বললেন, তা তুমি যে অর্থেই বল অসৎ আসলেই হল অনস্তিত্ব মন। মায়া যে সৎ বৃত্তি তার কারণ মায়া অস্তিত্বের প্রকাশ। মায়াকে শুদ্ধ মায়াতে আনতে হবে। শরীরকে, মনকে অনস্তিত্বের জায়গায় আনতে হবে। তবে না আনন্দশক্তির আত্মপ্রকাশ আসবে। ঘর কী?
বললাম, কী?
বললেন, ঘর হল গিয়ে দেহক্রিয়া। মূলাধারের অস্থি, স্বাধিষ্ঠানের মেদ, মণিপুরের মাংস, অনাহতের রক্ত, বিশুদ্ধের ত্বক আর আজ্ঞার মজ্জা নিয়ে ঘর গঠিত। ঘরকে আগে ক্রিয়াশীল করতে হবে।
বাউলের ঘর ক্রিয়াশীল, সক্রিয় এখন সবথেকে বোধহয় গানে। সাধক বাউল কোথায় এখন? সবদিক গায়ক বাউলে শুধু ছয়লাপ। মুরশিদাবাদ জুড়ে আগে ছিল কেবল সাধক বাউলদের আখড়া। আর মুরশিদাবাদ এখন গায়ক বাউলদের আখড়া সাজিয়ে বসে আছে। শশাঙ্কশেখর যখন শরীরে ছিলেন মুরশিদাবাদ তখন কিছু ক্রিয়াকরণের স্রোত নিয়ে জেগে ছিল। এখন মরা সেতায় কেবল গান ঘুরে বেড়াচ্ছে। শশাঙ্কশেখরের ছেলে মদনমোহন বাবার গুরুপাটের ঐতিহ্য সেভাবে আর রক্ষা করতে পারলেন কই! যে উচ্চমার্গের সাধক ছিলেন শশাঙ্কশেখর তার ধারকাছ দিয়েও যেতে পারলেন না তিন জেলায় ছড়িয়ে থাকা তার শিষ্যদের কেউই। তিনি আখড়ায় সাধনসঙ্গিনী নিয়ে বসবাস করতেন না। একক সাধনে ব্রতী ছিলেন। যতদূর জানি সন্তান উৎপাদনের পর থেকেই তিনি বিন্দুধারণ করে আসছিলেন। প্রবৃদ্ধ এই সাধকের মৃত্যুর পরও হয়তো বা এই জেলায় প্রাজ্ঞ নির্জন সাধক রয়ে গেছেন কেউ। তার হদিস আমার গোচরে নেই। শশাঙ্কশেখরের ছবছর আগে দেহ রেখেছিলেন মুরশিদাবাদ জেলার আর এক নির্জন সাধক সাঁটুইয়ের মনমোহন দাস বাউল। তার সাধনসঙ্গিনী ছিলেন স্ত্রী সুলক্ষণাই। নিঃসন্তান ছিলেন তিনি। ধর্মরক্ষা করে গেছেন। আমি তাকে দেখেছি একেবারেই অর্থব অবস্থাতে। তখন শরীর বশে নেই। কণ্ঠও। সুলক্ষণা বলেছিলেন, তিনি নাকি মাদুর, কুলো, ধামা, ফুলদানি-বাঁশের নানা কাজে পারদর্শী ছিলেন। তার নিজের হাতে লেখা একখানি জীবনীর কথাও শুনেছিলাম সে সময়। দেখতে চাইলে সুলক্ষণা জানিয়েছিলেন, সে আর নেই। একজন দেখতে চেয়ে নিয়ে গিয়ে শেষে আর ফিরিয়ে দেননি। অথর্ব হলেও মনমোহনের বাকশক্তি তখনও তাজা ছিল। স্মৃতিও বেশ প্রখর। আমাকে তিনি তার জীবনের বেশ কিছু কথা বলেছিলেন।
মনমোহন প্রথমে তন্ত্রশিক্ষা করেছিলেন রতিকান্ত মোহন্তর কাছে। তিনি নাকি কামাখ্যাতে সাধনা করতেন। কিন্তু মনমোহন আমাকে জানিয়েছিলেন তার তান্ত্রিক গুরুর দীক্ষা ছিল নদিয়ার সতী মায়ের ঘরে। এটা কতখানি সঠিক এখন বলা শক্ত। কেননা সতী মা’র ঘরের ধারক আউলচাঁদের সঙ্গে সুফি যোগসাজশের একটা ঐক্য পাওয়া গিয়েছে ভাবপন্থায়। কিন্তু আউল তন্ত্র করতেন এর কোনো প্রামাণিক বহর এখনও পর্যন্ত উঠে আসেনি। মনমোহন শ্মশানে-মশানে ঘুরবার কথাও বলেছিলেন। সেখানেই বোধহয় তিনি গুরু ছিলেন; আবার এমনও হতে পারে আউলপস্থার সেই সাধকই পরে তন্ত্রধারায় এসেছিলেন। তন্ত্র থেকে সরে মনমোহন বাউলপথে এসেছিলেন। তখনই তার নাম আশুতোষ থেকে মনমোহন হয়। নামকরণ করে গুরু সদানন্দ। মনমোহনের শিক্ষাগুরু ছিলেন সদানন্দ। সাঁটুইয়েই গঙ্গাঘেঁষা তার আশ্রম ছিল। মনমোহনের আশ্রমের অদূরে। মনমোহনের ভেকের গুরু তবে সদানন্দ নন। সদানন্দও ছিলেন বাউল সাধক। তার রচিত বহু পদ এখনও গায়কদের মুখে ফেরে। তারও বাউল নাচের একটি নিজস্ব ধারা ছিল। সদানন্দের আশ্রম দেখেছি কিন্তু তাকে দেখবার সৌভাগ্য আমার হয়নি। সদানন্দের কথা শুনেছি মুরশিদাবাদের খ্যাতনামা তরুণ বাউল সোমেন বিশ্বাসের কাছে। সোমেন আমাকে জানিয়েছিলেন, তিনি সদানন্দের কাছে গান ও নাচের শিক্ষা নিয়েছিলেন। তাকে নাকি ওঁর কাছে যেতে বলেছিলেন তার গুরু মনমোহন। মনমোহন তার নিজের অথর্ব দশাকে গুরু মা’র অভিশাপ হিসেবে চালাতেন। গুরু মা তাকে কেন অভিশাপ দিয়েছিলেন সাঁটুইয়ের আশ্রমে বসেই আমি ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, নিজ গুরুসেবার জন্য তিনি তার শিষ্যের কন্যাকে ভেট দিয়েছিলেন। এজন্য গুরু মা তাকে অভিশম্পাত করেছিলেন। গুরুর নাম তিনি বলেছিলেন ননীগোপাল মোহন্ত। বহরমপুরের ভাকুড়িতে তার আশ্রম রয়েছে। মনমোহনের সাধনসঙ্গিনী শেষমেশ সুলক্ষণাতে গিয়ে ঠেকেছে ঠিকই। কিন্তু তিনি দেহসাধনার সঙ্গিনী হিসেবে বহুগামী হয়েছিলেন যে একথা আমার কাছে নিজ মুখেই স্বীকার করেছেন। আর সেখান থেকেই তার যৌনশিথিলতা এসেছিল বোধহয়। কেননা সুলক্ষণাকে তিনি শেষপর্যন্ত বিবাহ করলেও সন্তান দিতে পারেননি। তা বোধহয় বিন্দুসাধনার জন্য নয়। সুলক্ষণা অসহায় ছিলেন। তার অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না বলেই সটুইয়ের আশ্রমে যে তিনি পড়ে আছেন এ আমাকে সে সময় সুলক্ষণাই বলেছিলেন। আর এও জানিয়েছিলেন মনমোহনের আসলে শিরার অসুখ আছে। ভালো পদ লিখলেও প্রথম প্রথম বিন্দুসাধনার শিক্যে রপ্ত করে সাধনপন্থাতে থাকলেও মনমোহনের সঙ্গী পালটানোর বাই ছিল তার গুরুর মতোই। এসব ধামাচাপা দেওয়ার জন্যই তিনি নাকি তার জরাকে গুরু মা’র অভিশাপ বলে চালাতেন। বলেছিলাম, মনমোহন কেন করবেন এমন? ওঁর তো গায়ক ও পদকর্তা হিসেবে সম্মান রয়েছে। কিছুক্ষণ থম মেরে সুলক্ষণা বলেছিলেন, সুম্মানের তলে কালি গো কালি। ধলা গুরুও কালি মুখো। এ পথে নারী বদলানোর কালি আছে। বলেছিলাম তখন, উলটোটাও তো আছে। সুলক্ষণা বলেছিলেন, আমাদের কালে নারীর গান কোথায়! আশ্রমের বাইরে গান অপরাধ। পুরুষ বদলাতে স্বাধীন পথ লাগে গো। একলা গাওয়ার দাপট।