তবে আমরাও ইচ্ছে করলে চাঁদকে অনায়াসে গান শোনাতে পারি। তাঁর জন্য আমাদের শরীরকে কেবল জাগ্রত করতে হবে যোগে। শরীরের ভেতর আমাদের চাঁদ আর সূর্য সদা বিরাজমান হয়ে দিব্যি আলো ছড়াচ্ছে। আমরা কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না। তন্ত্রে মৎস্যসাধক তিনিই হতে পারেন, যিনি শরীরের গঙ্গা ও যমুনা নামে দুই মাছকে বেশ ভালোভাবে তৃপ্তি সহকারে খেয়ে নিতে পারেন। কীভাবে খাবেন তন্ত্রসাধক শরীরের এই দুই কল্পিত মৎস্যকে?
‘গঙ্গা যমুনয়োর্মধ্যে মৎসৌ ঘৌ চরতঃ সদা/ তৌ মৎসৌ ভক্ষয়েদ যস্তু স ভবেন্মৎস্য সাধকঃ।।’ অর্থাৎ কিনা গঙ্গা যমুনার মধ্যে দুটো মাছ চরে বেড়াচ্ছে। গঙ্গাকে। সাধক বলছেন ইড়া, পিঙ্গলা হল যমুনা। রজ ও তম এই দুই মাছ তার মধ্য দিয়ে চলাচল করে। রজ=শ্বাস, তম=প্রশ্বাস। যে সাধক এই দুই মৎস্যকে ভক্ষণ করতে পারেন তিনি। মৎস্যসাধক বা মৎস্যাসী। কীভাবে এটা সম্ভবপর? এটা সম্ভবপর যোগক্রিয়ায়। প্রাণায়ামে রেচকেপূরকে। কুম্ভকে।
মৎস্য অবতারের গল্পে আছে মৎস্যের আবির্ভাবই হয়েছিল সপ্ত ঋষিকে প্লাবনের হাত থেকে রক্ষা করবার জন্য। এক অসুর বেদ চুরি করে সমুদ্রের তলায় লুকিয়ে রেখেছিল। বেদও মৎস্য অবতার উদ্ধার করে আনেন।
সমুদ্রকে আমরা ধরতেই পারি মানবদেহ। সমুদ্রের তলদেশ হল মূলাধার। মূলাধার চক্র নীচস্থ অবস্থানেই থাকে শরীরে। শ্বাসবায়ু হল মৎস্য, অসুর হচ্ছে প্রশ্বাস বায়ু। এই অসুর কুলকুণ্ডলিনীকে মূলাধারের দিকে টেনে নামিয়ে আটকে রাখে। সপ্ত ঋষিকে আর বেদ চুরি করে এনে রাখার মতো করেই। শ্বাস মৎস্য অবতার সেজে মূলাধার থেকে সেই কুলকুণ্ডলিনী অর্থাৎ চক্ৰমধ্যস্থিত শক্তি বা জ্ঞানকে টেনে ওপরে তোলে। এইজন্য শ্বাসকে মৎস্য অবতার রূপে ভাবতে পারি। আর এই রূপকে, প্রতীকে শ্বাসকে ভাবলে প্রশ্বাসকে করতে হচ্ছে অসুর। তাহলে দাঁড়াল এইঃ শ্বাস/ প্রাণবায়ু/ মৎস্য, প্রশ্বাস/ অপান বায়ু/ অসুর।
সাধক যেমন আমাদের নাড়িকে নদীরূপের প্রতীকী অবয়ব দিয়েছেন তেমনই নাড়িকেই আবার আকাশ, মহাকাশের দ্যোতনাও দিয়েছেন। আর সেই দ্যোতনাকে সাথে নিলে ফকির কথিত চন্দ্র রয়েছে আমাদের শরীরের মধ্যেই। কীভাবে? চন্দ্রকে বাউল সাধক / দেহ সাধক / সহজিয়া সাধক বলেন ইড়া আর পিঙ্গলাকে সূর্য। বাউল অবশ্য সরাসরি চন্দ্রকে ইড়া বলেন না। চন্দ্র হল তাঁদের কাছে বাঁ নাক আর সূর্য ডান নাক। রেচক করার সময় শরীরের ভেতর টেনে নেওয়া বায়ু ডান নাক দিয়েই বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পূরকে যা বাঁ নাকের মাধ্যমে শরীরের মধ্যে টেনে আনা হয়। ডান নাক দিয়ে বায়ু রেচন করা হয় আবার বিপরীতক্রমে মানে শ্বাস ছেড়ে দেবার পর ডান নাকেই টেনে দুই নাকে রেখে কুম্ভক করে বাঁ নাক দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয় রেচক করেই।
মহাবিশ্বের সৃষ্টির স্তরকেও সাধক শরীরের মধ্যেই দেখেন। ছটি স্তরকে তাঁরা দুটি চক্র হিসাবে বর্ণনা করেন এবং প্রত্যেকটি চক্রে এক একজন নিয়ন্ত্রক দেবতা আছেন আর চক্ৰমধ্যে একটি বিশেষ গুণও বর্তমান বলে তাঁদের বক্তব্য। চক্রে চক্রে সাধক যখন সেই চেতনাকে অপর চক্রে ঠেলে তুলে উধ্বক্রমে শক্তিকে তুলতে তুলতে চক্র পার হয়ে যান তখন একেক চক্রকে তাঁরা বলে থাকেন মহাবিশ্বের স্তর। এই ছয় চক্রের শেষ দুই চক্রের মধ্যে কিন্তু চন্দ্র রয়েছেন। চন্দ্রই এই দুই চক্রের নিয়ন্ত্রক দেবতা। বিশুদ্ধ চক্র সাধকের কাছে মহাবিশ্বেরই তর্পলোক, তা সত্ত্ব গুণে আচ্ছন্ন আর নিয়ন্ত্রক দেবতা চন্দ্র। আজ্ঞা চক্র সত্যলোক, সত্ত্ব গুণ তার। নিয়ন্ত্রক দেবতা সেই চন্দ্রই। তাহলে এখানে এভাবে। দেখলেও কিন্তু দেখব শরীরের ভেতরই রয়েছে চন্দ্র। প্রসঙ্গত এখানে বাকি চার চক্রের কথাও বলে রাখি। মূলাধারে ভুবর্লোক, গুণ তম, নিয়ন্ত্রক দেবতা অগ্নি। স্বাধিষ্ঠানে স্বর্লোক, তমগুণ, অগ্নি দেবতা। মণিপুরে মহর্লোক, গুণ রজ, দেবতা সূর্য। অনাহতে জনর্লোক, রজ গুণ, সূর্য দেবতা।
মুদ্রা সাধকের তন্ত্রে বর্ণনা করা হয়েছে এইভাবেঃ ‘সহস্রারে মহাপদ্মে কর্ণিকা মুদ্রিতা চরেৎ। আত্মা তত্রৈব দেবেশিকেবলং পারদোপমম।।/ সূর্য কোটি প্রতীকাশং চন্দ্রকোটি সুশীলতম। অতীব কমনীয়ঞ্চ মহাকুণ্ডলিনী যুতম। যস্য জ্ঞানোদয় তত্র মুদ্রা সাধক উচ্যতে।।’ মানে হল মাথার উপরের অংশে সহস্রার মহাপদ্ম বর্তমান। তার কর্ণিকার মধ্যে পারদের মতোই ঢল ঢল সুনির্মল সাদা বর্ণ সব আছে। সেই বর্ণের এমনই জ্যোতি যে, চন্দ্ৰসূর্যের জ্যোতি থেকেও সে জ্যোতিস্মান। এর সঙ্গে যুক্ত আছেন কুণ্ডলিনী আকারে মহাশক্তি। তিনি পরমাত্মা, পরমব্রহ্মণ, তুরীয় তুরীয়াতীত আনন্দ সব। যার জোরেই শরীরের রাস্তাঘাট, গাছপালা সব প্রকট হয়ে পড়ছে। চাঁদকে কিন্তু মনের প্রতীক হিসাবেও ধরে থাকি আমরা। ধরার কারণ চন্দ্রের বিভিন্ন কলাতে মনের প্রভাব। মহিলাদের, বলা ভালো, সঙ্গিনীর রজঃপ্রবৃত্তির সময়কে বাউল সাধক অভিহিত করে ‘অমাবস্যা’ বলে। আমাদের এক সংস্কারও আছে–মাসিক বা রজঃপ্রবৃত্তির সময় বাড়ির মহিলারা ঠাকুর ঘরে ঢোকেন না। পুজো করেন না ওই সময়। বলেছি আমরা চাঁদকে মনের প্রতীক। চেক বিজ্ঞানীরা প্রমাণও করেছেন রজঃপ্রবাহের সময় মহিলাদের চিত্তচাঞ্চল্য বেশি হয়। আর দেবার্চনা হল গিয়ে ধ্যানস্থ অবস্থার কাজ। ধ্যানে ভক্তিতে দেবতাকে ডাকার, অর্চনা করার নিয়ম। এই রজঃপ্রবাহের কালে যেহেতু মহিলাদের চিত্তচাঞ্চল্য বেশি মাত্রাতে থাকে সেইজন্যই আসলে এই সংস্কার। এই যৌক্তিকতাকেই বোধহয় সংস্কারে গাথা হয়েছে। তবে তাও নয়। সংস্কার আগে তৈরি। প্রামাণিক নথি বিজ্ঞানীদের হাতে এসেছে বেশ পরে। তবে বোধহয় সংস্কার এ কারনেই গড়া–রজঃপ্রবাহের সময় বা চলাকালীন সেই স্রোতে যৌনাঙ্গ তথা চারপাশ অশুচি বা চটচটে হয়ে পড়ে। কাপড় জাতীয় বস্তু ব্যবহার করতে হয়। তখন তো আর টেনে নেবার মতো ন্যাপকিন জাতীয় কিছু ছিল না। তাই এই অপরিচ্ছন্ন দশাতে, ঘিন ঘিনে ভাবে ঠাকুরের কাছে যেতে যেন বাঁধো বাঁধো লাগে। সেই থেকেই এই বিধিকল্পের সংস্কার। চন্দ্রের প্রভাবে যে চিত্তচাঞ্চল্য ঘটে তা জ্যোতিষীরাও মানেন। সেজন্যই তাঁরা অস্থির মতি ব্যক্তিদের ‘মুন স্টোন’ ধারণ করার পরামর্শ দেন।