—আর মাংস?
-মাংস হল জ্ঞানখঙ্গ দিয়ে ষড়রিপুকে বিনাশ করে দেওয়া। কাম, ক্রোধ, লোভ ইত্যাদি যাবতীয় সব ইন্দ্রিয় তো মাংসরূপ। এগুলোর ছেদন দরকার। এগুলোকেই বৈষ্ণব ভক্ষণ করবেন।
-মৎস্য?
-শরীরের ছয়টি মৎস্য থাকে বাবা। অহংকার, দম্ভ, মদ, পৈশুন্য, মাৎসর্য আর হিংসা। এই ছয় মৎস্যকে বৈরাগ্যজালে আবদ্ধ করে রাখাই হল বৈষ্ণবের মৎস্য সাধনা।
–মুদ্রা সাধনা?
–এও তো পশুপাশই বাবা। এই পাশ মুক্ত হবে অষ্টমুদ্রাকে জয় করে।
–কী কী এই মুদ্রা?
-আশা, তৃষ্ণা, জুগুপ্সা, ভয়, ঘৃণা, মান, লজ্জা ও ক্রোধ। এই আটমুদ্রা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়াই হল গিয়ে মুদ্রা সাধনা।
বললাম, বাকি রইল কেবল মৈথুন সাধনা।
বললেন, বাকি থাকবে কেন? যুগল সাধনে তো ইড়া ও পিঙ্গলা উভয় নাড়িতে বাহিত বায়ুকে সুষুম্নাতে মিলন করা হয়। এ হল সূক্ষ্ম মিলন। আর এই সুক্ষ্মযোগে দুই শরীর আলিঙ্গনরূপ মৈথুন স্বরূপ উপলব্ধি করে।
বাউল পঞ্চম ম-কার নয় পঞ্চভূতে সিদ্ধির কথা বলেন। তাদের পঞ্চভূতের সঙ্গে আবার অঘোরী মতের পঞ্চ ম-কারে কিছুটা মিল রয়েছে। অঘোরী মতে মৃত্তিকা-মুদ্রা, জল-মৎস্য, অগ্নি-মদ, মৈথুন-ব্যোম। তবে সাধক ভেদে এর প্রভেদ থাকতে পারে। যেটুকু বুঝেছি আমি, প্রতীকী অর্থময়তাতে এসব তলিয়ে দেখলে বোঝা যায় পার্থক্য কেবল দৃষ্টিকোণের এর বেশি কিছুই নয়। অনুরাগে সাড়া পাওয়ার কথা বাউল বলেন। এই সাড়া হল গিয়ে নিজের অন্তরের সাড়া। সে সায় দিলেই তো আত্মার জাগৃতি হবে। তবে বাউলের আত্মার ফর্দ অন্য। উপনিষদের ব্যাখ্যার সঙ্গে তো সচরাচর মিলবে না।
উপনিষদে আত্মা কী? কীভাবে তাকে দেখানো হয়েছে? ‘স ম আত্মেতি বিদ্যুৎ’–তিনিই আমার স্বরূপ। ওঁ আত্মা বা ইদমেক একাগ্র আসীৎ। আত্মা হল আমি নিজে। কে এই আমি? এই আমি হল পঞ্চেন্দ্রিয়ের শরীর। বাক্, নাসিকা, চক্ষু, শ্রাত্র ও মন। এই পাঁচটি ইন্দ্রিয়ই দেহ দ্বারা অধিগত থাকে। এজন্য এদের আধ্যাত্মিক বলা যেতে পারে। এই পঞ্চেন্দ্রিয় আবার পঞ্চপ্রকৃতি বা পঞ্চভূতের সঙ্গেও যুক্ত। বাক্-অগ্নি, নাসিকা-বায়ু, চক্ষু-আদিত্য, শ্রোত্র-দিক, মন-চন্দ্রমা। আত্মাকে আমরা জ্ঞানের ব্যাপ্তি হিসেবেও দেখতে পারি। ভারী সংজ্ঞায় যাচ্ছি না। বলছি আত্মা সর্বজ্ঞ। আমার এই যে আদন প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত তার ক্রিয়া দু-ধরনের। স্বরূপ পরিণাম আর বিরূপ পরিণাম। স্বরূপ পরিণাম কী? আপনার বা নিজের সত্ত্বকে সত্ত্বরূপে, রজকে রজরূপে, তমকে তমরূপে অবস্থান করানো। এগুলো সবই হল গিয়ে ব্যক্তিসত্তার আবরণ। যা নিজের স্বরূপকে বিস্মৃত করিয়ে রাখে। সত্ত্ব হল গিয়ে প্রকৃতি, স্বভাব, মন—এই তিনটি গুণকে ঠিকভাবে চিনে নেওয়া। রজ হল দর্শনজনিত গুণ আর তম তামসিক গুণ বা অজ্ঞানতাকে দূর করা। আবরণ তিনটি। যা নিজস্ব স্বরূপকে বিস্মৃত করে দেয়। মোহ-দরজা বন্ধ করে দেয়। সাধক এই তিন আবরণ খসিয়ে ফেলেন। প্রথম আবরণ তিন গুণ (সত্ত্ব, রজ, তম) যার কথা এতক্ষণ বললাম। দ্বিতীয় আবরণ ছয়টি স্বাদ (মিষ্টি, টক, লবণাক্ত, তিক্ত, ঝাল, কষা)। তৃতীয় আবরণ পঞ্চভূত (ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম) তিন গুণ আমাদের মনকে প্রভাবিত করে। পঞ্চভূত আমাদের দৈহিক গঠনকে ঠিক রাখে। ছয় স্বাদ আমাদের দেহের রাসায়নিক অবস্থাকে ঠিক করে দেয়। এভাবেই আমাদের মন ও দেহ এক সুতোয় বাঁধা পড়ে। তার সঙ্গে দশটি ইন্দ্রিয় (পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় ও পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়) যুক্ত হয়ে কুণ্ডলিনী শক্তির উপর চব্বিশটি আবরণ সৃষ্টি করে। কুণ্ডলিনী হল চৈতন্যস্বরূপ। শক্তিরূপবলে শাস্ত্র তাকে চৈতন্যস্বরূপা করে নারীর অভিজ্ঞান দিয়েছে। এই কুণ্ডলিনী বা চৈতন্যস্বরূপ / স্বরূপা যাই বলি না কেন তা যদি নিজের স্বচ্ছ দৃষ্টি হারিয়ে ফেলে তবেই গণ্ডগোল লাগে। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে যায়। আর দৃষ্টি যদি সে অর্জন করে ফেলে তবে ব্যক্তিসত্তা বা আমিরও সবরকমভাবে জাগরণ ঘটে। আমরা স্বরূপ পরিণাম বুঝলাম। অরূপ পরিণামও এক বলতে পারি। আর বিরূপ পরিণাম কী? পুরুষ ও প্রকৃতির সংযোগ আর সেইসময়ে প্রকৃতির বিরূপ আচরণ। পুরুষ হল আমাদের নিজের অজ্ঞানতা। প্রকৃতি হল নিত্যতা। আমরা ধরছি পুরুষ ও প্রকৃতি আসলে আমাদের নিজের অজ্ঞানতা। প্রকৃতি হল নিত্যতা। আমরা বলছি পুরুষ ও প্রকৃতি আসলেই এক সংযোগ। যে যোগে প্রাণের সৃষ্টি হয়। বাউলের আত্মা দেহগত প্রাণকে ঘিরেই। কিন্তু তার অবস্থান বস্তুগত। কী এই আত্মাতে শামিল? দুদ্দু শাহের একটি গান আছে, তাতে বলা হয়েছে : বস্তুকেই আত্মা বলা হয়। আত্মা কোন অলৌকিক কিছু নয়। কিন্তু ব্যাপারটা এতে স্পষ্ট হয় না। আরেকটি গানে দুদ্দু বলেছেন : যে বস্তু জীবনের কারণ / তাই বাউল করে সাধন। এই বস্তু শরীরের রজ-বীর্য। সাধক বাউল নিজেদের শরীরের অন্তঃস্থিত পদার্থকে সংরক্ষণ করেন। গায়ক বাউলারা কেবল গানের তত্ত্বকথাকেই ব্যক্ত করেন ধর্মকথায়। পালন করেন তা কেবল সাধক বাউলরা। যাঁদের সংখ্যা এখন একেবারে হাতেগোনা। আরও একটি গানে দুদ্দু মেয়ের চরণ ধরেই সাধনার কথা জানিয়েছেন : ‘সাধন করো রে মন ধরে মেয়ের চরণ। বলেছেন : ‘পিতা শুধু বীর্যদাতা/ পালন ধারণ কর্ত্রী মাতা / সে বিনে মিছে কথা সাধন-ভজন / আগে মেয়ে রাজী হবে / ভজনের রাহা পাবে / কেশ ধরে পাড়ে নেবে দুদ্দুর বচন।’