মনমোহনের বিখ্যাত শিষ্য হলেন সোমেন বিশ্বাস। পঞ্চাশের ওপর বয়স তার। ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেন। পড়াশুনা করতে করতে গাঁয়ের বাউল আবহে তার রক্তে মেশে গায়ক হওয়ার নেশা। এ তথ্য আমাকে সোমেনই দিয়েছেন। গান শিখবার জন্য তিনি সাঁটুইয়ে গিয়ে উঠেছিলেন। গানের জন্যই মূলত মনমোহনের কাছে সশিক্ষা নিয়েছিলেন। একথা তিনি নিজমুখেই স্বীকার করেছেন। পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত বাউল শিল্পী বলা যায় সোমেনকে। রাজ্য সংগীত অকাদেমি তাকে পুরস্কার দিয়েছে। সরকারি-বেসরকারি মান্য বাউল উৎসবে অনুষ্ঠানে তিনি গান পরিবেশন করেন। ভারতের বহু জায়গায় তিনি গান পরিবেশন করেছেন। বিদেশে যাওয়ার সুযোগ এসেছে তার জীবনে বহুবার। নেহরু যুবকেন্দ্র থেকে রাজস্থানে শিল্পী হিসেবে যোগদানের জন্য তাকে পাঠানো হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গ লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসীকেন্দ্র, পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্র, বাউল ফকির সঙ্গ সহ নানা লোকায়ত মাধ্যমে তিনি পদে রয়েছেন। তার নিজস্ব গায়নশৈলীও রয়েছে একটা। সুকণ্ঠের অধিকারী। মহাজনদের পদ আমি অন্তত দেখেছি সোমেনকে শ্রদ্ধাসহকারে গাইতে। নিজে গানও লেখেন এবং সুর করেন। ক্যাসেড-সিডি আছে। নিয়মিত আকাশবাণী-দুরদর্শনের শিল্পী। কেরলের বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী পার্বতী পারিয়াল শশাঙ্কশেখরের কাছে এসে নাচ ও গানের তালিম নিয়েছিলেন। সেই সূত্রে সোমন পার্বতীর সঙ্গে কেরলেও বহু অনুষ্ঠান করেন। সোমেন বাউল শিল্পী। বাউল সাধক নন। বিন্দুধারণ, করণ, চক্ৰসাধন এসব ববাঝেন বলে মনে হয় না। সেসবে আগ্রহ নেই তার। তিনি ব্রহ্মচারী। দীর্ঘ কেশ ও দাড়িতে পুরোপুরি বাউল আধার হলেও কোনোভাবেই নামি, পেশাদার শিল্পী ছাড়া আর কিছুই নন। গানের তত্ত্ব সেভাবে বিশ্লেষণেও দক্ষ নন। হওয়ার কথাই তো নয়। সাধন অনুভূতি তার কোথায়? যা ছিল শশাঙ্কশেখরের, সদানন্দের, কিছুটা মনমোহনের। মুরশিদাবাদের সাধক বাউলের পরম্পরা ভেঙে সোমেন জীবন-জীবিকার তাগিদে এখন বাউল গায়ক।
.
অখণ্ড নদিয়ার স্রোতে রয়েছে লালনশাহি মত। কিন্তু কালের নিয়মে সে মতেও এখন জং ধরেছে। নদিয়ার ছেউড়িয়া পাকিস্তানের পর বাংলাদেশে গিয়ে উঠেছে কুঠিয়া জেলায়। লালনকে দেশবিভাগের আগে হিন্দু প্রতিপন্ন করবার প্রবল প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন তার আখড়াতে যাওয়া কাঙাল হরিনাথ, অক্ষয়কুমার মৈত্ররা। পাকিস্তানি আমলে সেই প্রচেষ্টায় জল ঢেলে তাকে রীতিমতো মুসলমান বানিয়ে নেওয়া হল। সমাধি হয়ে উঠল মাজার। মাজারে লাগল স্থাপত্যের ছোঁয়া। বাংলাদেশ আমলে তারই যেন আবার বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা হল। কবরকে পিরদের কবরের মতো করে গম্বুজ খিলান-টিলান বানিয়ে সাজিয়ে তোলা হল। এর পেছনে হয়তো বা তখন আমাদের নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মাজারই আইডল হয়ে উঠেছিল। এবারের সতী মা’র মেলাতে এসে ছেউড়িয়ার এক সাধক আমাকে বলে গেলেন সেই দুঃখেরই কথা।
বললাম, সতী মা’র ঘরের চারদিকে খ্যাপা, কর্তাভজাদের আর রমরমা নেই।
বৃদ্ধ ফকির মনমরা হয়ে তাকিয়ে বললেন, আপনে কি মনে করে আমাদের শুরুর ঘরে আমাদেরও তেমন রমরমা আছে? কিছুই নাই গো খ্যাপা। সবই শূন্য। হাহাকার ভরা। আমাদের ঘর হল গিয়ে মানুষ ভজনার ঘর। সে ঘর বর্তমান। সেখানে মৃত জিনিসের পূজা হয় না। কিন্তু সেখানে দেখেন গা খ্যাপা, সব ধূপতি জালায়ে লালনের পূজা করতাছে। আমার গুরু বলতেন, গুরু রে কেবল ভক্তি দেওনের কথা। গুরু বর্তমান। তার পূজা হয় ক্যামনে?
বললাম, সতী মা’র ঘরকে তো আপনারা খুব মান্যতা দেন বলে শুনেছি। এ ঘরেও তো দেখি তার ভাবছবিতে পূজা-অর্চনা চলে।
আমার কথায় হতবাক হলেন না ফকির। ঘন দাড়ির জঙ্গলে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘আমার গুরু ছিলেন লবান শাহ। চেনেন তারে? তিনি লালন সাঁইয়ের সাক্ষাৎ শিষ্য ভোলাই শাহের দীক্ষিত। গুরু বলতেন, ঘর আমাদের ভাবের। ভাবের কোনো পূজা হয় না। পূজা-নামাজ ওসব তো শাস্ত্র-শরিয়তের ধর্ম খ্যাপা। লালন ঈশ্বর আল্লাকে অগ্রাহ্য করবেন বলেই তো তারে সাঁই ডেকে শাস্ত্র-শরিয়তকে খর্ব করে মাইনষের জয়গান করলেন। লালনের সঙ্গে শেষে সাঁই জুড়ে তার শিষ্যরা সাঁইকে জুড়লেন নিজের সঙ্গে। এভাবেই খ্যাপা, মানুষে পরমে অভেদ হল। তা খ্যাপা, একাত্মতার কোনো পূজা হয় নাকি আবার? সাঁইয়ের মাজারে বাতিদান, প্রণাম এসব হয় বলেই আমরা মাজারে ঢুকি না। বাইরে থেকেই সাঁইজিকে ভক্তি দিই। ভাবভক্তি আমাদের পথ। সাঁইজি সতী মা’র ভাবের বশে এখানে এসেছিলেন। আমিও এলাম সেই ভাবের ঘরের টানেই।’
বললাম, সে টানের সুতো কি তবে এবার এখানেও এসে ছিড়ল?
–না খ্যাপা, গুরু আমার পাঁচ ঘরকে ভক্তি দিতেন। সাঁইজির নিজের ঘরের ভক্তির পাশে রাখতেন সতী মারে। ঘোষপাড়ার ঘরকে জানবেন ঘেঁউড়িয়ার ফকিরেরা সবসময়ই মান্যতা দেয়। এ তো আমাদের সাঁইজির কাছ থেকে পাওয়া। পাঞ্জু শাহের ঘরকে আমাদের গুরু ভক্তি দেন। আমরাও দিই। চৌধুরীদের ঘর, দেলদার শাহের ঘরের ভাবে গুরুজি বলতেন সাঁইজির মত রয়েছে। পাঁচ ঘরের একতায় সাঁইজির ঘর বুঝলেন খ্যাপা। সেই বাঁধনে কালের টানে সুতো আলগা হবে। সুতোর ফ্যাকড়ায় মূল ভাব নষ্ট হবে না তবে। ভাব বইবেন ভাবের গুরু। আমি-আপনে সেই ভাবের ঘর চর্মচক্ষে কতখানি পারব দেখতে! ভাব দিয়ে ভাব দেখতে হয়।