বীরভূমের আর এক সাধক বাউল হলেন বেণীমাধব দাস বাউল। এখন তিনি অবশ্য মাধব গোঁসাই নামে সুপরিচিত। বয়স তার পঞ্চাশের কাছাকাছি। স্কুল শিক্ষা ক্লাস ফোর। পারিবারিক মিষ্টির কারবারে মন লাগত না তার। মন পড়ে থাকত সবসময় সাধু বাউলে। এখান হতেই চর্চা, গুরু ধরা, আশ্রম বানানো। সাধনসঙ্গিনী নিয়ে রীতিমতো সেখানে এখন বসবাস। গাইতেও ভালো জানেন। তত্ত্ব জানেন। সেখানে তার শ্রদ্ধা ও সম্মান থাকলেও গলাতে রয়েছে খেদ বিদেশ না যাওয়ার। হয়তো বা বিদেশি সাধনসঙ্গিনী পাওয়ারও। কেননা বীরভূম দেখেছে মেম নিয়ে সাধন করা। সেই ঐতিহ্য মেনে চলতে চেয়েছেন অনেকে। আর চলতে গিয়ে মাঝপথে থুবড়ে পড়ছেন আবার অনেকেই। এসব তো আমার গোঁসাইয়ের কাছেই শোনা। বিশ্বনাথ বাউলের মেম নিয়ে বীরভূম দাপানো কষ্ট দিয়েছিল বেণীমাধব গোঁসাইকে। কেননা বিশ্বনাথ তার সমসাময়িক। তিনি নাকি গোঁসাইকে বিদেশে নিয়ে যাবেন বলে কথা দিয়েও নানাদিকে রটিয়ে নিয়ে যাননি শেষমেশ। এত তার আঁতে ঘা লেগেছে। স্বাভাবিক। লাগারই কথা। গোঁসাই তো গানটা খারাপ গান না। তত্ত্বকথাও জানেন। তাঁর শিষ্যসামন্তও কম নয়। তো মাধব গোঁসাইয়ের সেই ক্ষোভের আগুনে খানিক জল দিয়েছিল বিশ্বনাথের ছেলে আনন্দ দাস বাউল। গোঁসাই আমাকে বলেছেন, সেদিনের ছোঁড়া আনন্দ সেও জানো মেম বগলে বীরভূম ঘোরে। আমার আশ্রমে আসে। তা সেই মেম সঙ্গে করেই ও বিদেশে পাড়ি দিল।
বললাম, এখানে মেম কোথায় পেলেন তিনি।
-শোনো কতা! মেম তো ওর জলভাত। ঠাকুরদা সিদ্ধ সাধক। বাপ নাম করেছে। দম-শাস শিখতে খয়েরবুনিতে সাহেব-মেমের লাইন লাগে। সেখান থেকেতুলেছে।
জিজ্ঞাসা করলাম, তার পর?
–তার পর আর কী। মেম নিয়ে গেল আনন্দরে বিদেশ বিভূঁই। সেখানে নিয়ে তারে ছিবড়ে করে দিল। আনন্দ মেম-হীন হয়ে ফিরে গেল খয়েরবুনি। আর আসে না বীরভূম। আমি খবর পাই পঙ্কজ বাউলের কাছে। ও তো ধান্দা করেছিল বিদেশ যাওয়ার। দিলি গিয়েছিল আনন্দকে ধরে। তা সেই আনন্দ ফেল মেরে ফিরে আসতে পঙ্কজ মনমরা।
আমি ভাবছি পঙ্কজের মন বিষাদগ্রস্ত হলেও বেণীমাধব এখন বেশ আনন্দিত। কেননা তার প্রবল প্রতিপক্ষের ছেলে বিদেশ থেকে সাধনসঙ্গিনী ছাড়া ফিরে এসেছে এটা তার কাছে মনে হয়েছে চরম লজ্জা আর অপমানের। অনেকটা সেই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটার মতোই বেণীমাধব আনন্দিত। তবে যেটা মনে হয় বেণীমাধব দাস বাউল আনন্দ সম্পর্কে ভুল কিছু বলেননি। আমি পবন দাসের মিকলু, সাধন দাস বৈরাগ্যের রীতিমতো খ্যাতিমান সাধনসঙ্গিনী মাকি কাজুমিকে সম্মাননীয়া করে রেখেই কথা ক-টা বলছি। মাকিকে আমি স্যালুট জানাই। বর্ধমানের হাটগোবিন্দপুরে সাধনের আশ্রম একা হাতে সামলাতে দেখেছি আমি মাকিকে। সাদা থান পরে জাপানি ছোটোখাটো চেহারার এই মহিলা হয়ে উঠেছেন গুরু মা। শিষ্যদের নিজে হাতে পাত পেড়ে খাওয়াচ্ছেন। বাংলাতে বলছেন সব। আমার মনে হয়েছে এখানে সাধনের কৃতিত্ব কিছু নেই। সবই মাকির। বাংলাকে ভালোবেসে বাংলার লোকায়ত সাধনাকে বুঝে আর বোধহয় সাধনকে ভালোবেসেও মাকি হয়ে উঠলেন আমজননী। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে সবাই মাকি নন। মিকলু আশ্ৰমজননী হয়ে না উঠলেও পবনকে ছেড়ে যাননি। পাশে পাশে রয়েছেন। তা ছাড়া পবনের সাধনের মতো ভাবতন্ময়তা নেই। আশ্রমে তার মন টিকবে না। তিনি পৃথিবী ভ্রমণে আন্তর্জাতিকতা মাখতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। বাউল গানকে ফিউশন করে চমক লাগাতেই যেন পবন সিদ্ধহস্ত। তবে এটাও ঠিক পূর্ণদাসের পর তার হাত ধরে বাংলার বাউল বিশ্বজগৎসভায় বেশিমাত্রায় স্থান করেছে। পূর্ণদাস, পবন পাকা প্রোফেশনাল। তবে এখনকার বিশ্বনাথ, কার্তিক নাম করা সব বাউল নিজের ঢঙে গেয়ে প্রোফেশনালিজম বজায় রেখেছেন যথেষ্টই। বিশ্বনাথ সনাতনের পুত্র বলেই ভাবতন্ময়তার ভেতর মানুষ হয়েছেন। তাই তার গায়নে সিদ্ধ সাধকের দশা ফুটে ওঠে। তবে তা সনাতনকে ছাড়াতে পারে না। কথাও নয়। প্রবীণ বহুমান্য সাধক বাউল তিনি। গানের সঙ্গে বাউল নাচকেও একটি উচ্চ রূপকল্পে নিয়ে গিয়েছিলেন সনাতন। বাউলতত্ত্ব নিয়ে বইও পর্যন্ত লিখেছেন তিনি। বিদেশেও গেছেন কয়েকবার। অনেক পদ রচনা করেছেন। এখনকার বাউলেরা তার পদও সম্মানের সঙ্গে দরদ দিয়েই গেয়ে থাকেন। আকাদেমি পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। লালন পুরস্কার। তাকে নিয়ে সম্প্রতি ‘মায়ানদীর কারিগর’ নামে একটি আকরগ্রন্থও প্রকাশ পেয়েছে। বিশ্বনাথ বাবার ঘরানা কিছুটা রাখতে পারলেও নাতি আনন্দ বেণীমাধব দাসের মতে ঠিকই আসলে ‘বংশে চুনকালি’ দিয়েছে। যে পরম্পরা তিনি পেয়েছিলেন, মেম-প্রীতিতে তা তিনি ধরে রাখতে পারেননি। শুনতে পাই তার সেই বাই এখনও যায়নি। আসলে বর্তমান বাউল গায়কদের এই এক সমস্যা। বিদেশে গিয়েও যে সকলের খুব রোজগারপাতি হয় তাও নয়। যাঁরা সরাসরি উদ্যোক্তাদের হাতে পড়েন তাদেরই কপাল খোলে। সে কপাল তো মোটামুটি নামি ও চালাকচতুর বাউলের হতে পারে। বাদবাকি যাঁরা বাউলের সঙ্গে পোঁ ধরেন মানে বাউল নিজ উদ্যোগে নিয়ে যান, তাদের প্রোগ্রাম পিছু সামান্যই দিয়ে থাকেন বাউল। তারা এখন এসব জেনেও যান একটাই কারণে যদি ফিরে গাঁ-দেশে বিদেশ ভ্রমণের তকমা লাগিয়ে বাড়তি কিছু অনুষ্ঠান আর ভক্তশিষ্য-শাগরেদ জোটাতে পারেন। অনেকে আবার এও ভাবেন যদি মেমের নেকনজরে পড়ে, সাধনসঙ্গিনী হয়ে আসে সে সাধন-পবন সহ আরও অনেকের মতো। কিন্তু বহু ক্ষেত্রে সে গুড়ে বালিই পড়ে যায়। আর এইসব বিদেশিনি এদেশে এসে গ্রামগঞ্জ ঘুরে সকলেই যে বাউল গান ও গায়ক কিংবা সাধককে মান্য করে সংসর্গ করেন তাও নয়। এখানে অনেক ক্ষেত্রে বিদেশিনীর যৌন কামনাও কাজ করে। বাউলকে ভালোবেসে মিশে সিদ্ধ বাউল হলে তার রমণাবস্থার বীর্যধারণের সেই মজা লুটে এঁরা আসলে যৌনতাকেই আস্বাদন করতে চান অসম সংসর্গের নতুন এক স্বাদে। তাকে নিজ জায়গাতে নিয়েও যান। অনেকে পরবর্তীতে ভালোবাসা গাঢ় হলে এদেশে আসেনও পুনর্বার। অনেকে আবার এ পথ আর মাড়ান না। এ ঘটনা এখন বাউল গানের চূড়ান্ত বাণিজ্যিক প্রক্রিয়া ও চাহিদায় বলা ভালো নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। এখানে বাউলের কৃতিত্ব কতটা? বিদেশিনিই তো বাউলকে নির্বাচন করেন। বাংলার বাউল শুধু রাজি হন তাঁর সুবাদে বিদেশে যেতে পারবেন বলে। অনেক বিদেশিনির বদান্যতায় বাউলের চালাঘর পাকা হয়। স্যানিটারি পায়খানা বসে। পাতকুয়ো। টিউবওয়েল। তবে সে ভাগ্য হয় প্রবৃদ্ধ বাউল সাধকদের। যাঁদের কাছে সাহেব-মেম আসেন বাংলার বহুচর্চিত যোগ শিখতে। তারা তো আর মেমকে সাধন সঙ্গিনী করতে চান না। তাদের শরীরের সেই দাপটও নেই। আর সাধক বাউল জীবনে তিনি তখন তো একেবারেই পরিতৃপ্ত। সচ্ছলতা, নাম, পুরস্কার, বিদেশ গমনের পর এইসব অতীন্দ্রিয় সাধকদের আর কী লাগে! তেমনই সাধক হরিপদ গোঁসাই, সনাতন দাস বাউল। এঁরা বিদেশিদের অনুদানে আশ্রমে তাক লাগানো সচ্ছলতা এনেছেন। সাধনও এনেছেন তবে সেটা কেবলমাত্র সাধনসঙ্গিনী মাকির সৌজন্যে। এখানে যোগপন্থা নেই। ভালোবেসে মাকি রয়েছেন গ্রামবাংলায়। আর একটা কথা, সব বিদেশিনি যে বাউলবাড়ি আসেন সংগীতের সুরমূর্ধনায় আর সাধনরত প্রচুর দম ধরতে পারার কিংবদন্তির সেই যুবাপুরুষের শরীর পাওয়ার লোভে তাও নয়। অনেকে এসে এখানে ওঠেন পশ্চিমবঙ্গ দেখবেন বলে ঠিকঠাক অনেক সময় নিয়ে। হয়তো বা তারা সংস্কৃতি কিংবা কোনো একটা কিছু নিয়ে কেবল গবেষণা করবেন বলে। কিন্তু হোটেলে বা ঘর ভাড়া করে থাকবার মতো তাদের সামর্থ্যও নেই। তখন তারা শরণাপন্ন হন বাউলবাড়ি। আর এখানকার অবাধ যৌনতার পরশ তাঁদের জীবনের সঙ্গে একেবারে মানানসই হয়ে যায়। দু-তরফের সুবিধায় এক হন বাউল আর বিদেশিনি। এও আমার গ্রামবাংলার আখড়া-আশ্রম ঘুরে চরম বাস্তব বুঝবার অভিজ্ঞতা। বাউলসাধনে একেবারেই নিজস্ব অনুধাবনের টিপছাপ।