বোধিচর্যাবতারে শান্তিদেব বার বার বিপক্ষদের একটি কথা বলিয়া গালি দিয়াছেন। সে গালিটি কিন্তু বাংলা ছাড়া আর কোথাও শুনি নাই ; সে কথাটি ‘গূথ-ভক্ষক’। আমাদের দেশে দিনরাত্রি এই গালিটি শুনা যায়।
আরও কথা, একটি ভুসুকর গানে আছে,–
আজ ভুসুকু তু ভেলি বাঙ্গালী।
নিজ ঘরিণী চণ্ডালী নেলী।
আজ ভুসুকু তুই সত্য সত্য বাঙ্গালী হইয়াছিল ইত্যাদি।
এই সকল কারণে আমি শান্তিদেবকে আমাদের অষ্টম গৌরব মনে করি। তেঙ্গুর গ্রন্থে লেখা আছে, শান্তিদেবের বাড়ি জাহোর। জাহোর কোথায় জানি না, তবে উহার সন্ধান হওয়া আবশ্যক।
০৯. নাথপন্থ
আমাদের দেশে এখন যে সব যোগীরা আছেন, তাহাদের সকলেরই উপাধি নাথ। তাহারা বলেন, “আমরা এ দেশে রাজাদের গুরু ছিলাম, ব্রাহ্মণের আমাদের গুরুগিরি কড়িয়া লইয়াছে।” তাই এখন আবার তাঁহারা পৈতা লইয়া ব্রাহ্মণ হইবার চেষ্টায় আছেন। নাথেদের আচার-ব্যবহার কিন্তু ব্রাহ্মণদের মত নয়। এই জাতি কোথা হইতে আসিল, অনেক বৎসর ধরিয়া আমি অনুসন্ধান করিতেছি। রয়েল এসিয়াটিক সোসাইটির জানালের পুরাণ-পর্যায়ে ষোড়শ খণ্ডে হজ্সন সাহেবের মৎস্যেন্দ্রনাথ প্রভৃতি কয়েকজন নাথের সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ পড়িয়া আমার প্রথম ধারণা হয় যে, নাথপন্থ নামে এক প্রবল ধর্মসম্প্রদায় বহু শত বংসর ধরিয়া বাংলায় এবং পূর্ব-ভারতে প্রভূত্ব করিয়া গিয়াছে। পূর্বে সকলেরই ধারণা ছিল যে, গোরক্ষনাথের ‘হঠযোগপ্রদীপিকা’য় যে চৌদ্দজন নাথের নাম করা আছে, তাঁহারা সকলেই কবীরের সময়ের লোক। কবীরের সঙ্গে গোরক্ষনাথের কথাবার্তা লইয়া কবীরপন্থীদিগের একখানি বই আছে, সুতরাং গোরক্ষনাথ ও কবীর এক কালের লোক। কিন্তু বাসিলীফ তিব্বতীয়-গ্রন্থমালা হইতে দেখাইয়া দিয়াছেন যে, গোবৃক্ষনাথ খৃস্টের আট শ বছর পরের লোক। নেপালে বৌদ্ধদিগের সংস্কার যে, সব নাথেরাই বৌদ্ধ ছিলেন, কেবল গোরক্ষনাথ বৌদ্ধ ধর্ম ছাড়িয়া শৈব হন। বৌদ্ধ অবস্থায় তাহার নাম ছিল রমণবজ্র কি অনঙ্গবজ্র। ক্রমে খুঁজিতে খুঁজিতে ‘কৌলজ্ঞানবিনিশ্চয়’ নামে মৎস্যেন্দ্রনাথ বা মচ্ছঘ্নপাদের ‘অবতারিত’ একখানি তন্ত্র পাইলাম। উহা যে অক্ষরে লেখা, সে অক্ষর খ্রীস্টের নয় শত বৎসরের পর উঠিয়া গিয়াছে। তাহাতে কিন্তু বৌদ্ধ ধর্মের নামগন্ধও নাই ! একখানি বৌদ্ধ গ্রন্থে মীনমাথের একটি বাংলা পদ তুলিয়া বলিয়াছে যে, ইহা পরদর্শনের মত। আরও অনেক কারণ আছে, তাহাতে বেশ বোধ হয় যে নাথেরা না-হিন্দু না-বৌদ্ধ এমন একটি ধর্মমত প্রচার করেন।
শিব তাঁহাদের দেবতা। তাঁহাদের বইগুলি হরপার্বতী-সংবাদে তন্ত্রের আকারে লেখা। তাঁহারাই সেইগুলি কৈলাস হইতে নামাইয়া লইয়া আসেন। তাঁহারাই হঠযোগ প্রচার করেন। নানারূপ আসন করিয়া যোগ করা তাহাদের ধর্ম। তাঁহাদের ধর্মের মূল কথাগুলি এখনও পাওয়া যায় নাই। যা কিছু পাওয়া গিয়াছে তাহাতে বোধ হয় যে, তাঁহারা লোককে গৃহস্থাশ্রম ছাড়িতেই পরামর্শ দিতেন। তাঁহাদের ধর্মে স্বৰ্গ-অপবর্গের দিকে তত ঝোঁক ছিল না। তাঁহাদের চেষ্টা সিদ্ধিলাভ। এই সিদ্ধি পরিণামে ভেল্কি হইয়া দাঁড়াইয়াছে। মূল নাথেরা কি করিতেন, জানা যায় না ; কিন্তু এখন অনেক নাথেরা ভেল্কি দেখাইয়া ভিক্ষা করিয়া বেড়ায়। ইন্দ্রিয়সেবায় নাথেদের কোন আপত্তি নাই। এখন যোধপুরের মহামন্দির নাথেদের একটি প্রধান স্থান। নাথজি খুব বড় মানুষ। তাহার মহামন্দির একটি প্রকাণ্ড সহর, চারিদিকে পাঁচিল দিয়া ঘেরা।নাথজির মন্দিরে গিয়া দেখিলাম,নাথজিরা পূর্ব পূর্ব নাথেদের পদচিহ্ন পূজা করেন। লোকে নাথজিদের দেবতা বলিয়া মনে করে। তাঁহারা বিবাহ করেন না, কিন্তু তাঁহাদের সন্তানসন্ততি হইবার কোন আপত্তি নাই, মদ্যমাংসেও উহাদের কোন আপত্তি নাই। নাথজির এক ভাঁটি মদ নামিতে দশ হাজার টাকা খরচ হয়।
নাথেরা যে বাংলা দেশের বা পূর্ব-ভারতের লোক, আহার স্পষ্ট প্রমাণ–মীননাথের একটি পদ পাইয়াছি, সেটি খাঁটি বাংলা।গোরক্ষনাথের লীলাক্ষেত্র বাংলাতেই অধিক। তাঁহারই চেলা হাড়িপা আমার ময়নামতীর গানের নায়ক। মীননাথ যখন তাঁহার নিজের ধর্ম ভুলিয়া গিয়াছিলেন গোরক্ষনাথই তখন তাঁহাকে সে কথা মনে করায়াই দেন। মৎস্যেন্দ্রনাথকে অনেক সময় মচ্ছঘ্ননাথ বলে, অর্থাং তিনি জেলের ছেলে ছিলেন। এ কথা যদি সত্য হয়, তাহা হইলে তাঁহার বাংলাদেশের লোক হওয়াই সম্ভব।
ক্রমে নাথপ্রন্থ খুব প্ৰবল হইয়া উঠিলে বৌদ্ধরা ও হিন্দুরা নাথেদের উপাসনা করিত। মৎস্যেন্দ্রনাথের গ্রন্থে বৌদ্ধ ধর্মের নামগন্ধ না থাকিলেও, তিনিই এখন নেপালী বৌদ্ধদিগের প্রথান দেবতা। তাঁহার রথযাত্রায় নেপালে যেমন ধুমধাম হইয়া থাকে, এমন আর কোন দেবতার কোন যাত্রায় হয় না। গোরক্ষনাথের উপর নেপালী বৌদ্ধরা সকলে খুশী না থাকিলেও অনেক বৌদ্ধরা এখনও তাঁহার পূজা করে, তিব্বতেও তাঁহার পূজা হয়।
১০. দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান
বাংলা দেশের দশম গৌরব দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। তাঁহার নিবাস পূর্ববঙ্গে বিক্রমণীপুর। তিনি ভিক্ষু হইয়া বিক্রমশীল বিহারে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেখানে অল্প দিনের মধ্যেই তিনি প্রধান পণ্ডিত বলিয়া গণ্য হন। সে মঠের অধ্যক্ষ তাঁহাকে সুবর্ণদ্বীপে প্রেরণ করেন। তিনি সুবর্ণদ্বীপে বৌদ্ধ ধর্ম সংস্কার করিয়া প্রসিদ্ধ হন। তথা হইতে ফিরিয়া আসিলে তিনি বিক্রমশীল-বিহারের অধ্যক্ষ হন। তখন নালন্দার চেয়েও বিক্রমশলের খ্যাতি-প্রতিপত্তি অত্যন্ত অধিক হইয়াছে। অনেক বড় বড় লোক, অনেক বড় বড় পণ্ডিত, বিক্রমশীল হইতে লেখাপড়া শিখিয়া, শুধু ভারতবর্ষে নয়, তাহার বাহিরেও গিয়া বিদ্যা ও ধর্ম প্রচার করিয়াছিলেন। বিক্রমশীল-বিহারের রত্নাকর শান্তি একজন খুব তীক্ষ্ণবুদ্ধি নৈয়ায়িক ছিলেন। প্রজ্ঞাকরমতি, জ্ঞানশ্রীভিক্ষু প্রভৃতি বহুসংখ্যক গ্রন্থকার ও পণ্ডিতের নাম বিক্রমশীলের মুখ উজ্জ্বল করিয়া রাখিয়াছিল।