ফকির লালন শাহ চৈতন্যদেবের লৌকিক উদারতাকে চিহ্নিত করে। দিয়েছিলেন তার গৌরগানে। তিনি গৌরকে শরীরের বিকাশ ও প্রতিষ্ঠার ইতিবৃত্ত দিয়েছিলেন। এই ভাব চৈতন্যজাত চৈতন্য হয়ে উঠেছিলেন। হয়ে ওঠাটি করণ বা শরীরকেন্দ্রিক। সতী মা’র ঘর চৈতন্যদেবের সেই হয়ে ওঠাটিকেই মোক করেছিল। সেই একই ভাব লালন ধারণ করেছিলেন বলেই একেবারে স্পষ্ট বোঝা যায় শুধুমাত্র এই হয়ে ওঠাটিকেই চিহ্নিত করতে তিনি সতী মা’র ঘরকে প্রাধান্য দেন। মজনু শাহ ফকিরও কিন্তু তাই দিয়েছিলেন। হেঁউড়িয়ার সেই ফকির বলেছিলেন গুরুর মান্যতায় তাদের তৃতীয় ঘর হল পাঞ্জু শাহের ঘর। লালনের সমকালে ও পরবর্তীকালে পাও সারা বাংলার বাউল ফকিরমহলে একজন প্রধান ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন। তিনি বেঁচেও ছিলেন দীর্ঘকাল। লালনের মৃত্যুর পর থেকে প্রায় পঁচিশ বছর যাবৎ তিনি লালনের অপূর্ণতা অনেকখানি পূর্ণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন একজন তান্ত্রিক সাধক ও গীতিকার। অভিজাত বংশেই তার জন্ম। লালনের মতো দুর্বিপাকে গোত্রহীন তিনি কখনও নন। গোড়া মুসলিম পরিবার বলেই আরবি-ফারসি পাঠ তার নখদর্পণে ছিল। তথাপি বাংলার মরমি সাধনা তাকে টেনেছিল বলেই তিনি পরবর্তীতে ফকিরি জীবন বেছে নেন। পাঞ্জু লালনের মতোই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মসাধনার বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন। তার গানে জাতি-বর্ণের আচরণ থেকে বেরিয়ে আল্লা-ঈশ্বর মতবাদ দূরে ঠেলে সেই জীব ও পরমের অভেদতত্ত্বটিইউঠে এসেছিল বলেই বোধহয় ফকির লালন শাহ তার ঘরকেও নিজ বারামে শামিল করে নিয়েছিলেন। চতুর্থ ঘর উজল চৌধুরি ও তার শিষ্য জহরউদ্দিন শাহের ঘর। চৌধুরিদের ঘর বলেই সেটি চিহ্নিত। মজনু শাহ ফকির তাই-ই বলেছিলেন। জহরউদ্দিনের গানে সুফি ভাবের সমালোচনা আছে। তবে তার গানে আরবি-ফারসি শব্দের বহু ব্যবহার বলে অনেকে এই ঘরকে সুফি ভাবধারার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। লালন, জহরউদ্দিন দুজনেই তাদের গানে নবীন তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন ইসলামকে দূরে রেখে। ইসলাম সম্পর্কে তাদের ব্যাখ্যা বাংলার ভাব, ভাষা, সংস্কৃতির মধ্য থেকে বেরিয়ে এসেছে। ইসলামকে তারা মোকাবিলা করেছেন আরব দেশে বসে বা আরবি ভাষাকে শিরোধার্য করে নয়। আরবের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল থেকে ইসলামকে বের করে এনে নদিয়ার প্রবাহমান ভাবের সঙ্গে তাকে তারা মিশিয়ে দিয়েছিলেন বলেই ইসলামে যেমন বাংলার সংস্কৃতির ছোঁয়া লেগেছিল, তেমনি সেই ছোঁয়াতে বেদ-কুরান বিরোধিতারও একটা জায়গা ছিল। যে বিরোধিতা থেকেই আলাঈশ্বর ভজনা পাশ কাটিয়ে মানুষ ভজনা তাদের মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কেননা জীবের মধ্যে মানুষই একমাত্র দেহগত সাধনার বলে পরমে মিশে যেতে পারে। এই হয়ে ওঠা আল্লা ও ঈশ্বরের সঙ্গে অভেদের মীমাংসাকেই জন্ম দেয়। জহরউদ্দিন তার গানে এই মীমাংসাকেই আরবি-ফারসির দোটানায় বাংলার লোকায়ত ভাবে এনে ফেলেছিলেন বলেই তার গান নিয়ে একটা সুফি তরিকার সংশয় কাজ করেছিল বোধহয় সে সময়। লালন যেজন্য তার নিজের ঘরের সঙ্গে চৌধুরিদের ঘরকে জুড়ে রেখেছিলেন। শেষ ঘর হল দেলদার শাহের ঘর। এই ঘরে পাটনার শাস্ত্রীয় সংগীত ঘরানার একটা আমেজ আছে। লালনের গানের মধ্যেও জয়জয়ন্তী, সিন্ধুভৈরবী, বৃন্দাবনী সারং ইত্যাদি ক্ল্যাসিকাল ঘরানার ছাপ সুস্পষ্ট। দেলদার শাহের গানে লালন ঘরের একটা প্রভাব কাজ করেছিল অবশ্য তারই স্বতন্ত্র মুনশিয়ানায়। তার শিষ্য বেহাল শাহের গানে লালন ঘরানা আরও যেন সুতীব্র। যেজন্য এ ঘরও লালন ঘরের অন্তর্ভুক্ত। এই পাঁচটা ঘরকে একসঙ্গে লালনের ঘর বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে। আর এই পাঁচ ঘরেই কিন্তু গৌরাঙ্গের গৌর হয়ে ওঠাটা বেশ বর্তমান। নারী-পুরুষসত্তা ভেদ করে এই পাঁচ ঘরই একটা আলাদা আইডেন্টিটির জন্ম দিয়েছিল। যে আইডেন্টিটি তৎকালীন প্রাতিষ্ঠানিকতার বাইরে দাঁড়িয়েছিল।
ঘোষপাড়ার বাউলদের এই ঘর নিয়ে কখনও কোনোরকম মাথাব্যথা আমি অন্তত দেখিনি। তারা যে এই ঘর সম্বন্ধে খুব একটা ওয়াকিবহাল তাও বোধহয় না। কেননা ঘোষপাড়ার বাউলরা দু-একজন বাদে কেউই সাধক বাউল নন। কখনও ছিলেন না। সতী মা’র মন্দিরের চারপাশ জুড়ে যে বাউল পাড়া সেখানকার বাউলরা সব উদ্বাস্তু হয়ে এখানে এসে ওঠেন। কেউ কেউ আবার জাতে ওঠার জন্যও এখানে একেবারে জায়গাজমি কিনে পাকাপাকি বসবাস করেন। গৃহী, রীতিমতো সংসারী এইসব বাউলেরা যে কর্তাভজা সম্প্রদায় সম্পর্কেও খুব একটা কিছু জানেন তাও নয়। কর্তাভজা সাধন এখন গৃহসাধনাতেই কেবল আটকে। সতী মা’র ঘর বংশপরম্পরা মেনে এবং ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে চলছে। সেখানে সকাল-সন্ধ্যায় গুরুভজন, শুক্রবার পালন, বিশেষ উৎসব-অনুষ্ঠান ছাড়া আর কিছু পালনীয় নয়। উপলক্ষ্যেই সেখানে কেবল ভক্তশিষ্যের সমাগম হয়। তারা কেবল এখন মেনে চলেন আউলাদ প্রবর্তিত সৃষ্টাচার। দেহধর্ম পালনের চর্চা সেখানে আর নেই। আমি অনন্ত ঘোষপাড়ায় তেমন কোনো সাধক দেখিনি। দেখেছি মহাশয়দের। যাঁরা বয়াতিদের দীক্ষা দেওয়ার সময় আচরণীয় বিধিদেশ যেমন—পরীতে গমন না করা, পরদ্রব্য হরণ না করা, পরহত্যার কারণ না হওয়া, মিথ্যে না বলা, দুর্ব্যবহার না করা, প্রলাপ না বকা, জীব হত্যার চিন্তা না করা—এইসব কায়ধর্ম, বাক্যধর্ম, মনধর্ম বলে দিয়ে থাকেন। তবে ভজন সংগীতে লালশশীর গান গাওয়ার চল আছে। সেই গানের উপলব্ধ সাধন প্রণালীর পথের আর অনুসরণ নেই। লালশশীর গান ঘোষপাড়ার বাউলরা গেয়ে থাকেন। ঘোষপাড়ার সাধক বাউল বলতে ছিলেন কেবল নবকুমার দাস ও তার সাধনসঙ্গিনী কৃষ্ণা দাসী। যখন আমার ওঁদের সঙ্গে আলাপ, জোড় ভেঙে গেছে। নবকুমার অন্য সাধনসঙ্গিনী জোগাড়ও নাকি করেছিলেন। সে জোড়ও টেকেনি। আমি যখন নবকুমারের কাছে গিয়েছিলাম তিনি তখন বিয়ে করে ঘোর সংসারী। ওদিকে কৃষ্ণাকেও দেখেছিলাম তিনিও শাখা-সিঁদুর পরা এক স্বাভাবিক রমণী। বাউল গানের দল খুলেছেন। পাঁচ পুরুষের দলকে একা হাতে সামলাতেন কৃষ্ণা। কৃষ্ণার জামাই তখন দলে বাঁশি বাজাতেন। মেয়েও গাইতেন। কৃষ্ণা চলে যাওয়ার পর জামাই এখন দল ম্যানেজার। মেয়ে সে দলের প্রধান গায়িকা। নবকুমারের বেশি বয়সের বিয়েতে সন্তানাদি না আসায় তিনি চলে যাওয়ার পর তার দল এখন শিষ্যসামন্তদের হাতে। দোলমেলায় আমতলাতে বোসড়ো আখড়া করতেন নবকুমার। নানা জায়গার বাউল এসে ঘোষপাড়ার মেলার তিনদিন উঠতেন এই আখড়াতে। দু-একজন সিদ্ধ বাউলের দেখাও পেয়েছি আমি নবকুমারের আখড়াতে। মহাজনি পদ বিশ্লেষণে যাঁদের জুড়ি মেলা ভার। তাদের তত্ত্বকথাই বলে দিচ্ছিল বাউল সাধনের অনিবার্য পরম বা সহজানন্দের দ্যুতি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। নবকুমারের আখড়ার সেই বহর এখন আর নেই। তার ভক্তশিষ্যরা গুরুর জমির ওপর ঘাঁটি গেড়েছেন এই যা। দলের সুনামও তেমন এখন নেই। নবকুমার কৃষ্ণার সঙ্গে জোড় ভেঙে যখন সংসারী হলেন তখন থেকে গানকেই পেশা করলেন। সঙ্গে জুড়েছিল গুরুগিরি। জাতি-বৈষ্ণবভাবাপন্ন নবকুমার এরপর থেকে দীক্ষা দিতেন। স্ত্রী-ও হয়ে উঠলেন গোঁসাই মা। তার স্ত্রী বোধহয় এখনও গোঁসাই মা’র ভেকেই রয়েছেন। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে একলা গ্রামবাংলার অসহায়া রমণী এর বেশি আর কী-ই বা করতে পারেন। পরবর্তীতে নবকুমার গায়ক বাউল হলেও যুগল সাধনা তিনি একসময় করেছিলেন। বাউল সমাজে সেই সাধনভজনের কদর ছিল। অনেককেই বলতে শুনেছি নবকুমার কৃষ্ণার জুড়ির কথা। জোড় ভেঙে যাওয়ায় সে কথার ভেতর তাদের আপশোসও ঝরে যেতে দেখেছি। তবে একটা বিষয়ে ঘোষপাড়াকে বদহাই দেওয়া দরকার সেটা হল নবকুমারের সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর একলা নারী কৃষ্ণার সামাজিক অবস্থানটি নিয়ে। ঘোষপাড়া বাউলবৃত্ত হলেও সেখানে সংসারী মানুষজনের বাস। নবকুমার কৃষ্ণা সাধক ও সাধনসঙ্গিনী হিসেবে ঘোষপাড়ার আখড়ায় ছিলেন। সেখান থেকে সরে এসে সেই ঘোষপাড়াতে কৃষ্ণার একলা অবস্থান, বাঁচা, লড়াই, জীবনযাপন ঘোষপাড়া মেনে নিয়েছে। কৃষ্ণা একজন সাথি পেয়েছিলেন যিনি তাকে পরবর্তীতে সম্মান দিয়েছিলেন। তাকে বুঝবার চেষ্টা করেছিলেন। তার জমির হাতায় কৃষ্ণার ঘর। কৃষ্ণার মেয়েকে তিনি দাড়িয়ে থেকে বিয়ে দিয়ে বাবার কর্তব্য পর্যন্ত করেছেন। এখনও কৃষ্ণা চলে যাওয়ার পর কৃষ্ণার মেয়ে-জামাইকে তিনিই পিতৃস্নেহে আগলিয়ে রেখেছেন। নবকুমারের সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর কৃষ্ণা বিয়ে করে সংসারী হয়েছিলেন কেবলমাত্র সামাজিক নিরাপত্তায়। এসব কৃষ্ণাই আমাকে বলেছিলেন। কিন্তু সেই মানুষটি তাকে একটি কন্যা উপহার দিয়ে নিরাপত্তার সিঁদ কেটে ভেগে গিয়েছিলেন। বাউল মতের কৃষ্ণা মনের মানুষ পেয়েছিলেন পরবর্তীতে যাকে কেন্দ্র করে তার নাম কৃষ্ণা কখনও আমাকে বলেননি। কৃষ্ণা শাখা খোলেননি, সিদুরও ছাড়েননি জীবনের শেষদিন অবধি। ঘোযপাড়া তাকে রক্ষিতার নজরে দেখেনি কোনোদিন। দেখেছে তাকে কেবল পেশাদার বাউল গায়িকা হিসেবে। নবকুমারকে টেক্কা দিয়ে কৃষ্ণা দল গড়েছেন। খ্যাতি পেয়েছেন। তার সংগ্রামকে ঘোষপাড়া স্যালুটই দিয়েছে। প্রথম যেদিন আমি নবকুমারের সন্ধানে গিয়ে পড়েছিলাম সেখানকারই মানুষজনের কাছে, কৃষ্ণার কথা জিজ্ঞাসা করতে তারা সম্মানের নজর নিয়ে কথা বলেছিলেন, কৃষ্ণা দাসী? তিনি আর নবকুমারের সঙ্গে থাকেন না। ওই গলি দিয়ে চলে যান। শেষ মাথায় কৃষ্ণা দাসী বাউলের বাস। সাধনসঙ্গিনীর এই সম্মান আমাকে মুগ্ধ করেছে। আশ্চর্যের যেটা, প্রাচীনপন্থী সাধিকারা যারা কেবল আশ্রমে-আখড়ায় শত অপমান, লাঞ্ছনা সহ্য করে সাধকের সঙ্গে থাকার পক্ষপাতী তারা কৃষ্ণাকেই কেবল গালমন্দ করেছেন। এ আমার নিজের চোখে দেখা। নবকুমার তাদের চোখে যেন ধোয়া তুলসীপাতা। বাউল সঙ্গিনী বদলাতেই পারেন, কিন্তু বাউলানির তা মেনে হয় আশ্রম-আখড়ায় পড়ে থাকা, নয় পরিত্যক্ত সঙ্গিনী হয়ে মাধুকরীতে জীবনধারণ কিংবা নতুন সাধকের খোঁজ—এই তিন ভিন্ন যেন আর জীবন নেই। একলা নারীর গান বাউল বাগান বাড়ির সদস্যরা কখনোই মেনে নিতে পারেননি প্রথম প্রথম। কৃষ্ণাকে তাই তারা মানতে পারেননি। পারেননি নদিয়ার আর এক নারী সুমিত্রাকেও। তবে এই নারীরাই দেখিয়েছেন গায়কের মতো তারাও গানকে সঙ্গী করে একা বাঁচতে জানেন। বাউলের নারী চরণদাসী, তার গান আশ্রম-আখড়ায়, মঞ্চে নয়, সরকারি ঝলসানিতে নয়—এই ধারণা ভেঙেছেন কৃষ্ণা, সুমিত্রাই। সাধকের কাছ থেকে অসম্মানিত হয়ে, দাগা খেয়ে, ব্যথা পেয়ে এই নারীরা গানকে ভালোবেসে তারই সাধনা করে দাপট নিয়ে আছেন। কৃষ্ণা চলে গেছেন। আছেন সুমিত্রা। এঁদেরও অগ্রবর্তিনী রাধারানি, ফুলমালা, কালীদাসীরাও তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গিয়ে গেছেন। সাধকের সাধনার নামে নারীকে ব্যবহার বড়োবড়ো গালগল্প দিয়ে এসব পরবর্তীতে আর মেনে নেননি এইসব জেহাদি নারী সাধিকারা। তারা গানকে সত্য মেনে, ধ্রুবকরে এগিয়েছেন। বয়স্কা রাধারানির তার অবস্থান নিয়ে আপশোস থাকলেও ভাগ্যদোষ বলে মেনে নিয়েছিলেন। বলেছিলেন আমাকে, নবনী দাসের মেয়ে আমি, পূর্ণর দিদি। গান আমার রক্তে বয়, অথচ দ্যাখো কেউই গাইতে ডাকে না। রাধারানির গান বীরভূমের বাইরেই বেরোতে পারেনি কোনোদিন। মাধুকরী সম্বল এই মহিলার ইচ্ছে ছিল কলকাতাকে গান শোনানোর। তার সে ইচ্ছে সফল হয়নি। ব্যক্তিগত আগ্রহে কিছু মানুষজনদের কাছে রাধারানির গানের সংগ্রহ আছে। কিন্তু তাঁর গানের ক্যাসেট-সিডি না থাকার দরুন সেসব বিপুল ভাণ্ডার হারিয়েই গেছে। এ আমাদেরই দুর্ভাগ্য। ফুলমালার ক্ষেত্রেও আদতে তাই হবে। এখন অতি বৃদ্ধা হয়েছেন ফুলমালা। তাকে আমি ট্রেনেও গাইতে শুনেছি। জয়দেবের মেলায় দাপটের সঙ্গে একসময় গাইতেন একখানা একতারা হাতেই। বাউলরা কেউ সংগতে এগিয়ে আসতেন না। এ আমার নিজের চোখে দেখা। সমস্ত অসহযোগিতার ভেতর থেকে তবু ফুলমালা যা গাইতেন তা দেখে দক্ষ বাউল শিল্পীও অবাক হয়ে যেতেন। সেই ফুলমালাও প্রচারের আলো পাননি। কলকাতা একবার দু-বার তার গান শুনেছে কেবল। বীরভূমের আহমেদপুরের ভাঙা পরিত্যক্ত রেল কোয়ার্টারে ফুলমালার বাস। তিনি এখন প্রায় অথর্ব হয়ে আপশোস নিয়ে এখানকার থেকেও আরও বড়ো কোনো ইন্দ্রসভায় গান গাইবার জন্য দিন গুনছেন। সদ্য আমি তাকে দেখে ফিরেছি। চিকিৎসার জন্য তার অর্থের প্রয়োজন। একটু সেবা, পথ্য, সুচিকিৎসা পেলে বোধহয় ফুলমালা তার বিবাগী বহীন গলাতে এখনও বিপুল গানের ভাণ্ডার উজাড় করে মণিমুক্তো দিতে পারেন। আমি জানি সেটা আমাদের চরম উদাসীনতায় আর সম্ভবপর হবে না। এই ফুলমালাই জেহাদ তুলেছিলেন। কেঁদুলির সরকারি মঞ্চে তাকে গাইতে না দিতে চাইলে তিনি উদ্যোক্তাদের বলেছিলেন, ‘ওসব হবে না বাবু। বাউলেরা নেচেকুঁদে মঞ্চ মাতাবে, বিদেশে যাওয়ার মতলব আঁটবে আর আমরা আশ্রমে টুংটুঙি বাজাব। আমরা দেখাতে চাই যে আমরাও গাইতে জানি। জোর করে প্রোগ্রাম ছিনিয়ে নিতেন ফুলমালা। এমন দাপট ছিল আরও একজনের। তিনি হলেন নদিয়ার ঘূর্ণির কালীদাসী বৈষ্ণবী। জেলা অফিসে মাঝে মাঝে গিয়ে দরবার করতেন একাকী এই মহিলা। গাইবার জন্য হন্যে হয়ে ফিরতেন। কী তার গায়নশৈলী। মহাজনের পদ, ব্যাখ্যা ও গায়ন সহযোগে আসরে এক নৈসর্গিক পরিবেশ সৃষ্টি করতেন কালীদাসী। তার সম্পদও আমরা ধরে রাখতে পারিনি। কৃষ্ণা বেতার-দূরদর্শনে গেয়েছেন। কলকাতার রবীন্দ্রসদনে অনেকবারই তিনি শ্রোতাদের মুখোমুখি হয়েছেন। ক্যাসেট, সিডি-ও আছে তার। মাধবপুরের সুমিত্রা এখনও নিজের জেলা নদিয়াসহ বাকি ষোলোটিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। মঞ্চে অনেক যন্ত্রানুষঙ্গ নিয়ে সুমিত্রা গান করেন এখন। সুমিত্রাকে বলেছিলাম, এত সব আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করো কেন তুমি? সুমিত্রা বলেছিল, ‘কী করব বলো? আমার আগের বাউল লম্পঝম্ফ দিয়ে গান গেয়ে গেল, তারপর আমি উঠে যদি একতারা নিয়ে টুংটাং করে গান গাই লোকে নেবে? পেটের টানে আমাকেও সময় উপযোগী করে গাইতে হয়।‘ এর উলটো পিঠে দাঁড়িয়ে আছেন নদিয়ার পাগলদহের মীরা মোহন্ত, বীরভূমের নবাসনের নির্মলা গোস্বামীরা। রীতিমত তারা স্বচ্ছন্দ মা গোঁসাই। নির্মলা বছর তিনেক হল দেহ রেখেছেন। প্রবৃদ্ধ বাউল হরিপদ গোঁসাইয়ের সাধনসঙ্গিনী ছিলেন নির্মলা। হরিপদ তাকে নবাসনে সম্মাননীয়াই করে রেখেছিলেন। আমাকে বলেছিলেন ‘নির্মল সেবাদাসী নন, সাধনসঙ্গিনী।’ নির্মলার মতো ভাগ্য নিয়ে সকল নারী পথে আসেন না। হরিপদ মান্য সাধক। তার কাছে যোগ শিখতে বিদেশ থেকে লোক আসেন সমানে। তার মতো তাত্ত্বিক, যোগী বাউল পথে আমি কমই দেখেছি। ফকির লালন সাঁই ছিলেন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক। ঘোড়ায় চড়ে গ্রামের গ্রামে গিয়ে তিনি গাছগাছড়া দিয়ে চিকিৎসা করতেন। হরিপদও এ বিষয়ে সিদ্ধহস্ত। আমাকে বলেছিলেন তিনি, ‘এখনকার বাউলদের বেশি রোগভোগ। সংযম নেই বাউলের। রোগ গিয়ে ঠেকে তার সাধনসঙ্গিনীর শরীরে। তাই প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্র ঘেঁটে রোগ নিরাময়ের প্রচেষ্টা করি।‘ তার যোগচর্চার গল্প বলেছিলেন হরিপদ গোসাই। বিদেশে তাকে নাকি নাঙ্গ করে মেয়েরা সব জলের মধ্যে জাপ্টাজাপ্টি করেছিল। তিনি তখন কুম্ভক করে দম-শ্বসে সব মেমদের কাবু করে ফেলেছিলেন। তারা নাকি তাকে বলেছিলেন, আমাদের পুরুষেরা যা পারে না, তুমি তা পারো কী করে বাবা? হরিপদ বেশ গর্বের সঙ্গে আমাকে বললেন, আমি তাদের বললাম আমার ঊর্ধ্বযোগ হয়। বীর্যকে টেনে তুলে মস্তিষ্কের ব্রহ্মরন্ধ্রে আমি উঠিয়ে নিতে পারি। আমার দম বেশি। এসব করতে দম লাগে। হাজার রমণেও আমার পাত হবে না। আমি যে সাধক। নির্মলার দুই মেয়ে ছিল। হরিপদই তাদের পাত্রস্থ করেছেন। হরিপদর সন্তানাদি নেই। বলেছিলেন, ‘সাধক সন্তানের জন্ম দেয় না কখনও। সে কি আর গৃহী?‘ নির্মলা গোস্বামী নবাসনের বেশ স্বচ্ছল আশ্রমে সকলেরই মা। তার মুখেই শুনেছিলাম সাধিকা জীবনের আগের গল্প। বলেছিলেন অল্প বয়সেই বিধবা হয়ে দুই মেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ির গলগ্রহ হয়েছিলেন তিনি। এক কীর্তনের আসরে তার সঙ্গে গোঁসাইয়ের আলাপ। যোগাযোগ। এরপর ঘড়ছাড়া। ঘুরতে ঘুরতে শেষমেষ এই নবাসনেই স্থায়ী আশ্রম বানানো গাঁয়ের লোকেদের সহায়তায়। সন্ধ্যায় আশ্রমে কীর্তন হয়। স্বায়ংসন্ধ্যা নামগানের পর বাউল আসর বসে। সে আসরে নির্মলাও গান। কী তার গানের দাপট। পাল্লা গানে হরিপদকে পর্যন্ত কাবু করে দিতে পারেন। নবাসনের মচ্ছবের আসরে নির্মলার সঙ্গে পাল্লা গানে নামতেই চাইতেন না কোনো বাউল। নির্মলা বলেছেন আমায়, কিছুই জানতেন না তিনি। গোঁসাই তাকে হাতে ধরে সব শিখিয়েছেন। শ্বাসের কাজ, যোগ, যুগল আসন, গান সবই তার গোঁসাই সংসর্গে পাওয়া। সেইসঙ্গে বোধহয় আশ্রম জীবনের ঘোর স্বচ্ছলতা, সম্মান, বিদেশবাস, ক্যাসেট, সিডি। তাই এসব নিয়ে নির্মলার হেলদোল নেই। তাকে তো আর যুদ্ধ করতে হয়নি কৃষ্ণা, সুমিত্রার মতো! রাধারানি, কালীদাসীর মতো অসহায়াও তিনি নন। ফুলমালার মতো তাকে ট্রেনে গান গাইতে হয় না। তার রোজগারের দরকার নেই। কিংবা নদিয়ার বাঙালঝির সুভদ্রা শর্মার মতো শয্যাশায়ী স্বামী-সাধকের চিকিৎসা ও নিজেদের জীবনধারণের জন্য গেয়ে ফিরতে হয় না। নির্মলা ভাগ্যবতী। প্রথম জীবনে কিছু দুর্বিপাকে পড়লেও প্রকৃত বাউল সাধকের ছত্রছায়ায় সে দুর্যোগ তার কেটে গেছে। যতদিন ছিলেন নবাসনের আশ্রমে বলা যায় রাজ করে গেছেন। তাই সাধনসঙ্গিনীর চৌহদ্দির বাইরে গানের প্রয়োজনীয়তা তিনি ধরতেই পারেননি বলে কৃষ্ণা-সুমিত্রাদের গালমন্দ করতেন। প্রাচীন সিদ্ধ মহাজন, সাধকদের প্রতিষ্ঠিত নারীসাধনের সম্মানে তিনি বিশেষ বিশ্বাস রাখতেন। কেননা সাধনের সেই উপলব্ধ স্বচ্ছতা, অনুভূতি, বোধ তিনি পেয়েছিলেন সাধক হরিপদ গোঁসাইয়ের কাছ থেকে। ক-জন নারী এখন এ পথে এমন সাধক সংসর্গ পেয়ে থাকেন? আশ্রমে তাই নির্মলা সান্ধ্য আসরে অনায়াসেই গাইতে পারতেন, ‘আছে ভাবের তালা সেই ঘরে / সে ঘরে সাঁই বাস করে। ভাব দিয়া খোল ভাবের তালা / দেখবি সেই মানুষের খেলা / ঘুচে যাবে শমন জ্বালা / থাকলে সেই রূপ নেহারে।’ হরিপদ যখন গাইতেন নারীভজনার কোনও মহাজনি পদ, তখন গর্বিতা নির্মলাকে আমার দিকে সম্মতির চোখে চেয়ে থাকতে দেখেছি। সাধকের চরম এই দুর্দিনে, সমাজ বাস্তবতায় নারীর গানকে আমার সমর্থন নির্মলা মেনে নেনইনি কোনোভাবে। বলেছিলেন, ‘ও নারীর পথ নয়। নারীর পথ আশ্রমে থেকে সাধনভজন। সংসারী নারী যেমন গৃহকর্ম করে পতি-সন্তানের যত্নআত্তি করে, তেমনই সাধিকা নারী আশ্রমে সাধনচর্চা করবে, গোঁসাইসেবা করবে। ভক্তশিষ্যদের মাতৃস্নেহে কাছে টানবে। সাধনে এসে সাধিকা কি তার সহজাত নারীধর্ম খোয়াবে তুমি বলো ছেলে?’ ‘নির্মলা মা’র যুক্তিকে আমি খর্ব করতে পারিনি। প্রতিপক্ষ যুক্তি দিয়ে তাকে অমান্য করার ইচ্ছে ও সাহস কোনোটাই আমার ছিল না। কেননা নির্মলা মা বাউল সাধনের প্রকৃতাবস্থার মধ্যে ছিলেন। তাই তার মনের বিসদৃশ ভাবনা, সাধন ভাবনা, অনুভূতি, উপলব্ধি, সিদ্ধ সাধকের পরশ থেকে সরে আসা অসম্ভব। কেননা তিনি সেই সহজ মানুষের বোধটি রপ্ত করতে পেরেছিলেন সহজ সাধকের বদান্যতায়। সাধনের ব্যভিচার, সঙ্গী পালটানো, আশ্রমে গিয়ে যুবতি বয়সের নারী হাতানোর পাশে যেজন্য নারী সাধিকা বা সঙ্গিনীর ধর্মমত থেকে তাকে কোনোভাবে সরানো যায়নি। যেমনটি নদিয়ার মীরা মা-কেও সাধকের প্রবল অবিচারে সরানো যায়নি। কেননা মীরা মহন্তও একসময় সিদ্ধ সাধকের কাছ হতে পরশমণি পেয়েছেন। যা তিনি আজও হৃদয়ে রেখে দিয়েছেন। সত্তর পেরোনো কালীদাসীর গায়ন দাপট তার দেখাবার প্রয়োজনই-বা কী? কালীদাসীকে বৃদ্ধা বয়সেও এ মেলা সে মেলা করতে হত। জেলা তথ্য-সংস্কৃতি অফিসে, বিধায়ক বা পঞ্চায়েত সভাপতির কাছে করতে হত অনুনয় গানের সুযোগ, পেনশনের জন্য। কালীদাসীর তিন কুলে কেউ ছিল না। নিঃসম্বল মহিলা তত্ত্বগান রপ্ত করে আর কীই-বা করতে পারতেন। তিনি তো একই জেলার মীরা মার মতো গুরু মা নন। সচ্ছল আশ্রমের কত্ৰী নন। তিনি চান আখড়ায় গাইবার সুযোগ। সেখানে গাইলে যদি রসিক-ভক্ত সমঝদার কিছু দান দক্ষিণা দেন তবে তার জীবনধারণে সুবিধে হয়। আর মীরা আখড়া বসান নিজে অগ্রদ্বীপের মেলায়। সেখানে নানা জায়গার বাউল গাইতে আসেন। তার তো আর গান গেয়ে রোজগারের দরকার নেই। তিনি গান ঘরোয়া আসরে মনেরই আনন্দে। গৌরবর্ণা, রূপসী মহিলা, তেজস্বিনী। মধ্যবয়স্কা এই মহিলা কিন্তু বাউলের ছেড়ে যাওয়া সাধনসঙ্গিনী হননি। তিনি নিজে ছেড়ে গেছেন সাধক বাউল নরোত্তম দাসকে। নরোত্তমকে ছেড়ে গেলে মীরা তিনি আবার বৈষ্ণব ঘরের বউ শ্যামা দাসীকে বের করে এনে সাধনভজন শুরু করলেন। দশ বছর এভাবে চলার পর মীরা একদিন এসে হঠাৎ উপস্থিত। অল্প বয়সি মীরাকে পেয়ে নরোত্তমই বলা চলে শ্যামা দাসীকে ত্যাগ করলেন। যদিও শ্যামা দাসী তা মানতে চান না। আসলে তিনি বৈষ্ণব নরোত্তমকে বাড়িতে পেয়ে সেবাযত্ন করে প্রেমে মজে স্বামী-পুত্র ছেড়ে তার সঙ্গে বেরিয়ে এসেছিলেন। সেই প্রেম বজায় ছিল বলেই বোধহয় তার বিশ্বাস গোঁসাইয়ের সায় ছিল না মীরা এসেই তাকে খেদিয়েছে। মীরার পাকা সচ্ছল আশ্রমের পাশে এখন জীর্ণ কুঁড়েতে শ্যামা দাসী থাকেন। বৃদ্ধ হয়েছেন। মাধুকরীতেও যেতে পারেন না। উপোস দিয়ে থাকেন। মাঝে মাঝে দয়া পরবশ হয়ে কোনো ভক্ত কিছু দিয়ে গেলে জোটে। মীরা বোধহয় ফিরেও চান না। দাপুটে মীরাকে টপকিয়ে আমার অবশ্য শ্যামা দাসীর কুঁড়েতে যাওয়ার সাহস ছিল না। একদিন বেলাবেলি গেলে আশ্রমে মীরা ছিলেন না। এক ভক্তই বললেন, ‘পাশেই শ্যামা দাসী থাকেন। যাবেন? গেলে এ পথের অনেক কিছু জানতে পারবেন।