বয়ঃসন্ধির সময় শরীরে আমার এসে ঢুকল বাড়ি থেকে শ্মশানে পালিয়ে যাওয়ার রোগ ভৈরবী মায়ের আস্তানায় সামনে আমার তখন অপার রহস্যের জগৎ। নিত্য নতুন হরেক কিসিমের সাধু দর্শন। তারপর একসময় গোটা পশ্চিমবঙ্গের নানা প্রত্যন্ত শ্মশানই হয়ে উঠল আমার শ্বাস নেওয়ার জায়গা। তন্ত্র বোঝা, যুগল মিলন দেখা, শবের। ওপর বসে অঘোরী সাধুর নানা ক্রিয়াকরণের আমি সাক্ষ্মী। শাস্ত্রিক বিচক্ষণতার বাইরে প্রায় প্রান্তিক ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা এই সমাজবৃত্তান্তই এক সময় বই হয়ে উঠল প্রকাশকের তৎপরতায়। বাজারে এল ‘ভৈরব ভৈরবীর সঙ্গে তন্ত্র জিজ্ঞাসায়’ বইখানি। সাড়া মিলল পাঠকের। তার আগে অবশ্য আমার ‘বাউল গানের কথকতা’ বেরিয়ে গেছে। আমাদের এখানকার সর্বমান্য পত্রিকা ‘আনন্দবাজার’এ তার প্রশংসাধ্বনি বেজে উঠল বাউলের আখড়াবাড়িতে একতারা, খমক বেজে উঠবারই মতো। এরপর এল বাউল, তন্ত্র, সহজিয়া সাধনার যুগল মন্ত্রটি লেখার অনুরোধ। কেননা তখন আমার বাংলার বাউল-ফকির তান্ত্রিকগুরু-ভৈরবী মা-সাধু-বাউলানি ভৈরব-ফকিরানি-সহজিয়া-বৈষ্ণব-কায়াবাদী সাধক বৈষ্ণবী-অঘোরীদের সঙ্গে আখড়া শ্মশান বাসের এক যুগ অতিবাহিত। লিখে ফেললাম ‘দেহ সাধনায় যৌনতা’। এক বছরের মাথায় ফুরিয়ে গেল বই। বেরোলো দ্বিতীয় সংস্করণ। আমার মতো নতুন লেখকের কাছে এ যে কত আনন্দ ও সম্মানের। আমি উৎসাহ পেলাম। আমার সঙ্গে ২০১২ সালে দেখা করতে এলেন ফারহাদ মাজহার। ঘোষপাড়ায় সতীমায়ের বাড়িতে তাঁকে নিয়ে বসালাম বাউল গানের আসর। তারপরই আমার বৃত্তিহুদায়, নিশ্চিতপুর, দৈকিয়ারি, শালুনিতে ছোটাছুটি বাড়লো। লিখলাম কর্তাভজা, সাহেবধনী, বলাহাড়ি, লালনশাহী ধর্মের ইতিবৃত্ত ‘নারী সাধনার ভাষা’। মনে খেদ কুষ্টিয়া তথা বাংলাদেশের পীর-ফকির-বাউলের আস্তানা দেখা হলো না। হলো না আমার একবারও বাংলাদেশ ভ্রমণ।
তবু আমি স্বপ্নে এখনও চলে যাই আমার ঠাকুরদাদার দেশে। ময়মনসিংহে পাগলাপন্থী সাধকদের ভদ্রাসন ঘুরে দেখি, নেত্রকোনায় বাউল উকিল মুনশির বাড়ি পৌঁছে যাই, মালজোড়া গানের কথাও মনে আসে যে আমার; আবদুস সাত্তার, জালালউদ্দীন খাঁয়ের স্মৃতিধন্য নেত্রকোনার মাটি স্পর্শ করি; ওখানে যে আমারও পূর্ব পুরুষের অস্তিত্ব লেগে! বড় আনন্দ হয় আমার চলে যাই রতিরাম দাস, করিম শাহ, লালন শাহ, শিতালং শাহ, পাগলা কানাই, দুদ্দু শাহ, পাঞ্জু শাহের দেশে। সিলেট যেতে গেলেই মনে পড়ে হাসন রাজার কথা। আমি শাহ আবদুল করিমের কবরে গিয়ে বসি, রাধারমণের সমাধি মন্দিরে বসে বসে ভাবি এই গান ও ভাটির দেশ তো আমারও মাতামহের ভূমি, এখানে যে আমারও অস্তিত্ব নিয়ে অদেখা অথচ স্বপ্নে চেনা কালনী নদীর বুকে মেঘ ওঠে, বৃষ্টি নয়ে আমি ঝরি সিলেট নামের দেশে। সুনামগঞ্জের নোয়ারাই চলে যাই দুর্বিন শাহের বাড়ি। এভাবেই বাংলাদেশের গান ও বাউলের রাজত্বে আমি প্রবেশ করি।
যৌবনের একেবারে সন্ধিক্ষণে সদর্থক বাউল পাঠ শুরু হয় আমার। প্রথম যাই আমি ঘোষপাড়ার মেলায় বাউল গান শুনতে, সেবারই এ গানের মধ্যে আবিষ্কার করি কৈশোরে ফেলে আসা বৈষ্ণবীর গাওয়া কৃষ্ণময়তার প্রতীক। কৃষ্ণা দাসী যখন গান; মীরা মা যখন সুর ধরেন; সুমিত্রা দাসী মঞ্চে ওঠেন; ভাবি, তাঁদের গলা থেকে বৈষ্ণবীরই আওয়াজ বেরোচ্ছে। ষষ্ঠী খ্যাপা, নবকুমার, নটবর, দয়াল সরকার, নরোত্তম দাসের গলা বৈষ্ণবের সুর নিয়ে গমগম করে। মজলিশপুরের আখড়ায় বসে যখন প্রবৃদ্ধ শশাঙ্কশেখর দাস বৈরাগ্য কথা বলেন তখন আমার বাড়ির কাছে পরিত্যক্ত হাজরাতলার ধূসর আখড়ার কবেকার সেই বৈষ্ণবের মুখ জ্বলজ্বল করে। আমি বেশ বুঝতে পারি কৈশোরে গড়ে ওঠা এই বৈষ্ণব–বৈষ্ণবীর সঙ্গে আমার সখ্য এখন আজীবনের। সেই স্নেহ সখ্য বুকে করে আমি পাক খাই নদিয়ায়। আসাননগরে গিয়ে সুবল দাস বৈরাগ্যের আখড়ায় বসি; তিনিই আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যান মুড়াগাছার সুমিত্রা দাসীর কাছে। বৈষ্ণবপাড়া, ঘূর্ণীর কালিদাসী অধিকারীর বয়স ও রূপে আবার বৈষ্ণবী ধরা দেন। আসাননগরে তুলিকা মণ্ডল, ভীমপুরের অনিল ক্ষ্যাপা, মাটিয়ারীর মীরা মোহন্ত–এভাবে গোটা নদিয়া চক্রাকারে ঘুরে বর্ধমান ফুঁড়ে উঠি বীরভূমে, হাটগোবিন্দপুরের সাধন দাস বৈরাগ্যের আখড়ায় সময় কাটে, এখানেই দেখা হয় আমার ওসাকার কানসাই ইউনিভার্সিটির দর্শনের ছাত্রী মাকি কাজুমির সঙ্গে। ১৯৯১ সালে সাধন দাস ভারত উৎসবে যখন জাপান সফররত তখনই ওঁর গান শুনে মাকি চলে আসেন এ দেশে। সাধন দাসের তত্ত্বাবধানে বাংলা শিখে এরপর সাধনায় ডুবে মাকি হয়ে ওঠেন বাংলারই বাউলানি। এক সময় পৌঁষমেলায় শান্তিনিকেতনের মূল মঞ্চে তিনি প্রবেশাধিকারই পাননি বিদেশিনী বলে। কিন্তু আজ তিনি বিশ্বের দরবারে পশ্চিমবঙ্গের বাউল সমাজেরই উজ্জ্বল প্রতিনিধি। ওসাকায়ও মাকি বাউল। চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরই টানে প্রতি বছর জাপানি বাউলরা আসেন পশ্চিমবঙ্গে জয়দেবে কেঁদুলির মেলায়। সাধন দাস বৈরাগ্যের ‘মনের মানুষ’ আখড়া সাজে জাপানি বাউলদের সমাহারে। সাদা পোশাকে এঁরা সকলেই তখন বাংলার বাউল। হাটগোবিন্দ পুরের আখড়া তথা এখানকার বাউল সমাজে মাকি কাজুমি এখন মাকি মা; আশ্রম চালান, দীক্ষা দেন, তত্ত্বকথা বলেন। পশ্চিমবঙ্গে নারী বাউল বা বাউলানির তিনি তো এখন উজ্জ্বল প্রতিনিধি।