বললাম, তিনি কে?
জনৈক ভক্ত বললেন, আপনি এত আসেন এখানে। দেখি। কিছুই কি জানেন না?
বললাম, সত্যিই আমি জানি না।
বললেন, মীরা মা জিনিস একখানা। শ্যামা দাসী ছিলেন গোঁসাইয়েরই সাধনসঙ্গিনী। মীরা মা তার পরের সাধনসঙ্গিনী। অল্পবয়সি মীরা মা তখন গোঁসাইয়ের মোহে এসেছিলেন। গোঁসাই এ অঞ্চলের নামকরা সাধক। ভক্তশিষ্য
প্রচুর।
—আপনি কি ওঁর দীক্ষিত?
—শুধু আমি কেন এ গাঁয়ের সবই ওঁর দীক্ষিত। গোঁসাই দেহ রাখবার পর সব বাগিয়ে মীরা মা দীক্ষা দেন। এখন এখানকার সর্বেসর্বা।
-তোমাদের গোঁসাইয়ের কতজন সাধনসঙ্গিনী ছিল?
—আমিই তো জনা পাঁচেক দেখেছি। আসলে বিন্দুধারণ করতেন। তাই তার সাধনসঙ্গিনী লাগত। তিনি বৃদ্ধ হলে কী হবে যোগবলে তো উর্দ্ধরেতা করে নিতে পারতেন বীর্যকে। এ তো রজ-বীর্যের সাধনা। গোঁসাই মা বয়স্কা হয়ে স্রাব না হলে সাধন হবে কীসে? তাই গোঁসাইয়ের সাধনসঙ্গিনী অদলবলদ।
-মীরা মা তবে ছেড়ে গেলেন কেন তোমাদের গোঁসাইকে?
-ওই যে বললাম না জিনিস। ছেড়ে গেলেন বাঁকুড়ার এক সাধকের কাছে। সেখানে সুবিধে না পেয়ে আবার এখানে।
জিজ্ঞাসা করলাম, গোঁসাই রাখলেন?
–রাখবেন না কেন? পড়ন্তবেলার গোঁসাই। ডাগর সুন্দরী সাধনসঙ্গিনী থাকলে তো বোঝানো যায় যে তিনি মস্ত সাধক।
—কীভাবে? জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
—কীভাবে আবার! এটা তো প্রমাণ হয় তিনি ডাগর সাধিকার গুপ্ত বৃন্দাবন ভ্রমণে সক্ষম, নাকি?
বললাম, তাহলে বলছেন আপনি আপনাদের গোঁসাই বড়ো সাধক ছিলেন।
—তা নয়। কীর্তন, দেহতত্ত্ব এসবে তার নাম ছিল। দেশগাঁয়ের লোক মান্যি করতেন তো। মীরা মার তারই সঙ্গ করা। গোসাই যোগ জানতেন। চারচন্দ্র করতেন। মীরা মা তো সেই গুড়েরই লাডু পাকাচ্ছেন এখন।
-ঠিক বুঝলাম না।
-ওই যে এখন মধ্যবয়স্কা, দাপুটে, গেরুয়া বসনে রসকলি আঁকা বৈষ্ণব-বাউল। শাস্ত্ররপ্ত। জ্ঞানচর্চা আছে। গান জানেন। সব রপ্ত করে নিয়েছেন গোঁসাইয়ের কাছ থেকে। তাকে আর পায় কে!
–মীরা মা’কে এ গাঁয়ের লোক তাহলে খুব একটা বোধহয় ভালো নজরে দেখেন না?
-তা দেখবে না কেন শুনি? হাজার হোক সিদ্ধ সাধকের সাধনসঙ্গিনী। গুরুসঙ্গে তাঁরও সিদ্ধাই যোগ এসেছে যে! শাস্ত্রকথা বলেন যখন থ মেরে শুনতে হয়। মনে হয় তিনি বলছেন না কিছুই। কোনো এক দৈবশক্তি তারে দিয়ে বলাচ্ছেন।
ঘোষপাড়ার নবকুমার দাসকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম চারচন্দ্রের কথা। নিত্যানন্দ বালা, নরোত্তম দাসকে বললে কিছুই বলেননি তারা। নরোত্তম গান গেয়ে শুনিয়েছিলেন। প্রথমে গুনগুন করেই গাইছিলেন বাউল। শিষ্য (বাজনদার) একতারাতে সুর দিতেই গাইলেন, দিন-দুপুরে চাঁদের উদয় রাত পোহান ভার। হলো অমাবস্যায় পূর্ণিমার চাঁদ তের প্রহর অন্ধকার। / সূর্যমামা মরে গেছে বুকে মেরে শূল,/ বামুনপাড়ায় কায়েতবুড়ি মাথায় বইছে চুল। / আবার কামরূপেতে কাকা ম’ল, / কাশীধামে হাহাকার। দরাজ গলায় বাউল বাড়ি (আখড়া) ম ম করতে থাকল চাঁদেরই গন্ধে।
গান শেষে থামলেন বাউল। বললেন, লাইনে না এলে এর মানে জানা যাবে। একটু ঘোরাফেরা করেন, ঠিক একদিন জেনে যাবেন। আমাকে আর শুধোতে হবে না।
হাসলেন বাউল। বললেন, দীক্ষা হয়েছে?
বললাম, না।
—আগে চট করে দীক্ষাটা নিয়ে ফেলুন। তাহলেই দেখবেন অনুরাগ আসবে। প্রথম প্রথম শুধু চারচন্দ্ৰ কেন, নবকুমার আমার কোনো প্রশ্নেরই সেইভাবে জবাব দিতেন না। বিরক্ত প্রকাশ করতেন। ভাবখানা এমন এখানে না আসলেই পারেন। ওদিকে যখন অত যাতায়াত তাহলে ওখানে গিয়েই মেটান না কৌতুহলী জিজ্ঞাসা সব। তবে আমি রাগ করতাম না। বুঝতাম বিষয়টা হয়তো পছন্দ করছেন না নবকুমার। কিন্তু কোনোদিন এই বিষয়ে তিনি আমাকে কটু কথা বলেননি। বাউল সমাজে মিশে এটা বুঝেছি সেখানে তাদের ভেতরে নানা অরাজকতা থাকলেও তারা বাইরের মানুষদের প্রাপ্য অতিথির সম্মান দেন। প্রথম প্রথম তাকে বোধহয় কেউ ভুল বুঝিয়েছিল। বাউলে আগ্রহী মানুষ জেনে শেষমেষ তিনি মধুর সম্পর্কই রেখেছিলেন।
একদিন বেশ ঠান্ডা মেজাজেই পেয়েছিলাম নবকুমারকে। গরিফার এক অনুষ্ঠানে গাইবার আগে কথা চলছিল।
বললেন, আমাদের শরীরে তো নিয়ত চন্দ্রের চলাচল। চন্দ্র হল শীতলতা।
-কীসের? জিজ্ঞসা করেছিলাম।
—কীসের আবার, সিদ্ধির।
–কীভাবে আসবে এই সিদ্ধি? বললাম।
–চন্দ্ৰতত্ত্বে আসবে তা। শরীরের মধ্যে সাড়ে চব্বিশ চন্দ্র আছে। যুগলে অমাবস্যাতে এই সাড়ে চব্বিশকে ধরতে-ঘঁতে-জানতে-বুঝতে হবে। তারপর জোয়ার নামবে।
আর কিছু বলতে চাইলেন না নবকুমার।
বললেন, একদিন ঘোষপাড়া আসেন। সেখানে হবে ‘খোন। এই হাটে-মাঠে তত্ত্ব হয়? হয় না।
ইতিমধ্যে ডাক পড়ল তার। বাজনদাররা উঠে মঞ্চের দিকে এগোতে লাগলেন। নবকুমার পায়ে ঘুঙুর-জোড়া বাঁধতে বসলেন।
গুরুতত্ত্ব নিয়ে কথা বলছিলেন নিত্যানন্দ বালা তার নতুনপল্লির আখড়াতে বসে। নবকুমারের মতো খ্যাতিমান বাউল না হলেও নিত্যানন্দ ঘোষপাড়ার বাউল হিসেবে যথেষ্টই পরিচিত। যেদিনকার কথা বলছি এখন সেদিন নিত্যানন্দ ছিলেন দারুণ মুডে। ভক্ত-শিষ্য পরিবেষ্টিত একেবারে। সবে সতী মা’র মেলা ভেঙেছে গতকাল। আজও সব বাউল যেয়ে উঠতে পারেননি আখড়া ছেড়ে। নিত্যানন্দের বাড়ির আখড়াতেও বাউল গমগম। সন্ধ্যার আসরে ক্রিয়াকরণের পর গেয়ে উঠলেন তিনি পাঞ্জু শাহের পদখানা—’গুরু-রূপে নয়ন দে রে মন। / শুরু বিনে কেউ না তোর আপন।। / গুরু-রূপে অধর মানুষ দিবে তোরে দরশন।।‘