বাউলের কাছে অমাবস্যাই পূর্ণিমা হয়ে ওঠে। পদকর্তা তাই বলেছেন–‘পূর্ণিমা সে অমাবস্যে।‘ কীভাবে পূর্ণিমা অমাবস্যা হয়ে যাচ্ছে আর অমাবস্যাই হয়ে উঠছে পূর্ণিমা? পূর্ণিমার চাঁদ ‘পূর্ণচন্দ্র’ বাউলের হল প্রেম। এই প্রেম আসে চন্দ্ৰসাধনায়। গোপালের গানে ইঙ্গিতময়তার মধ্যে উঠে এসে চন্দ্ৰসাধনা–’চন্দ্ৰসাধন কর রে মন সময় থাকিতে/ সময় গেলে শের পটকালে হবে না তাই আখেরেতে।।’ ‘চন্দ্রসাধন’ কী? চাঁদ নিয়ে উপাসনা? অবশ্যই তাই। বাউল চাঁদ খায়, চাঁদ মাখে। চাঁদের বেসাতি তৈরি করে বাউল। কীভাবে তা হয়? বাউলের ‘চন্দ্র’র নানারূপ আছে। চাঁদকে তারা প্রতীকময়তার ভেতর রেখে হেঁয়ালি তৈরি করেন শুধু। ‘চন্দ্র’ তাঁদের বাঁ নাক। পূর্ণচন্দ্র প্রেম, আবার ‘শুক্র’ বলতেও বাউল অনেক সময় চাঁদকে ইঙ্গিত করেন। চন্দ্র বলতে তাঁরা আবার সাধন লব্ধ আত্মজ্ঞানকেও সামনে রাখেন। ‘চারভূত’-ও বাউলের চন্দ্র। ‘চারিচন্দ্র’। মল, মূত্র, রজ, শুক্র। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম–এই পাঁচটি পঞ্চভূত। চারভূত তাঁদের ‘চারিচন্দ্র’। তবে ফকিররা কিন্তু চারভূত বলতে বৈদিক মতের পঞ্চভূতকে একেবারে মানেন না।
আমির চাঁদ ফকির বলেছিলেন, চারভূত হল গিয়ে আব, আতস, জল, আগুন, মাটি ও বাতাস।
ফজর শাহ জলকে জানিয়েছিলেন খাক বাত বলে।
তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বাউল ফকিরে পার্থক্যটা কী?
বললেন, পার্থক্য কিছু নেই খ্যাপা। যা আছে সব তৈরি করা। মুর্শিদ আর কৃষ্ণ আলাদা নাকি খ্যাপা! সব এক। সব শরীরের উদরে রয়েছেন।
আমির চাঁদ বলেছিলেন, ফকিরিতে নানাবিধ সাধনা আছে। কোনটা করবা তুমি। যুগল আছে, পৃথক আছে, দমের সাধনা আছে। বস্তুরও আছে।
চারচন্দ্রের সাধনা ফকির করে? জিজ্ঞাসা করেছিলাম আমি।
–করে, করে না। মানে, মানে না। সব আছে গো। আসল হল গিয়ে নিজেরে জানা। তা তুমি চার-পাঁচ যে চন্দ্রই বল বাপু নিজেরে না বুঝলে কিছুই হবে না। নবী কে গো?
–কে?
–নবী হল গিয়ে আমি নিজে।
ঘোষপাড়ার নবকুমার দাসকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম চারচন্দ্রের কথা। নিত্যানন্দ বালা, নরোত্তম দাসকে বললে কিছুই বলেননি তাঁরা। নরোত্তম গান গেয়ে শুনিয়েছিলাম। যেটি শুনিয়েছিলাম আমার বেশ চেনা গান। প্রথমে গুনগুন করেই গাইছিলেন বাউল। শিষ্য (বাজনদার) একতারাতে সুর দিতেই গাইলেন। দরাজ গলায় বাউল বাড়ি (আখড়া) ম ম করতে থাকল চাঁদেরই গন্ধে।
দিন-দুপুরে চাঁদের উদয় রাত পোহান ভার।
হলো অমাবস্যায় পূর্ণিমার চাঁদ তের প্রহর অন্ধকার।।
সূর্য-মামা মরে গেছে বুকে মেরে শূল,
বামুনপাড়ায় কায়েতবুড়ি মাথায় বইছে চুল।
আবার কামরূপেরে কাকা ম’ল,
কাশীধামে হাহাকার।
ময়রা-মামীর কুলের স্বামী বসে রয়েছে,
তার গর্ভেতে তিন জনার জন্ম হয়েছে।
আবার ভাদ্র-মাসের তেরোয় পৌষে
চড়ক-পূজার দিন এবার।।
বৃন্দাবনে বলছে বামী বোষ্টমী–
একাদশীর দিনে হবে জন্মাষ্টমী।
আবার রাজবাড়ীতে টাট্ট ঘোড়ার
সিং বেরিয়েছে দু’টো তার।।
গোঁসাই পোদয় কয় ভেবে এবার,
কথা শুনতে চমৎকার,
সাধক বিনে বুঝতে পারে
এমন সাধ্য কার।
কথা যে বুঝেছে, সেই মজেছে,
গিয়েছে সে বেদের পার।।
গান শেষে থামলেন বাউল। বললেন, লাইনে না এলে এর মানে জানা যাবে না। একটু ঘোরাফেরা করেন, ঠিক একদিন জেনে যাবেন। আমাকে আর শুধতে হবে না।
হাসলেন বাউল।
বললেন, দীক্ষা হয়েছে?
বললাম, না।
আগে চট করে দীক্ষাটা নিয়ে ফেলুন। তাহলেই দেখবেন অনুরাগ আসবে।
নবকুমার দাসকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, চারচন্দ্র সম্বন্ধে আপনার অনুভূতি কী?
প্রথম প্রথম শুধু চারচন্দ্র কেন, নবকুমার আমার কোনও প্রশ্নেরই সেইভাবে জবাব দিতেন না। বিরক্ত প্রকাশ করতেন। ভাবখানা এমন এখানে না আসলেই পারেন। ওদিকে যখন অত যাতায়াত তাহলে ওখানে গিয়েই মেটান না কৌতুহলী জিজ্ঞাসা সব। তবে আমি রাগ করতাম না। বুঝতাম বিষয়টা হয়তো পছন্দ করছেন না নবকুমার। কিন্তু কোনওদিন এই বিষয়ে তিনি আমাকে কটু কথা বলেননি। বাউল সমাজে মিশে এটা বুঝেছি সেখানে তাঁদের ভেতরে নানা অরাজকতা থাকলেও তাঁরা বাইরের মানুষদের প্রাপ্য অতিথির সম্মান দেন।
দুপুরের ঠাঠাপোড়া রোদে মাটিয়ারী গিয়ে মহিলা বাউল বিশেষত কৃষ্ণা দাসীর সম্পর্কে; তাঁর গান বিষয়ে নানা কথা এলে মীরা মার উত্তেজিত সুর সব মনে আছে।
বলেছিলেন, মেয়েদের আখড়া ছাড়া, আশ্রম ছাড়া গান গাওয়া অপরাধ। এই সব মেয়েরা বাউল মতের কলঙ্ক।
বলেছিলাম, বাউল যদি অনুষ্ঠানে গাইতে পারে তাহলে মহিলা বাউলরা গাইতে পারবেন না কেন?
রেগে উঠেছিলেন তিনি।
বললেন, বাউল মতের বোঝ কী তুমি গান কি বাউলের পথ?
মীরা মা’কে বোঝাতে পারিনি গানই এখন বাউল-পথ। বাউলরাই তাই করে নিয়েছে। বাউল এখন আর নিভৃত সাধনার বিষয় নেই। আলো, প্রচারের জন্য সেও যা নয় তাই করে ফিরছে।
মা বললেন, মেয়েদের কাজ হল সাধুসঙ্গ করা। বাউলকে এগিয়ে দেওয়া বাউল মত কে, পথকে প্রতিষ্ঠা করা। ধরে রাখা।
বলে যাচ্ছেন মীরা মা–নবকুমার জাত বাউল। ও তো ওর সাধনসঙ্গিনী ছিল। এখন সাধন ভুলে গান ধরেছে। মেয়েরা নেচেকুঁদে গাইবে কেন? আখড়ায় গাইতে পারে। মেয়েদের কাজ হল সাধনভজন করা।
খুবই ঝাঝি দিয়ে কথা বলছেন মীরা মা। আমি চুপ। শুনে যাচ্ছি। কথা বলছি না। ভাবছি শুধু তাঁর বিশ্বাসের আসন টলাবে কে শুনি! কতজন সাধক বাউল আছেন এখন। যারা আছেন তাঁরা সাধনাতে কতটা বা আগ্রহী! গান, প্রচার, বিদেশ যাত্রার তদবির নিয়ে অনেকে ব্যস্ত। মেয়েরা এর ভেতর কতটা সাধুসঙ্গ পাচ্ছে। সাধুই নেই, সাধকই নেই তার আবার সঙ্গ। সঙ্গিনীর সঙ্গে সাধক জীবন তো এখন ব্যাভিচারে, অনাচারে হয়ে উঠেছে। পাশ্চাত্যের তথাকথিত live together