তাঁহার বাল্যকালের কথাও কিছু এখানে বলা আবশ্যক। পূর্বেই বলিয়াছি যে, তিনি সমতটের রাজার ছেলে, তিনি নাকি ব্রাহ্মণ ছিলেন। বাল্যকাল হইতে তাঁহার বিদ্যায় অনুরাগ ছিল এবং খ্যাতিপ্রতিপত্তিও খুব হইয়াছিল। তিনি বিদ্যার উন্নতির জন্য সমস্ত ভারতবর্ষ ভ্রমণ করিয়া ত্রিশ বৎসর বয়সে নালন্দায় আসিয়া উপস্থিত হন । সেখানে বোধিসত্ত্ব ধৰ্মপাল তখন সর্বময় কর্তা। তিনি ধর্মপালের ব্যাখ্যা শুনিয়া উাহার শিষ্য হইলেন এবং অল্প দিনের মধ্যেই ধর্মপালের সমস্ত মত আয়ত্ব করিয়া লইলেন। এই সময় দক্ষিণ হইতে একজন দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত মগধের রাজার নিকট ধর্মপালের সহিত বিচার প্রার্থনা করেন। রাজা ধর্মপালকে ডাকাইয়া পাঠাইলেন । ধর্মপাল যাইবার জন্য উদ্যোগ করিলেন। শীলভদ্র বলিলেন, “আপনি কেন যাইবেন ?” তিনি বলিলেন, “বৌদ্ধ ধর্মের আদিত্য অস্তমিত হইয়াছে। বিধর্মীর চারিদিকে মেঘের মত ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। উহাদিগকে দূর করিতে না পরিলে সদ্ধর্মের উন্নতি নাই।” শীলভদ্র বলিলেন, “আপনি থাকুন, আমি যাইতেছি।” শীলভদ্রকে দেখিয়া দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত হাসিয়া উঠলেন, “এই বালক আমার সহিত বিচার করিবে?” কিন্তু শীলভদ্র অতি অল্পেই তাঁহাকে সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত করিয়া দিলেন। সে শীলভদ্রের না যুক্তি খণ্ডন করিতে পারিল, না বচনের উত্তর দিতে পারিল, লজ্জায় অধোবন হইয়া সে সভা ত্যাগ করিয়া গেল। শীলভদ্রের পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হইয়া রাজা তাহাকে একটি নগর দান করিলেন। শীলভদ্র বলিলেন, “আমি যখন কাষায় গ্রহণ করিয়াছি, তখন অর্থ লইয়া কি করিব?” রাজা বললেন, “বুদ্ধদেবের জ্ঞানজ্যোতি ত বহুদিন নির্বাণ হুইয়া গিয়াছে, এখন যদি আমরা গুণের পূজা না করি, তবে ধর্ম কিরূপে রক্ষা হইবে? আপনি অনুগ্রহ করিয়া আমার প্রার্থনা গ্রাহ্য করিবেন না।” তখন শীলভদ্র তাঁহার কথায় রাজী হইয়া নগরটি গ্রহণ করিলেন এবং তাহার রাজস্ব হইতে একটি প্রকাণ্ড সংঘারাম নির্মাণ করিয়া দিলেন।
হিউয়ান চুয়াং এক জায়গায় বলিতেছেন যে, শীলভদ্ৰ বিদ্যা বুদ্ধি ধর্মানুরাগ নিষ্ঠা প্রভৃতিতে প্রাচীন বৌদ্ধগণকে ছাড়াইয়া উয়িছিলেন। তিনি দশ-কুড়িখানি পুস্তক লিখিছিলেন। তিনি যে সকল টীকা-টিপ্পনী লিখিয়া গিয়াছেন, তাহা অতি পরিষ্কার ও তাহার ভাষা অতি সরল।
০৮. বৌদ্ধ লেখক শান্তিদেব
আমি মনে করি যে, যিনি বৌদ্ধ ধর্মের কয়েকখানি খুব চলিত পুঁথি লিথিয়া গিয়াছেন, সেই মহাত্মা শান্তিদেব বাঙালী ছিলেন। কিন্তু তারানাথ আমার বিরোধী। তিনি বলেন, শান্তিদেবের বাড়ি সৌরাষ্ট্রে ছিল। দুঃখের বিষয় এই যে, আমি শান্তিদেবের যে অমূল্য জীবনচরিতখানি পাইয়াছি, তাহাতে কে তাঁহার জন্মভূমির নামটি কাটিয়া দিয়াছে- এমন করিয়া কাটিয়াছে যে, পড়িবার জো নাই ! কিন্তু তাঁহার লীলাক্ষেত্র মগধের রাজধানী ও মালদা। তিনি যখন বাড়ি হইতে বাহির হন, তাঁহার মা বলিয়া দিয়াছিলেন, “তুমি মঞ্জুঞ্জান লাভ করিবার জন্য মঞ্জুবজ্রসমাধিকে গুরু করবে।” সৌরাষ্ট্রে মঞ্জুশ্রীর প্রাদুর্ভাব বড় শোনা যায় না। সেখানে বৌদ্ধ ধর্মের প্রাদুর্ভাবই বড় কম ছিল।
তাঁহাকে বাঙালী বলিয়া মনে করিবার আরও একটি কারণ আছে। নালন্দায় তাঁহার একটি ‘কুটী’ বা কুঁড়ে ঘর ছিল। লোকে দেখিত, তিনি যখন ভোজন করিতে বসিতেন তাঁহার মুখ প্রসন্ন থাকিত, যখন শয়ন করিতেন তাঁহার মুখ প্রসন্ন থাকিত, যখন কুঢ়ীতে বসিয়া থাকিতেন তখনও তাঁহার মুখ প্রসন্ন থাকিত ; সেইজন্য—
ভুঞ্জানোপি প্রভাস্বরঃ
সুপ্তোপি প্রভাস্বরঃ
কুটীং গতোপি প্রভাস্বরঃ।
এই জন্যে তাঁহার নাম হইয়াছিল ‘ভুসুকু’। তিনি যখন মগধের রাজধানীতে থাকিতেন, তখন তিনি রাউতের কার্য করিতেন। এমন কতগুলি বাংলা গান আছে, যাহার ভণিতায় লেখা আছে ‘রাউতু ভণই কট, ভুসুকু ভণই কট।’ এখন এই রাউতু, ভুসুকু ও শান্তিদেব একই ব্যক্তি কিনা, ইহা ভাবিবার কথা। তিনজনই এক, ইহাই অধিক সম্ভব।
আরও এক কথা, শান্তিদেব তিনখানি পুস্তক লিখিছেন–(১) সূত্র সমুচ্চয়, (২) শিক্ষাসমুচ্চয় ও (৩) বোধিচর্যাবতার। শেষ দুইখানি পাওয়া গিাছে ও ছাপা হইয়াছে। প্ৰথমখানি এখনও পাওয়া যায় নাই। কিন্তু ভুসুকুর নামে আমরা একখানি বই পাইয়াছি, সেখানি ভুসুকুর লেখা। উপরের দুইখানির মত এইখানিও সংস্কৃতে লেখা, তবে মাঝে মাঝে বাঙ্গলা আছে। উপরের দুইখানির মধ্যেও আবার শিক্ষাসমুদয়ে অনেক অংশ সংস্কৃত ছাড়া অপর আর এক ভাষায় লেখা ! এখন আপত্তি উঠতে পারে যে, শান্তিদেবের যে দুইখানি পুস্তক ইতিপূর্বেই পাওয়া গিয়াছিল, সে দুইখানিই মহাযানের বই ; শেষে যেখানি পাওয়া গিয়াছে, সেখানি হয় বজ্রযানের, নাহয় সহজযানের। এক লোক কি দুই যানের পুস্তক লিখে? এ সম্বন্ধে বেন্ডল সাহেব বলেন যে, শিক্ষ-সমুচ্চয়েও তান্ত্রিক ধর্মের অনেক কথা পাওয়া যায়। আমরাও দেখিয়াছি যে, বজ্রযান সহজযান ও কালচক্রযান মহাযানছাড়া নয়। এই সকল যানের লোকেরা মনে করিত যে, “আমরা মহাযানেরই লোক, কেবল আমরা মহাযানকে সহজ করিয়া তুলিয়াছি ও উহার অনেক উন্নতি করিয়াছি।” এখনও নেপালী বৌদ্ধেরা বলে, “আমরা মহাযান বৌদ্ধ।” কিন্তু তাহারা বাস্তবিক বজ্রযান বা সহজযানের উপাসক।