সত্যিই তো। খৈবরের প্রশ্নকে উপেক্ষা করা যায় না বর্তমান এই জীবন জীবিকায়। আত্মমগ্ন ফকিরেরও তো ফকিরানি আছেন, মুরিদ-বায়েদ-শিষ্যভক্তদের আনাগোনা, অনেকেরই সন্তান—তাদের ভরণপোষণ কীভাবে বা করবেন দেল-কোরান নিয়ে মেতে থাকা ফকির? ইসলাম উপেক্ষার জের তাকে বইতে হয়। বাউলের এই প্রতিষ্ঠিত ধর্মপেষণ তেমন নেই। ফকিরদের রীতিমতো আছে। চাপড়ার ফকিরেরা তো এই একুশ শতকেও ঘরছাড়া হয়েছিলেন শরিয়ত উপেক্ষার কারণেই। গ্রামের মাতব্বরা তাদের টিকতে দেননি বলে শেষপর্যন্ত পুলিশকেও জানাতে বাধ্য হয়েছিলেন তারা। সেখান থেকেও চূড়ান্ত হতাশ হয়ে তারা তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। চাপড়ার আড়ংসারিষার এ সংবাদ তো আমি আনন্দবাজার পত্রিকাতেই পড়েছিলাম। তাই খৈবরদের পাশে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের এই তৎপরতা ওঁদের মনোবল বাড়িয়েছে বই কি। তারা গান সংরক্ষণের কাজ করছে। অমিতাভ জানিয়েছেন যে ফকির-বাউল গুরুর দেহাবসানের সঙ্গে সঙ্গে গানও তো হারিয়ে যায়। তাই তাদের রচিত গান খেরো খাতা থেকে তুলে ছাপিয়ে বিলিও করা হচ্ছে। এসবের মাঝে তথাকথিত গুটিকতক গবেষরাও পোঁ ধরেছেন। তাদের বক্তব্যটি এইরকম : গোরভাঙার ফকিরদের তো এখানকার বাউলদের মতো দেখানেপানা ছিল না। তারা এখন প্রচার পেয়ে বাউলের মতো আলখাল্লা পরে মঞ্চে উঠছেন। কথাটি মিথ্যে নয় ঠিকই। গোরভাঙার বাউল-ফকির উৎসবে গেলে ফকিরদের জাঁকজমক এখন টের পাওয়া যায়। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে অর্থনীতির জাঁতাকলে পিষ্ঠ সাধক ফকির-বাউল বা গায়ন শিল্পী চিরকালই অন্তরালে থাকবেন কেন? লোকগান আমাদের ঐতিহ্য। সম্পদ। মহাজনের পদাবলি আমরা মান্য করেছি আর বর্তমান মহাজনদের সাধনসম্পদ এই গান যদি একটু বৃহত্তর আঙিনায় আসে তাহলে তো আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যই পরিপুষ্ট হয় আমজনতার দরবারে। নির্জন সাধক কমে আসছেন। লোকায়ত সাধন ধর্মের অনেকগুলোরই এখন মরা সোঁতা। কিন্তু লোকায়ত সাধকের মূল সম্পদ সাধন উপলব্ধির গান সেটা নষ্ট হবে না। কোনোদিনই সাধকের না হোক পেশাদার গায়নের বদান্যতায় এ আমার বিশ্বাস। নদিয়ার বাউল-ফকিরদের নিয়ে তাই এই নতুন ঐকতানকে আমি অন্তত কোনোভাবেই খাটো করে দেখতে পারি না আমাদের বাস্তবিক বিশ্বায়নের দুনিয়ায়। অস্তেবাসীর বিশ্বকে অন্তর্মুখিতা দিয়েই এখনও চেপে রাখতে হবে এই বোধ আমাদের আগে নষ্ট করতে হবে। না হলে পর লোকায়ত সাধনসম্পদকে অনুধাবন তো পরের প্রশ্ন, রক্ষা পর্যন্ত আমরা করতে পারব না।
বাউল গান নিয়ে বুদ্ধিজীবী, গবেষকদের পাশাপাশি মার্কিন ও ইউরোপীয় সমাজের উৎসাহের কথা না বললে বর্তমান বাউল সাধকদের অবস্থাটি একেবারেই অন্ধকারে চলে যাবে। সে দিকটির কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই আমি বলব কার্তিক দাস বাউলের কথা। তাকে এখন ই-টিভির জনপ্রিয় শো বিগ বসে পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। কার্তিকের বাড়ি বর্ধমানের আলুটিয়ায়। আলুটিয়া গুসকরা অঞ্চলের প্রত্যন্ত গাঁ। তার বাবা প্রথমে রিকশা চালাতেন। তার পর আর না পেরে ভিক্ষা করে বেড়াতেন। কার্তিক সে সময় বর্ধমান-রামপুরহাট ট্রেনের কামরায় অ্যাসবেস্টারের ভাঙা টুকরো বাজিয়ে জনপ্রিয় সব হিন্দি ও বাংলা গান গেয়ে একপ্রকার ভিক্ষাই করতেন বলা যেতে পারে। এই লাইনের ট্রেনে উঠতেন বীরভূমের বাউলরাও গান গেয়ে পয়সা রোজগারের জন্য। কার্তিকের সেই দেখে বাউলের রোগ লাগে। সুর-তালের জ্ঞান তার বরাবরই ছিল। আর ছিল শুনে শুনে গান তুলে ফেলবার ক্ষমতা। এই দুই ক্ষমতা প্রয়োগ করে প্রথম প্রথম নিজেই বাউল শিখতে শুরু করেন। দু-একদিন কামরায় বাউল না উঠলে সেই ফঁাক ভরাট করে দিতেন। এখনকার জনপ্রিয় বাউল গায়ক কার্তিক দাস বাউল। এভাবেই চলছিল তার নিজস্ব বাউল সাধনা। বিশ শতকের আশির দশকে ফরাসি চিত্র পরিচালক জর্জ লুনো আসেন পশ্চিমবঙ্গের বাউলদের নিয়ে তথ্যচিত্র বানাতে। সেই সময়ে বরাত খোলে কার্তিকের। তাকে ট্রেনে গাইতে দেখে লুনো তথ্যচিত্রের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। এর পর স্টুডিয়োতে শুটিং চলাকালীন কার্তিকের সঙ্গে আলাপ হয়ে যায় বীরভূমের সাধক বাউল দেবদাসের সঙ্গে। কার্তিক নাড়া বাঁধেন ওঁর কাছে। দেবদাসের আশ্রমে থেকে বাউল শিক্ষা করে হয়ে ওঠেন এরপর কার্তিক দাস বাউল। এদিকে সেই ছবি ‘সঙস অফ ম্যাডম্যান’ সারা পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন উৎসবে দেখানো হয়। কয়েকটি পুরস্কারও পায় ছবি। ছবিতে দেখানোও হয় কার্তিক দেবদাসের কাছে তার বোলপুরের শুড়িপাড়াতে বসে বাউল শিক্ষা করছেন। আশির দশকের মাঝামাঝি ১৯৮৫-তে ওয়াশিংটন ডিসি-তে ভারত উৎসব হয় সেখানে তিনি গান গাইবার আমন্ত্রণ পান। এরপর বহুবার বিদেশযাত্রা কার্তিকের। দেশের বিভিন্ন জায়গায় বাউল গান পরিবেশন। কলকাতার এক রক ব্যান্ডের নজরে পড়া। সেই ব্যান্ডে বাউল গেয়েই আবার আমেরিকা থেকে ফ্রাঙ্কফুট দাপিয়ে বেড়ানো। হিন্দি-বাংলা ছবিতে সুর ও গানে কণ্ঠদান। এভাবেই ট্রেনের কামরাতে সেই গান গেয়ে ফেরা যুবকের পরনে ওঠে গেরুয়া আলখাল্লা। মাথায় নেমে আসে চুলের ঢাল, বুক পর্যন্ত দাড়ি। কার্তিক মাথার চুল চুড়ো করে বেঁধে, গলায় নানা বাহারের হার, হাতে বালা পায়ে ঘুঙুর বেঁধে দেবদাসের কাছে গান আর কিছু দম-শ্বাসের চর্চা করে পুরোপুরি নামি বাউল হয়ে ওঠেন। তিনি চারচন্দ্র করেন না। বিন্দু ধরতে পারেন না। তার সাধনসঙ্গিনীও নেই। এখন তাকে পয়সার জন্য ট্রেনে গাইতে হয় না। বিয়ে করে রীতিমতো সংসারী। পাকা বাড়িতে বাস করেন। সেখানে কালার টিভি, ফ্রিজ সহ আধুনিক নানা উপকরণও রয়েছে। এক ছেলে এক মেয়ে তার। সম্প্রতি মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। মিডিয়ার পরিচিত মুখ এখন কার্তিক দাস বাউল। বিজ্ঞাপনে পর্যন্ত তার গান ব্যবহার হয়-সারের গুণাগুণ, ম্যালোরিয়ার সচেতনতা নিয়েও গাইতে দেখা যায় টিভিতে কার্তিককে। এমনকি তথ্যচিত্রে অভিনয় দিয়ে জীবন শুরু করে বাংলাদেশের বিশিষ্ট চলচিত্রকার তনভির মোকাম্মেলের ছবিতে পর্যন্ত তিনি অভিনয় করেন সেই বাউল বেশে। কার্তিক সাধক বাউল নন কখনও। তার চর্চায় আগ্রহে তিনি নামকরা পয়সাওয়ালা গায়ক বাউল। বিগ বসেও আসর জমান। ‘যাওরে আনন্দবাজারে চলে যাও। / বাজারে বসতি করে স্বরূপ-রূপে মন মাতাও। / সহজ সে আনন্দবাজার, / সহস্র খবর খুলেছে যার, / সহজ আছে হৃদে তোমার, / হেরে ত্রিতাপ জুড়াও।‘ তবে কার্তিকের মতো বাউলদের সঙ্গে তাদের জীবনের ওঠাপড়া নিয়ে কথা বলা যায় কেবল, সাধনার বিচিত্র জগৎ নিয়ে এগোনো যায় না তেমন। এ আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। কার্তিক বৈষ্ণবভুক্ত বাউল। কেননা তার শুরু হলেন নিত্যানন্দ পরিবারের। অচ্যুতানন্দ গোত্রের। অর্থাৎ কিনা জাতি-বৈষ্ণব। দেবদাসের বংশকৌলিন্য ছিল। ব্রাহ্মণ। সেখান থেকে এ পথে তিনি। সচ্ছল পরিবার থেকে বাউল মতে এসেছেন। দাসকলের রামানন্দ গোঁসাইয়ের কাছে তাঁর শিক্ষাদীক্ষা। গুরুর কন্যাকেই সাধনসঙ্গিনী হিসেবে পেয়েছেন। সাধনা তার বাউল মতের হলেও সেখানে বৈষ্ণবাচার বেশ মিশে। রামানন্দ তাকে যত্ন করেই তৈরি করেছেন। না হলে কি কোনো গুরু-গোসাই তার মেয়েকে শিষ্যর হাতে সমর্পণ করেন? দেবদাস যৌন যৌগিক গুহ্য সাধনা রপ্ত করেছেন। সাধক বাউল হিসেবে সমাজে তিনি প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু শিষ্য কার্তিকের মতোর্তার অত খ্যাতি নেই। খ্যাতি তার সীমাবদ্ধ বাউল সমাজে। অনেকেই বাউল শিক্ষা করতে তার আশ্রমে গিয়ে ওঠেন। ভাবতন্ময় সাধক হিসেবে দেবদাস বীরভূমে এখনও যথেষ্ট সম্মাননীয়।