‘পশ্চিমবঙ্গের বাউল’ অমর একুশে গ্রন্থমেলাতে রমরম করে চলল। চক্ৰতীর্থে বসেই সে সংবাদ এলো। এরপর ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ছড়িয়ে পড়ল বই। বন্ধুরা জানাতে থাকলেন ফেসবুকে। ওখানকার মান্য সংবাদপত্র ও পত্রিকাতে আদৃত হল। বই। এর পাশাপাশি বহিবঙ্গ ত্রিপুরা থেকেও বের হল বই ‘বাউল বাউলানির দেহসাধনা’। স্রোত প্রকাশনার গোবিন্দ ধর যত্ন নিয়ে ছাপলেন বই। ত্রিপুরা থেকে অসম ছড়িয়ে পড়ল বই। সেখানকার বাঙালি পাঠকদের কাছ থেকেও খবর আসতে থাকলো। এইসব বার্তার ভেতরই আবার নতুন কাজ, নতুন বই, দুই বাংলার বাউল আখড়ার আখ্যান। বাংলাদেশ, ত্রিপুরা, অসম, পশ্চিমবঙ্গ–বাংলাভাষার পাঠকদের কাছে এভাবে যে ছড়িয়ে পড়ব কোনওদিন ভাবিনি। গুরুকৃপা না হলে এমন উজানে ভাঁটির নাও বাওয়া কখনো কি সম্ভব? তন্নো ধিয়ঃ প্রচোদ্দয়াৎ।
এবারের ছড়িয়ে পড়ার দায়িত্ব নিয়েছে বন্ধু অরুণাভ। ওদের আত্মজা পাবলিশার্স এর তৎপরতায় নতুন বই পাঠক আদৃত হলে দীর্ঘদিনের আমার এই ঘোরাফেরাটা আরও একটু পূর্ণতার দিকে যেতে পারে। সাঁইজি বলেন, ‘মুর্শিদ পথের দাঁড়া যাবে কোথায় তারে ছাড়া।’
০১.১ প্রতিপদে পূর্ণিমা যার তিন ধারাতে জনম তার
ঘোষপাড়া মেলার আগের রাত। মেলা শেষ পর্বের প্রস্তুতির আয়োজন সেরে ফেলেছে পুরোদমে। আখড়ায় বাউল ফকিরদের সমাবেশ। সাধুরা তাঁদের ডেরায় ভক্ত শিষ্যদের সঙ্গে গল্পে মশগুল। হোমযজ্ঞ শুরু হয়ে গিয়েছে দু’এক জায়গায়। আজ চাঁচর। এ রাতের চাঁদে পূর্ণিমার ঘোর লেগে। চতুর্দশীর আলো নিয়ে চাঁদ দাঁড়িয়ে পড়েছে সতীমার পুকুরের পাড়ে। এ ধারটা নির্জন। দু’একজন বৃদ্ধা ভিখারি রাতে শোবারও প্রস্তুতি সেরে নিয়েছে বাঁধানো পাড়ে ময়লা ঘেঁড়া চাঁটাই পেতে। পুকুরের সিঁড়ির দিকটায় এগিয়ে গেলাম গানের আওয়াজ পেয়ে লোকজন তেমন নেই। অথচ এখানে এমনভাবে বসে কে গাইছেন এই গান! কাকে বা শোনাচ্ছেন! এগিয়ে গেলাম আমরা তিন বন্ধু। শীতের কামড় না থাকলেও ঠাণ্ডা একটা বাতাস বইছে। এ বছর দোল আগে। মাঝ ফেব্রুয়ারি বলে শীত তার লোটাকম্বল গুছিয়ে নেয়নি। ভাঁজ করা চলছে সবে। আমি গায়ের পাতলা চাদরটা কানে মাথায় জড়িয়ে নিলাম। আমার আবার চট করে ঠাণ্ডা লেগে যায়। গানের রেশ আমাদের কানে পুরোপুরি লেগে গিয়েছে। আমরা নিবিষ্ট মনে শুনছি। বৃদ্ধ এক ফকির একমনে গেয়ে চলেছেন। আমি নিশ্চিত তিনি আমাদের উপস্থিতি টের পাননি এখনও। পুকুরের দিকে মুখ করে রয়েছেন বলে আমাদের তিনি দেখতেও পাচ্ছেন না। হাওয়ায় আমার দুই বন্ধুর চুল ফরফর করে উড়ছে। চাদরের ভেতর ঢুকে পড়ছে হাওয়া। চাদর পুরোটা জড়ানো নয় বন্ধুদের শরীরে। উত্তরীয় করে গলাতে দোলানো। হাওয়া ঢুকে চাদর বেঁকেচুরে যাচ্ছে। উত্তরীয় যেন দোল খাচ্ছে রাধাকৃষ্ণের মতো। দু’জন দু’জনকে ভালোবাসতে শুরু করলে শরীরী সেই ভালোবাসার মধ্যে যেভাবে দু’জনের প্রত্যঙ্গ নড়ে; দোল খায়, ফকিরের পিঠে তারই ছায়া পড়েছে যেন। ভালোবাসায় মেতে উঠেছেন তিনি। এমনি তাঁর গায়কির আবিষ্টতা। তন্ময় হয়ে যাচ্ছি আমরা সব। আবীর ঘনঘন সিগারেট ধরাচ্ছে না। সুজিত ফাঁকা নির্জনে এসেছে সিগারেটে গাঁজা ভরে টানবে বলে, টানা দূরের কথা গাঁজার প্যাকেটও পকেট থেকেই বের করে উঠতেই পারেনি। গান এভাবেই বিবশ করেছে ওদের, মশা কামড়াচ্ছে। মুখের চারধারে ঘুরঘুর করছে মশা। তবু আমারও বিরক্তবোধ নেই। ফকির যেন গানের গাঁজা খাইয়ে দিয়েছেন আমাদেরকে। গাইছেনঃ
পূর্ণিমার চাঁদ ধরবি কে রে
তোরা দেখ চেয়ে ত্রিবেণীর উত্তর-দক্ষিণ
রবি শশি তার দুই কিনারে। বা
পের ঘরে রবির কিরণ
শশির ঘরে মার দর্শন
তোরা দেখতে পেলে হবি সৃজন
বাছাধন তাই চিনে নেরে।
কি করে চিনি চক্ররে
উদর ভরে আধ অক্ষরে
তোরা রুহিনির চাঁদ ধরবি যদি
ফাঁদ পেতে নে হৃদয়পুরে।
শাহা শির আলির হৃদয়পুরে
কেনে রয়েছে ঘুমের ঘোরে
ও তোর প্রেমের কক্ষে দেখনা
চেয়ে তোর নগরচাঁদ নগরের পরে।
ঘোর ভাঙল ফকিরের। পিছন ফিরে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, বুঝলাম। তারে আর গান শোনানো হবে না। সে বলল মানুষ এসেছে গো। তুমি থোও। কথা কও ওদের সঙ্গে। গান শোনাও। আমি পিছন ফিরি দ্যাখলাম সত্যি। আপনারা সব এসি গিয়েছেন। বসেন খ্যাপারা সব। দুটো-একটা কতা কই। পরাণের কতা।
আমাদের তিনজনই ফকির বসার একটা সিঁড়ি বাদ দিয়ে বসে পরলাম। আবীর সিগারেট ধরাল। সুজিত বের করে নিল গাঁজা। ফকির আর আমাদের দূরত্ব এখন এক সিঁড়ির। কিন্তু এই মানুষটাকেই এতক্ষণ আমরা ধরতে ছুঁতে পারছিলাম না। গানে তিনি আমাদের থেকে যোজন দূরত্ব তৈরি করে নিয়েছিলেন। এখন যেন খানিক ছুঁতে, ধরতে পারছি বলে মনে হচ্ছে। আবীর কলকে ছাড়া গাঁজা টানে না। ওর নাকি সিগারেটে আমেজ হয়না। কলকে প্রস্তুত করে বার দুই টানার পর ও ফকিরের দিকে বাড়িয়ে ধরল সেটা। বলল, নেন আসেন।
কলকে প্রসন্ন বদনে কপালে ঠেকালেন ফকির। টানলেন। বার দুই টানার পর বললেন, ওধারে খেপী মা রয়েছেন। ওনারে একটু দিই, ডাকি? কী বলেন আপনারা।
কিছু বলার আগেই তিনি ডাকলেন–মা, মাগো, আসো দিকি এদিক পানে। বাবারা সব প্রসাদ করিছে।