বললাম, এসব তো সাধনপথের অনুশাসন।
-ঝাঁটা মারি ওসব অনুশাসনের মুখে। সব ভাঁওতাবাজি বুঝলে। যাঁরা বানিয়েছিলেন সাধুগুরু সব আর এরা তার কদর করবে! ক-জন বিন্দু ধরতে পারে শুনি? সবেরেই তো পাত হয়। সব জানা হয়ে গেছে আমার। শুধু গোঁসাইঠাকুর সেজে মশকরা করতে পারে ওরা।
সুমিত্রা বলেছিল, বুঝলে, আসল হল পেট।
বলেছিলাম, তাহলে সাধনে এলে কেন? অন্য কিছু করে তোত পেট চালাতে পারতে।
–এসেছি কি আর সাধে ভাই। নিয়তি এনেছে। এসে দেখলাম গড়ের মাঠ। পাই পাঁই দৌড়াচ্ছে সব। নামের লোভে, টাকার লোভে। আর সেই লোভে মরছে মেয়েগুলো সব। ভাগ্যিস গানটা শিখেছিলাম দাঁতে দাঁত মেরে, না হলে বলল এই সমাজ ছেড়ে বের হয়ে সমাজকে দাপট দেখাতে পারতাম?
এক অর্থে সুমিত্রা ঠিকই বলেছে। সবাই পারে না। সকলের মনোবল সমান নয়। মিনতি পারেনি। শেফালি নতুন সাধনসঙ্গী খুঁজে নিয়েছে।
জয়দেবের মেলায় দেখা হয়েছিল ওর অসহায়তার কথা শোনার পরের বছরই। পাশে একজন যুবক বাউল। আমাকে দেখেই বলল, দাদা ভালো?
বললাম, ভালো। তুমি?
–আমি আবার সাধনে এলাম দাদা। গুরুই সঙ্গী জুটিয়ে দিলেন। দেখুন কেমন ডাগর সঙ্গী আমার।
দেখেছি যুবক বাউল একতারা হাতে শেফালির পাশে দাঁড়িয়ে। পথঘাট, গান, সাধনা বুঝে সে যে একদিন সরে পড়বে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? তখন শেফালির কী হবে? কী আর হবে? বাদবাকি শেফালিদের যা হয় ওরও তাই হবে। সুষমারও যা হয়েছে। আর এদের মাঝেই আর এক দল। যাদের সাহসিকা ছাড়া কী আর বলতে পারি আমরা? যারা আত্মমর্যাদাকে উপলব্ধি করতে পেরেছেন, নিজেকে জানতে পেরেছেন। প্রকৃত বাউল সাধনা তো এই জানাকেই উসকে তোলে। আজকের অনেক নারী তাই নিজেকে জেনেই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছেন। এতে করেই কিন্তু বাউল সমাজের অচলায়তন ভাঙছে। টলে যাচ্ছে ভিত। তাতেই গুরু-মায়েদের পাশাপাশি সাধক শুরুও ফুঁসে উঠছেন। কেননা তাদেরও যে মান্যিগণ্যি কমে আসছে ক্রমশই।
বাউলরা বিশ্বাস করেন, মানবশরীরের ভেতরই পরমেশ্বরের সিংহাসন পাতা। তাকে লাভ করাই সাধকজীবনের মোক্ষ। কীভাবে তা সম্ভব? গুরুর শেখানো দম ও শ্বাসের কাজে-হঠযোগ, কুম্ভক, পূরকে, রেচকে বীর্যের নিম্নগতিকে তারা রুদ্ধ করে দেন। ওপরে উঠিয়ে নিতে পারেন তারা। বীর্য নারীর যোনিতে রমণের পর চিহ্নরূপ লেগে থাকবে না। রীতিমতো সেখানে যোনি পরীক্ষার নিয়ম। দুটো শব্দ বাউল ব্যবহার করেন। ‘বিন্দুধারণ’ আর ‘বিন্দুপতন’। তার মানে হল বীর্যের গতিবেগকে ওপরে উঠিয়ে নেওয়া হল বিন্দুধারণ। পতন হল বাউল বলেন-’যোনিতে পতন। মানে রমণে বীর্যপাত হয়ে যাওয়া। এই মিলন হয় সঙ্গিনীর রজঃস্রাবের তিন-তিনটে দিন। বাউল বলেন এই এর উৎকৃষ্ট সময়। এই তিনদিন তারা কামকে এই প্রক্রিয়ায় শুদ্ধ করে, তাদের মতে প্রেমে রূপান্তরিত করেন। মেয়েদের রজঃস্রাবের তিন-তিনটি দিন বাউলের ভাষায় ‘মহাযোগের সময়’ ঠিকঠাক উত্তীর্ণতায় বাউল সিদ্ধ স্তরে পৌঁছান। তারা বলেন নারীশরীরের মধ্যে ষড়দল, চতুর্দল, শতদল পদ্ম আছে। সে সব জেনে বুঝে তারপর হবে ‘জেন্তে মরা’। ‘জেন্তে মরা’ হল কাম থেকে প্রেমে নিষ্কামী হওয়া।
কথা হচ্ছে, নারীশরীরের মধ্যে যে ষড়দল, চতুর্দল, শতদল পদ্মের কথা বাউল বলেন তা শুধু নারীশরীর কেন, পুরুষ তথা মানবশরীরেও বর্তমান। তবে বাউল সাধক শুধু নারী শরীরে থাকবার কথা বলছেন কেন? শরীরের ছটা চক্রে এইসব পদ্মরূপের কল্পনা রয়েছে। কারণ হল পদ্ম কাদায়, পাকে জন্মায়, কিন্তু নিজে পঙ্কিল হয় না। কাদার উপরে সুন্দর ফুল হিসেবে ফুটে থাকে। এই কাদা বা পাক হল প্রতীকী অর্থে মায়া। এই মায়াকে ভেদ করে পদ্মফুল ফুটছে। পদ্ম সূর্যের আলো পেলেই তার পাপড়ি খোলে। তেমনই আমাদের শরীরের পদ্মগুলো তাদের দল খোলে কুণ্ডলিনীশক্তি জেগে উঠলে। সূর্যের আলো থাকা সত্ত্বেও যদি পদ্মের উপর জল ছিটিয়ে দেওয়া হয় তবে দেখা যাবে পাপড়িগুলো সব মুড়ে যাচ্ছে। সাধক বলছেন মানুষকে হতে হবে এই জলের উপরে ফোটা পদ্মের মতো। পদ্মের পাপড়িগুলো যেমন গায়ে জল পড়লে গুটিয়ে যায়, তেমনই ইন্দ্রিয়ের আচরণগুলোও বন্ধ হয়ে যেতে পারে বিরূপ আচরণে। যার জন্যই যোগক্রিয়ায়, সংযমে তাকে জাগিয়ে রাখতে বলছেন সাধক। যোগীতস্ত্রগুলো আমাদের সেই পথেই নির্দেশিত করছে বারবার। যোগীগুরু, তন্ত্রসাধকরা এইসব পদ্মে ধ্যানমগ্ন হয়েই পড়েন। মানে শরীরক্রিয়ায় শরীরকে জাগান। উপাসনা করেন। বাউল নারীর শরীরে এই পদ্ম, ওই পদ্ম আছে বলে সাধনসঙ্গিনীকে মনে হয় উচ্চাসনই দিতে চান। কিন্তু এটা তো ঠিক, লালন ফকির, চণ্ডীদাস গোঁসাই, হাউড়ে গোঁসাই, পদ্মলোচন, দুন্দুশাহ প্রভৃতি পদকর্তারা তাদের সব ক্রিয়াকরণের গানে নারীকে যে সম্মান প্রদান করেছেন সে সম্মান বাস্তবে নারীর বা সাধনসঙ্গিনীর এখন নেই। তার কারণ অবশ্যই পুরুষের, সঙ্গীর, সাধকের, ব্যভিচার। না হলে আমাদের লোকায়ত সাধন কিন্তু নারীকে যোগ্য আসনই দিয়েছিল। কী তন্ত্র, কী বৈষ্ণব, কী বাউল সাধনে। বাউল সঙ্গিনীটিকে ‘রাধারানি’, ‘মনের মানুষী’, ‘শক্তি’ ইত্যাদি বিশেষণের মালা পরান ঠিকই—যেমন তন্ত্রে ভৈরব সঙ্গিনীকে, ভৈরবীকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করেন। আসলে এই বিশ্লেষণ, সম্বোধন, মান্যতা, যথাযযাগ্য প্রাপ্য স্বীকৃতি সব ছিল প্রকৃত সাধকদের। বাউলের গানে মেয়েদের মান্যতার যে-সব পদ আমরা পাই তা কিন্তু এখনকার কারও রচনা নয়। বেশিরভাগটাই সাধক পদকর্তাদের। এখন কথা হচ্ছে এই সাধনক্রিয়া কীভাবে ঘটে থাকে আর সাধন-মিলনযোগে বাউলের কী প্রকারের অনুভূতি হয়? সে সম্পর্কে জানতে বুঝতে আমি মিলনযোগে শামিল অনেক বাউলের সঙ্গেই কথা বলেছিলাম। তাদের সঙ্গে টুকরো-টাকরা কথিকাগুলের এই প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ করে নেওয়া যেতেই পারে। তাহলে বাউল সাধনে বিন্দুসাধনার প্রেক্ষিতগুলো সব ধরতে বোধহয় সহজগম্য হবে।