লোকধর্মে এভাবেই মিশেছে অত্যাচারের কাহিনী আর ঘুরে দাঁড়ানোর স্রোত। সেই স্রোতে শরিয়ত–তরিকত–হকিকতকে এক করে দেখাতে চেয়েছেন আধুনিক বাউল সাধক। লোকধর্মের ভিত্তিভূমি এভাবেই দাঁড়িয়ে আছে এখন দুই বাংলার অখণ্ডপন্থায়–
মন মুসল্লি ভাই
শরিয়তে আছ তুমি
তরিকতে নাই
তরিকতে নাই তুমি
হকিকতে নাই।
হকিকতের হক বিচারে
মন পবিত্র হলে পরে
দেখতে পাবে আপন ঘরে
আল্লা আলেক সাঁই।।
হও যদি খাঁটি মুসলমান
বাহির ভিতর করো সমান
যে হবে মুনাফিক নাদান
নরকে তার হবে ঠাঁই।।
আসা যাওয়া করে দমে
দিনে দিনে আয়ু কমে
কয় বাউল আবদুল করিমে
মরণকালে চরণ চাই।।
০২.৫ সাধনসঙ্গিনী
মেয়ে অমূল্য রতন সাধনার ধন।
যে করে ভজন কাছে রয় সদায়।
যত যোগী ঋষি মুনি মহা মহাজ্ঞানী
মেয়ের সঙ্গ ছেড়ে পড়েছে দশায়।
তখন সবে চেনাজানা হয়েছে ওঁদের সঙ্গে। আমি যাতায়াত করছি ঘোষপাড়ার আখড়ায়, গান শুনছি। ঠিকানা নিয়ে চলে যাচ্ছি উঁদমারি, সাহেবকলোনি, দিগরে। আরও দুর চৌহদ্দিতেও বিস্তার ঘটছে আমার আস্তে আস্তে। চক্রাকারে পাক খাচ্ছি নদিয়া। চলে যাচ্ছি আসাননগর, ভীমপুর, ঘূর্ণি, মাটিয়ারি, ভাতজাংলা, দেবগ্রাম। বর্ধমান ফুঁড়ে উঠছি বীরভূমে। হাটগোবিন্দপুরের সাধনদাস বৈরাগ্য বলছেন নবাসন গিয়ে নির্মলা মা-র সঙ্গ দেখা করতে। চলে যাচ্ছি আমি। সেখান থেকে খয়েরবুনি। সনাতন দাস বাউলের কাছে। বাঁকুড়া পরিক্রমায় সোনামুখী, বেলিয়াতোড় হয়ে পাত্রসায়ের। এদিকে নরম বীরভূম। আহমেদপুরের ভাঙা পরিত্যক্ত রেল কোয়ার্টারে ফুলমালা দাসীর আস্তানাতেই রাত কাটিয়ে দিচ্ছি। মাধুকরীর নানা সাইজের চাল জড়ো করে ফুলমালা ভাত চাপাচ্ছেন। আর সারাদিনভর মাধুকরীর উপোসী পেটের ধকল সহ্য করে হাসি মুখেই গাইছেন : ‘অধর স্বরূপে, মূলাধারে রূপ রয়েছে, / স্বধনে শ্যাম গউর হয়েছে।’ শ্যামের এই রক্তমাংসের গৌর হয়ে ওঠার তত্ত্ব তখনও আমি ভালো করে বুঝে উঠতে পারিনি। অহরহ গান শুনছি আখড়া-আশ্রমে। জয়দেব-সতীমা-অগ্রদ্বীপ-সোনামুখী-কুলের পাট-যুগলকিশোর-পাথরচাপুড়ি বাউলের কোনো মেলা-উৎসবই তখন বাদ যাচ্ছে না আমার। এমনই এক উৎসবের রাতেই আমার ‘বিন্দুধারণ’ কথাটির সঙ্গে প্রথম পরিচয়। ‘পাত’, ‘ছারাব’ —এইসব সাধন এলাকার কথাও সেদিনই আমার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন আখড়ারই বাউলনি। বেশ মনে আছে সেটা ছিল অগ্রদ্বীপের মেলার দ্বিতীয় দিন। গতদিন মাটির পাত্রে দই চিড়ে কলা খেয়ে কেটেছে। সেদিনটা হল ঘোষঠাকুরের শ্রাদ্ধ। এই ঘোষঠাকুরের শ্রাদ্ধকে উপলক্ষ্য করেই অগ্রদ্বীপের মেলার সূত্রপাত বলা চলে। এখানকার গোপীনাথ প্রতি বছরের চৈত্র একাদশীতে কাছা পরে শ্রাদ্ধ সারেন ঘোষঠাকুরের। কৃষ্ণ এখানে সন্তান। গোপীনাথের সেবাপুজো গোবিন্দ ঘোষ বাৎসল্যভাবে করে আসছিলেন দৈবনির্দেশিকায়। সেজন্য ছেলের অবর্তমানে গোপীনাথই নাকি তার শ্রাদ্ধ করে আসবেন ফি বছর, এমনই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এই মেলার মাহাত্ম বোধহয় এখানেই। ভক্তবৎসল ঈশ্বর প্রতি বছরের এই দিনে মন্দির থেকে বের হয়ে গোবিন্দ ঘোষের মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে রীতিমতো কাছা পরে এক হাতে কুশ ও অপর হাতে পিণ্ড নিয়ে শ্রাদ্ধ সারেন। সন্তান হয়ে ঈশ্বরের এই জাগতিক রূপারূপ আর কোথাও দেখা যায় কিনা আমি জানি না। বোধহয় নয়। শ্রাদ্ধানুসারে তাই প্রথম দিন কেউই অনুগ্রহণ করেন না এখানে। দ্বিতীয় দিন অন্নোৎসব। বেশ বেলাবেলি খেয়ে ওঠার পর ঠাই মিলেছে মীরা মা-র আখড়ায়। ওখানে বসেই হাপিত্যেশ করছি আমি সাধনার মূল বিষয় কিছু শুনবার বুঝবার। এমন সময় মীরা মাই এলেন আমার সামনে। শান্ত কোমল বাংলার বাউলনির চেহারা। কিন্তু কে বলবে গত রাতে এ চেহারাই কেমন বদলে উঠেছিল পাল্লাগানে। কী অনায়াসেই মা আসরের বাউলদের অপদস্থ করেছিলেন অভিজ্ঞতা আর জ্ঞানসমৃদ্ধ সুরের ভাষায়। কত আসরেই তাকে আমি দেখেছি মধ্যমণি হয়ে বসে থাকতে। কোলে রাখা ভুগিতে চাপড় মারতে। ডান হাতে ধরা একতারাতে টুং টাং বাজিয়ে নিতে। তারপরই আসর বন্দনা দিয়ে শুরু করে একেবারে সুর আর শব্দের মহাসমুদ্রে ঝাপিয়ে পড়তে। তবে এই আসর হাট-মাঠ-ঘাটের নয়। একান্ত ঘরোয়া আসর সব। বেশিরভাগই শিষ্য-শিষ্যাদের বাড়ির। সেখানে কেবল সাধুগুরু বাউল-বৈষ্ণবদের যাতায়াত। সাধারণের কৌতূহলী প্রবেশ সে অর্থে নেই। একান্ত ভক্তজনের সামনেই মীরা মা কেবল গান করেন। তিনি ছিলেন কাকা গোঁসাইয়ের প্রধান সঙ্গিনী। শুনেছি গোঁসাই ছিলেন সিদ্ধ সাধক। দেহ রাখার পর মীরা মা তার আশ্রমের দায়ভার নিয়ে আছেন। ভক্ত-শিষ্য সকলেরই মা তিনি। আশ্রমে তত্ত্বকথা শুনিয়ে, সাধনার গান গেয়ে তিনি বেশ মর্যাদার সঙ্গে দিন কাটান। বাউলের প্রচার-খ্যাতি-ব্যভিচার এসব নিয়ে তাঁর হেলদোল নেই একেবারে। ভাবে মজে থাকেন। সেজন্য তিনি বর্তমান বাউল সমাজের যোজন হাত দূরে। তাই তাঁর বিশ্বাস এখনও কাকা গোঁসাইয়ের ভাবধারায়। বাউলের অবক্ষয়, অবনতি এসবে তার কলরব সেই এখনও প্রাচীন পন্থাতেই পড়ে। মেয়েরা সাধনসঙ্গিনী হয়ে সাধকের অতলস্পর্শকেই শুধু ছোঁবে। গান করবে কী!
সেই রাতেই মা-কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সাধনায় মেয়েদের স্থান কতটুকু? রেগে উঠলেন মা।