শশাঙ্কশেখরের জন্ম বিশ শতকের প্রথম দশকেই। বেশ দীর্ঘায়ুরই মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁর আদি নিবাস ছিল মুরশিদাবাদেরই মালতীপাড়ায়। পরে চলে আসেন রসোয়াড়ার ভাটেরায়। বন্যায় ভিটে হারিয়ে এরপর কাটোয়ার আতুরহাটে চলে যাওয়া। সেখান থেকে আবারও সেই আদি নিবাস মালতীপাড়ায়। বহরমপুরের রাধার ঘাটে আখড়া করে ছিলেন প্রায় এক যুগেরও বেশি। সেখান থেকে আখড়া সরে আবারও সেই কান্দির রসোড়ায়। বারবার ঠাইনাড়ার পর রেজিনগরের কামনগর গ্রামে পাকাপাকিভাবে আখড়া গড়ে এখানেই ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেন। শশাঙ্কশেখরের বাবার পেশা ছিল গান ও মাধুকরী। জাতবৈষ্ণব বলে একই পথে আসেন ছেলেও। বৈষ্ণব উৎসবে তাকে শেষ বয়সে গাইতেও দেখেছি। রীতিমতো আগে মহোৎসবে তিনি পৌঁরোহিত্য করতেন। রাধাকৃষ্ণের ভোগরাগ দিতেন। পরবর্তীতে গাঁয়েগঞ্জে গেয়ে ফিরলেও শহরে গান শোনানোর ক্ষেত্রে তার ছিল তীব্র অনীহা। যদিও কয়েকবার শহরের মঞ্চে, আকাশবাণীতে গেয়েছেন। তবে মধ্য যৌবনে কলকাতার যাত্রাদলেও বিবেকের পাঠ করতেন। ঐতিহ্যবাহী বাউল নাচের ধারক তিনি যে ক্রমে ক্রমে হয়ে উঠছিলেন, তার মুখে শুনেছি এ নাচের হাতেখড়ি নাকি হয়েছিল যাত্রাদলে। বৈষ্ণবপন্থী থেকে দরবেশি মতে সরে আসেন শশাঙ্কশেখর। মুরশিদাবাদের পদ্মাতীরের আখেরিগঞ্জে ছিল অটলবিহারী দরবেশের আশ্রম। সেই আশ্রম অবশ্য পরে সরে যায় বীরভূমের দুবরাজপুরে। রাঢ়ের বহু বৈষ্ণব-বাউল এখনও এই মতে চলে আসছেন। শশাঙ্কশেখরের মুখেই শুনেছি এই স্রোতটি নাকি নিত্যানন্দের ছেলে বীরভদ্রের। বীরভদ্র সহজিয়া সাধক মাধববিবির দীক্ষিত বলে কিংবদন্তি রয়েছে। আর এভাবেই নৈষ্ঠিক-সহজিয়া এক হয়েছে। সহজিয়া আবার বাউলে গিয়ে মিশেছে। সে যাই হোক না কেন, লোকায়ত সাধনের মূলগত ঐক্য হল জাতপাতের ভেদাভেদহীনতায়। নদিয়া-মুরশিদাবাদ-বীরভূমে শশাঙ্কশেখরের অনুগামী ভক্তশিষ্যের সংখ্যা নেহাত কম নয়। তার পদ বহু খ্যাতিমান গায়ক বাউলরা গেয়ে ফেরেন। মজলিশপুরে বসেই তিনি আমাকে বলেছিলেন তার শিক্ষাগুরুর নাম। গুরুপ্ৰণালীর ভাগ বলেছিলেন। সেই ভাগে মধুরানন্দের স্রোত এসে মিশেছে। ‘মাজবাড়ি’ বলে তিনি তাকে চিহ্নিত করেছিলেন। বলেছিলেন সন্ন্যাস দীক্ষা তার এখানকার। আর শিক্ষাদীক্ষার প্রণালী তার কাছাধারী’ মতে। সেজন্যই পত্নী নিয়ে প্রথম জীবনে তার বসবাস। তারপর ভেকগুরু প্রণালী মেনে হয়েছিলেন তিনি আখড়াধারী। সাধকজীবনের নানা কথা নানা সময়ে বলেছিলেন শশাঙ্কশেখর। তার আখড়াতে ঘন ঘন একসময়ে আমার যাতায়াত ছিল। জন্মরহস্য বলতে গিয়ে একবার বলেছিলেন, ‘জীবনে চার বার জন্ম হয়।
-কীরকমভাবে? জিজ্ঞেস করেছিলাম।
বলেছিলেন, প্রথম জন্ম হয় মাতৃক্রোড়ে। পিতার বীর্য মাতার রজ নিয়ে। দ্বিতীয় জন্ম দেন দীক্ষাগুরু। তৃতীয় জন্ম ক্রিয়াকরণের। গুরুর হাতে নিজেকে সমর্পণ করতে হয়। চতুর্থ জন্ম হয় ভেকে।
ভেক হল সিদ্ধি। প্রচলিত ভাষায় ভেক নেওয়া হল ছদ্মবেশ। যেমন বলা হয়—ছিল চোর, বদমাশ এখন সাধুর ভেক নিয়েছে। হতভম্ব হয়ে যাওয়াকেও ভেক বলা হয়। কিন্তু শশাঙ্কশেখর দাস বৈরাগ্যের বলা ভেক হল বাউল সিদ্ধি। সাধনার সর্বোচ্চ দশা।
ভেক জন্মের আগে ক্রিয়াকরণ নিয়ে নানা সময়ে নানা কথা তিনি বলেছিলেন আমাকে। একবার বললেন, দশেন্দ্রিয়, ষড়রিপু এগুলো সব হল গিয়ে বাবা চিনি খাওয়া রাক্ষুসি। শরীরের মধু সব খেয়ে নেয়। সাধনায় আগে এদের মারতে হবে বাবা।
গুরুর নির্দেশে শিক্ষানবিশ বাউল প্রথমে বাঁ নাকের সাহায্যে বাইরের বাতাসকে টেনে এনে শরীরের অভ্যন্তরে রেখে ধীরে ধীরে ডান নাক দিয়ে ছেড়ে দেয়। এই যে বাইরের বাতাসে শরীরের অভ্যন্তর পূর্ণ হচ্ছে সেজন্য এর নাম পূরক। শরীরের ভেতরে এই যে বাতাস ধরে রাখা তা অনেকটা কলশিতে জল ভরে রাখার মতোই। তাই এর নাম কুম্ভক। আর বাতাসকে যখন ডান নাকে নিয়ে বা নাক দিয়ে বের করে দেওয়া হচ্ছে তখন তার নাম হচ্ছে রেচক। এই ক্রিয়া বাউলকে শিখতে হয়। এতে সমস্ত নাড়ি পরিশুদ্ধ হয়ে সুষুম্না দিয়ে সোজা উপরে উঠতে আরম্ভ করে। উর্ধপথ এভাবেই তৈরি করে নিতে থাকেন শিক্ষানবিশ বাউল। এই উর্পযোগেই ‘বিন্দুধারণ’ শক্তি অর্জন করা যায়।
প্রাণায়ামের প্রসঙ্গ নিয়ে কথা হয়েছিল আমার মজলিশপুরে বসেই। তিনি দাঁতহীন গালের দু-দিকে হাসিতে সেই গর্তে বুজিয়ে বললেন, এই করণকৌশলের নানা নিয়ম আছে। শুরুর কাছে এসবই শিখতে হয়। বুঝলে বাবা, সাধকের কাজ হল, বায়ুর ঘর বায়ু বাড়ি বায়ু নিয়ে নাড়িচাড়ি। এই নাড়াচাড়া না হলে সাধক সিদ্ধ হবেন কোন্ প্রকারে শুনি? বায়ু কী জানো বাবা?
বললাম, কী?
-বায়ু হল বীজাবস্থা। শুদ্ধ চৈতন্য বায়ু। বায়ু না হলে শক্তিতত্ত্ব আর শিবতত্ত্ব জাগবে কীভাবে? এই শক্তি কোথা থেকে আসে জানো বাবা?
-কোথা থেকে?
–মায়া থেকে বাবা।
–মায়া তো পাশ বলেন আপনারা? জিজ্ঞেস করলাম।
-মায়া তো পাশই বাবা। মায়ামুক্ত হলে আসে শুদ্ধ মায়া। আর এই শুদ্ধ মায়া থেকেই শক্তি ও শিব জাগরিত হয়। যুগল নেয় সত্তা। মায়া হল শরীরের সব সৎ বৃত্তি। অসৎ কী জানো বাবা?
বললাম, আপনার চোখে অসৎ কী? আমি যে অর্থে অসৎ বলব তা হয়তো আপনার সঙ্গে মিলবে না।