—এই বয়সে!
-এটা আশ্চর্যের কিছু না খ্যাপা। চন্দ্ৰসাধনের ফল গুসাইয়ের শরীর। তার সাধনে এলে আপনেও এই বয়স পর্যন্ত যাবেন আর ছুঁড়ি নিয়ে দিব্যি সাধনাতে মাততে পারবেন। মহাজন তাই কী বলছে জানেন খ্যাপা?
-কী?
-মহাজন বলছেন, চন্দ্ৰসাধন কর রে মন সময় থাকিতে। আর গুসাইয়ের সেই চন্দ্রসাধনে মেয়েটা গররাজি। বলে কিনা পাক ধরা শরীরকে সে সর্বস্ব দেবে না।
বললাম, ঠিকই তো বলেছে মেয়েটা।
—বাউলপাঠ নেন খ্যাপা। তাহলে এ ধারণা আর হবে না আপনের। আপনে শিক্ষিত। কিন্তু বাউলশিক্ষ্যে যে অন্যরকম। সেখানে কে কার শরীর ভোগ করে?
-কেন? দুজনে দুজনের।
-ভোগই নেই খ্যাপা। সেখানে কেবল প্রেম। সহজ মানুষ। সহজানন্দ। আসলে কী জানেন খ্যাপা মেয়ের কামের শরীর। আমাদের গুসাইও ছাড়ার পাত্তর নন। ও মেয়েকে তিনি সহজ মানুষ করবেনই। তাই তো এত মারধর।
শুনতে পারছি আমি মেয়েটার কান্নার আওয়াজ গাঢ় হচ্ছে। তার শরীরে চড়-থাপ্পড় পড়ছে সমানে।
গোঁসাই-মা বলে চলেছেন, কানে আসছে আমার সমানে সেইসব প্রজল্প : ঢলানি মাগি, শুধু ছোকছোকানি, ভেগে যাওয়ার তাল, ও মিনসে তোকে কী দেবে রে মাগি? মধু খেয়ে ফেলে যাবে রে তোরে। গুসাই সঙ্গে নিজেরে বুঝবি, গুসাই কি আর তোর গতর খাবে? গুসাই তোরে প্রেমে মজাবে, শরীরের কামদানা সব ঔড়ায়ে দেবেন শুসাই। মিনসে তোরে কী দেবে রে শুনি? পেট বাঁধানোর মন্তর ছাড়া আর কী দিবার পারে মানুষ? সহজ মানুষ ডাকতিছেন। যা রে মাগি যা যা। না হলে এই মার খা খা খা কালমুখী। গতরখাকী। পাতধারী মনুষ্যের প্রতি এত লোভ।
মেয়েটা এখন মার খেয়ে প্রবল জোরে চাচাচ্ছে। তার সেই অসহায় শরীর বাঁচানোর আর্তি ঢেকে দিতে চাচ্ছে আখড়ার বাউলের গুবগুবি। গান হচ্ছে : ‘মানুষ মিলে ভাগ্য ফলে / ডাকে যদি ভক্তিভাবে দীনের কাঙালে। / ব্রহ্মাণ্ডের পরপারে আছে মূলাধারমূলে। / নাহি দিবা, নাহি রাতি, মন, মানুষের মহলে।।‘
.
আখড়া আশ্রমে গেলে বাউলের এই ‘সহজতত্ত্ব’-র জ্ঞান মিলবে প্রথমেই। বাউলের সেই ‘সহজতত্ত’ জানা তো আসলে নিজেকেই জানা। এই আমি, দেহগত আমি, জন্মগত আমিকে সদ্গুরুর সাহায্যে জাগিয়ে ভোলা। বাউল আসলেই এক জাগরণকলা। এই জাগরণই যে তার গান। শরীরের সামগ্রিক দলিলমূল্য। বাউল সাধক বা পদকর্তা তাই-ই লিখে রাখেন তার দেহতত্তের গানে। যে তত্তের চারটি অনুপম যোগ বর্তমান। হঠযোগ, তন্ত্রযোগ, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ।
হঠযোগের কলা প্রায়শই বলে থাকেন বাউল সাধক। শিষ্যকে এই যোগ আর রেচক, পূরক, কুম্ভক করার উপদেশ আমি অনেক বাউল আশ্রমেই শুনেছি। এই ক্রিয়াকর্মের বেশ কিছু গানও আছে। যেমন—চণ্ডী গোঁসাইয়ের গান : যদি রেচক পূরক কুম্ভক করবি ভাই। তবে নাড়ির কপাট খুলা মায়া / শিখে নেগে আগে তাই।’ নাড়ির এই কপাট খোলার মায়াই হল গিয়ে যোগ। চারপ্রকার যোগের কথা আমরা জানি। মন্ত্রযোগ, হঠযোগ, রাজযোগ, লয়যোগ। মন্ত্রযোগ সর্বপ্রকার সাধনের মধ্যে নিকৃষ্ট বলেই কথিত। তথাপি কিন্তু জপেতে সিদ্ধির কথাও বলা হয়ে থাকে। মন্ত্রজপান্মনোলয়ো মন্ত্রযোগঃ। ‘অর্থাৎ মন্ত্র জপ করতে করতে যে মনোলয় হয়ে থাকে, তাই মন্ত্রযোগ। তবে একে নিকৃষ্ট বললেও জপসাধনায় যে আবার সিদ্ধিযোগ আছে শাস্ত্রে তারও উল্লেখ আছে। সেখানে বলা হয়েছে যে, জপ সাধনাও সিদ্ধি এনে দিতে পেতে পারে। কালী, কৃষ্ণ, শিব যাই বলি না কেন আমরা এতে বা এই ইষ্ট সাধনায় সিদ্ধি পেতে গেলে জপের ভূমিকা অনিবার্য। বাউলের ইষ্ট মানুষ। তারই ভজনা বা সাধনা সারাক্ষণ বাউলের সাধনা। সেই সাধনার জপ হল গিয়ে গান। আবার বাউল মিলনযোগে কাম বীজ, কাম গায়ত্রীও জপ করার কথা বলে থাকেন। দেহতত্ত্ব বা বাউলতত্ত্বে তন্ত্রযোগের কথা বলেছি কিছু আগে। অনেকে বলতে পারেন তন্ত্র ও বাউল দুটো তো পুরোপুরি আলাদা সাধনা, তাহলে বাউলতত্ত্বে তন্ত্র আসবে কী করে? উত্তরে বলি, বাউল ক্রিয়াকর্ম। তন্ত্রও তো তাই। শরীর আধারিত সব অধ্যায় এইসব লোকায়ত সাধনা। বাউলের কিছু গান যাকে আমরা মন্ত্র বা বন্দনা হিসেবে যেমন দেখতে পারি, তেমনই তাকে আবার অনায়াসে তন্ত্ৰআধারেও ফেলতে পারি। কেননা এইসব গানে ক্রিয়াযোগই স্পষ্ট এবং প্রবল। যেমন—’অনুরাগে ভজরে মন, / পাবি রাধার যুগলচরণ, / রাধাকৃষ্ণ একাসনে / ধ্যানে মগ্ন মদনমোহন।‘ এই গান যুগল ভজনেরই আখর। যে ভজন হল গিয়ে হঠযোগেরই নামান্তর। হঠযোগ হল গিয়ে একত্রে সংযোগ। বাউল সাধনে যা অপরিহার্য। গুরু-শিষ্যর। সাধক সাধনসঙ্গিনীর। গুরু-শিষ্যর সংযোগের একটি বহুল প্রচারিত গানের কথা আমরা সকলেই তো জানি : ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে, আমরা ভেবে করব কী? / ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম, তাকে তোমরা বলবে কী?’
এই চাঁদের গায়ে চাঁদ লাগা হল গুরু আর শিষ্যের মিলন। তত্ত্বটি লালন ফকিরের সাধনা টেনে অনায়াসে বোঝনো যেতে পারে। লালনের গুরু ছিলেন সিরাজ সাঁই। তবে শিষ্যের এই আকাশছোঁয়া পরিচিত গুরু সিরাজ সাঁইয়ের কখনও ছিল না। এই গানে ব্যবহৃত প্রথম চাঁদ হল গুরুচাঁদ। যিনি শিষ্যকে টানছেন, আশ্রয় দিচ্ছেন। গুরু এখানে যেন কল্পিত একটি বড়োসড়ো চুম্বকখণ্ড। এই চাঁদের গায়েই শিষ্যচাঁদ লেগে যাচ্ছে। অর্থাৎ শিষ্য হলেন লৌহকণিকা। শুরু তাকে নানা প্রাকরণিক কৌশলে চুম্বকের মতোই আকর্ষণ করছেন। দুজনেরই দেহই ঈশ্বরের অংশ হয়ে উঠছে যেন। পূর্ণচন্দ্র গুরু। তার আকর্ষণে চন্দ্রাংশ শিষ্য মিলিত হচ্ছেন বা হবেন, এতে কারও কিছু করবার নেই। ক্রিয়াশীল এই নিয়ম। তাই এখানে কোনোরকম ভাবনার অবকাশ থাকবার কথা নয়। লালন এখানে নিজেকে মাতৃঅংশ বলে মনে করেছেন। তাই ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম। ঝি হল সন্তানতুল্য অভিধান। নিজেকে তিনি মাতৃভাবে প্রতিপন্ন করে গুরুকে সন্তানের আসনে বসিয়েছেন। গানের এই মন্তব্যের প্রমাণ তিনি তো নিজেই।