জিজ্ঞাসা করলাম, শরীর তাহলে পুরুষ?
-শরীর পুরুষ ঠিকই, তবে প্রকৃতি কর্তা। প্রকৃতির গুণেই শরীরকে পুরুষ হিসেবে ধরে নেওয়া।
বললাম, তাহলে খ্যাপা সেই অনুমানের ধর্মই তো হল আমাদের?
অনুমান কী প্রকারে? শরীরকে ঘিরে অনুমান। শরীর তো বর্তমান। বর্তমানের ভেতর আমাদের অনুমান। অন্বেষণ। নিরাকার আল্লাহকে পুরুষ জ্ঞান করে বর্তমান সাকার শরীরে এনে তাকে কর্তা জ্ঞান করে তার গুণ বিচার করা। অধরাকে ধরবার জন্য আমাদের প্রাকৃতিক চিহ্ন।
বললাম, মানে ভেদাভেদ!
—হ্যাঁ ঠিক তাই। শরীরের কর্মঠ প্রকৃতিকে পুরুষের সাকাররূপে এনে প্রকৃতি-পুরুষের অভেদত্ব জ্ঞানই হল আমাদের ঘরের সাধনা। লবান শাহ আমাকে তা হাতে ধরে শিখিয়ে গেছেন খ্যাপা।
কর্তাভজারা গুরুকেই ‘কর্তা’ বা ‘মহাশয়’ নামে অভিহিত করে থাকেন। মানবদেহস্থিত পরমতত্ত্ব বা আত্মার সন্ধান তারা বিশ্বাস রাখেন গুরু নির্দেশিত পথেই একমাত্র হতে পারে। নচেৎ কোনোভাবে আর সম্ভব নয়। আত্মাকে তারা নামে নামেও ভূষিত করেন। ‘সহজ মানুষ’, ‘মনের মানুষ’, ‘ভাবের মানুষ’, ‘অধর মানুষ’, ‘আলেক’, ‘সাঁই’, ‘কাঙ্গাল’ ইত্যাদি নানা নামেই এই সম্প্রদায়ের মানুষেরা আত্মাকে চিহ্নিত করে থাকেন। আর এগুলো সবই কিন্তু হল গিয়ে বাউলভুক্তির শব্দ। এই পথে সাধনপদ্ধতিতে ভজন প্রসঙ্গটিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ভজনা এখানে সেই বাউলভুক্তির মানুষের হয়ে থাকে। কেননা মানুষই অভেদত্বে একমাত্র যেতে পারেন। মানুষই ঈশ্বরের উপলব্ধিকে তার দেহে রাখতে পারেন। সেজন্যই সহজিয়া ধর্ম মেনেই কর্তাভজারা তাদের সাধনসংগীতে সেই মানুষেরই জয়ধ্বনি দিয়েছেন। বলেছেন, ‘মানুষ ভজ, মানুষ চিন্ত, মানুষ কর সার / সকলি মানুষের খেলা, মানুষ বই নাই আর।‘ সাধক লালশশীর এই উপলব্ধিও মানুষের ভেতর আত্মা ও পরমাত্মার অভেদত্বকেই স্পষ্ট করে। লালনের ঘর মানুষের মধ্যেকার অভেদত্বকে ভিত্তি করেই কিন্তু দাঁড়িয়ে আছে। সে কারণেই সতী মা’র ঘরকে লালন ঘরের মানুষেরা শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। সতী মা’র ঘর চৈতন্যদেব এবং তাদের সম্প্রদায়ের প্রবর্তক আউলচাঁদের মধ্যে অভেদত্বর কিংবদন্তি চাপানোর ফলেই বোধহয় কর্তাভজাদের চৈতন্য-নিত্যানন্দ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছেন অক্ষয়কুমার দত্তের মতো ক্ষেত্রানুসন্ধানী গবেষকও। এটি বেশ আশ্চর্যেরও বটে। তিনি ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ নামক সেই মহামূল্য লোকায়ত আকর গ্রন্থে লিখেছেন, ‘…বাঙ্গালাদেশে চৈতন্যসম্প্রদায়ের অনুরূপ অথবা উহার শাখা স্বরূপ আর একটি সম্প্রদায় সংস্থাপিত হইয়াছে, তাহার নাম কর্তাভজা। দীনেশচন্দ্র সেনের মতো ঐতিহাসিক পর্যন্ত বৈষ্ণব শাখার সঙ্গে কর্তাভজাদের জুড়ে দিয়েছেন, যেটা কিনা আরও আশ্চর্যের। সম্প্রদায়ভুক্তরা মনে করেন যে চৈতন্যদেবই আত্মগোপন করে দীর্ঘদিন বাদে নবরূপে প্রকট হয়ে এই ধর্মমতের প্রবর্তন করেন। কিন্তু এটা তাদের মাথাতে আসে নানীলাচলে চৈতন্যের সেই অন্তর্ধান রহস্যের প্রায় ১৬১ বছর পর কীভাবে তিনি আউলাদ হয়ে ফিরে আসবেন। কিংবদন্তি চৈতন্য-আউলকে এক করেছে ঠিকই, তথাপি এই দুই সম্প্রদায় ভাবগত দিক থেকে এক নয়। ধর্মীয় মতবাদ, সাধনপদ্ধতি, আচার-অনুষ্ঠান যথেষ্টই আলাদা। দুই ধর্মপথের উদার মানবিক দিকটি একসূত্রে গ্রন্থনের একটা দিক হলেও গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম মূলত ভারতীয় বৈষ্ণবতার একটি শাখা বই আর কিছুই নয়। সহজিয়া বৈষ্ণবদের সঙ্গে কর্তাভজাদের সাধনপদ্ধতিতে কিছু মিল রয়েছে এটা মানা যেতে পারে। তবে সহজিয়া তো কোনো ধর্ম সম্প্রদায় নয়। এটি সুপ্রাচীন কাল ধরে বয়ে আসা একটি সাধন পদ্ধতি। যেখানে প্রকৃতি-পুরুষের মিলিত দেহকেন্দ্রিক চর্চায় মানুষে-পরমে অভেদত্ব আসে। বৈষ্ণবাচার্য বীরচন্দ্ৰ আউলচাঁদের শিষ্য মাধববিবির কাছ থেকে শিষ্যত্ব গ্রহণ করে সহজিয়া সাধনতত্ত্বের প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন, এই কিংবদন্তির কারণেই বোধহয় সহজিয়া কর্তাভজা একীভূত হয়েছেন। বৈষ্ণবতার সঙ্গে কর্তাভজাদের গুলিয়ে ফেলবার উদ্ভব এখান হতেই হয়েছে বলে মনে হয়। আসলে যেটা হয়েছে সহজিয়া স্রোতে তন্ত্র বা সঠিক করে বললে দেহভিত্তিক যোগক্রিয়ার ব্যাপারটি প্রথম থেকেই ছিল। বৌদ্ধ সহজযান ধর্মসাধনার ছোঁয়াও তাতে যেমন লেগেছিল, তেমনই বৈষ্ণব রাগাত্মিকা প্রেমসাধনাও এতে একীভূত হয়েছে। এমনকি ইসলাম বেশরিয়তি সুফিতত্ত্বও সহজিয়া স্রোতে যুক্ত হয়েছে বলেই কর্তাভজাদের সঙ্গে ইসলামও জুড়ে গেছে। এই সমস্ত জোড়াজুড়ির প্রধান কারণ হল, এইসব ধর্মমত সবই দেহাচারমূলক ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। আর সব গিয়ে কর্তাভজা ঘোতে মিশেছে তার সবথেকে বড় কারণ হল আঠারো শতকের মধ্যভাগে প্রতিষ্ঠিত এই লোকায়ত ধর্মমতে পরবর্তীতে সমাজের উচ্চবর্গীয় স্রোতের দাপট চোখে পড়বার মতো। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, সন্তুদাস বাবাজির মতো প্রতিষ্ঠিত ধর্মগুরুরা পর্যন্ত একসময় ঘোষপাড়ার কর্তাভজা সম্প্রদায়ের ধর্মগুরুদের কাছে নাড়া বেঁধেছিলেন। উনিশ শতকে ইউরোপীয় মিশনারিরাও কর্তাভজাদের মেলাতে এসেছিলেন। উইলিয়াম ওয়ার্ড তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Account of the writ ings, Religion and manners of the Hindoos’-a az qacerata সম্পর্কে মতপ্রকাশ করেন। ওয়ার্ডের সমকালে উইলিয়াম কেরি, মার্শম্যান, আলেকজান্ডার ডাফ পর্যন্ত ঘোষপাড়াতে এসেছিলেন, ১৮৪৬ সালের ‘Calcutta Review’-তে এ তথ্যও উজ্জ্বল রয়েছে। সম্প্রদায়ভুক্ত হারাধন মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘সত্যস্রোত’ গ্রন্থে তাদের বয়াতি রামনারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে রামমোহন রায়ের ঘোষপাড়াতে আসার বিবরণ দেন। ঈশ্বর গুপ্ত, অক্ষয়কুমার দত্ত, নবীনচন্দ্র সেনদের লেখাই প্রমাণ করে যে তারা ঘোষপাড়া সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। তবে ঘোষপাড়ার সাধন নিয়ে বিরূপ মন্তব্য ভেসে এসেছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুখ থেকে। নবীনচন্দ্র সেনকে তিনি বলেছিলেন, ‘কর্তাভজাদের মেলা! শুনিয়াছি, উহা বড় জঘন্য ব্যাপার।’ আর ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব ঘোষপাড়ার সাধন পদ্ধতি সম্পর্কে আগত ভক্তদের সাবধান করে দিয়েছিলেন, ‘হরিপদ ঘোযপাড়ার এক মাগীর পাল্লায় পড়েছে। ছাড়ে না। … আমি অনেক সাবধান করে দিয়েছি। …কী জান? মেয়েমানুষ থেকে অনেক দূরে থাকতে হয়, তবে যদি ভগবান লাভ হয়। … এরা সত্তা হরণ করে।’ যুগল সাধনা বরাবরই এইসব বদনামের শিকার হয়েছে। কাম-কামনার মধ্যে অপরকে আস্বাদনের তীব্র শারীরিক আকুতিকে যে পরমাবস্থা বা শরীরের যোগ যৌক্তিক অভেদত্বের ভেতর এনে একেবারেই পারমার্থিক প্রেমের উৎসবে মিশিয়ে দেওয়া যায় আর তা একটা দম-শাসের কৃৎকৌশল—এটা ধরতে অনেকেরই অসুবিধের কারণ সেই নারী-পুরুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি-প্রক্রিয়ার স্মরণ। আর তা করতে গিয়েই লিঙ্গগত, যৌনগত রাজনীতির দিকে গড়িয়েছে লোকায়ত সাধনের ধারা। তথাপি তারও যে প্রবল নামডাক বাংলার মনীষাদের সমালোচনা শিল্পই তার প্রমাণ। এর থেকে অনুমেয় সতী মা’র ধর্ম কীভাবে সেই সমসময়ের মনীষী ও সাধক সংযোগে অনন্য হয়ে উঠেছিল। না হলে তাকে নিয়ে এত মাতামাতিই বা থাকবে কেন? ফলস্বরূপ লোকায়ত সাধনের নানা স্রোত সে সময় সতী মা’র ধারাতে মিশে যেতে চেয়েছে বোধহয় বৃহত্তম সমাজের অনুশাসন থেকে রক্ষা পেতে। কেননা সতী মা’র ধর্ম সমাজের সেই চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করেই এগিয়েছে। লালনের ঘরের সঙ্গে আবার সতী মা’র সাযুজ্য কিন্তু এখানেই। জীবদ্দশাতেই ফকির লালন শাহ কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলেন। তার গান আর উপলব্ধি দুটোই নিজস্ব ভক্তশিষ্যমণ্ডলীর বাইরেও যে আদৃত ছিল তা তো তৎকালীন বুদ্ধিজীবীদের তার আখড়াতে যাতায়াতের বহরটি দেখলেই বোঝা যায়। আবার এই বহরটি লালনকে শ্রীচৈতন্যের বাইরে এনে দাঁড় করলেও শ্রেণিগত বিভাজন যে লালন ঘরের কিংবদন্তিতে লেগেছিল এটা তো ঠিক। তার ভক্তশিষ্যরা কোনোভাবেই উচ্চকোটির সংস্কৃতির মানুষজন ছিলেন না। সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণিও যে তার আখড়াকে খুব একটা নেকনজরে দেখত তা নয়। লালন বিশ্বাস রাখতেন করণে। আর এই করণ শরীরগত আচরণ বই তো আর কিছু না। শরীরের সেই আচরণ হল গিয়ে লিঙ্গ প্রক্রিয়াকে রুখে দেওয়া। নারী-পুরুষের কোনোপ্রকার লিঙ্গকেন্দ্রিক আচরণ এই ঘর বরদাস্ত করেনি। সৃষ্টিকাজ যে কারণে নিষিদ্ধ বলেই গ্রাহ্য ছিল। প্রাকৃতিকতাকে পুরোপুরি অস্বীকার করে লালনের ঘর নারী-পুরুষের মধ্যেকার জৈবিক তাড়নাকে নষ্ট করে দিয়ে মানুষের স্বাভাবিক আবির্ভাবকেই গ্রাহ্য করেছিল। সেই স্বাভাবিকতা ছিল প্রকৃতির মধ্যে যে অখণ্ড প্রকৃতির ধারা, তাকে অখণ্ড রেখেই প্রকৃতির উজানে ফিরে যাওয়া। নিম্নগামী না হওয়া। এভাবেই পুরুষের জৈবিক স্বলনকে ব্যর্থ করে দিয়ে শরীরের ভেতর সহজ মানুষের আবির্ভাবকে বরণ করে নেওয়া। যার ভেতর যৌনগন্ধ থাকলেও যৌনতাকে অস্বীকার—এই ভাব প্রচলিত সংস্কারের প্রবলরূপে বিরুদ্ধাচরণ করেছিল বলেই ফকির লালন শাহ এবং তার আখড়া লালনের জীবদ্দশাতেই কখনও কলঙ্কমুক্ত ছিল না। ফকির লালন শাহকে অনেক যুদ্ধ করেই উচ্চকোটি ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির আঁচ বাঁচিয়ে টিকে থাকতে হয়েছিল। চৈতন্যদেবের ক্ষেত্রে সেটি হলেও সেখানে যৌনচর্চার কোনো গন্ধ ছিল না বলেই তার সাধনায় ব্যভিচার, কামাচারের প্রলেপ পড়েনি কোনো। যে কারণে মনে হয় লালনের লড়াইটা আরওই মারাত্মক ছিল। শ্রেণি বায়োগ্রাফির একটা ব্যাপার ছিল। যতই তিনি সেটিকে অতিক্রম করতে চান না কেন। সুতরাং এইসব সামাজিক আহাওয়ার ভেতর তার জীবন ফুলের বিছানা হয়ে যায়নি। যে কারণে মনে হয় জীবদ্দশাতেই তার বহু বহু ভক্তের কলতানের কথা শোনা গেলেও বোধহয় খুব বেশি ভক্তপরিমণ্ডলবেষ্টিত হয়ে বসেছিলেন ফকির লালন শাহ এটা অন্তত আমার মনে হয় না। বরং বলা যায় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা তাকে নিয়ে তার মৃত্যুর পর করবার সময়ে ভক্তসংখ্যা সে সময় বাড়ার একটা সংগত কারণ থাকতে পারে। চৈতন্যের তিরোধানের পর বাংলার বৈষ্ণব সমাজে যে দিশেহারা দশা চলেছিল সেই দশা খানিকটা দিশাতে গিয়েছিল নিত্যানন্দ প্রভু বেঁচে থাকার কারণে। কিন্তু লালনের তিরোধানের পর তার দুই শিষ্য মনিরুদ্দিন শাহ ও ভোলাই শাহের ঝগড়া-বিবাদের মাঝখানে দিশা দেওয়ার মত যোগ্য মানুষের অভাবেই লালনের ঘর তখন ঝগড়া, ঝামেলা, মনকষাকষি, একজনের বিরুদ্ধে অন্যজনের নিন্দা ইত্যাদিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। এখনকারও লোকায়ত সাধনার বৃত্ত আঠারো শতকের শেষার্ধের সেই লালন পরিমণ্ডল থেকে খুব একটা বেরিয়েছে বলে আমার অন্তত মনে হয় না। আমরা লোকায়ত সাধনার ভাব ও ভাবুকতাকে এখনও ঠিকভাবে ধরতেই পারিনি। সেজন্য একে মূলধারা থেকে পৃথকই করে রেখেছি। লোকায়ত সাধক আমাদের কাছে ভীষণই অনাধুনিক, কিন্তু তার গান যেহেতু আজ নেহাতই কেবল বাউলিয়াপনার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সেহেতু তার যেমন খুশি শব্দ-বাক্য বদলিয়ে, ওপরের অন্তরা পরে, নীচের অন্তরা আগে—এইভাবে ইচ্ছামতো ওলোটপালট করে দেদার বিকোচ্ছে ক্যাসেট-সিডিতে। আমাদের প্রজন্মের কাছে লোকায়ত সাধকের কদর বেড়েছে বোধহয় কেবল তার নেশাদ্রব্য ও অবাধ শরীর ব্যবহারের স্বাধীনতায়। এখানে এসে আমরা অনেকেই তাই অন্তর্ভুক্ত হতে চেয়েছি আমাদেরই সমাজজীবনের কঠোর বাস্তবতার মারপ্যাচে। আবার কিছুদিন থেকে, নেশা করে, কেউ বা সাধিকা বা গুরু মা’র পালিতা আশ্রমকন্যার শরীরের আংশিক কিছু স্বাদ পেয়ে মূলস্রোতে ফিরে গিয়ে কেবলই টিপ্পনি কেটেছি। বুঝিনি, উপলব্ধি করিনি দেহকে ঘিরে, শরীরকে দিয়ে নিরাকারের সাকার রূপ পরিগ্রহণের এই ধর্মকে। বুঝিনি তার সাধনকেন্দ্রিকতার গানকে। সেখানকার প্রজ্ঞা বা জ্ঞান, উপলব্ধি কিছুই আমাদের টানেনি। কেননা আমরা আমাদের প্রবল আধুনিকতা নিয়েও এখনও সেই বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা উৎপাদনে তৎপর মানুষ। আত্মপরিচয়ের জায়গায় আছে আমাদের রক্তপাত, বিভেদ, বিরহ, ব্যথা, সংগ্রামের যাবতীয় অমীমাংসা। আমরা তাই সামাজিকবিধান, আইন থেকে দূরে থাকা এইসব মানুষদের বরাবরই সন্দেহের চোখেই দেখেছি। এরা এদের নিরক্ষরতা, দারিদ্রতার ভেতর কীভাবে অসাম্প্রদায়িক চর্চায় ব্রতী হতে পারেন আমরা তা ভেবে পাইনি। আমাদের ভাবারও অবকাশ নেই। আমাদের আছে কদাচার আর বিকার। গেঁজেল ও নেশাখোরদের দমসাধনা দেখে আমরা লোকায়ত সাধককে সবসময় বিচার করেছি। তাই তাঁর ভাবের নেশা আমাদের চোখে পড়েনি। এভাবে আঠারো-উনিশ শতকের লোকায়ত পথের আবর্জনা একুশ শতকে আরও স্তুপীকৃত জঞ্জালে পরিণত হয়েছে। তবু তারও ভেতর থেকে উঁকি মারছেন এই এখনও কোনো না কোনো লোকায়ত সাধক কিংবা তার বয়ে আনা কোনো গান।