সেইসব বৃত্তান্ত কোনওদিন লিখব এও আমি স্বপ্নে ভাবিনি। রক্তে লোকায়ত সাধনার বীজ থাকলেও লিখতাম তো কবিতা। এখনও লিখি না যে তাও নয়। তবে আমার গবেষণাকেন্দ্রিক নানা বিষয়ে লেখালেখির চাপে মূলত সে লেখা ‘দেশ’ পত্রিকা কেন্দ্রিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বাংলা কবিতার মান্য কবি রমেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরী হলেন মুক্তাগাছার বিখ্যাত জমিদার বংশের সন্তান। ওঁর বাড়িটি ছিল আমার আখড়া শশান বাদে সময় কাটানোর আরেক জায়গা। আমার কলেজে পড়ার বয়সে নৈহাটির সেই বনানী বাড়িতেই আমি তাবড় তাবড় সব কবিদের পেয়েছি। তাই সেই বৃত্তেও মেলামেশাটাও আমার সহজ হয়ে উঠেছে। একদিকে কবিতা লেখা, কবিতা বিষয়ক গদ্য লেখা, কবিদের সঙ্গে সময় কাটানো অপরদিকে আমার সেই লুক্কায়িত জগতে মেলামেশা–এভাবেই কাটছিল দিন। কিন্তু একসময় লুকনো জগত্তার কথা জেনে ফেললেন ‘পত্রলেখা’র কর্ণধার গুনেন শীল। ডেকে পাঠালেন আমাকে। বাউলদের নিয়ে লিখবার কথা শুনে কলমে আমার আড়ষ্টতা, অথচ এ জগতের অজস্র গান আমার টেপ রেকর্ডারে বন্দী আর কথা নিয়ম করে আমার ডায়েরী লেখার খাতায়। প্রকাশক তাড়া দিচ্ছেন। লিখতে পারছি না আমি। সেই অস্বস্তির সময় গুরু আমাকে বললেন, তুমি লেখ এ জগতের কথা; বেষ্টিত আড়াল ভেঙে ভাবসাধনার আসল সত্যটুকু তুলে ধর।
গুরুর কৃপাতে আপনাআপনিই লেখা হয়ে উঠল। এক তীব্র নেশায় লিখে ফেললাম বই। প্রকাশকের ঘর থেকে ২০১১ সালের বইমেলায় বেরোলো বাউল গানের। কথকতা। আমি দেখলাম আমার মতো লেখকের বইও বিকোচ্ছে, সংবাদ পত্রে আলোচনা হচ্ছে। এরপর একের পর এক লিখতে শুরু করলাম লোকায়ত সাধকদের কথা। আমাদের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেনীর তথাকথিত উচ্চকোটির সংস্কৃতির ভেতর এই যুগল সাধনা নিয়ে বেশ কিছু প্রচলিত ধারণা আছে। বহমান ধারণার ভেতর রয়েছে অবশ্য সাধনবৃত্তেরই কিছু ব্যভিচার ও যৌনবিকৃতি। যা দেখেছি, যেভাবে দেখেছি, বুঝেছি, রপ্ত করেছি সবই দিয়ে আমি আজও লিখে চলেছি প্রান্তিক এই সমাজ কাহিনী। শাস্ত্রবিধিকে উপেক্ষা করে আলাদা অধিষ্ঠানের এই জগৎ আমাকে শিখিয়েছে অল্পে তুষ্ট হয়ে বেঁচে থাকা। আখড়া-শ্মশানে আমার সেই সামান্য বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতার খবর যে এ দেশ ছেড়ে প্রাণাধিক বাংলাদেশে পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছবে এও তো আমি স্বপ্নে ভাবিনি।
আখড়া শ্মশানে থাকতে থাকতে কবে যেন তৈরি হয়ে গিয়েছে আমার একটা মাটির মন। তথাকথিত আমার উচ্চশিক্ষা ও উচ্চবৃত্তের সংস্কৃতির বাইরে আমি দাঁড়াতে চেয়েছি হয়তো বা নদিয়া-ময়মনসিংহের মরমিয়াবাদের বীজ আমার শরীরে ঢুকে পড়ার কারণে। এরকমই যে আমার বিশ্বাস। সেই বিশ্বাস থেকেই শিক্ষিত হয়েও আধুনিক যান্ত্রিক পদ্ধতিতে আমার তীব্র অনীহা। যদিও বিশ শতকের প্রথমেই হাটগোবিন্দপুরে বাউলের আখড়ায় টেলিফোন, ক্রমে ক্রমে মোবাইল, ফেসবুকে পর্যন্ত বাউলের আইডি। বিশ্বজোড়া বাউল এখন, আধুনিক জীবনে অভ্যস্থ; নানা দেশ দেখার অভিজ্ঞতাও তাঁর তাপ্পি মারা পোশাকে লেগে। তবে এতে আমি কিছু দোষ দেখি না। ধূলিতল অন্তরে রেখেও বিশ্ববোধের সঙ্গে লোকায়নের মেলবন্ধন ঘটানোটাই বুদ্ধিমানের। তাহলে আমাদের প্রাচীন শেকড়গুলো। ধরে রাখা সম্ভব। সেই সম্ভাবনা পশ্চিমবঙ্গের বাউল সমাজেও এসেছে কিছু শিক্ষিত সংস্কৃতিবান মানুষের সহায়তায়। এখানকার কিছু বাউল তাই তাঁদের দৈন্যতা ও মাটির জড়তা কাটিয়ে আধুনিক হতে পেরেছেন। তাছাড়া এখন লোকশিল্পীদের ভাতারও ব্যবস্থা করেছেন পশ্চিমবঙ্গের সরকার। সরকারী মেলা-অনুষ্ঠানে গান গেয়ে উপার্জনের পথে গিয়েছেন বাউল। সামান্য শ্রী ফিরেছে বাউলের জীবনে।
আমিও আমার জড়তা কাটিয়েছি অনেক। মোবাইল ব্যবহার করি। যদিও অনেক লেখকের মতো কম্পিউটারে বসে লিখতে পারি না। এখনও হাতে লিখতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করি। বছরখানেক হলো ফেসবুক ব্যবহার করি আমার বন্ধু ও প্রকাশকদের বকাবকিতে। আর এই ফেসবুকে এসে যেটা হল, আমার পূর্বপুরুষের দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বেড়ে গেল। আস্তে-ধীরে জানতে পারলাম এখানকারও কিছু মানুষ আমার বইপত্র পড়েছেন। আমার মতো সামান্য লেখকের বই কোলকাতা উজিয়ে বাংলাদেশ পৌঁছেছে এতেই আমার আনন্দ।
সিলেটের বাসিন্দা লোকসংস্কৃতি গবেষক সুমনকুমার দাশ আমার অনীহার সেই ফেসবুকের দৌলতেই এখন প্রাণের বন্ধু। যদিও ওকে সামনাসামনি কখনো দেখিনি। ও একদিন আমাকে চমকিত করে বলে বসল, আমার বইগুলো ও পড়েছে এবং রেফারেন্সের কাজে লাগিয়েছে কিছু, আর সে আমাকে ‘বাউল গানের কথকতা’ বেরোবার পর হতে খুঁজছে। আমার তো তখন পিলে থমকে যাওয়ার জোগাড়। তা সেই সুমনই একদিন প্রস্তাব দিয়ে বসল বইয়ের। ওরই ব্যবস্থাপনায় বই করতে এগিয়ে এলেন ঢাকার উৎস প্রকাশনার কর্ণধার। আমি এত সম্মানিত ও বিস্মিত যে মোস্তফা সেলিম কোলকাতা এসে আমার সঙ্গে দেখা করে গেলেন। সুফিবাদ, মরমিবাদ, পুঁথি সাহিত্যের নানা বিষয় নিয়ে রীতিমতো পাণ্ডিত্যপূর্ণ এই মানুষটির সঙ্গে আমি সময় কাটিয়ে নিজেকেই ধন্য মনে করি। তিনিও এখন আমার বন্ধু। আমার আশা অন্যান্য প্রকাশকদের মতোই তাঁর সঙ্গে আমার প্রকাশক–লেখক সম্পর্ক কখনোই হবে না। চিরকালই আমার বন্ধু ভাগ্য ভালো। বন্ধুরাই সবসময়। এগিয়ে এসে আমাকে তুলে ধরেছেন, আমি শুধু ওদের সঙ্গে সেঁটে থাকতে চেয়েছি। এছাড়া আমার যে আর কোনও যোগ্যতা নেই।