মাকির বেড়ে দেওয়া ভাত খেয়ে হাটগোবিন্দপুর ছেড়ে আমি রওনা দিই বাঁকুড়ার নবাসনে। সেখানে নির্মলা মা দেখি আশ্রম সামলাচ্ছেন। তাঁর সাধনসঙ্গী হরিপদ গোঁসাই বাউল সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত। হটযোগ ও প্রাণায়ামে দক্ষ এই বাউল প্যারিসে যান যুবক-যুবতীদের যোগ শেখাতে। শীতকালে নবাসনে উঠে আসে টুকরো প্যারিস। ফরাসি সহায়তায় হরিপদ গোঁসাইয়ের মাটির বাড়ির আখড়ায় পাকা ঘর ওঠে, স্যানিটারি পায়খানা, পাতকুয়ো, টিউবওয়েল। এসব দেখে কোথাও যেন আমি সাজুয্য খুঁজে পাই সাধন দাস বৈরাগ্যের আখড়াবাড়ির। ফরাসি-জাপানি সহায়তায় স্বচ্ছল হয়ে ওঠে পশ্চিমবঙ্গে বাউলের সংসার। নির্মলা মা আমাকে প্যারিস থেকে প্রকাশিত সিডি উপহার দেন। পৃথুল চেহারার পান-দোক্তা খাওয়া কালো দাঁতের, গেরুয়া বসন পরিহিতা হাসিখানা আজও যে আমার বুক কাঁপায়!
এদিকে নরম বীরভূম। আহমেদপুরের ভাঙা পরিত্যক্ত রেল কোয়ার্টারে ফুলমালা দাসীর আস্তানাতে দুপুর দুপুর উঠি। ওঁর অশক্ত শরীরে মাধুকরী করে পাওয়া নানা সাইজের জড়ো করা চালের ভাত খেয়ে মরমে মরে যাই। আমি যদি না খাই তাহলে কাল হয়তো তাঁকে ভিক্ষাতে বের হতে হতো না, কিন্তু এ সমাজ এমনই অতিথি পরায়ন কোনও বারণই শোনে না। মহম্মদবাজারে চলে যাই গৌর ক্ষ্যাপার আস্তানায়। সাধনার সঙ্গে পরিচয় হয় আমার। আমি দেখে চমকে যাই মোটা থানের শাড়ি পরা এই মেয়েই আগে অভাবের তাড়নায় শরীর বেচতেন সিউড়ির লজে লজে। বাউলের নারীর এও এক রূপ। সাধন সঙ্গিনীর আগমন এই জায়গা থেকেই। অসহায়, নির্যাতিতা, স্বামীহারা। মেয়েদের গুরুপাঠই যে ভরসা। সেখানেও জায়গা নিরিখে অনেকেরই পূর্বতন অভিজ্ঞতাগুলো কাজ করে। তথাপি এ সমাজে গৌর ক্ষ্যাপার মতো সাধকেরা রয়েছেন। সাধনা, নির্মলারা খেয়ে-পড়ে সম্মানের সঙ্গে বাঁচেন। বাউল সাধনার এও এক দিক। অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া মেয়ে মানুষদের দেখা মেলে এখানে। কোথায় যেন এসে সাধনা ও যৌনতা এক হয়ে ওঠে। সাধন সঙ্গিনীর থাকা ও চলে চলে যাওয়া, সাধক বাউলের সঙ্গিনী বদলানোর তরঙ্গেও দুলতে থাকে পশ্চিমবঙ্গের বাউল সমাজ। জয়দেবে বসে প্রখ্যাত বাউল পূর্ণচন্দ্র দাসের দিদি রাধারানি অভিযোগ করেন, কেউ তাঁকে আর গাইতে ডাকে না এখন; জানান বৃদ্ধ বয়সেও ওকে এখনও মাধুকরীতে বেরোতে হয়। গোপালনগরে গিয়ে আমি তাঁর হতশ্রী দশা দেখে আসি। ছোট ভাই চক্ৰধরের পোলিও রোগে দুটি পা পঙ্গু হয়ে যাওয়া ছেলে নিয়েই যে তাঁর সংসার। ওরই জন্য গান গাওয়া, মাধুকরী। পূণ্যর দিদির এই করুণ কাহিনী শুনে আমি আসি কেন্দুয়াতে ওদেরই ভাই লক্ষ্মণ দাস বাউলের বাড়ি। দেখি নবনী দাস বাউলের সমাধি। আমার সারা শরীরে তখন ঝড় ওঠে। আমি দেখি শান্তিনিকেতনের আশ্রমে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথকে গান শোনাচ্ছেন নবনী দাস বাউল!
আসি মুর্শিদাবাদ। থাকতে শুরু করি মজলিশপুরে শশাঙ্ক দাস বৈরাগ্যেরই ওখানে। আলাপ হয় ওঁর শিষ্য বেলডাঙ্গার সোমেন বিশ্বাসের সঙ্গে,চলে যাই সাটুই। প্রখ্যাত বাউল মনোমোহন দাসের সমাধি বাড়িতে। সুলক্ষনার সঙ্গে আলাপ হয় আমার। এভাবেই বাউল বৃত্তে ঘুরপাক খেতে থাকে আমার জীবন, ফাল্গুনে ঘোষপাড়া, চৈত্রে অগ্রদ্বীপ, শেষচৈত্রে পাথরচাপুড়ি, জৈষ্ঠ্যে আড়ংঘাটার যুগলকিশোর–বাৎসরিক মেলার সুবাদে আমার বাউল সমাজের সঙ্গে ঘনিষ্টতা বেড়ে চলে। এইসব মেলায় আমি খুঁজে পাই সাহেবধনী, কর্তাভজা, বলরামভজা, জাতবৈষ্ণব, পাটুলি স্রোতের সহজিয়া, রাধাবল্লভী, বৈরাগী, ন্যাড়া, সাঁই, আউল, দরবেশ, খুশি বিশ্বাসী, গৌরবাদী, মতুয়াপন্থীদের–যারা সকলেই বাউলের সমাজে ঢুকে পড়েছেন। সেই সমাজে, মেলায়, দিবসী, মচ্ছবে দেখা হয়ে যায় তান্ত্রিক ভৈরবী মা, অঘোরী সাধুদের সঙ্গেও। বুঝি লোকায়ত সাধকদের মধ্যে আড়াআড়ি নেই। বৈষ্ণবতীর্থ কেঁদুলি তাই পশ্চিমবঙ্গের বাউলদের প্রধান আখড়া। বাৎসরিক সমাবেশে এখানে সবচেয়ে বড় বাউল সমাগম হয়। ফরাসি, জাপানিদের পাশাপাশি কুষ্টিয়া থেকেও সাধক বাউলেরা আসেন। সাধকদের পাশাপাশি পাকা প্রোফেশনাল পূর্ণচন্দ্র দাস, পবন দাসেরা পর্যন্ত এ সময় জয়দেবে গান করেন। থাকেন খয়েরবুনির সনাতন দাস বাউলের মতো প্রবীন সাধক বাউল; দেশবিদেশ ঘুরে উল্লেখযোগ্য সরকারী খেতাবও তাঁর ঝুলিতে; ঋত্বিক ঘটকের পুত্র ঋতবান তাঁকে নিয়ে তথ্যচিত্র পর্যন্ত নির্মান করেন, এখনকার পাকা আরেক প্রোফেশনাল শিল্পী পার্বতী দাস বাউলও সনাতনের শিষ্যা। গৌর ক্ষ্যাপা সনাতনের মতো অতখানি উঁচু পর্যায়ে না পৌঁছলেও বাউল সমাজে ওরও যথেষ্ট সম্মান আছে। তিনিও বহুবার বিদেশ গেছেন। এখনকার গুরুত্বপূর্ণ তথ্যচিত্র নির্মাতা ল্যাডলী মুখোপাধ্যায়ও ওঁর ওপর একটি তথ্যচিত্র তৈরী করেছেন। তা এই গৌর ক্ষ্যাপাও মেলার জয়দেবে আকর্ষনের। বাঁকুড়ার সোনামুখীর বাউল সমাবেশ বৈষ্ণব সাধক মনোহর ক্ষ্যাপার প্রসিদ্ধিতে। একইভাবে বর্ধমানের অগ্রদ্বীপও বৈষ্ণব প্রসিদ্ধিতে জুড়ে। বীরভূমের কোটাসুরের আশ্রম ও মেলা নারায়নচাঁদ গোঁসাই ও তাঁর সাধন সঙ্গিনী ক্ষ্যাপা মা’র প্রসিদ্ধিতেই। বর্ধমানের দধিয়ার বোরেগীতলার মেলা, বেনালীপুরের মেলা, মালদহের রামকেলীর মেলা সবই কায়াবাদী বৈষ্ণব সহজিয়াদের মিলনক্ষেত্র। কিন্তু এগুলো সব এখন বাউল সমাবেশে পূর্ণ। আসলে বৈষ্ণব বাউল মিল-অমিলের ব্যাপার নয়, আসল ব্যাপারটি হল গিয়ে আরোপ সাধনার। অনুমানের পথ ছেড়ে বর্তমানের পথে, দেহভাণ্ডের মশগুল রসে নিমজ্জিত মানুষজনের মিলনক্ষেত্র হল গিয়ে এইসব গ্রাম বাংলার পুরনো মেলা, দিবসী, সাধু সমাগমের অনুষ্ঠান। আচরণবাদীদের সেই ভিড়ের আমিও তো একজন। আমি সাধক নই, সাধনসঙ্গে মিশে মিশে সাধকদেরই ‘মনের মানুষ’। সাধকেরা সব কৃপা করে, ভালোবেসে, স্নেহ দিয়ে আমাকে জায়গা দিয়েছেন তাঁদেরই আখড়াবাড়িতে। আমি সেখানেই থেকে দেখেছি সাধনস্রোতকে। গানে মজে প্রতীকী ভাষার আলোকসম্পাত খুঁজতে সখ্য বাড়িয়েছি এঁদের সঙ্গে। এঁরা দেহতত্ত্ব, সাধনরীতি, স্থলন, ব্যভিচার, সাধনের উচ্চদশা কখন কেমনভাবে যে খুলে দিয়েছেন আমার সম্মুখে নিজেরাও জানেন না।