.
যখন শুরু করেছিলাম তখন সেটা সরেজমিনে অনুসন্ধানের বিষয়ই ছিল না কোনো। মনের টানে আমি ওদের সঙ্গে রীতিমতো বসবাস করতে শুরু করেছিলাম। ভূমিতলকে বুঝতে একেবারেই ভূমিতে নেমে পড়তে হয় আমার ঠাকুরদা বলতেন এ কথা। আমি যখন মেলা, মোচ্ছব, দিবসী, সাধু-গুরুদের অনুষ্ঠানে ঘন ঘন যাতায়াত করছি তখনই প্রবৃদ্ধ বাউল সাধক শশাঙ্কশেখর দাস বৈরাগ্য একদিন আমাকে বললেন, আলগা ঢঙে দেখলে বাপ বাউলের জমিখান দ্যাখবা তুমি ক্যাম্বা। দ্যাখতি হবে তোমারে ধূলিতলে নামি। ভাবসত্য, জীবনবীক্ষণ হল গিয়ে বাউল সাধনা। ও কি আর গায়নশৈলী? তুমি শুনে বুঝে রপ্ত করবা! অচেদ্য শরিক না হলে পর আলগা বাঁধনে ধর্ম বোঝা যায় না। আশ্রমে কাটাও। গুরুপাটে বসবাস করো। অনুগত হও। তবে না পৌঁছবার পারবা আয়নামহলে। শশাঙ্কশেখর আমার চোখ খুলে দিয়েছিলেন। বলা ভালো ঠাই-ও দিয়েছিলেন মজলিশপুরের আশ্রমে। আমি তার শিষ্য না হলেও বাউল মতের সেই গুরুর সন্নিধানে শিক্ষা এবং দীর্ঘ প্রস্তুতি পেয়েছিলাম কেবলমাত্র জিজ্ঞাসু হয়েও এই আশ্রমে। শশাঙ্কুশেখর এতখানি করেছিলেন আমার জন্য। তিনি চাইতেন বাউল সম্পর্কে একটা পরিচ্ছন্ন ধারণা গড়ে তুলতে। ভাবের পরিমণ্ডলকে প্রসারিত করতে। সবসময় বলতেন, মরমিবাদ না জানলে মরমিয়া সাধকের কথা কইবা তুমি ক্যামনে? আমি বুঝতাম তার কাছে আসা গবেষকদের জট খোলা অনুমান তার পছন্দই নয় একেবারে। বলতেন, এ পথে অনুমান নেই বাপ। বর্তমান। তা সেই শশাঙ্কশেখরের কথা বলি প্রথমে। আমি তাকে পেয়েছি বছর তিনেক মতো। ২০০৬-এর তিনি দেহ রেখেছেন। মজলিশপুরেই তাঁর সমাধি রয়েছে। শশাঙ্কশেখর রাঢ়ের লোক। অথচ গোটা নদিয়া জুড়ে তার অনেক বাঙাল ভক্তশিষ্য। মদনপুরে আমার জ্যাঠাদের বাড়িতে তার প্রতিষ্ঠিত রাধাগোবিন্দ আছে। বাৎসরিক ভোগরাগে তিনি এখানে পৌঁরোহিত্য করতে আসতেন। আর অসাধারণ বাঙাল ভাষাও বলতে পারতেন। আমি বয়ঃসন্ধির কাল থেকে তাকে দেখেছি। আমাকে বাঙাল ভাষার মধুরিমা বোঝাতে তিনি এ ভাষায় মাঝে মাঝে বাক্যালাপ করতেন। তবে শশাঙ্কশেখর একা নন রাঢ়ের অনেক বাউলই ভালো বাঙাল ভাষা বলতে পারেন। তবে বাঙাল বাউল রাঢ় বলছেন আমি দেখিনি। আসলে রাঢ়ের খটোমটো ভাষা বলতে বাঙালদের জিভে কুলোবে না। এ ভাষায় পেলবতার ছোঁয়া কম বলে রপ্ত করা শক্ত।
শশাঙ্কশেখর পুরোপুরি বাউল নন। জাতবৈষ্ণব। কায়াবাদী বৈষ্ণবদের সঙ্গে বাউলের সাযুজ্য নিয়ে বরাবরের এক গোল রয়েছে। সেজন্যই বোধহয় লালনশাহি ধারার সাধক দুন্দু শাহকে বিশ শতকের গোড়াতেই এর নিষ্পত্তিতে নামতে হয়েছিল। তিনি লিখলেন : ‘বাউল বৈষ্ণব ধর্ম এক নহে তো ভাই—বাউল ধর্মের সাথে বৈষ্ণবের যোগ নাই। / বিশেষ সম্প্রদায় বৈষ্ণব / পঞ্চতত্ত্বে করে জপতপ / তুলসী-মালা-অনুষ্ঠান সদাই। / বাউল মানুষ ভজে। যেখানে নিত্য বিরাজে / বস্তুর অমৃতে মজে / নারী সঙ্গী তাই।’ দুদ্দু যতই বাউল বৈষ্ণব পন্থায় ভেদরেখা টানবার চেষ্টা করে থাকুন না কেন, এই একুশ শতকেও দুই সম্প্রদায়ের ভেতর এখনও কিন্তু এক ঐক্যসূত্র বর্তমান আছে। তবে সেই ঐক্যসূত্র নৈষ্টিক গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের সঙ্গে নয়। ঐক্য মূলত জাতি-বৈষ্ণব বা সহজিয়াদের সঙ্গে। এর প্রধান কারণ বোধহয় সহজিয়াদের কায়াবাদী সাধন। এরা দেহকে বৃন্দাবন মেনে আরোপ সাধনাতে বিশ্বাসী। সেখানে অনুমানের ব্যাপার নেই কোনো। সবই বর্তমান। দেহভাণ্ডেই সবকিছু রয়েছে। দেহের তাই কোনো কিছুই ঘৃণ্য এবং বর্জ্য হতে পারে না। আর এখানেই বাউল বৈষ্ণব এক হয়েছে। যে কারণে গ্রামবাংলার অনেক বাউল সাধকদের মুখে বলতে শুনেছি, আমরা হলাম গিয়ে খ্যাপা, বৈষ্ণব-বাউল। গ্রামের মানুষ বাউল ও তার সাধনসঙ্গিনী মাধুকরীতে এলে বৈষ্ণবীয় আচরণ বলেই সে সময় গুলিয়ে ফেলে বাউলের সাধনসঙ্গিনীকে ‘বোষ্ট্রমী’ বলে ডেকে উঠেছে, এ তো আমার স্বচক্ষে দেখা। বাউলদের সিংহভাগ যেসব জমায়েত সবই তো বৈষ্ণবতীর্থ হিসেবেই চিহ্নিত। কেঁদুলিতে বাউলদের সবচেয়ে বড়ো সমাবেশ। আড়ংঘাটার বাউল সুবল দাস বৈরাগ্য আমাকে বলেছিলেন জয়দেব-কেঁদুলি হল খ্যাপা, আমাদের কাশী। ঠিক একই তানে গোরভাঙার ফকিরদের মুখে ধ্বনিত হতে শুনেছি, পাথরচাপড়ি হল গিয়ে ফকিরদের মক্কা। আসলে বাউল-ফকিরেরা বেদবিধি-শাস্ত্র-কোরান-শরিয়ত মানেন না বলেই বিধি-বিশ্বাসকে বর্তমান করতে গিয়েই কেঁদুলিকে কাশী বলেন, পাথরচাপড়িকে মক্কা। ঠিক একইভাবে যেমন জাতবৈষ্ণবরা দেহকেই রাধারানির বাসস্থান বলে মানেন। কায়াবাদী সাধনের মান্য বর্তমানকে তারা এভাবেই আরোপ করেন। বর্ধমান-বীরভূম-বাঁকুড়ায় প্রতি বছর নির্দিষ্ট তিথিতে যে-সব প্রাচীন বাউল সমাবেশ হয়ে থাকে তার মূল সুরে রয়েছে সহজিয়া বৈষ্ণবদের ঐক্যসূত্র। বাঁকুড়ার সোনামুখীর বাউল সমাবেশের পেছনে রয়েছে মনোহর খ্যাপার যোগ। মনোহর জাতি-বৈষ্ণব ছিলেন। বর্ধমানের অগ্রদ্বীপে ঘোষঠাকুরের শ্রাদ্ধে গোপীনাথের কাছা পরে শ্রাদ্ধশান্তির অনুষ্ঠান বৈষ্ণবীয় পন্থার আচার হলেও সেখানে বাউলদের আখড়া রীতিমতো প্রসিদ্ধ। একশো বছর ধরে চলা বীরভূমের কোটাসুরের উৎসব বৈষ্ণবদের সাধুসেবার হলেও সেখানে বাউলদের রমরমা। বেনালীপুরের মেলা, রামকেলীর সমাবেশ, বোরেগীতলার মেলা-সবই হল গিয়ে আখড়াধারী জাতি-বৈষ্ণবদের রীতিপরম্পরার স্মরণ উৎসব। কিন্তু সেখানে বাউলদের জমায়েত। নদিয়ার গয়েশপুরের কুলের পাটের মেলা, ডিগরের রসরাজ গোঁসাইয়ের মোচ্ছব, আড়ংঘাটার বিখ্যাত যুগলকিশোরের মেলা, কৃষ্ণনগরের বারুণীর মেলা-সবেতেই বৈষ্ণবীয় আচরণ প্রধান হলেও শেষমেষ বাউলস্রোতেরই গিজগিজ। নদিয়ার কর্তাভজা, সাহেবধনী, বলরামী স্রোতে লালনশাহি মতের সমাবেশ ঘটলেও জাতি-বৈষ্ণবদের আনাগোনা তো আছেই। সব মিলিয়ে এটাই বলা চলে যে, নিম্নবর্গীয়দের গোপন, গুহ্য স্রোতে দুদ্দু শাহের সেই ভেদরীতিকে সরিয়ে সমাঝোতা জোটের মতো বাউল-বৈষ্ণব পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছেন বাংলারই লোকায়ত সাধনপথে। বাউল সাধকদের তো জাতগোত্র ধারণের দরকার নেই কোনো। বাউল ভাবনার মূলে তো উদার ও সমন্বয়বাদী মানবচেতনা। যেখানে শাস্ত্র নেই। মন্ত্র নেই। তথাপি সিংহভাগ বাউলদের বলতে শুনেছি যে, তারা সব হলেন অচ্যুতানন্দ গোত্রের। শশাঙ্কশেখরও এই একই পোত্র বলেছিলেন আমাকে। নবনী দাসের পুত্র, পূর্ণদাসের ভাই নামি বাউল লক্ষ্মণ দাসও আমাকে তার গোত্র বলেছিলেন বৈষ্ণবীয় পন্থায়। সিউড়ির কেন্দুয়াতে থাকেন তিনি। এ বাড়িতেই আছে নবনী দাসের সমাধি। রবীন্দ্র আবহে মিশে থাকা নবনী দাসের সমাধি দেখতে গিয়ে গায়ে রীতিমতো কাটা দিয়েছিল। সন্ধেবেলা লক্ষ্মণের বাড়িতে মেয়ে-বউরা যে সান্ধ্যকালীন প্রার্থনা করলেন সঙ্গে ক্রিয়াকর্ম, যাতে তিনি নিজেও উপস্থিত; সবেতেই বৈষ্ণববাড়ির নামগন্ধ পেলাম আমি। লক্ষ্মণ যেখানে থাকেন বীরভূমের সেই কেন্দুয়া নদিয়ার ঘোষপাড়ার মতোই পুরোপুরি বাউল পল্লিই বলা চলে। গেরুয়া অঙ্গবাস, চুল চুড়ো করে বাঁধা, গলায় নানা পাথুরে মালা, ঘোষপাড়ার দীনদয়ালের পায়ে আবার নেলপালিশ, রুপোর মল। কিন্তু সবাই সহজিয়া মতে শামিল। সকলেই রীতিমতো স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-নাতি-নাতনি নিয়ে প্রবল সংসারী। আয়ের উৎসে বাউলপন্থা। ভেক। গান। অনুষ্ঠান। দু-একজন করণগুণে ঘরনার বশবর্তী হয়ে বেশ খ্যাতিমান। লক্ষ্মণদাস তাদেরই একজন। তার বিদেশ গমন, বিদেশিনি সংসর্গ, নানা জায়গার সরকারি ও সম্রান্ত অনুষ্ঠানের ডাক কেন্দুয়ার অনেকেরই কাছে বেশ ঈর্ষণীয়। লক্ষ্মণ না হয় বাউল বংশেরই সন্তান। ঘোষপাড়ার দীনদয়াল তো আর বংশপরম্পরার বাউলও নন। থাকতেন রানাঘাটে। আড়ংঘাটার সুবল দাসের কাছে প্রথমে নাড়া বাধা। বাড়ি পুরোপুরি বৈষ্ণবীয় মতের। ছেলেবেলাতেই দীক্ষা পেয়েছেন সেই অচ্যুতানন্দ গোত্রেই। লেখাপড়া প্রাইমারি ইস্কুলের গণ্ডি পর্যন্ত। সুবলের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গাতে যেতে যেতেই তার চিন-পরিচয়ে মুরশিদাবাদের বেলডাঙার কাছে মানিকনগরে মদনমোহন দাসের আখড়াতে গিয়ে ওঠা। মদনমোহন হলেন শশাঙ্কশেখর দাসবৈরাগ্যের একমাত্র পুত্র। পদকর্তা হিসেবে তারও একটা মান্যতা আছে এখন নদিয়া–মুরশিদাবাদ-বীরভূমে। যোগ্য পিতার উত্তরসূরি। তবে শশাঙ্কশেখরের মতো সাধনভজনের উচ্চাবস্থা তার নেই। কিছু ভক্তশিষ্য আছে। দীনদয়াল সুবলকে ছেড়ে মদনমোহনের পোঁ ধরেন। এখানকার আনুকূল্যে তার বিদেশযাত্রার সুযোগ ঘটে। বাস গিয়ে ওঠে বাউল আভিজাত্যের কিংবদন্তিসম সতী মা-র থানের ঘোষপাড়াতে। দীনদয়াল আমাকে তার ইটালি-প্যারিস-আমেরিকা অস্ট্রেলিয়া যাত্রার গল্প শোনান। এখানকার পরিবেশ, রাস্তাঘাট, ট্রামে-বাসে ভ্যানরিকশায় তার এখন রীতিমতো অনীহা। আমি স্বদেশেই ঘুরতে পারিনি ঠিকমতো। তাই তার সেই বিদেশবাসের গল্প হাঁ মেরে শুনি। তিনি আমাকে বিদেশি নামি ব্রান্ডের সিগারেট, চুরুট, মদ উপহার হিসেবে দেন। দীনদয়াল এমনিতে সজ্জন অতিথিবৎসল আধ্যাত্মিক মানুষ। ভাগবত, চৈতন্যচরিতামৃত সহ নানা বৈষ্ণবীয় গ্রন্থ নিজ উদ্যোগে এবং শশাঙ্কশেখর-মদনমোহনের তদারকিতে আত্মস্থ করে নিয়েছেন। তারও কিছু ভক্তশিষ্য আছে। দীক্ষা দেন বৈষ্ণবীয় মতো হরিকথা, হরিনাম করেন উত্তরবঙ্গের গ্রামে গ্রামে। আমাকে নিয়ে গিয়ে তার সেই অনুষ্ঠান দেখানোর জন্য জোরাজুরি করেন। তবে সেখানে না গেলেও বেশ কয়েকবারই দীনদয়ালের কণ্ঠে বাউলগান শুনবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। গলা সুমিষ্ট, সুরে খেলে, ভালো বাঁশি বাজাতে পারেন। তাঁর কাছে দেখেছি অনেকে বাঁশি ও গান শিখতে আসেন। আগে লালনগীতি, শশাঙ্কশেখরের পদই বেশি গাইতেন। এখন নিজের গানই বেশি পরিবেশন করে থাকেন আসরে। সে গানে নিজস্ব সাধনভজনের অনুভব না থাকলেও দেহতত্ত্বের যোজনা তারিফ করার মতো। সব মিলিয়ে দীনদয়াল বাউল না হয়েও তার গানের পন্থাকে অবলম্বন করে ভাবসাম্রাজ্যে বেশ জাঁকিয়ে বসেছেন। সাধনসঙ্গিনী না থাকলেও স্ত্রীকে সেই হিসেবেই দেখে থাকেন। কিছুদিন আগে ঘটা করে ছেলের বিয়ে দিলেন। ছেলেও গান-বাজনা করে। ঘোষপাড়াতে পুরসভার সহযোগিতায় তার স্থায়ী আখড়া হয়েছে। সরকারি অনুদানও আসে মাসে মাসে। সূতরাং প্রবীণ লক্ষ্মণ দাস বাউলের খ্যাতির পাশটিতে দীনদয়াল তার পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়সে তো অনায়াসেই বসে পড়তে পারেন। একুশ শতকে বাউল এখন এভাবেই বৈষ্ণব-বাউল যোগসূত্রে স্বমহিমায় বিরাজ করছেন। সহজিয়াদের অচ্যুতানন্দ গোত্রে শামিল হওয়ার পেছনে বোধহয় অভিজাত বৈষ্ণবশ্রেণির সঙ্গে সমঝোতাই কাজ করে। অবহেলার জাঁতাকলে পিষ্ট হয়েই বোধহয় তারা চৈতন্যদেবের শিক্ষাগুরু অদ্বৈত আচার্যের বড়ো ছেলে দক্ষ বৈষ্ণব সংগঠকের সঙ্গে অন্তর্ভুক্তিতে চলে আসেন। হচ্ছিল শশাঙ্কশেখরের কথা। সেখানেই আবার ফিরে যাই।