয়ে সহস্রার চক্রের ব্রহ্মরন্ধ পর্যন্ত চলে গিয়েছে। সুষুম্না নাড়ির বাঁ দিকে রয়েছে ইড়া নাড়ি। দক্ষিণ বা ডান দিকে রয়েছে পিঙ্গলা নাড়ি। এই দুই নাড়ি দু-দিক থেকে উঠে স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত ও বিশুদ্ধ চক্রকে ধনুকাকারে বেষ্টন করে আছে। ইড়া দক্ষিণ নাসাপুট পর্যন্ত এবং পিঙ্গলা বাম নাসাপুট পর্যন্ত গমন করেছে। মেরুদণ্ডের মধ্যে দিয়ে সুষম্না নাড়ি ও মেরুদণ্ডের বাইরে দিয়ে পিঙ্গলা নাড়ি চলে গেছে। বাউল সাধক দক্ষিণের পিঙ্গলা নাড়িতে কিছু সময় নিশ্বাস-প্রশ্বাস প্রবাহিত করে দক্ষিণ চোখে দৃষ্টিকে নিবদ্ধ করে রাখেন। মদনবাণের সময় ইড়া নাড়িতে (বাঁ নাকে) শাসগ্রহণ করে মাদনবাণের সময় পিঙ্গলাতে নিয়ে যান। মাদনের সময় ডান বা দক্ষিণ নাকে শাসগ্রহণ করে সঙ্গিনীর শরীরে উত্তেজনা বৃদ্ধি করেন। বাউলের কাছে ‘বাম’ ও ‘দক্ষিণ’ শব্দদুটি বিশেষ অর্থদ্যোতক। কারণ হল বাম দিকে চন্দ্র নাড়ি-বলা হয় একে ইড়ার সাম্যাবস্থা আর ডান দিকে বাউলের সূর্য নাড়ি-পিঙ্গলারই চাঞ্চল্যকর দশা। যোগশাস্ত্র এরকম ব্যক্ত করেছে। দক্ষিণ বা ডানের দিককে বাউল বলেন কামের অবস্থা। সেজন্য তারা দক্ষিণকে পরিত্যাগ করেন। তবে শুধু বাউল কেন, সহজিয়া বৈষ্ণবরাও যুগল সাধনে তাই-ই মানেন। এ বিষয়ে তো চণ্ডীদাসেরও নিষেধনামা আছে : দক্ষিণ দিগেতে কদাচ না যাবে। যাইলে প্রমাদ হবে। মদন-মাদন যে বাম ও দক্ষিণনেত্রে অবস্থিত চণ্ডীদাস তার কথাও উল্লেখ করেছেন পদে। লিখেছেন :’মদন বৈসে বাম নয়নে। মাদন বৈসে দক্ষিণ কোণে।‘ তৃতীয় বাণ শোষণ বাণ। শোষণ বাণের সময় বাউল যোগাভ্যাসের ক্রিয়াকে চালিত করেন। লিঙ্গনালে উত্থিত শুক্র বা বীর্যকে তারা ঠেকিয়ে রাখেন। স্তম্ভন বাণে যুগল শরীরেই একটা স্থিরতা আসে। শ্বসাদির কাজ কিন্তু কিছুটা বাউলসঙ্গিনীও করে থাকেন। বিশেষত কুম্ভক প্রক্রিয়া। স্তম্ভন বাণের সময়ই দেহের বিভিন্ন স্পর্শকাতর অংশ স্থির চঞ্চল হয়ে পড়ে। সাধক তখন চরম দশায় উত্তীর্ণ হয়ে যান। সম্মোহনের সময় তাদের দেহস্মৃতি লুপ্ত হয়। বাহ্য দেহে বিপুল আনন্দের তরঙ্গ উত্থিত হয়ে পড়ে। এরপরই তারা বলেন পরমাত্মার বিকাশ ঘটে। নাভিপদ্ম থেকে হৃদয়পদ্মে এই অনুভূতির জাগরণ ঘটে। এতে তারা নানা সুমধুর ধ্বনি শুনে থাকেন। পরিশেষে চরম পরিণতি আসে তখন আজ্ঞা চক্রের দ্বিদলপদ্মে তারা মনের মানুষকে উপলব্ধ করেন।
এখন প্রশ্ন বাণক্রিয়া যদি শুধু চক্ষুস্পর্শেরই হবে তবে স্তম্ভন বাণের সময় দেহ স্থির চঞ্চল হয়ে পড়ছে কেন? যেটা মনে হয় চন্দ্ৰস্পর্শ, অষ্টমচন্দ্ৰস্পৰ্শ এগুলো কোনোটাই আসলে চক্ষুস্পর্শ নয়, প্রত্যঙ্গকে প্রত্যক্ষ ছোঁয়া। মদনবাণের সময়ই তা শুরু হয়ে যায়। শ্বাসক্রিয়া দিয়ে সাধক সঙ্গিনীর অঙ্গ স্পর্শ করেন আর সঙ্গিনীও শাসাদির কাজে সাধকের অঙ্গকে নিজ শরীরে একীভূত করে নেন। কামশাস্ত্র মিলনক্রিয়ার সময় চারপ্রকার আলিঙ্গনের কথা বলেছে। সঙ্গিনী সঙ্গীর দিকে আসতে থাকলে যদি তাকে আলিঙ্গন করা সম্ভব না হয়, অথচ সঙ্গিনীকে সঙ্গীর অনুরাগ জানানোর প্রবল ইচ্ছে তখন সঙ্গী অন্য কোনো কাজ করবার ছলে, বুদ্ধি করে সঙ্গিনীর পাশ দিয়ে যেতে যেতে তার শরীরে নিজের শরীর স্পর্শ করবে। একে সৃষ্টক আলিঙ্গন (Slight Contact) বলে। সঙ্গী কোনো নির্জন স্থানে থাকলে তাকে সেই অবস্থায় দেখে সঙ্গিনী যদি কিছু নেওয়ার ছলে সেখানে গিয়ে স্তন দিয়ে সঙ্গীকে আঘাত করে তখন সঙ্গী সঙ্গিনীকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে যদি নিজের শরীরে চেপে রাখে সেটা বিদ্ধক আলিঙ্গন (Breast Pressure Embrace)। অন্ধকার জায়গাতে সঙ্গিনীর শরীরের সঙ্গে সঙ্গীর শরীরের যে মিলন চলে সেটা উদ্ধৃষ্টক আলিঙ্গন (Huffing Embrace)। আর সঙ্গিনী এবং সঙ্গী যখন উদ্ধৃষ্টক আলিঙ্গনে আবদ্ধ অবস্থার কথা ভেবে একা একাই নিজের দু-হাত চেপে নিজেকে জড়িয়ে নেয় সেটা পীড়িত আলিঙ্গন (Pressive Rubbing Embrace)। কামশাস্ত্রে চুম্বনের সঙ্গে পাঁচটি ব্যাপারকে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে—চুম্বক, নখক্ষত, দক্ষত, প্ৰহণন ও শীৎকার। তবে কামশাস্ত্র কখনও মিলনক্রিয়ার সময় তিথি নির্দেশ করেনি। বাউল সাধনে মিলনসময় নির্ণীত। ইড়া নাড়িতে বা নাকে যখন শ্বাস চলে তখনই মিলনের প্রশস্ত সময় বলে থাকেন বাউল গুরু। এই সময়টা রাতে খাবার ঘণ্টা দুই পরে আসে বলে বাউল বলে থাকেন। এটিকে সাধক অর্ধপ্রহর হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন। সময়কাল তারা বলেন দেড় থেকে দুই ঘণ্টা স্থায়ী হয়। এই ক্রিয়ার আরম্ভের সময় প্রথম চলে আলাপন। পরস্পর স্পর্শ করে পরস্পরের প্রত্যঙ্গগুলোকে। তারপরই শুরু হয়ে যায় দমের খেলা। অনেক সাধক বলেন এইসময় কাম-বীজ জপ করতে হয়। আর সঙ্গিনীকে কাম-গায়ত্রী।