খেপী মা সেদিন আমাকে শিবের মাথার বাঁকা চাঁদকে বলেছিলেন সাধকের সিদ্ধির জাগৃতির স্বরূপ।
তা বাবা ফকির তো কোলো তার মতো। চাঁদ, ব্যোমভোলার মাথার চাঁদ কী। বাবা? কী মনে কর তুমি?
আমি চুপ।
মা বললেন, ওসব সাধনযোগ তুমি ছাড়ান দাও দিকি।
ফকির হাসছেন মিটমিট করে। কালভৈরব তখন মায়ের পাশে।
খেপী মা বললেন, শিবের চাঁদ সাধনে সিদ্ধি গো।
কীভাবে? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
খেপী মা বললেন, চাঁদ শূন্যতা। শূন্যতা পরম। পরম হল গিয়ে শিব–বলেই মা ব্যোমভোলে ব্যোমভোলে বলে দু’বার চিৎকার তুললেন।
ভৈরবের ডেরায় তখন যজ্ঞের আগুন নিভে আসছে। ফকির চিমটে নিয়ে তৈরি। ভৈরবের কথামতো গান ধরলেন তিনি।
কালভৈরব বলতে লাগলেন–চন্দ্র হল ব্রহ্মাণ্ডস্বরূপ। বাউল ফকিরও তা মানে। তাদেরও ব্রহ্মাণ্ড শরীর। আমাদেরও। সবার ব্রহ্মাণ্ড হল গিয়ে সেই শরীর। আমি-আমি আমি-আমি–বলতে লাগলেন ভৈরব।
থামেন দিকি।
খেপীর কথায় বাবা থামলেন।
মা বললেন, শরীরের আজ্ঞা চক্র ভেদ হলেই চন্দ্ৰজ্যোতি বের হয়। শিবের মাথার চাঁদ হল সেই জ্যোতি। শরীরই শিব বাবা।
ভৈরব বললেন, আজ্ঞা ভেদ হলে একে একে শক্তি উপরে উঠেই শিবত্ব লাভ। জীবত্ব থেকে মানুষ শিবত্ব লাভ করে। মানে হল মানুষই ভগবান।
বেষ্টিত ভক্ত-শিষ্য বলতে লাগলেন, কালভৈরব কী জয়। খেপী মা কী জয়। তারাপীঠ কী জয়। তারা মা কী জয়। জয় শঙ্কর।
খেপী মা বললেন, হারামজাদারা সব জয় দিলি,সিদ্ধ ফকিরের জয় দিলি না। বলেই বললেন, ফকির ফজর শাহ কী।
সমবেতভাবে জয়ধ্বনি উঠল–জয়।
গান ধরলেন ফকির। শোনা সেই গান। পুকুর ধারে যা গেয়েছিলেন ফকির।
*****
গানে স্পষ্টই বলা হয়েছে–’পূর্ণিমার চাঁদ ধরবি কে রে/ তোরা দেখ চেয়ে ত্রিবেণীর উত্তর দক্ষিণ/ রবি শনি তার দুই কিনারে।’ পূর্ণিমার চাঁদ হল চন্দ্রকলার বৃদ্ধির পর একেবারে পূর্ণাঙ্গ অবস্থা। এই পূর্ণচন্দ্র হল বাউল মতের প্রেম। পূর্ণচন্দ্রের প্রতীককে বাউল প্রেমই বোঝেন। ‘পূর্ণিমার চাঁদ’ ধরার অর্থ প্রেমকে সাঙ্গ করা। যে প্রেম শরীরের মধ্যে রয়েছে। প্রেম এখানে কাঙ্খিত পরম ঠিকই কিন্তু সেই পরমকে পেতে, উপলব্ধি করতে শরীরের যোজন যোজন পথই অতিক্রম করতে হয় বাউলকে। Platonic Love এর কথা আমরা জানি। আবার শরীর ছাড়া প্রেম হয় না কিছুতেই; আমি তোমাকে ভালোবাসির অর্থ তোমার সত্ত্বাকে ভালোবাসি ঠিকই, কিন্তু এই সত্ত্বা তো শরীরের মধ্যস্থিত সত্ত্বা; রক্তমাংসের সত্ত্বা, তাই শরীরের প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলোকেও ভালোবাসার সঙ্গে জড়িয়ে নিতে চান অনেকে। বাউল এই দ্বিতীয় মতে থাকলেও তাঁদের। বিশ্বাস শরীরের পথঘাট, রজ-বীর্য পার হয়ে এই ভালোবাসা হল কাম-পথকে পেছনে। রেখে প্রেম-পথকে সামনে আনা। এই পথ সাধনার পথ। প্রকৃতি-পুরুষের / যুগল শরীরের সাধনপথ। বাউল বলে একে ‘রাগের ভজন’। ‘রাগ’ এখানে, এ পথে আত্মার মোহাবস্থা বা নিজের কামাবস্থা কাটিয়ে ফেলে নিজের জাগ্রত দেহকে গরীয়সী করে তোলা। দেহ করে তোলা ভাবদেহ। বাহ্যদেহকে নষ্ট করলেই দেহ হবে ভাবদেহ। তার জন্যই দেহসাধনা। বাউলের সাধনা বাউল মতে ‘রাগের ভজন’ যেমন, তেমনই, ‘রাগের কারণ’। তাঁরা নিজেকে অনেক সময় ‘রাগের মানুষ’ বলেও উল্লেখ করে থাকেন। যা ‘মনের মানুষের নামান্তর ছাড়া আর কিছুই নয়।
গানে ‘পূর্ণিমার চাঁদ’ ধরবার জন্য ‘ত্রিবেণীর উত্তর দক্ষিণ দিকে যেতে বলা হয়েছে। ‘ত্রিবেণী’ বাউলের কাছে তিন নদীর নামান্তর। গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী নদীরূপী তিনি নাড়ি ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না। শুধু বাউল সাধক নন, তন্ত্র তথা আমাদের যোগশাস্ত্র এই তিন নাড়িকে নদীনামের শিরোপা দিয়ে ‘ত্রিবেণী’ বা ‘ত্রিকূট’ বলে অভিহিত করেছে। বাউল অবশ্য ‘ত্রিকুট’ বলেন না। প্রধান চোদ্দ নামই আমাদের চোদ্দটি নদীর নামেই। চোদ্দ নাড়ি কী কী? ‘সুষুড়ো পিঙ্গলা চ গান্ধারী হস্তি জিত্বিকা। / কুহূঃ সরস্বতী পূষা শঙ্খিনী চ পয়স্বিনী। / বারুণ্যলয়ুষা চৈব বিশ্বোদরী যশস্বিনী। / এতাসু তিম্রো মুখ্যাঃ সুঃ পিঙ্গলেড়াসুষুমিকাঃ।।’ ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, গান্ধারী, হস্তিজিহ্বা, কুহু, সরস্বতী, পূষা, শঙ্খিনী, পয়স্বিনী, বারুণী, অলম্বুষা, বিশ্বোদরী ও যশস্বিনী–এই চোদ্দটি নাড়ির মধ্যে ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্না প্রধান। সাধক এই চোদ্দ নাড়িকে বলছেন পূণ্যনদী। তিনটি নাড়ির নদীনাম বলে ফেলেছি আমরা। বাকি এগারোটি নাড়ির নদী নাম হল–গান্ধারী = কাবেরী, হস্তিজিহ্বা = সিন্ধু, কুহু = নর্মদা, পূষা = তাম্রপর্ণী, শঙ্খিনী = তাপ্তী, পয়স্বিনী = গোদাবরী, বারুণী = চন্দ্রভাগা, অলম্বুষা = গোমতী, বিশ্বোদরী = বিতস্তা, যশস্বিনী = ইরাবতী। সাধক বলেন গঙ্গারূপা ইড়া, যমুনাস্বরূপা পিঙ্গলা আর সরস্বতীরূপিণী সুষুম্না। আজ্ঞাচক্রের উপরে ত্রিবেণী বা ত্রিকূট রূপের প্রতীকী স্থানে মিলিত হয়েছে। এই তিন নদীরূপী নাড়িতে সাধক যোগক্রিয়ায় বাহ্যস্নান সারেন প্রতিনিয়ত। এলাহাবাদের ত্রিবেণীতে স্নানে যে পূণ্য এই বাহ্যস্নানেও সাধকগণ একইরকম পূণ্যফল লাভ করে থাকেন। বাউল সাধকও তাই বিশ্বাস করেন। তন্ত্রমতে ইড়াকে চন্দ্রস্বরূপা, পিঙ্গলাকে সূর্যস্বরূপা এবং সুষুম্নাকে চন্দ্র, সূর্য ও অগ্নিস্বরূপা হিসাবে দেখা হয়। আর এই তিন নাড়িতেই সত্ত্ব, রজ, তম এই তিনটি গুণ বিরাজমান।