-কতটুকু মানে! মেয়ে না হলে সাধন হবে? মেয়েরা হল গিয়ে সরোবর। সাধক সেখানে স্নান সারেন। সিদ্ধ হন।
–মেয়েদের তবে সিদ্ধতা আসে না? তারা সঙ্গিনীই কেবল?
আবার রেগে উঠলেন মা।
–কে বলেছে আবোল-তাবোল?
বললাম, না সাধনায় সাধকেরা তো উর্ধ্বগামী করে দিতে পারেন বস্তুকে।
বলতে দিলেন না মা।
বললেন, তা বস্তু উধ্বগামী করতে সাহায্য করে কে? মেয়েরা যদি শ্বাস আর দমের কাজ না শেখে সে পারবে? কীভাবে উর্ধ্বগামী হবে শুনি। যত আজেবাজে কথা।
জানি আমার দৃষ্টিভঙ্গি মনঃপূত হচ্ছে না মা-র।
বললেন, মেয়েরা সমান তালে যোগ করে। রেচক, পূরক, কুম্ভক সব করে।
মা-কে বলতে পারলাম না আমি, তা নয় করল, করে সাধক সিদ্ধ হল, নাম রটল তার। তাতে হল কী সঙ্গিনীর? সে তো আর সিদ্ধ আসন পেল না। সে যে কেবল সাধনসঙ্গিনী। বুঝলাম মীরা মা দাপুটে বলে প্রাপ্য সম্মান আদায় করে নিতে পারেন। একথা নবাসনের নির্মলা মা-র ক্ষেত্রেও ভীষণরকম সত্য। সকলের কাছেই তিনি মা-গোঁসাই নামে পরিচিত। সাধক হরিপদ গোস্বামীর সাধনসঙ্গিনী ছিলেন তিনি। বছর তিনেক হল দেহ রেখেছেন নির্মলা মা। তাঁর মুখেই শুনেছিলাম দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর গোঁসাই ঠাকুরের তিনি সাধনসঙ্গিনী। বাউল পথে আসার আগে গোঁসাই ছিলেন তন্ত্রসাধক। নির্মলা নিজে ছিলেন সচ্ছল পরিবারের গৃহবধূ। চাকরি করতেন স্বামী। আঠারো বছরে বিধবা হয়ে হঠাৎ করেই এ পথে আসেন তিনি। গোঁসাইকে শিষ্যবাড়িতে দেখেই মুগ্ধা নির্মলা বেরিয়ে পড়েন তার হাত ধরে। আর তাকে পেয়েই নাকি গোসাই এবার বাউল পথ ধরে। তা এই নির্মলা মা-রও গোঁসাইকে নিয়ে নিশ্চিন্ত জীবনযাপন। আশ্রমে অনটন ছিল না কোনো। শিষ্যদের বদান্যতায় বিদেশেও পাড়ি জমিয়েছেন দুজনেই। বেশ ঠাটবাটে ছিলেন। মা-গোঁসাই। জানি না এখন গোঁসাই ঠাকুরানির কী দশা? নির্মলা মা-রও মতাদর্শ সঠিক সাধনের সাহচর্যে অনেকটা মীরা মোহন্তর মতোই। কিন্তু সবাই তো আর মীরা মা বা নির্মলা মা নন, তাহলে তাদের অবস্থান কী? আর সেই অবস্থান চিহ্নিত করতেই এখন মেয়েরা সাধক নন, গানের সঙ্গে বসবাস করছেন অনেকেই। গান গাইছেন। অনুষ্ঠান করছেন। বাউলের ধার আর ধারছেন না। অনেক দিনের বঞ্চনার ফলে এটা হয়েছে। এটা স্বাভাবিক। মীরা মা এসব আঁত থেকে দুরে গুরু মা, মা-গোঁসাইয়ের জীবনধারণ করছেন তাই মেয়েদের অসহায়তা তিনি ঠিক ধরতে পারছেন না। নির্মলা মা-ও পারতেন না।
বলতেন, সাধনে দুজনা হল গিয়ে দুজনের আশ্রয়। গোঁসাই আমার আত্মা। ওকে ধরেই তো পরমাত্মার সঙ্গে মিলতে হবে।
জিজ্ঞাসা করেছিলাম, পরমাত্মার মিলনে সিদ্ধি কেবল সাধকের?
-কে বললে এ কথা! সঙ্গিনীর সঙ্গে সাধন করতেছে সাধক। তার গতি আছে আর সঙ্গিনীর গতি নেই? এ হয় নাকি? সাধনায় দুজনেরই সিদ্ধি আসে।
—এক সঙ্গিনী কি সবসময়ে সাধককে সাধনায় সহায়তা করতে পারেন?
—শোনো কথা! পারবে না ক্যান?
–সঙ্গিনীর রজঃপ্রবাহ বন্ধ হলে সাধনা হবে কীসে?
-এই কথা! বাইরের রস বন্ধ হল তো কী হল? ভিতরের রস তো আছে নাকি! নারী সবসময়ই রস ধরতে পারে। তাই সে তো রজকিনী, এ পথে আয়। না এলে বুঝবি কী করে সঙ্গিনী রসহীন হয়ে ক্যামনে রস ধরবে।
নির্মলা মা-র বিশ্বাসে চিড় ধরাতে আমি পারিনি ঠিকই। আসলে চেষ্টাও করিনি। কেননা তিনি তো যথার্থ সাধনেই ছিলেন। নিবিড় দাম্পত্যের মতোই ছিল এক সাধকের পরম নিশ্চিন্তের তার আশ্রমজীবন। কথা হচ্ছে ক-জন মেয়ে পায় তার ও মীরা মা-র এই নিশ্চিন্ত সাধনজীবন-যা পাওয়ার জন্যই সকলে এ পথে আসে। ভাগ্যবতী সেই নারী আর ক-জন। তাই প্রবঞ্চিত গনগনে দহনজ্বালা ওঁদের বোঝার কথা নয়।
দুপুরের ঠাঠাপোড়া রোদেই কথা চলছিল বেশ আমাদের। রাধাচূড়া গাছের নীচে মীরা মা-র আখড়া। অদুরে গঙ্গা। চৈত্রের তাপ জল-হাওয়া-ছায়ায় মোটও স্বস্তিদায়ক নয়। তবু তারই মধ্যে মহিলা বাউল নিয়ে বিশেষত কৃষ্ণা দাসীর সম্পর্কে; তার গান বিষয়ে নানা কথা এলে মীরা মা-র সুর চড়ছে সেই রোদের মতোই।
বললেন, মেয়েদের আখড়া ছাড়া, আশ্রম ছাড়া গান গাওয়া অপরাধ। এইসব মেয়েরা বাউলমতের কলঙ্ক।
বললাম, বাউল যদি অনুষ্ঠানে গাইতে পারে তাহলে মহিলা বাউলরা গাইতে পারবেন না কেন?
রেগে উঠলেন তিনি।
বললেন, বাউল মতের বোঝো কী তুমি? গান কি বাউলের পথ?
মীরা মা-কে বোঝাতে পারিনি গানই এখন বাউল-পথ। বাউলরাই তাই করে নিয়েছে। বাউল এখন আর নিভৃত সাধনের বিষয় নেই। আলো, প্রচারের জন্য সেও যা নয় তাই করে ফিরছে।
মা বললেন, মেয়েদের কাজ হল সাধুসঙ্গ করা। বাউলকে এগিয়ে দেওয়া। বাউল মতকে, পথকে প্রতিষ্ঠা করা। ধরে রাখা।
বলে যাচ্ছেন মীরা মা, নবকুমার জাত বাউল। কৃষ্ণা তো ওর সাধনসঙ্গিনী ছিল। এখন সাধন ভূলে গান ধরেছে। মেয়েরা নেচেদে গাইবে কেন? আখড়ায় গাইতে পারে। মেয়েদের কাজ হল সাধনভজন করা।
খুবই ঝঝি দিয়ে কথা বলছেন মীরা মা। আমি চুপ। শুনে যাচ্ছি। কথা বলছি। ভাবছি শুধু তার বিশ্বাসের কথা। সেই আসন কে টলাবে শুনি। কতজন সাধক বাউল আছেন এখন। যারা আছেন তারা সাধনাতে কতটা বা আগ্রহী। গান, প্রচার, বিদেশযাত্রার তদবির নিয়ে অনেকে ব্যস্ত। মেয়েরা এর ভেতর কতটা সাধুসঙ্গ পাচ্ছে। সাধুই নেই। সাধকই নেই তার আবার সঙ্গ। সঙ্গিনীর সঙ্গে সাধকজীবন তো এখন ব্যভিচারে, অনাচারে হয়ে উঠেছে পাশ্চাত্যের তথাকথিত live-to gether i