আর এই মেয়ের চরণ ধরতে গিয়েই তো সাধনপথে যত বিপত্তি। নাবালিকা কন্যাকে গুরুপাঠে রেখে চলে যান মা। কিছুটা সাধন-বিশ্বাসে কিছুটা আবার অভাবে। আশ্রমে অন্তত মেয়ের ভাত-কাপড়ের অভাব হবে না। আর বাড়ন্ত শরীরে লোলুপ দৃষ্টিদানকারী পুরুষের উপদ্রব তো এখানে হবে না। তা ঠিক, প্রত্যন্ত গ্রামের বহু আশ্রম আমি দেখেছি যা গুরু-মা পরিচালিত। এসব আশ্রমে গুরু-মা ছোটো মেয়েদের শিক্ষাদীক্ষা দিয়ে তৈরি করতে থাকেন পরে যাতে বাউলদের হাতে তুলে দেওয়া যায়। আর মেয়েদের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে কত গুরু-মা যে অনেকটা সেই নিজের জীবনের মতোই নাবালিকা মেয়েগুলোকে খানিক সাবালকত্বে পৌঁছে দিয়ে চরম সর্বনাশের হাতে ঠেলে দেন তা তারা নিজেরাও জানেন। আসলে এইসব গুরু-মারা নিজেরাও তো খানিকটা অসহায়; পুরুষ সাধকের উদাসীনতার শিকার। তিনি তো নিজেই জানেন যাকে বা যাদেরকে তিনি শ্বাস আর দমের কাজ যত্নভরে শিখিয়ে সাধনার উপযোগী করে তুলছেন তারা সব একদিন তারই মতো অব্যবহৃতা, পরিত্যক্তা নারী হয়ে উঠবে। সাধক তাদের ছুঁয়েও দেখবেন না। তখন কেবল বাউলের পরিত্যক্তা নারী হয়ে নিঃসঙ্গ বৃদ্ধা বাউল সঙ্গিনী হয়ে পথে পথে মাধুকরী সম্বল করে কাটাতে হবে। এদের মধ্যে যারা কেবল একটু চালাকচতুর তারাই গুরু-মা সেজে সাধককে কবজা করে, সাধকের সাধনার নামে যৌন ব্যভিচার সাধনার অসাড় বুলিবাণীকে শিরোধার্য করে জীবনধারণ করতে পারবে। নানা গ্রামগঞ্জ ঘুরে এমন গুরু-মা যেমন আমি কম দেখিনি, তেমন বাউলের পরিত্যক্তা সাধনসঙ্গিনীও তো কম দেখিনি। গলা যদি সুরে খেলে, কিছু গান যদি রপ্ত করতে পারে আর সাধকের ব্যভিচার লোলুপতা বুঝে গিয়ে যদি গর্জে ওঠে, একা চলতে পারে সঙ্গিনী; বাউল যখন তাকে ছেড়ে দেয়, সেই দুঃসহ সময়ে যে নারী গান ফেরি করে বাঁচবার পথ করে নিতে পারে, তাদের পেছনে পরবর্তীতে বাউলের লাইন কেবল একটি কারণে গান বেঁচে নির্বাহের আশায়। এইসব দেখেই আজকের নতুন মেয়েরা সঙ্গীহীন হয়ে গানকেই কেবল গলায় তুলে সদর্পে, সম্মানের সঙ্গে বেঁচে আছেন আর সেই বাঁচাকেই মানতে পারছেন না প্রাচীন গুরু-মায়েদের দল। সাধনের সার বুঝে গেছেন কৃষ্ণা, সুমিত্রা, কল্যাণীদের মতো অসংখ্য নারী। কৃষ্ণার কথা আগেই বলেছি। এখন বাকিদের কথা বলি।
আসাননগরের মিনতি, ভীমপুরের শেফালি, ঘোষপাড়ার সুষমা কেউই আজ আর সাধনসঙ্গিনী নেই। সকলেই অর্থাভাবে আর পরিবেশের চরম অসহযোগিতায় অসহায়তার মধ্যে দিনাতিপাত করছে মাত্র।
মিনতিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সুবাস যে চলে গেল, তুমি আটকালে না কেন?
করুণ দৃষ্টিভরে সে উত্তর করেছিল, যেতে চাইলে কাউকে কি আর ধরে রাখা যায় বলো? তাও স্বামী হলে না হয় কথা ছিল; একে-তাকে বলতাম, পঞ্চায়েত করতাম, এখানে তো সে বালাই নেই। লোককে বললে মজা মারবে, বলবে শরীর তো আছে, বেচে খাও গে। সুবাস গেছে এবার প্রভাতরে ধরো। তোমাদের এই তো জীবন। বলো, আর কথা বলা যায়?
—এ পথে এলে কীভাবে?
—কীভাবে আর! মায়ে রেখে এল গুরুপাঠে। সেখান থেকে তার সঙ্গী হলাম। ছ’বছর একসঙ্গে। এখন সে ছাড়াছাড়ি করে নিল।
-কেন? সুবাস ছেড়ে গেল কেন? তোমাদের জুড়ির তো নাম ছিল।
–হলে কী হবে গো। তাকে লোভে পেল। ডাগর মেয়েমানুষ এসে লোভ দেখাল।
–কীসের? শরীরের?
—শুধু শরীরের লোভে বাউল কি আর যায় গো। এক ঠাঁই-এ থেকেই তো সাধনার দোহাই দিয়ে নিত্যিনতুন শরীর পাওয়া যায়।
—তবে সুবাস গেল কেন?
-ওই যে বললাম লোভ। ডাগর মাগি এসে বলল বিদেশে যাবার পথ সে নাকি বলে দেবে।
সুবাস তাহলে এখন বিদেশে?
—অত সস্তা যাওয়া? কলকাতায় গেড়েছে। ধরাধরি চলছে শুনতে পাই।
—তোমার এখন চলে কী করে?
-ওই চেয়েচিন্তে। —গান গাও না?
—কী করে গাবো বলো? জুড়ি নেই। জুড়িহীনের গান কে শুনবে বলে তুমি?
তা ঠিক। সঙ্গীহীন রমণীর গায়নের কদর খুব বেশি নেই আখড়া-মোচ্ছবে। কৃষ্ণা, সুমিত্রা, কল্যাণীরা পেরেছে কেবল জীবনসংগ্রামে ঋদ্ধ হয়ে প্রবল জেদে আর দু-একজন সুহৃদের সহযোগিতায়। সুমিত্রা, কল্যাণী রীতিমতো এখন বাউল গায়িকা। মস্ত দল তাদের। মঞ্চে বাঁশি, খমক, গুবগুবির পাশে ক্যাসিয়ো। কৃষ্ণারও তাই ছিল।
সুমিত্রাকে বলেছিলাম, এই পরিবর্তন কেন?
উত্তর করেছিল আমায়, কেন নয় গো? বাউলরা সব লম্ফঝম্ফ মেরে গান করে। শ্রাতার হাততালি পায়। কেবল টুং টাং আওয়াজে শ্রোতা পাওয়া যায় না। পয়সা দিয়ে উদ্যোক্তারা সব নিয়ে যাচ্ছে আমাদের আনন্দ দেওয়ার জন্য। তা সেখানে গিয়ে যদি জমাতে না পারি, নাম হবে? আর ডাকবে আমাকে?
কল্যাণীর সেই একই কথা।
-মেলাখেলায় আর গাই না, যাই।
–না গাইলে যাও কেন?
–যাই লোক ধরতে। যোগাযোগ হয়। সুযোগ আসে। প্রোগ্রাম পাই।
–ভালোই রোজগার হয় তাহলে?
–হয়। তোমাদের আশীর্বাদে মন্দ নয়। রেডিয়ো, টিভিতে ডাক পাই। সরকারি অনুষ্ঠানেও খবর আসে। ক্যাসেট বের হয়েছে সরকারি খরচে। সব মিলিয়ে ভালোই চলে।
—আর ভজনসাধন?
–সেসব অনেক করেছি। গানই এখন সাধনভজন সব। সাধুগুরু ক-জন আছে গো? সব ভেক নিয়েছে। মুখোশ। সব আমার চেনা। নিজে গাইবে, নানা শরীর খাবে আর মেয়েরা কি মুখ গুঁজে আশ্রমে থেকে গাব জ্বাল দেবে?