-তখন থেকে তোমার আশ্রমেই বসবাস।
-হ্যাঁ খ্যাপা। শুরু হয়ে গেল আমার সাধনপর্ব। গুরু বললেন ঘেন্না দূর কর তুষার। রেচক-পূরক-কুম্ভক রপ্ত হল তোর। এখন শুরু হবে তোর রসপালন ব্রত। তিন রস পালন করতে হবে তোকে। এটা তোর ব্রহ্মচর্যের সময়। গুরুর কথার পর পরদিন সকালের প্রস্রাব ধরে রাখলাম মালুইয়ে। ভোরবেলা দেখি প্রাতঃকৃত্যের আগে গুরু আমার ওখানে দাঁড়িয়ে। গুরু-মারে কইলেন, কই গো, নারকেল মালুইখান দাও। তুষার যে আজ থেকে রস খাবে।
জিজ্ঞাসা করলাম, খেলে তুমি তুষার?
তুষার বলল, হ্যাঁ গো খ্যাপা। অবলীলায় খেয়ে নিলুম। শুধু কি প্রথম বাসি পেটের প্রস্রাব নাকি, যতবার তা হয়েছে ততবারই মালুইয়ে ধরে সেটা খেয়ে শরীরে ফিরিয়ে দিয়েছি।
—সেই অনুভূতি কেমন তুষার? ঘেন্না লাগত খুব?
-না গো খ্যাপা। প্রথমে ভেবেছিলাম পারব না। উগরে দেব। আমার যা পিতপিতানি ছিল। ওসব সবই শুরুকৃপাতে দূর হল। প্রথম প্রস্রাব খেয়ে মনে হল কচি ডাবের জল খাচ্ছি। তারপর তো মনে হত সুমিষ্ট ডাবের জল। প্রথম দিনই গুরু বললেন, বিষ্টাও ধরে রাখ তুষার। আজ থেকেই গায়ে-মাথায় মাখতে থাক। খেতেও থাক।
—খেলে তুমি! কীভাবে?
–হ্যাঁ গো। গুরু বললেন প্রথমদিন, মালুই থেকে তোল কিছুটা তুষার।
—তুললে হাতে?
–ঘেন্নায়-ঘেন্নায় তুললাম। কিন্তু তোলার পর শুরুকৃপা।
—মানে!
-আমার হাতের বিষ্ঠা দেখি আমি মুখের ভেতর নিয়ে আস্বাদন করছি। স্বাদ তার অমৃত। তারপর স্নানের আগে গায়ে মাখছি। রাখছি তা গায়ে ঘণ্টা দুয়েক।
বললাম, গন্ধ বেরোত না গা থেকে? ঘিনঘিন করত না গা?
–ওসব কিছুই হত না। গুরুকৃপা। গুরু বললেন, হাতের তালুতে নে। ভালো করে ফেঁটে তোল আগে। ও মা, ফাটতে ফাটতে দেখি মাখন! বদগন্ধ আর নেই তার। অবলীলায় গায়ে মাখলাম। বুকে পেটে মুখে ভালো করে মালিশ মেরে ঘণ্টা দুই রোদে। চড়চড়ে হয়ে গেলে ঘষে তুলে স্নান করে ফেলতাম। তারপর দেখি আমার গা থেকে সুরভি বের হচ্ছে। সেন্ট মাখলে তোমাদের যেমন গা থেকে গন্ধ বের হয় আর কী।
–স্নানের পর কী করতে তুষার?
—স্নানের পরই দমের কাজ। ওদিকে সারদাকেও দমের কাজ শিখিয়ে তৈয়ারি রাখছেন গুরু-মা আমার।
-সারদা সেখানেই ছিল? আশ্রমে?
-হ্যাঁ। গুরু-মা আমার জন্য তাকে কোন্ এক আশ্রম থেকে জানি এনেছেন। জিজ্ঞাসা করলাম, সারদা কি রসপালন করত?
-না না। সাধিকাকে ওসব করতে হয় না। ওরা তো রসবতী নিজেরাই। ওদের এই ব্রহ্মচর্য নেই।
—তার পর কী হল তুষার?
–চলতে লাগল মাসখানেক এই একই নিয়ম। একদিন স্নান সেরে আসনে বসেছি আমি। দেখি গুরু এলেন ঘরে। পেছনে গুরু-মা। হাতে তার মালুই। বললেন আমায়, নাও ছেলে খাও। জিজ্ঞেস করলাম, কী মা? ক্ষীর? মা বললেন, হ্যাঁ বাপ। ক্ষীর। ভাবলাম খেতে গিয়ে গরম কেন!
—খেলে?
-খেলাম তো। খেয়ে দেখলাম স্বাদ নেই কোনো। গুরু বললেন, ওটা না কি ছিল সারদার রজ।
—শোনার পর কি ঘেন্না এল?
–না না। ততক্ষণে আমার ঝিম। ঘুম এল। মরণ ঘুম। বিকেলে উঠলাম।
—উঠে?
–উঠে শুনলাম রাতেই আমার বিন্দুধারণ শিক্ষে হবে আজ। তার নির্দেশে ধ্যানে গিয়ে বসলাম খ্যাপা। নির্দিষ্ট সময়ে গুরু ডেকে নিলেন ঘরে। দেখি সেখানে সারদাও বসে গুরু-মার পাশে। দুজনেরই মন্ত্রজপ চলল। একসময় দুজন দুজনের পাশে এলাম। তার পরই আমি তার সর্ব অঙ্গে চুমু দিতে থাকলাম। আশ্চর্য মাদকতা।
-কামের?
-না গো খ্যাপা। প্রেমের। শরীরে আমার সাড় ছিল না। পরে শুনলাম যে সারদারও। একসময় মনে হল সগ্যে বাস করছি। হিতাহিত জ্ঞান নেই। জ্ঞান যখন ভাঙল দেখি সূয্যি উঠেছে। গুরু এসে দোর খুলে দিলেন। গুরু-মা সারদার যোনি দেখে মাথা নাড়লেন। তারপর শুরু বললেন বিন্দুসাধনায় তুই পাস। ঠান্ডা মেরে ছিলি তুই। পরম এসেছিল শরীরে। শীতলতায় সে আসে।
-কে?
-কে আবার খ্যাপা! তিনি গো তিনি। মনের মানুষ। গুরু বললেন, আজ থেকে তোর নাম দিলাম তুষার। আর ভবা পাগলা আমারে খ্যাপা টাইটেল দিয়েছিলেন। তোর সাধনায় খুশি হয়ে তোরে আমি ওই টাইটেল ব্যবহারের অনুমতি দিলাম। আর তোর সঙ্গিনী, সে যে তোরে পার করল। সাধনার সার ও বুঝেছিল রে। তাই আজ থেকে ও সারদা আর তোর সাধনসঙ্গিনী বলেই টাইটেল ওরও প্রাপ্য।
বললাম, সেই থেকে তোমরা হলে খ্যাপা-খেপী। তাই তো? তাহলে এসব নামও তোমাদের গুরুপ্রদত্ত।
তুষার বলল, হ্যাঁ গো খ্যাপা। না হলে আমার সামাজিক নাম ছিল স্বপন। আর খেপীর রমলা।
—তোমরা তাহলে এখন আর সামাজিক মানুষ নয় তুষার?
-বাউলের আবার সমাজকী? সামাজিক জীব সে তো নয়। হলে পরে তো খ্যাপা আমার বাপ-মা হতাম এতদিনে। আমরা হলাম সহজ মানুষ। বিন্দুধারী সহজানন্দ আমাদের সমাজ।
জানি না এ কোন্ সমাজের কথা তুষার আমায় বলল! সন্ধ্যা নামছে এখন। ফঁাকা নির্জন অজয়ের ধারে আমরা এখন তিন মানুষ। সামাজিক আমি আর দুজন অতীন্দ্রিয় জগতের মানুষ-মানুষী। যদিও সারদা নেই। তুষারের হাতের একতারায় ও তার প্রতিভূ এখন।
০২.৬ আখড়ানামা
লোককবি বিজয় সরকারের একশো এগারোতম জন্মোৎসবে যোগ দিতে কেউটিয়া এসেছিলেন লালনশাহি সাধক, বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবি-চিন্তক ও বাংলার ভাবান্দোলন নিয়ে সব সময় কর্মনিবিষ্টতার মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে রাখা ফরহাদ মজহার। যদিও অনুষ্ঠানের দিন আমি কেউটিয়া থাকতে পারিনি। আমাকে চলে যেতে হয়েছিল একচক্ৰায় নিত্যানন্দ প্রভুর জন্মস্থানে জন্মতিথির অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। তার আগের দিন হঠাৎ করে ঘনিয়ে আসা নিম্নচাপের ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়ে গিয়েছিলাম কেউটিয়া। মজহারের আমন্ত্রণ উপেক্ষা করতে পারিনি। দিন তিনেক আগে অবশ্য তিনি ঘোষপাড়ায় এসেছিলেন সতী মা’র ঘর দেখবার বাসনা নিয়ে। সে রাত্রেই তাকে সমস্ত ঘুরিয়ে দেখিয়ে দিয়েছি। ঘোষপাড়ার বাউলদেরও সঙ্গ করিয়েছি। সে রাত্রেই ফাকে কথা উঠেছিল তন্ত্র নিয়ে। মজহার শুনেছেন আমার তন্ত্রচর্চার সরেজমিন গবেষণার কথা। কলকাতা এসে জোগাড় করে নিয়েছেন ‘ভৈরব ভৈরবীর সঙ্গে তন্ত্র জিজ্ঞাসায়’। কিন্তু নিজস্ব সেমিনার, অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত থাকার দরুন পাতা উলটানোরও ফুরসত পাননি। কেউটিয়ায় লজের নিরালায় বিজয়ের জন্মোৎসবের আগের দুপুর আমার সঙ্গে একান্তে আড্ডায়, আলোচনায় কাটাবেন বলেই তিনি আমাকে নিমন্ত্রণ করেছেন। দুপুরে ঘি-পুরি, মটর-পনির, টক দই দিয়ে আহারের পর আমরা সেই বৃষ্টিস্নাত দুপুরে ঘুরে বেড়িয়েছি লোকায়ত সাধনপথে। মজহার নিজে যেহেতু সাধক, তাই তার লালনচর্চার বোধ ও বোধি এক ভিন্নমাত্রা যোগ করে। লোকায়ত সাধনা মৌখিক ঐতিহ্যের মেলবন্ধনে বিশ্বাসী। গুরু সেখানে বন্ধনটিকে শুরু করেন। মনে পড়ছে আসাননগরে, লালন মেলায় প্রবীণ লোকায়ত সাধক ত্রিভঙ্গ খ্যাপা আমাকে বলেছিলেন, ‘গুরু ধরো, গুরু। গুরু না হলে এ পথ যে তোমার শুরুই হবে না বাবা।’ লোকায়ত পথ করণে বিশ্বাসী। আর সেই করণক্রিয়ার মূল আধারই হল গিয়ে ‘গুরু পূচ্ছিঅ জান’। গুরুকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নাও। মজহার বলছিলেন জিজ্ঞাসার সেই ধারাক্রমেই আমাদের গণ্ডগোলটা বেধেছে। আমরা বাউলকে দেখছি আমাদের চিন্তার তর্কবিতর্ক দিয়ে। ভাবের ভাষায় পৌঁছোনোর আমাদের যোগ্যতা নেই। কেননা আমাদের শুরু নেই। আমাদের আছে কেবল অনুসন্ধিৎসু মন। যে মন লোকায়ত সাধনপথের সরেজমিনে বেরিয়ে প্রশ্ন করছে, উত্তর মনঃপূত না হলেই তৎক্ষণাৎ সেটা নিজেদের সর্দারি ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় নাকচ করে দিচ্ছে। আর এভাবেই ভাব দিয়ে ভাব বুঝবার আসল অভিমুখটি নষ্ট হয়ে গিয়ে তখন কেবল পুরুষের বীর্য আর মহিলার মাসিক চর্চায় গিয়ে আটকে যাচ্ছে আমাদের মন। সেখান থেকে আমরা খুঁজে ফিরছি নব্য অভ্যুদয়ের কোনো উপমহাদেশ নয়। খুঁজে ফিরছি ব্যভিচার-পতন-লাঞ্ছনার গল্প। আমরা যুগল ভজনার একপেশে একটি দিকই দেখছি। অপরদিকের বা মূল দিকের ভাবের আধুনিকতা নিয়ে আমাদের তখন কোনো প্রশ্ন নেই। প্রশ্ন আমাদের ভাবের সীমান্তবর্তী স্থানে দাঁড়িয়ে গিয়ে ভাবসাধকের আধুনিক বিকাশের টানাপোড়েন নিয়ে।