হকারঃ কীৰ্ত্তিতঃ সূৰ্য্যষ্ঠকারশ্চন্দ্র উচ্যতে। / সূৰ্য্যাচমসোর্যোগাদ্ধঠযোগা নিগদ্যতে। অর্থাৎহশব্দে সূর্য ঠশব্দে চন্দ্র, হঠ শব্দে চন্দ্র-সূর্যের একত্র সংযোগ। অপান বায়ুর নাম হল চন্দ্র আর প্রাণ বায়ুর নাম হল সূর্য। প্রাণ আর অপান বায়ুর একত্র সংযোগকেই শাস্ত্রে হঠযোগ বলেছে। যোগশাস্ত্রে এই দুই বায়ু ত্যাগ গ্রহণের মাধ্যমেই ক্রিয়াকর্মের কথা বলা হয়েছে।
সবসময়ে গুহ্য ভাষাতেই কথা বলে থাকেন বাউল। কারণ শুরুর নির্দেশ : ‘আপন সাবধান কথা না কহিও যথা তথা / আপনার আমিরে তুমি হইও সাবধান। বাউলের গানও তাই প্রহেলিকাতে ভরা। হঠযোগের চন্দ্র বাউলের সংকেতময়তার বা নাক আর সূর্য ডান নাক। অর্থাৎ সেই ঘুরেফিরে শ্বাস প্রক্রিয়ারই কথা কিন্তু হল। জ্ঞানযোগ শরীর জাগৃতির গাণিতিক অধ্যায়ের পর উপলব্ধ বিশ্বাস। মনুষ্যত্বের প্রতি পুরোপুরি আস্থা। ভক্তিযোগ হল মহামিলনের পর স্থিতাবস্থা আর কী।
বাউল মূর্তিপুজোতে বিশ্বাস করেন না। কিন্তু যেটা আশ্চর্যের-মদীক্ষার সময় মালসাভোগ নিবেদনে আত্মগুরুর সাথে সাথে পঞ্চপ্রভুকেও নিবেদন করেন। আত্মগুরু এখানে নিজের গুরুদেব বা তাকে মনগুরু হিসেবেও দেখতে পারি। আর পঞ্চপ্রভু হলেন—গৌরাঙ্গ, নিত্যানন্দ, অদ্বৈত, শ্রীবাস, গদাধর। এ যথেষ্টই বৈষ্ণবীয় আচার। ‘বাউল আর বৈষ্ণব এক নহে তো ভাই’ বলা হলেও অন্তত এক্ষেত্রে এখন অনেকাংশেই একাকার হয়ে গেছে। বাউসের মাধুকরী তো বৈষ্ণব আচারের অঙ্গ। তবে পঞ্চ ম-কারে সাধনার নির্দেশ আছে। সেই সাধনা স্কুলের সঙ্গে সূক্ষ্ম সম্পূর্ণরূপেই নাড়িকল্পের। বৈষ্ণবীয় আচরণেও পঞ্চম-কার আছে। তার কথা আমাকে জানিয়েছিলেন সহজিয়া বৈষ্ণব অনন্তদাস বৈরাগ্য। তবে নৈষ্টিক বৈষ্ণবরা এইসব সহজিয়াপন্থীদের বেশ নীচু নজরে দেখেন। বলেন, জাতখোয়ানো বৈষ্ণব। অনন্তদাস আমাকে বলেছিলেন, তারা হলেন অচ্যুতানন্দ গোত্রের। আসলে যেটা দেখেছি, সহজিয়াপন্থীরা প্রায় নব্বইভাগই এই গোত্রেরই। তিনি বলেছিলেন, এটাকে আপনি কৃষ্ণ গোত্রও ভাবতে পারেন। আমাদের পরিবার হল নিত্যানন্দ পরিবার। আর আমরা হলাম গিয়ে একশো বাইশ ঘরের বৈষ্ণব।’
বললাম, ‘এই জায়গাটা তো ঠিক বোধগম্য হল না।‘
হাসলেন প্রবৃদ্ধ অনন্তদাস।
বললেন, ‘মহাপ্রভুর অপ্ৰকটকালে নানা বৈষ্ণবীয় আচারের সম্প্রদায় যে গজিয়ে উঠল। বাউল, কর্তাভজা, নেড়া-নেড়ির দলও এই বৈষ্ণবধর্মে সংযুক্ত হয়ে পড়লেন। তখন নিত্যানন্দ প্রভু দেখলেন বৈষ্ণব ধর্মের শুদ্ধিকরণ প্রয়োজন। আর এটা করতে গিয়েই তিনি একশো একুশ সম্প্রদায়কেই বাতিল করে দিলেন। নিজেরটি কেবল রাখলেন। তাই আমরা হলাম শুদ্ধাচারী একশো বাইশঘরের বৈষ্ণব।’
জিজ্ঞাসা করলাম, ‘বৈষ্ণবীয় যে চারটি সম্প্রদায়ের কথা বলা হয়ে থাকে তবে তাদের মধ্যে কি পড়েন না আপনারা?
-কেন পড়ব না? রামাত, নিমাত, বিষ্ণুস্বামী, মাধ্যাচার্য-এই হল গিয়ে চার সম্প্রদায়।
বুঝতে পারছি অনন্তদাস রামানুজ সম্প্রদায়কেই রামাত বলছেন আর নিম্বার্ক বা কারও কারও মতের সনক সম্প্রদায়কেই নিমাত বলে অভিহিত করেছেন। একাদশ শতাব্দীর লোক ছিলেন রামানুজ। তিনি শঙ্করের মায়াবাদ ও শৈবধর্মকে অগ্রাহ্য করে বিষ্ণুসাম্রাজ্যের ভক্তিবাদ প্রচারকেই গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তার সম্প্রদায়কে অনেকে আবার শ্রীসম্প্রদায় নামেও অভিহিত করে থাকেন। এই শ্ৰীসম্প্রদায় বা রামানুজ সম্প্রদায়ের বৈষ্ণব ছাড়াও সনক, রুদ্র প্রভৃতি সম্প্রদায়ের বৈষ্ণবরাও চৈতন্যদেবের বহু পূর্বেই ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিদ্যমান ছিলেন। সনক সম্প্রদায়ের প্রধান ব্যক্তি নিম্বাদিত্য। কথিত, সূর্যদেব নিমগাছের আড়াল থেকে তাকে দর্শন দিয়ে প্রায়োপবেশন অর্থাৎ কিনা আহার বর্জন করে মৃত্যুর প্রতীক্ষায় উপবেশনের ব্রত ভঙ্গ করে দেওয়ার পরই নিম্বাচার্য উপাধি দিয়েছিলেন। তা এই নিম্বাচার্যও কৃষ্ণসহ রাধার যুগলতত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু অনন্তদাস বৈরাগ্য এই দুই সম্প্রদায়গত অস্তিত্বকে মুছে যা বললেন তা আমার কাছে একেবারেই নতুন।
বললেন, রামাত হলেন রামের উপাসক। নিমাতরা নিরাকারবাদী। বিষ্ণুস্বামীরা বিষ্ণুনারায়ণের উপাসক আর মাধ্যাচার্যরা কৃষ্ণ উপাসক। আমরা হলাম সেই মাধ্যাচার্য সম্প্রদায়ের। কৃষ্ণকে আমরা বৈধীরীতিতে পেতে চাই।
জিজ্ঞাসা করলাম, কী এই বৈধী?
—আমাদের আশ্রয় হল রাধারানি। বিষয় গোবিন্দ। রাধাকে আশ্রয় করে কৃষ্ণ বা গোবিন্দতে পৌঁছোবার জোড়কলম তো মহাজনেরই দেওয়া।
—পন্থাটি কী তবে এ পথে?
—পন্থা তো চেতন্যচরিতামৃতেই আছে বাবা। আপনি খেয়াল করবেন। বলা রয়েছে সেখানে একেবারেই স্পষ্ট : লোকধর্ম, বেদধর্ম, দেহধর্ম, কর্ম, লজ্জা, দেহসুখ, আত্মসুখ, মর্মসুখ, দুশ্চার্য, আর্যপদ, নিজপরিজন স্বগুণ যত করে তাড়ন ভৎসন সর্বত্যাগ করি করে কৃষ্ণের ভজন ইহ্যকে কহিহে কৃষ্ণের দৃঢ় অনুরাগ। শৌচ ধৌত বস্ত্রে যেন নাহি কোনো দাগ। এই ভজনে পঞ্চ ম-ও লাগে বাবা।
বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তন্ত্রের পঞ্চ ম-কার?
-হ্যাঁ বাবা। কুণ্ডলিনীযোগ লাগবে না বাবা? বীর্যবস্তু তাহলে উর্ধ্বে উঠবে কীভাবে শুনি? এই বীর্যবস্তুকে সহস্রারে নিতে গেলেই তো ব্ৰহ্মরন্ধ্র থেকে মদ ঝরে ঝরে পড়বে।