ফকিরের গাওয়া গানের মধ্যেও রয়েছে তারই যথার্থ সংকেত। পূর্ণিমার চাঁদ ধরার জন্য ‘ত্রিবেণীর উত্তর দক্ষিণ’ দিকে চেয়ে দেখতে বলা হয়েছে। ‘ত্রিবেণী’ তিন নাড়িরূপী নদীর মিলনক্ষেত্র। সুষুম্না নাড়ি মূলাধার থেকে উৎপন্ন হয়ে একেবারে ব্রহ্মরন্ধ্র। পর্যন্ত গিয়েছে। ব্রহ্মরন্ধ্রে শরীরের শেষচক্র সহস্রারের স্থান। সুষুম্নার বাঁ দিকে রয়েছে ইড়া আর পিঙ্গলা ডান দিকে। ত্রিবেণীর উত্তরদিক বলতে ইড়া এবং দক্ষিণ দিক বলতে সুষুম্নাকেই বুঝিয়ে দিয়েছেন পদকর্তা প্রতীকী ভাষাতে। ‘রবি শশি দুই কিনারে’ মানে হল ইড়াতে চন্দ্রের স্থান আর সুষুম্নাতে সূর্যের স্থান। যার কথা প্রতীকময়তার ইঙ্গিত আমরা কিছু আগে বলে নিয়েছি। পদকর্তা বলেছেন: ‘বাপের ঘরে রবির কিরণ/ শশির ঘরে মার দর্শন / তোরা দেখতে পেলে হবি সৃজন / বাছাধন তাই চিনে নেরে।’ বাপ–মা এখানে পুরুষ আর প্রকৃতি। যুগলদেহ। সাধক ও সাধন সঙ্গিনী। বাপকে সূর্যের প্রতীকে রাখা হয়েছে, মাকে চন্দ্রপ্রতীকে। কারণ ইড়াতে চন্দ্র আর পিঙ্গলাতে সূর্যের অবস্থান বলে। পদকর্তা বা সাধক এ নির্দেশ দিচ্ছেন শিষ্যকেই। সেজন্যই বলা হয়েছে গানে ‘তোরা দেখতে পেলে হবি সৃজন’। সৃজন হল যুগলসাধনের জন্য প্রাণোচ্ছ্বসিত সৃষ্টিবলয়। একত্র সাধনার ইঙ্গিত। বাছাধন’ বলে শিষ্যকে সে সাধনায় নামবার জন্যই বিধিকল্প বেঁধে দিয়েছেন গানে। যার জন্যই চক্রকে চেনার ইঙ্গিত–’কি করে চিনি চক্ররে’। কেন না চক্রের ভেতরেও তো চাঁদ আছে।
কীভাবে রয়েছে সেই চাঁদ? কোন্ অবস্থাতে শক্তির কলাকৃতিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে চাঁদ? সেটা একটু দেখে নেওয়া যাক। চাঁদ রয়েছে বিশুদ্ধ আর সহস্রার চক্রে। বিশুদ্ধ চক্রে শাকিনী শক্তির কল্পনা করে থাকেন দেহসাধক। তিনি কিন্তু আবার চন্দ্রের মতো শুক্লবর্ণা। আর এই চক্রতেই চন্দ্রমণ্ডলকেও কল্পনা করে বসেন সাধক। বিশুদ্ধ চক্রের পকে দ্বিদলের রূপ দেওয়া হয়েছে। এই দুটো দলই আবার চাঁদের মতোই শ্বেতবর্ণ। সহস্রারে কলঙ্করহিত শুদ্ধ চাঁদের অবস্থান। এই চক্রের সহস্রদল পদ্ম সম্পর্কে নানা বিশেষণ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে এই সহস্রার থেকেই আনন্দপ্রবাহ নির্গত হয় সাধকদের উদ্দেশ্যে: ‘সুধাধারাসারং নিরবধি বিমুঞ্চন্নতিতরাং / যতেঃ স্বাত্মজ্ঞানং দিশতি ভগবান নির্মলমতেঃ। / সমাস্তে সৰ্ব্বেশঃ সকল-সুখ-সন্তান-লহরী/ পরিবাহো হংসঃ পরম ইতি নাম্ন পরিচিতঃ।।’ যিনি নিরন্তর সাধকজনের প্রতি অমৃতধারা রূপ সারবস্তু বা চন্দ্র থেকে নিঃসৃত শুক্লবর্ণ অমৃতকিরণ অতিমাত্রায় বর্ষণ করতে করতেই স্বাত্মজ্ঞান (জীবাত্মা ও পরমাত্মার অভেদ জ্ঞানকারক তারক ব্রহ্ম মন্ত্র) উপদেশ দিচ্ছেন। যা সকলের অধীশ্বর এবং সর্ব রকম সুখের বিস্তার স্বরূপ লহরীর নিঝর রূপ, সেই পরমহংস নামে পরিচিত ভগবান পরম শিব সহস্রদল পদ্মে অবস্থান করেন। সাধকগন তাঁর ধ্যানেই সদা নিমগ্ন থাকেন। আর এই পদ্মতেই চন্দ্রের অমানামে সেই প্রসিদ্ধা ষোড়শী কলা আছেন–’অত্রাস্তে শিশুসূৰ্য্য সোদরকলা চন্দ্রস্য সা ষোড়শী’। এই পদ্মতেই ইষ্টচৈতন্য স্বরূপের বিকাশ ঘটে। বোধদয় হয়। বলা হয় এর আকৃতি অর্ধচন্দ্রের মতো বক্র।
তাহলে দেখা যাচ্ছে শরীরের মধ্যেই আমাদের চন্দ্রের বসবাস। যে চন্দ্র শরীরের সবকটি, বিশেষত প্রধান তিন নাড়ির সঙ্গে সর্বদাই ফিসফাস করছে। কথা বলছে। সেজন্যই ফকির আমাকে বলেছিলেন, ‘আপনি চাঁদের সঙ্গে কতা কন না? কন কন। ফকিরের সেই চাঁদের কথাবার্তা আমাদের শরীরের ভেতরে চলতে পারে কিন্তু প্রতিনিয়তই। তবে যোগক্রিয়াতে সেটা একমাত্র সম্ভবপর। গানে সেজন্যই চক্ৰচেনার কথা বলা হয়েছে। ‘যা উদর ভরে আধ অক্ষরে’ রয়েছে। অর্থাৎ কিনা শরীরের অভ্যন্তরে অচেনা অবস্থাতে রয়েছে। এজন্যই পদকর্তা বলেছেন-’কি করে চিনি চক্ররে’। বলেছেন–’তোরা। রুহিনির চাঁদ ধরবি যদি/ ফাঁদ পেতে নে হৃদয়পুরে’। ‘রুহিনি’ কথার অর্থ কী? ‘রুহিনি’ হল আত্মা, নিজের ভেতরজাত অংশও বলতে পারি। তাকে চিনতেই ফাঁদ পাততে বলা হয়েছে ‘হৃদয়পুরে’।
বাউলের দৈগন্তিক প্রসারকে এভাবেও আমরা দেখতে চাইছি এখানে, গানের শঙ্খিনীমালার সৌন্দর্যে শরীরের মধ্যবর্তী ছায়ার অপরূপকে খুলে ফেলে তার থেকে চকিত বিপর্যয়ের ঢেউ নিয়ে উদ্দীপ্ত সমুদ্রে স্নান করতে চাইছি বারবার। যে স্নানে চাঁদের মর্মস্পর্শী পটভূমিকা রয়েছে। তার জন্যই ফকির গাইছেন–শাহা শির আলির হৃদয়পুরে। কেনে রয়েছ ঘুমের ঘোরে / ও তোর প্রেমের কক্ষে দেখনা চেয়ে/ তোর নগরচাঁদ নগরের পরে। ‘হৃদয়পুর’ হল শরীরের সদর অন্দর। উপলব্ধর প্রতীকী সুগভীর গূঢ়ার্থ। ‘প্রেমের কক্ষ’ যুগল শরীরের মত্ততা। সাধকের মতো ভাবের প্রতিফলনের কুঠুরি। ‘নগর’ হল শরীর। ‘নগরের চাঁদ’ শরীরের চন্দ্ররূপী নাড়ির জাগরণ। যার ফলে সাধকের মনে সাধনা বহত্যা-বিস্তারী শক্তি ঘোরাফেরা করে। যে শক্তি; চাঁদ চিনতে পাড়ার এই কলাকৌশলই একদিন সাধককে সিদ্ধস্তরে ঠেলে দেবে।
ফকির আরেকটি গানও আমাদের শুনিয়েছিলেন। সে গানেও চাঁদের কথা রয়েছে। বহুশ্রুত লালনের পদ এটি। বহু বাউলই প্রতিনিয়ত এটা গেয়ে থাকেন। বাউল মোচ্ছব ও মেলাতে এলে এ গান শোনাই যায়। কতবার যে কতজনের মুখে শুনেছি এ গান। মনে আছে সোনামার আশ্রমে এক সন্ধ্যায় আমির চাঁদ ফকিরের মুখে শুনেছিলাম এ গান। চৈত্রের হাওয়ায় বালিউড়াতে তাঁর চুলদাড়ি নড়ছে। বাঁশের খুঁটিতে হেলান খেয়ে বয়স্ক মানুষটি গাইছেন–’সে কথা কি কইবার কথা জানিতে হয় ভাবাবেশে/ অমাবস্যা পূর্ণিমা সে পূর্ণিমা সে অমাবস্যে’।