নিত্যানন্দ বললেন, তা খ্যাপা আপনি মনের মানুষের কথা বলছিলেন না সেদিন? আজ বলি দেহ না জাগলে চিনবেন কী করে তারে। দেহ তো সাতে আবদ্ধ।
জিজ্ঞাসা করলাম, কী এই সাত?
বাউল বললেন, সাত সপ্তধাতু। যা দিয়ে স্থূল দেহ তৈরি। শুক্র, রজ, রক্ত, মাংস, মেদ, অস্থি, ত্বক—এই সাতে শরীর গঠিত। তাতে আবার পাঁচের সমন্বয়–ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম। এই এগারোর আবাসভূমি শরীর। গুরু চেনান তারে।
—কীভাবে চেনান গুরু?
–সে বড়ো কঠিন কাজ। চক্ৰ চেনেন আপনে?
–মাথা নেড়ে বললাম, না। সেভাবে জানি না।
বললেন, এত অল্প জ্ঞানে মনের মানুষ বুঝবেন কী করে আপনি?
–সহজভাবে বলুন না। যদি ধরতে পারি।
-কী করে ধরবেন খ্যাপা? আগে গুরু ধরেন। তবে তো আপনে মানুষ ধরবেন।
ইচ্ছে করে কিছু বললাম না। কেবল হাসলাম। আসলে আমার জানাটা কেবল নয়—নিত্যানন্দর জানাটা দিয়ে আমি জানতে চাইছি আজকের বাউল সমাজকে। তার গান পেশা। গানের জন্য দরবার করেন। এখানে-ওখানে ছুটে বেড়ান। রীতিমতো গৃহী বাউল তিনি। ঘোষপাড়ার প্রায় সমস্ত বাউলই এখন তাই। তার মধ্যে একজন-দুজন যাঁরা কিছুটা সাধনভজন করতেন, তারা কেউ আর শরীরে নেই। তবে এখানকার এবং এখনকার গায়ক বাউলেরা তত্ত্বটাকে বেশ রপ্ত করেছেন। গান বেচে, খানিকটা গুরুগিরি করে তারা পেট চালান। ভক্তশিষ্য জোটান। নিত্যানন্দ কথা বলেন সুন্দর। ভক্তশিষ্যর সংখ্যা নেহাত কম নয়।
বাউল বললেন, গুরু তো রস-সাধনা শেখান। নরদেহকে গুরুই আমাদের নারায়ণ করে দেন। নররূপী নারায়ণ। দেখেন, আমাদের দেহঘরে গুহ্যদেশে যে মূলাধারটি তা পৃথিবীর হদিস দেয়। লিঙ্গের সন্ধিমূলে স্বাধিষ্ঠান জলের কথা বলে। নাভিমূলের মণিপুর শিখা ছড়ায়। হৃদয়ের অনাহত বায়ু ধরে। এই বায়ু পার করে। সহজ মানুষ করে।
কীভাবে করে? জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
বললেন, শুরুবস্তু বায়ুক্রিয়াতেই ধরে রাখেন বাউল। নিজ শরীরে সঞ্চিত সব গুরুতত্ত্ব শরীরের চক্রগুলোর ভেতর দিয়ে মাথায় ওঠে। ঊর্ধ্বে ওঠেন বাউল। পরমাত্মার দেখা পান।
বুঝলাম, নিত্যানন্দ আমাকে দীক্ষিত হতে বলছেন তার কাছে। দলে টানতে চাইছেন আর কী। প্রান্তিকতার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজনকে এঁরা তো সবসময়ই টানতে চান। শিক্ষিত, অভিজাত এদের কাছে ঘুরঘুর করলে যে সমাজে তাদের দড় বাড়ে। শিষ্য তৈরি হয় একটু বেশি।
দেবগ্রাম, নদিয়ার দয়াল ব্যাপার নিবাস সেখানকারই মদনমোহন আশ্রম। দুবেলা মদনমোহনের সেবাপুজো চলে এখানে। দয়ালের মা ছিলেন জাত বৈষ্ণব। বাবা ব্রাহ্মণসন্তান হলেও ঘোষাল পদবি উড়িয়ে খ্যাপা হয়েছিলেন। সাধক পিতার একমাত্র সন্তান দয়াল। পূর্বনাম ছিল দয়ালচন্দ্র ঘোষাল। তিরিশ বছর ধরে সাধনরত দয়ালের আবার একাধিক সন্তান রয়েছে। পিতা-পিতামহক্রমে অনেক শিষ্য দয়াল খ্যাপার। নিরামিষাশী। ঘর তাদের মাজবাড়ি। উপাধি খ্যাপা। এ ঘরে নাকি সর্বকেশ রক্ষা করতে হয়। কিন্তু দয়ালের দাঁড়ি-গোফ অল্প বলেই তা তিনি আর রক্ষা করেননি। নব্বইয়ের কাছাকাছি সুঠাম শরীরের দয়াল। তার পিতা কালিদাস খ্যাপা একশো কুড়ি বছর নাকি বেঁচেছিলেন। দয়াল বলেন সাধকজীবনে চারচন্দ্রের ক্রিয়া জরুরি। তার সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ চারচন্দ্রেই রয়েছে। তিনি লিখতে পড়তে জানেন। গানও রচনা করেছেন অনেক। বয়সের কারণে এখন অবশ্য তার গাইবার শক্তি কিছুটা কমে এসেছে তথাপি তিনি গাইবার ঢঙে, দমে যুবক বাউলকে কাত করে দিতে পারবেন। আর দয়ালকে দেখলেও তার বয়স বোঝ যাবে না একদম।
চাপড়া, মহাখোলার সামসুল আলম বাউল চর্চা করলেও তিনি হাটখোলা হাই মাদ্রাসার শিক্ষক। রক্ষণশীল মোল্লা পরিবারে জন্মিয়েও সামসুলের বাউল জীবন আমাকে হতবাক করে। তিনি জানিয়েছেন হাই মাদ্রাসার শিক্ষক বলে তার এখানে একটা প্রাধান্য থাকলেও শরিয়তপন্থীদের সঙ্গে তাকে এখনও যুঝতে হয়। মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে তাই সরে এখন চাপড়া শান্তিপাড়ায় তাকে উঠে আসতে হয়। চাপড়ার সামাজিক ইতিহাসেইসলাম থেকে খ্রিস্টান ধর্মান্তরেরও একটা স্রোত আছে। সেই স্রোত ও ইসলাম উপেক্ষা করে তার গুরু ওয়াদেব শা ফকির শ্যাওড়াতলা আশ্রমে হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান শিষ্যদের নিয়ে উৎসব করে আসতেন। এখন সামসুল করেন। সামসুল বলেন, দেহে কৃষ্ণ-যিশু-নবি সব রয়েছেন। তার খৈবর ফকির আমাকে জানালেন, শ্রীচৈতন্য নদে জেলার মানুষ। আবার আমাদের লালন সাঁইও তো এই নদে জেলারই। একজন অবতার, অন্যজন মানবতাবাদী। গোরভাঙার ফকির, চাপড়া-করিমপুর-আসাননগর–ভীমপুরের বাউল এখন বাইরের মানুষের কাছে পরিচিত হচ্ছে এটা অনেকেরই জানেন সহ্যি হচ্ছে না তেমন।
জিজ্ঞাসা করলাম, তারা কারা?
–কারা আবার। এখানকারই কিছু ধ্বজাধারী ফকিরেরা।
—বাউলদের এতে সায় নেই বলছেন।
-না না। ওরা তো এমনিতেই পরিচিত। আপনি তো ঘোরাঘুরি করেন। জানেন তো নদে জেলার গান গাইতে না পারা বাউলরা পর্যন্ত বিদেশ ঘুরি এ্যয়েছে। আর আমরা কেবল গান আগলিয়ে বসি রয়েছি। গোঁড়া ফকিররা সব এখানকার বলে কী জানেন খ্যাপা সাঁই?
-কী বলেন তারা?
-বলে সাধনার অঙ্গ গানরে বাজারে নিয়ি যেতে দেবুনি আমরা। বলেন খ্যাপা কুনড়া এ্যাহন বাজার লয়। সাধনে পেট ভরে খালি? আমাদের মুরিদ-বায়েদ হাতে গোনা। তাদের দানধ্যানে কতটা কী হয়!