মস্ত এক হাওয়া বইল এ সময়। আমরা দেখলাম হাওয়া ফুঁড়ে উঠে এলেন যিনি তাঁর সর্বাঙ্গ জলে ভেজা। লাল শাড়ির আঁচলে তবু লেপ্টালেপ্টি খাচ্ছে হাওয়া। কপালের সিঁদুর জল লেগে মিয়ে গেছে যেন। হাত ভর্তি পলায় চাঁদ লেগে জলের চিকচিক।
মা এসে ছিলিম ধরলেন। কোনওদিকে তাকালেন না পর্যন্ত। কপালে ঠেকালেন। বললেন, ব্যোম শঙ্কর। বার তিনেক টেনে তিনি নেমে গেলেন সোজা। যেখান থেকে উঠে এসেছিলেন সেখানেই চলে গেলেন তিনি। এ যেন সীতার পাতাল প্রবেশ।
ফকির বললেন, গরম ধরিসে মার সেই থেকে জলে।
আমি ভাবলাম, এই শেষ শীতেও মা-র শরীরে এত গরম।
বললেন, তারাপীঠ থেকে এসেছেন মা। সঙ্গে কালভৈরব। এসে থেকে জলে রয়েছেন তিনি। তন্ত্র করেন তো। তাই শরীরে এত তাপ মা’র। তারাপীঠ যাবেন। দেখবেন শ্মশানে মায়ের দাপট। প্রতি অমানিশায় ক্রিয়াকর্ম করেন তিনি আর কালভৈরব। ভৈরব এসে থেকেই যে কোথায় গায়েব হলেন!
হাওয়া দিচ্ছে। খেপী মা জলেই সেঁধিয়ে রয়েছেন। চুপ হলেন ফকির। চোখে বোধহয় রং লেগেছে। বেশ কিছু টান হয়ে গেছে তাঁর।
******
জিজ্ঞাসা করলাম–কাকে গান শোনাচ্ছিলেন?
–কাকে আবার! ফিক হেসে বললেন ফকির। আমার এ সময় মনে পড়ে গেল কবির কথা–’চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পড়ে আলো। / ও রজনীগন্ধা, তোমার গন্ধসুধা ঢালো।।’
আমি সত্যিই চাইছি ফকির তাঁর জ্যোৎস্না হাসির পরত ছুঁয়ে কিছু বলুন। অমন যার গান; ভেতর থেকে ঠিকরে বেরোনো সব কথার কুচি, এমন ভাব যেন তিনিই পদকর্তা। এতখানি একাত্মতা! গানের সেই পরশ কথাতেও নিশ্চয়ই থাকবে। এ আমার বিশ্বাস। তবে অভিজ্ঞতার পর এরকম বিশ্বাস আমি সংগ্রহ করেছি।
জবাব দিলেন না ফকির।
তবে কি তিনি কথা বলতে চাইছেন না!
ভাবলাম আমি।
বললাম, ‘তালে আমাদের দেখার সাথে সাথে বললেন যে, ‘তারে আর গান শোনানো হবে না।‘ কাকে গান শোনাচ্ছিলেন আপনি? খেপী মা তো বললেন ডুব মেরেই থাকেন জলে। কুম্ভক করে। তবে শ্রোতাটা কে শুনি? কেউ তো নেই এখানে।
আবারও ফিক হাসলেন ফকির। চুপ মারলেন। বুঝলাম তিনি কিছুই বলবেন না।
বললাম, আমরা আসার সঙ্গে সঙ্গেই বললেন পরাণের কতা কইবেন। কই কিছুই যে কইছেন না!
নীরবতা ভঙ্গ দিলেন ফকির।
বললেন, খ্যাপার যে আর তর সইছে না।
আবীর, সুজিত থম মেরেছে। বুঝলাম ধরেছে ওদের।
ফকির বললেন, আমি খ্যাপা চাঁদরে শোনাচ্ছিলাম গান। চাঁচরের চাঁদ কথা কইছে। ভাবলাম চাঁদরে চাঁদের কতাই শোনাই। তাই চিমটে বাজিয়ে গাইছিলাম আর কী।
চমকে গেলাম আমি।
বলেন কী ফকির! চাঁদকে শোনাচ্ছেন গান। আশ্চর্য!
বিস্ময়কে তিনিই ভাঙলেন।
বললেন, ভাবছেন নেশা ধরি গেছে আমার। তা খ্যাপা চাঁচরে তো চাঁদের নেশাই ধরে।
আমি চুপ কী বলব ভেবে পাচ্ছি না।
ফকির বললেন, আপনে চাঁদের সঙ্গে কতা কন না? কন কন।
আমি অবাক।
বলে চলেছেন তিনি–সকল মানুষই কথা কয় চাঁদের সঙ্গে। বুঝে, না-বুঝে, জেনে, না-জেনে কথা চলে চাঁদের সঙ্গে। খ্যাপা জানেন তো আপনে। এ লাইনে ঘোরাফেরা তো অনেকদিনের বলেই মনে হচ্ছে। চিমটেটা বাজাতে থাকলেন তিনি। আবার গান ধরলেনঃ
সে কথা কি কইবার কথা জানিতে হয় ভাবাবেশে
অমাবস্যা পূর্ণিমা সে পূর্ণিমা সে অমাবস্যে
অমাবস্যায় পূর্ণিমা যোগ আজব-সম্ভব সম্ভোগ
জানলে খণ্ডে এ ভব রোগ
গতি হয় অখণ্ড দেশে।
রবিশশী রয় বিমুখা
মাস অন্তে হয় একদিন দেখা
সেই যোগের যোগে লেখাজোখা
সাধলে সিদ্ধি হয় অনায়াসে।
দিবাকর নিশাকর সদাই
উভয় অঙ্গে উভয় লুকায়
ইশারাতে সিরাজ সাঁই কয়
লালন রে তোর হয় না দিশে।
প্রথমেই বুঝেছিলাম বৃদ্ধ ফকির চাঁদ বলতে কী বোঝাতে চাইছিলেন। তবে এসব ক্ষেত্রে দেখেছি না জানার ভান করলেই বেশি জানা যায়। আমি যে তাঁর ইঙ্গিত ধরতে পেরেছি এটা অভিজ্ঞ ফকির ধরে ফেলেছিলেন। এজন্যই আমাকে এ লাইনে অনেকদিনের কথা বলেছিলেন তিনি।
গানের ভেতর দিয়েই ফকির বলে দিয়েছেন, সে কথা কি কইবার কথা জানিতে হয় ভাবাবেশে। সত্যিই ভাবের এই আবেশ না থাকলে প্রতীকী কথকতার অন্তঃসার কিছুই ধরা যাবেনা, বোঝা যাবে না। আর তা না ধরতে পারলে ‘পূর্ণিমার চাঁদ’ও অধরা থেকে যাবে। পূর্ণিমার চাঁদ’ ধরতে হলে আমাদের নিজেদের মধ্যেই ডুবে যেতে হবে। শরীরের গহন অন্দরে, কলকজায় রয়েছে সেই পূর্ণিমার চাঁদ। পদকর্তা শাহ শির আলি তারই হদিশ দিতে চেয়েছেন পদটিতে।
ফকির যার জন্য বলেছিলেন আমাকে ‘আপনে চাঁদের সঙ্গে কতা কন না?’ তাঁর এই জিজ্ঞাসা মানুষের অনন্ত জিজ্ঞাসা। দেহসাধক এর উত্তর পান দেহকে ধরে। তাঁর এই দেহ জানা, দেহ চেনার অন্তর্জগত তৈরি করে দেন গুরু। গুরু দেহের অবিকৃত প্রকৃতিগুলোকে খুলে ধরেন। দেহপ্রকৃতি তখন হাসে, জাগ্রত হয়, চাঁদও ধরতে পারে সেজন্যই সুফিসাধক জালালউদ্দিনের গানে আমরা পাই—’চিনগে মানুষ ধরে/ মানুষ দিয়া মানুষ বানাইয়া সেই মানুষে খেলা করে। / কীসে দেব তার তুলনা কায়া ভিন্ন প্রমাণ হয় / পশুপক্ষী জীব আদি যত এ সংসারে/ দুইটি ভাণ্ডের পানি দিয়া অষ্ট জিনিস গড়ে–/ তার ভিতরে নিজে গিয়ে আত্মারূপে বিরাজ করে।’
প্রশ্ন হল আমাদের দেহ কীভাবে এই চাঁদকে খুঁজে পাবে? কীভাবে বা আমরা ধরব শাহ শির আলির চাঁদ। বৃদ্ধ ফকির তো সেই চাঁদ খুঁজে, চাঁদ ধরে দিব্যি বেশ চাঁদের সঙ্গে কথকতা কইছেন। গান শোনাচ্ছেন চাঁদকে। ভাবা যায়, আশ্চর্য!