.
মদনমোহনের আশ্রমে বসে প্রবীণ সাধক দয়াল খ্যাপাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম দেহমিলনের যোগক্রিয়ার কথা।
বললেন, প্রথমে গুরু নাম দেন। গুরুমন্ত্র জপতেজপতেই শরীর সেই মন্ত্রভাবকে টেনে নেয়। ভাব এলেই ক্রিয়াকরণ শুরু হয়। চারচন্দ্র তো আগে থেকেই নিয়ম করে পালন করতে হয়।
বললাম, খুব জরুরি কি চারচন্দ্রের ক্রিয়া?
—অবশ্যই। চারচন্দ্র শরীরকে উপযোগী করে। দম ধরতে সাহায্য করে গিয়ে ওই চারচন্দ্র। এই আমার নীরোগ সুঠাম শরীর নিয়মিত চারচন্দ্র সাধনের ফল।
-আপনি কি এখনও ক্রিয়াযোগ করেন? মল, মূত্র শরীরে ফিরিয়ে নেন?
বললেন, রোজ নয়, তবে করণক্রিয়া একেবারে বাদ দিই না।
দয়াল খ্যাপাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বিন্দুর স্থিরতা কীভাবে রক্ষা করে থাকেন দেহসাধক?
বললেন, এ বিষয়ে তো বলে বোঝানো যাবে না বাবা। বিন্দুর স্থির দশার জন্যেই গুরু শিষ্যকে শ্বসনিয়ন্ত্রণ শেখান। এই ক্রিয়া আটবার, বত্রিশবার—এই করে-করে রপ্ত করে নিতে হয়। রেচক, পূরক, কুম্ভক করতে হয়। কুম্ভক নাড়ি শোধন করে দেয় বাবা। বিন্দুর স্থিরতা দেয় শরীরে।
-তাহলে আপনি বলতে চাইছেন যে, কুম্ভক যোগই বিন্দুধারণের স্থিরতা এনে দেয় শরীরে।
-হ্যাঁ বাবা। কুম্ভকক্রিয়াতেই এই শক্তি অর্জিত হয়। বায়ুর সাম্যতা যে কুম্ভকই ধরে রেখে দেয়। মূল সাধনা বাউলের ধরে রাখে কুম্ভকক্রিয়া।
—বাউলের সাধনা কি বিন্দুধারণের সাধনা?
—বিন্দু তো সহজানন্দ। বিন্দুরক্ষা না করলে সহজানন্দ আসবে কোথা থেকে বাবা? সহজানন্দে না এলে, সহজ না হলে মনের মানুষ সাধক পাবেই বা কেমন করে? আর এই মনের মানুষের সন্ধান দিতে পারে একমাত্র কুম্ভকযোগ।
জিজ্ঞাসা করলাম, তাহলে, রেচক, পূরকের কোনো অবদানই নেই?
—কেন থাকবে না। এ যে পারস্পরিক যোগ। প্রথমে যেটা করতে হয় শরীরের বাইরের বায়ুকে বাঁ নাকে টেনে নিতে হয়। প্রাণ বায়ু এতে শরীরের ভেতর প্রবেশ করে গেল। আর এই যে বা নাক দিয়ে বায়ুকে শরীরের ভেতর আনা হল, এই আনবার পরই খেলা শুরু।
-কীরকম!
-শুধু আনলে হবে, কাজে লাগাতে হবে না বাতাসকে। এনে রোধ করে রাখতে হবে সম্পূর্ণ বাতাস। তখনই গুরুমন্ত্র জপ চলবে। এই জপ চৌষট্টিবার করতে-করতে কুম্ভক করে নিতে হবে।
বললাম, কুম্ভক তো এমনিতেই হয়ে যাচ্ছে। আলাদা করে কী আর কুম্ভক হবে। বায়ু আটকানো মানেই তো কুম্ভক।
—সবই বুঝলাম বাবা। তবে শুধু আটকালে হবে। জমা বায়ু ডান নাকে টেনে কিছুসময় রেখে দিয়ে আবার বাঁ নাকেই ত্যাগ করতে হবে। ডান নাক থেকে বায়ু যখন ভোলা হবে তখনই মন্ত্র জপ চলবে বত্রিশবার। এই জপের ভেতরেই রেচক করে নিতে হবে। বায়ু আটকানোটাই আসল। যে যত বেশি সময় বায়ু আটকাতে পারবে তার বাণক্রিয়া তত ভালো হবে। কুম্ভক শক্তির উপরেই বাণক্রিয়া নির্ভর করে।
-পঞ্চবাণের কথা বলছেন আপনি?
-হাঁ বাবা। পঞ্চবাণের ছিলা কাটাই তো আসল কাজ। মদন, মাদন, শোষণ, স্তম্ভন, সম্মোহনের ভেতর দিয়ে যেতেই তো সাধক তার সঙ্গিনীর শরীরের বাণগুলো সব কেটে নাশ করে দেবে।
বললাম, সে তো লালনের গানেই আছে : পঞ্চবাণের ছিলা কেটে / প্রেম যজ স্বরূপের হাটে, / সিরাজসাঁই বসে রে, লালন, / বৈদিক বাণে করিস নে রণ, / বাণ হারায়ে পড়বি তখন রণ-খোলাতে হুবড়ি খেয়ে।
–সার কথা বললে বাবা। কিন্তু কথা হচ্ছে যত সহজে বললে বাস্তবে যে তা অত সহজ নয়। এ তো আর দেহমিলন নয় যে, আলিঙ্গন, চুম্বন ইত্যাদি দিয়ে দুই শরীরকে উত্তেজক করে নেওয়া।
-আপনাদের পঞ্চবাণের খেলাতে কি এইসব আলিঙ্গন, চুম্বন, নখক্ষত, দক্ষত নেই তাহলে?
—তুমি ভুল করছ বাবা। ওসব করণকৌশল কামের। দেহমিলনে ওসব আসে বাবা।
—আপনাদের মিলন তবে দেহমিলন নয়?
–না নয়। দেহমিলনের সময় কামই কামের একান্ত পরিণাম। ওই যে বৈদিক বাণ, লালনের জন্য রাখা সিরাজ সাঁইয়ের সাবধানবাণী, সেই বাণীকে মান্য দিয়েই গুরুগোঁসাই শেখান বৈদিক বাণকে নাশ করা। এটাই বাউল সাধনা।
জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি তাহলে বলতে চাইছেন আপনাদের মধ্যে দৈহিক মিলনে রিপুর উত্তেজনা থাকে না?
—উত্তজনা থাকে সঙ্গিনীর শরীরে।
—সঙ্গীর শরীর তবে কামহীন?
—মিলনের আগেই গুরু তা করে দেন।
–সঙ্গিনীর শরীরকে কেন কামহীন করে নেন না গুরু?
-সঙ্গিনী মাধ্যম বাবা। সঙ্গিনীর মধ্য দিয়েই যে সাধককে এগোতে হবে এই প্রেমের খেলাতে। তার শরীরের সমস্ত কামকে প্রেমে রূপান্তরিত করে নেওয়াই তো বাউলের সাধনা।
বললাম, এই একই কাজটা সঙ্গিনী করতে পারেন না?
বললেন, বুঝেছি। তুমি বাবা বিপরীত বিহারে নিয়ে যেতে চাইছ। নারীকে আমরা যে উচ্চাসন দিই। সাধনার দুই পদ্ধতি। এক, প্রথমে ধরতে হয় গুরুর চরণ। তারপরই…
বললাম, তারপরই দুই, মেয়ের চরণ?
—ঠিক।
—তা নয় হল। কিন্তু কী করে আপনারা মেয়ের চরণ ধরছেন? মেয়েকে তো ব্যবহার করছেন।
—এ কী কথা হল! মেয়ে পরমানন্দের শক্তি।
–তাহলে সেই শক্তিকে কি আপনারা ব্যবহার করছেন না?
—একেবারেই নয়। মেয়ের শরীরের কামশক্তিকে প্রেমশক্তিতে এনে দিচ্ছি। আপনাদের নারীর হল কাম প্রবর্তিত দেহ। তাই সেখানে সন্তান উৎপাদন হয়। আমাদের নারী প্রেমময়ী, তার সন্তান হবে না। বাউল সাধনায় সন্তানধারণ নিষিদ্ধ, শ্রীকৃষ্ণ শ্রীরাধাকে তো তার সন্তান দেননি।