লালন নিজে সাধুসঙ্গে জোর দিতেন। জীবদ্দশায় নিজে তিনি ভরা পূর্ণিমায় সাধুসঙ্গ করতেন। দোলের দিন তার বিশেষ পছন্দের ছিল। ওইদিন সাধুসঙ্গ ছিল যেন তার ভাববিনিময়ের মতো। সারা বছরজোড়া সাধন উপলব্ধির আধারমহিমা পরস্পরের মধ্যে বিতরণের উদ্দেশ্যেই সাধুর মেলে যাওয়া। লালনের ঘর তাই দোলকে এখনও গুরুত্বপূর্ণ মনে করে হেঁউড়িয়ার সেই স্মৃতিধামে সর্বজনীন উৎসব বা মেলা করে থাকে। বৃদ্ধ ফকির আমাকে বললেন, ছেউড়েতেও সাধুর মেলা বসে প্রতি দোল পূর্ণিমায়।
জিজ্ঞাসা করলাম, ওইদিন কী হয়?
বললেন, গুরুর আমল থেকেই তত্ত্বকথা হয়। গান হয়। জ্ঞানচর্চা হয়।
–সাঁইজির স্মরণ অনুষ্ঠান তাহলে?
একেবারে ঘাড়কে অসম্মতিসূচক সজোরে নাড়িয়ে ফকির বললেন, স্মরণ নয় খ্যাপা। মনন হয় সেদিন। স্মরণ পহেলা কার্তিক। সাঁইজির মৃত্যুদিবসে জ্ঞানচর্চা হয় না কোনো। হয় না কোনো ভাবেরও আদানপ্রদান। সেদিন কেবলই সাঁইজির দৈন্য গান গেয়ে সাঁইজিরে ভক্তি দিতে দীনহীনভাবে ডাকা হয়।
সতী মা’র ঘরেও দোল গুরুত্বপূর্ণ খুব। দোল এখানেও বাৎসরিক মিলন উৎসব। তিন দিনের সেই উৎসবে গুরু-পরম্পরায় সাম্প্রদায়িকগণ আসন স্থাপন করেন এবং সাধনভজনে নিরত থাকেন। গুরু (মহাশয়) ও শিষ্যের (বয়াতি) মেলবন্ধনে কর্তা বা মালিকের সঙ্গে এদিন প্রত্যক্ষ যোগাযোগ স্থাপিত হয়। তা এই দোলমেলাও বাউলদের প্রধান এক উৎসব হয়ে উঠেছে। যদিও কর্তাভজারা সরাসরি বাউল কিন্তু নন। কর্তাভজা আর বাউল এই দুই সম্প্রদায়ের সংযোগসূত্র হিসেবে রয়ে গেছেন চৈতন্যদেব। অনেক প্রাজ্ঞ বাউলকেই আদি পুরুষ হিসেবে চৈতন্যদেবকে চিহ্নিত করতে দেখেছি। নৈহাটির সাহেব কলোনিতে থাকেন স্মরজিৎ খ্যাপা। ভবা পাগলার সঙ্গ করেছেন নির্জন এই সাধক। স্মরজিৎকে আমি সবসময়ই ভাবতন্ময় দশার ভেতরই প্রত্যক্ষ করেছি। যথেষ্টই বয়স হয়েছে এখন তার। গলা প্রতিদিন সুরে খেলে না। উঁচু স্বরে সেইভাবে আর দাপটও রাখতে পারেন না। তথাপি গান নিয়ে গুরুকে ভক্তি দেওয়ার ঐকান্তিক ইচ্ছা কতবারই আমি দেখেছি সাহেব কলোনিতে তার গুরুর আশ্রমে। খুব গর্ব করে একদিন আমায় বলেছিলেন, ‘জানেন কাটোয়ার মচ্ছবে ভবা পাগলা আমার গান শুনে নিজের গলার মালা খুলে আমারে পরিয়ে দিয়ে খ্যাপা টাইটেল দিয়েছিলেন। সেই থেকে স্মরজিৎ বাউল থেকে আমি হলাম স্মরজিৎ খ্যাপা।
গুরুর আশ্রমে বসেই দুপুরে সেবা নেওয়ার পর স্মরজিৎ খ্যাপা একদিন আমাকে বললেন, চৈতন্যচরিতামৃতরে কী মনে হয় আপনার?
বললাম, চৈতন্য আকর হিসেবে দেখি। আবার ভক্তির বাড়াবাড়িতে কখনও ভগবানের লীলাপুস্তক বলেও ভ্রম হয় আমার।
আমার এই অভিমত শুনে দেখলাম খ্যাপার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বললেন, আপনি ধারপাশ দিয়েই গেছেন। সাধকসঙ্গে ঘোরাফেরা করেন তো। একটা আধার এমনিতেই রয়েছে আপনার।
বললাম, আপনার কী মনে হয় তবে? আর বাউল হয়ে গ্রন্থকে মানেন আপনি!
—চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থ আপনাকে এ কে বলল?
—তবে কী সেটা?
—চৈতন্যচরিতামৃত হল গুপ্তলীলার প্রহেলিকা। তার পাতায় পাতায় দেখুন মহাপ্রভু কেবল ক্রিয়ামূলক সাধন দেখিয়ে গেছেন।
বললাম, সেই সাধনে বিশ্বাস রাখেন আপনি?
—কেন রাখব না খ্যাপা! মহাপ্রভুর প্রেম ক্রিয়ামূলক। প্রকৃতি-পুরুষের মিলনযোগ বুঝিয়েছেন তিনি। গোপনে গুপ্তলীলার মতো করে দেখবেন চৈতন্যচরিতামৃতে ইন্দ্রিয় সংযমের কথা রয়েছে। প্রকৃতি-পুরুষ যোগ। পরম রহস্য এসব সেখানে স্পষ্ট করে বলা আছে।
জিজ্ঞাসা করলাম, বাউলেরা চৈতন্যকে মানেন?
-মানবেন না কেন খ্যাপা! চৈতন্যদেব তো রীতিমতো মানুষ ভজনা করেছেন। তার ভজনে করণ ছিল। পূজন ছিল না কোনো। শরীরকে প্রকৃতিযোগে বসিয়ে রেখে পুরুষের করণ করতে চেয়েছিলেন তিনি। বাউল গোপনীয়তায় বিশ্বাস করে। তার সাধনধারায় চৈতন্যদেবের গুহ্যসাধন প্রণালীর যোগ রয়েছে।
প্রায় একইরকম কথা বলেছিলেন এক কর্তাভজা সাধক। পড়ারি গ্রামে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের প্রবর্তক আউলচাঁদের সমাধির পাশে দাঁড়িয়ে তিনি আমাকে বলেছেন, আমাদের ধর্ম হল আচরণীয় ধর্মে যুক্ত। যার কোনো বাহ্য চিহ্ন নেই। পোশাক নেই। মালা-তিলক নেই। পুরোপুরি গৃহীর ধর্ম।
বললাম, তাহলে আপনাদের প্রকৃতি-পুরুষ সাধনা? সেটাকেও কি আপনি গৃহীর ধর্ম বলে মান্য করবেন?
–প্রকৃতি আর পুরুষ তো একই শরীরে। এ তো মহাপ্রভুর শিক্ষা। ধর্ম বুঝতে হলে আপনাকে আগে অভেদ বুঝতে হবে। সেই অভেদত্বগুণে মহাপ্রভু আর আউলাদ এক। সেই অভেদত্বগুণেই শরীরের প্রকৃতিতে পুরুষযোগ আসে। আপনি আসলে যুগল ভজনার ইঙ্গিত করেছেন। আমাদের ধর্মে উদাসীনরা কেউ কেউ যুগল ভজনা করেন। স্কুল সেই কায়াসাধনের ভেতর দিয়ে তারা সূক্ষ্মস্তরের প্রকৃতি-পুরুষকে অভেদ করেন আর কী!
কর্তাভজা, বাউল, বৈষ্ণব, সহজিয়া—সব এক হয়ে যাওয়ার পেছনে আসলে রয়েছেন সেই একজন মানুষই। সকলের সঙ্গেই চৈতন্যদেবের কিংবদন্তির নানা সূত্র নিয়ে যুক্ত হয়ে থাকাটাই সব সম্প্রদায়ের মতাদর্শগুলোকে কোনো একটিমাত্র বিশেষ বিধিপন্থায় একীভূত করে দেওয়ার মূলে রয়েছে। এর পেছনে ওপর ওপর দেখে ধর্মমতকে নির্দেশিকায় চাপিয়ে দেওয়া বিশিষ্ট গবেষকদের হাত যেমন রয়েছে, তেমনই আবার সম্প্রদায়গত মান্যতাও কিছু রয়েছে। যেমন—অদ্বৈত আচার্যের প্রহেলিকা ভরা চৈতন্যদেবের লিখিত চিঠির সেই ‘বাউল’ অভিধা থেকে চৈতন্যদেবকে তারা নিজেদের গোত্রভুক্ত মনে করে থাকেন। আবার ‘চৈতন্যচরিতামৃত’-এর মধ্যে শ্রীচৈতন্যের যে গুপ্তলীলার ইঙ্গিত রেখে গেছেন রচয়িতা সেই ইঙ্গিতকে পর্যন্ত তারা বাউল সাধনার দিকে ঘুরিয়ে নেন। স্মরজিৎ খ্যাপা কিন্তু সেই কাজটিই করছেন সাহেব কলোনিতে তার গুরুর আশ্রমে বসেই। তবে শুধু স্মরজিৎ খ্যাপাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। আসল দোষটি করেছিলেন এখানে চৈতন্যদেবই। তার বর্ণভেদহীনতাই লোকায়ত সাধকদের আকৃষ্ট করেছিল বেশি। সেজন্য লৌকিক ধর্মের সর্বস্তরে কালক্রমে চৈতন্যদেবই হয়ে উঠেছিলেন প্রধান পুরুষ। কেবলমাত্র বৈষ্ণবদের নানা উপশাখা তাকে মেনেছেন তা তো নয়। বাউল-ফকির-দরবেশ সকলেই তাকে মর্যাদা দিয়েছেন বোধহয় তার মানুষ ভজা’-র মতোই ভেদাভেদহীন জীবনপ্রণালীর তাপে। চৈতন্যদেবের সমন্বয়বাদ মনে ধরেছে ‘ভ্রষ্ট’, ‘পাষণ্ড’, ‘কদাচারী’ বলে খ্যাত লৌকিক ধর্মের এইসব সামাজিক দিক থেকে ভীষণই পিছিয়ে পড়া মানুষজনদের। আর এভাবেই বৈষ্ণব-বাউল এক হয়ে ওঠার ফলে বাউল ধর্ম আর বৈষ্ণব ধর্ম আলাদা বলে বাউল শুরুদের হাঁক পাড়তে হয়। কর্তাভজাদের সাধনপদ্ধতিতে শুরু হলেন ঈশ্বর। গুরুকে ঈশ্বরবোধে এঁরা পুজো করে থাকেন। এঁদের মূল আচরণ যেহেতু দেহাচারমূলক এবং ক্রিয়াসাধন, সেহেতু এখানে গুরু ছাড়া উত্তীর্ণ উপায় নেই। হাওয়ার খবর, মহাবায়ু, কুলকুণ্ডলিনী যোগের মাধ্যমে দেহগত সাধনার সাধনপদ্ধতি নির্দেশিত হওয়ার কারণে কর্তাভজারা গুরুর উপদেশ-নির্দেশে সাধনার পথে অগ্রসর হন। গুরুকেই আরাধ্যরূপে পুজো এ ঘরের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। মনে রাখতে হবে বাউলরা কখনও কিন্তু গুরুকে পুজো করেন না। ভক্তি দেন। ছেউড়িয়ার সেই লালন ঘরের সাধক মজনু শাহ ফকিরকে আমি ভক্তি দেওয়ার বিধিটি জিজ্ঞাসা করেছিলাম। মজনু হেসে বলেছিলেন, বিধি আমাদের নেই। ওসব তো খ্যাপা, বৈষ্ণব ধর্মের ব্যাপার। আমাদের করণের ঘর। করণের নিয়ত্তা হল গিয়ে শরীর। শরীরকে কর্তা মনে করতে হবে খ্যাপা।