এরূপ বিহারের অধ্যক্ষ হওয়া অনেক সৌভাগ্যের কথা। দীপঙ্কর অনেক সময় ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ও অন্য যানাবলম্বীদিগের সহিত ঘোরতর বিচারে প্রবৃত্ত হইতেন ও তাহাতে জয়লাভ করিতেন। এই সময় তিব্বত দেশে বৌদ্ধ ধৰ্ম প্রায় লোপ হইয়া আসে ও বনপার দল খুব প্রবল হইয় উঠে, তাহাতে ভয় পাইয়া তিব্বত দেশের রাজা বিক্রমশীলবিহার হইতে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানকে তিব্বতে লইয়া নাইবার জন্য দূত প্রেরণ করেন। দীপঙ্কর দুই-একবার যাইতে অসম্মত হইলেও,
বিষয়ের গুরুত্ব বুঝিয়া পরিণামে তথা যাইতে স্বীকার করেন। তিনি যাইতে স্বীকার করিলে, তিব্বতরাজ অনেক লোকজন দিয়া তাঁহাকে সসম্মানে আপন দেশে লইয়া যান। যাইবার সময় তিনি কয়েকদিন নেপালে স্বয়ম্ভূক্ষেত্রে বাস করেন। তথা হইতে বরফের পাহাড় পার হইয়া তিনি তিব্বতের সীমানায় উপস্থিত হন। যিনি তাঁহাকে আহ্বান করিয়া নিজ দেশে লইয়া গিয়াছিলেন, তাঁহার রাজধানী পশ্চিম-তিব্বতে ছিল। যে সকল বিহারে তিনি বাস করিাছিলেন, সে সকল বিহার এখনও লোকে অতি পবিত্র বলিয়া মনে করে। ফ্রাঙ্কে সাহেব যে আর্কিয়লজিকাল রিপোর্ট বাহির করিয়াছেন, তাহাতে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান বা অতিশার কর্মক্ষেত্র সকল বেশ ভাল করিয়া দেখাইয়া দিয়াছেন। অতিশা যখন তিব্বত দেশে যান, তখন তাঁহার বয়স সত্তর বৎসর। এরূপ বৃদ্ধ বয়সেও তিনি তিব্বতে গিয়া অসাধারণ পরিশ্রম করিয়াছিলেন এবং তথাকার অনেক লোককে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত করিয়াছিলেন। তাহার পরে তিব্বতে নানা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উদয় হইয়াছে। তিব্বতে যে কখনও বৌদ্ধ ধর্মের লোপ হইবে, এরূপ আশঙ্ক আর হয় নাই। তিনি তিব্বতে মহাযান মতেরই প্রচার করেন। তিনি বেশ বুঝিয়াছিলেন যে, তিব্বতীরা বিশুদ্ধ মহাযানধর্মের অধিকারী নয় ; কেন না, তখনও তাহারা দৈত্যদানবের পূজা করিত; তাই তিনি অনেক বজ্রযান ও কালচক্রযানের গ্রন্থ তর্জমা করিয়াছিলেন ও অনেক পূজাপদ্ধতি ও স্তোত্রাদি লিথিয়াছিলেন। তেঙ্গুর ক্যাটালগে প্রতি পাতেই দ্বীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান বা অতিশার নাম দেখিতে পাওয়া যায়। আজিও সহস্ৰ সহস্ৰ লোকে তাঁহাকে দেবতা বলিয়া পূজা করে। অনেকে মনে করেন, তিব্বতীয়দিগের যা কিছু বিদ্যা বুদ্ধি সভ্যতা–এ সমুদায়ের মূল কারণ তিনিই।
১১. জগদ্দল মহাবিহার ও বিভূতিচন্দ্র
রাইট সাহেব নেপাল হইতে কতকগুলি পুঁথি কুড়াইয়া লইয়া গিয়া কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটিকে দেন। তাহার মধ্যে শান্তিদেবের শিক্ষাসমুচ্চয় নামে একখানি পুঁথি থাকে। পুঁথিখানি কাগজের হাতের লেখা, অধিকাংশই বাংলা। বেলডল সাহেব যখন এই পুঁথিগুলির ক্যাটালগ করেন তখন তিনি বলেন যে, এ পুঁথিখানি খ্রীস্টের জন্মের চৌদ্ধ শ বা পনেরো শ বছর পরে লেখা। তাহার পর তিনি যখন উহা ছাপান, তখন তিনি ভূমিকায় লিখেন, “না, আর এক শ বছর আগাইয়া যাইতে পারে, কাগজ কি এর চেয়েও পুরানো হবে?” বেন্ডল সাহেব একজন বড় লোক। তাঁহার সহিত আমার সদ্ভাব ছিল। তিনি ও আমি দুই জনে একবার নেপাল গিয়াছিলাম। তথাপি এ জায়গায়ু আমি তাঁহার সহিত একমত হইতে পারি না। আমি নেপালে এর চেয়েও পুরানো কাগজের পুঁথি দেখিয়াছি এবং দুই-একখানি আনাইয়াছি। সুতরাং কাগজ বলিয়া যদি পুঁথিখানি নূতন হয়, তাহ হইলে আমি তাহাতে রাজী নই। ডা: হার্নলি সম্প্রতি দেখাইছেন যে, অনেক পূর্বে নেপালে ‘কায়গদ’ ছিল। ‘কায়গদ’ শব্দটি চীনের। আমরা কাগজ পরে পাইয়াছি, কেননা আমরা উহা সরাসরি চীন হইতে পাই নাই, মূসলমানদের হাত হইতে পাইয়াছি, মুসলমানেরা চীন হইতেই পাইয়াছিল। মুসলমানেরা কায়গদ শব্দটিকে কাগজ করিয়া তুলিয়াছে।
পুথিখানির শেষে লেখা আছে–দেয় ধর্মোয়ং প্রবরমহাযানযায়িনো জাগদ্দলপণ্ডিত বিভূতিচন্দ্রস্য ইত্যাদি।
বেন্ডল সাহেব বলিয়াছেন, “মহাযানপন্থী জগদ্দল পণ্ডিত বিভূতিচন্দ্র কে আমি জানি না।” ১৯০৭ সালে আমি আবার নেপালে গিয়া কয়েকখানি পুথিতে জগদ্দল-মহাবিহারের নাম পাই ; কিন্তু আমিও তথন সে মহাবিহার কোথায়, কি বৃত্তান্ত, জানিতাম না। সেই বারে আমি বিভূতিচন্দ্রের নাম পাই। তিনি ‘অমৃতকর্ণিকা’ নামে ‘নামসংগীতি’র একখানি টীকা করেন, ঐ টীকা কালচক্রযানের মতে লিখিত হয়।
তাহার পর রামচরিত কাব্য ছাপাইবার সময় জানিতে পারি, রামপাল রামাবতী নামে যে নগর বসান ‘জগদ্দল মহাবিহার’ তাহারই কাছে ছিল। উহা গঙ্গা ও করতোয়ার সংগমের উপরেই ছিল। এখন করতোয় গঙ্গায় পড়ে না, পড়ে যমুনায় ; গঙ্গাও এক সময় বুড়িগঙ্গা দিয়া যাইত। তাই ভাবিয়ছিলাম, রামপাল নামে মুন্সীগঞ্জে যে এক পুরানোগ্রাম আছে, হয়ত সেই রামাবতী ও জগদ্দল উহারই নিকটে কোথাও হইবে। আমি এ কথা প্রকাশ করার পর, অনেকেই জগদ্দল খুঁজিতেছেন, কেহ মালদহে, কেহ বগুড়ায় ; কিন্তু খোঁজ এখনও পাওয়া যায় নাই, পাওয়া কিন্তু নিতান্ত দরকার। কারণ, মগধে যেমন নালন্দা, পেশোয়ারে যেমন কনিষ্ক-বিহার, কলম্বোতে যেমন দীপদত্তম বিহার, সেইরূপ বাংলার মহাবিহার জগদ্দল। তাঞ্জুরে কোথাও লেখে উন্থ বরেন্দ্র ছিল, কোন কোন জায়গায় লেখে বাংলা, কোন কোন জায়গায় লেখে পূর্ব-ভারতে।
যাহা হউক, উহা একটি প্রকাণ্ড বিহার ছিল তাহাতে সন্দেহ নাই। রামপালই যে ঐ বিহার প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন, এমন বোধ হয় না। এই বিহারে অনেক বড় বড় ভিক্ষু থাকিতেন, তাঁহাদের মধ্যে বিভূতিচন্দ্ৰই প্রধান। বিভূতিচন্দ্র অনেকগুলি সংস্কৃত বৌদ্ধ গ্রন্থের টীকা-টিপ্পণী লিখিয়াছিলেন। যখন তিব্বত দেশে এই সকল বৌদ্ধগ্রন্থ তর্জম হইতেছে, তখন তিনি অনেক পুস্তকের তর্জমায় সাহায্য করিয়াছেন।
১৪. বাংলায় সংস্কৃত
মুসলমান-আক্রমণের পূর্বে বাংলায় অনেক সংস্কৃত গ্রন্থ লিখিত হইয়াছিল। ভবদেব একজন প্রকাণ্ড পণ্ডিত ছিলেন। সংস্কৃতে যাহা কিছু পড়িবার ছিল, তিনি যেন সবই পড়িয়াছিলেন। বাচস্পতি মিশ্র তাঁহার প্রশস্তি লিখিয়াছেন। সেই প্রসস্তিতে যাহা লেখা আছে তাহা যদি চারিভাগের একভাগও সত্য হয়, তাহা হইলেও ভবদেব যে দেশে জন্মিয়াছিলেন সে দেশ ধন্য। তাঁহার কত পুস্তুক ছিল, আমরা এখনো জানিতে পারি নাই। তবে সামবেদীদের পদ্ধতি ছাড়া আরও তাঁহার দশ-বারোখানি গ্রন্থ পাওয়া গিয়াছে।