অর্থশাস্ত্রে আমরা যে সংবাদ পাইলাম, সেটি বাংলার বড়ই গৌরবের কথা। যদি বাঙালীরা সকলের আগে রেশমের চাষ করিয়া থাকেন, তাহা হইলে ত তাঁহাদের গৌরবের সীমা নাই। যদি চীনেই সর্বপ্রথম উহার আরম্ভ হয়, তথাপি বাঙালীরা চীন হইতে কিছু না শিখিয়াই সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ভাবে যে রেশমের কাজ আরম্ভ করেন, সে বিষয়ে আর সন্দেহ নাই। কারণ, তাঁহারা ত আর তুঁতপাতা হইতে আর রেশম বাহির করিতেন না, এ কথা পূর্বেই বলিয়াছি। যে সকল গাছ বিনা চাষে তাঁহাদের দেশে প্রচুর জন্মায়, সে সকল গাছের পোকা হইতেই তাঁহারা নানা রঙের রেশম বাহির করিতেন। চীনের রেশম সবই সাদা, তাহা রঙ করিতে হয়। বাংলার রেশম রঙ করিতে হইত না, গাছবিশেষের পাতার জন্যই ভিন্ন ভিন্ন রঙের সুতা হইত। আর এ বিদ্যা বাংলার নিজস্ব, ইহা কম গৌরবের কথা নয়।
০৪. বাকলের কাপড়
বাংলার চতুর্থ গৌরব বাকলের কাপড়। প্রথম অবস্থায় লোকে পাতা পরিত। কটকের জঙ্গলমহলে এখনও দু-এক জায়গায় লোকে পাতা পরিয়া থাকে। তাহার পর লোকে বাকল পরিত; গাছের ছাল পিটিয়া কাপড়ের মত নরম করিয়া লইত, তাহাই জড়াইয়া লজ্জা নিবারণ করিত এবং কাঁধের উপর একখানি ফেলিয়া উত্তরীয় করিত। সাঁচী পাহাড়ের উপর এক প্রকাণ্ড স্তূপ আছে, উহার চারিদিকে পাথরের রেলিং আছে, রেলিংএর চারিদিকে বড় বড় ফটক আছে। দুই-দুইটি থামের উপর এক-একটি ফটক। এই থামের গায়ে অনেক চিত্র আছে। এই চিত্রের মধ্যে বাকল-পরা অনেক মুনিঋষি আছেন। তাঁহাদের কাপড় পরার ধরন দেখিয়া আমরা বুঝিতে পারি, কেমন করিয়া সেখানে লোক বাকল পরিয়া থাকিত। তাহার পর লোকে আর বাকল পরিত না, বাকল হইতে সুতা বাহির করিয়া কাপড় বুনিয়া লইত; শণ, পাট, ধঞ্চে, এমন কি আতসী গাছের ছাল হইতেও সুতা বাহির করিত। এখন এই সকল সুতায় দড়ি ও থলে হয়। সেকালে উহা হইতে খুব ভাল কাপড় তৈয়ার হইত এবং অনেক কাপড় খুব ভালও হইত। বালক হইতে যে কাপড় হইত তাহার নাম ‘ক্ষৌম’, উৎকৃষ্ট ক্ষৌমের নাম ‘দুকূল’। ক্ষৌম পবিত্র বলিয়া লোকে বড় আদর করিয়া পরিত।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের মতে বাংলাতেই এই বাকলের কাপড় বুনা হইত। বঙ্গে দুকূল হইত, উহা শ্বেত ও স্নিগ্ধ, দেখিলেই চক্ষু জুড়াইয়া যাইত। পৌণ্ড্রেও দুকূল হইত, উহা শ্যামবর্ণ ও মণির মত উজ্জ্বল। সুবর্ণকুড্যে যে কুকূল হইত তাহার বর্ণ সূর্যের মত এবং মণির মত উজ্জ্বল। এই অংশের শেষে কৌটিল্য বলিতেছেন, ইহাতেই কাশীর ও পৌন্ড্র দেশের ক্ষৌমের কথা ‘ব্যাখ্যা’ করা হইল। উহাতে বুঝা যায়, বাংলাতেই বাকলের কাপড় সকলের চেয়ে ভাল হইত এবং ‘দুকূল’ একমাত্র বাংলাতেই হইত। সুতরাং ইহা আমরা বাংলার চতুর্থ গৌরবের বিষয় বলিয়া উল্লেখ করিলাম।
এখানে আমরা কাপাসের কাপড়ের কথা বলিলাম না। কারণ, চাণক্যের মতে কাপাসের কাপড় যে শুধু বাংলাতেই ভাল হইত, এমন নয়—মথুরার কাপড়, অপরান্তের কাপড়, কলিঙ্গের কাপড়, কাশীর কাপড়, বৎসদেশের কাপড় ও মহিষদেশের কাপড়ও বেশ হইত। মথুরা, পাণ্ড্যদেশে, মহিষদেশ, নর্মদার দক্ষিণ, অপরান্ত বোম্বাই অঞ্চলে। কিন্তু চাণক্যের অনেক পরে কার্পাসের কাপড়ও বাংলার একটা প্রধান গৌরবের জিনিস হইয়াছিল। ঢাকাই মস্লিন ঘাসের উপর পাড়িয়া রাখিলে ও রাত্রিতে তাহার উপর শিশির পড়িলে, কাপড় দেখাই যাইত না। একটি আংটির ভিতর দিয়া এক থান মসলিন অনায়াসেই টানিয়া বাহির করিয়া লওয়া যাইত। তাঁতীরা অতি প্রাত্যুষে উঠিয়া একটি বাখারির কাটি লইয়া কাপাসের খেতে ঢুকিত। ফট্ করিয়া যেমন একটি কাপাসের মুখ খুলিয়া যাইত, অমনি বাখারিতে জিড়াইয়া তাহার মুখের তুলাটি সংগ্রহ করিত। সেই তুলা হইতে অতি সূক্ষ্ম সুতা পাকাইত, তাহাতেই মস্লিন তৈয়ার হইত। আকবর যখন বাংলা দখল করিয়া সুবাদার নিযুক্ত করেন, তখন সুবাদারের সহিত তাঁহার বন্দোবস্ত হয় যে, তিনি বাংলার রাজস্ব-স্বরূপ বৎসরে পাঁচ লক্ষ টাকা মাত্র লইবেন, কিন্তু দিল্লীর রাজবাড়িতে যত মালদহের রেশমী কাপড় ও ঢাকার মস্লিন দরকার হইবে, সমস্ত সুবাদারকে জোগাইতে হইবে।
০৭. বৌদ্ধ শীলভদ্র
অভিধর্মকোষ-ব্যাখ্যার মঙ্গলাচরণে লেখা আছে যে, গ্রন্থকার বসুবন্ধু দ্বিতীয় বুদ্ধের ন্যায় বিরাজ করিতেন। এ কথা দি ভারতবর্ষের পক্ষে সত্য হয় তাহা হইলে সমস্ত এশিয়ার পক্ষে হিউয়ান্ চুয়াং যে দ্বিতীয় বুদ্ধের ন্যায় বিরাজ করিতেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। চীনে যত বৌদ্ধ পণ্ডিত জন্মিয়া ছিলেন, হিউয়ান চুয়াং তাঁহাদের মধ্যে সকলের চেয়ে বড়। তাঁহারই শিষ্য-প্রশিষ্য এক সময় জাপান, কোরিয়া, মঙ্গলিয়া ছাইয়া ফেলিয়াছিল। হিউয়ান চুয়াং বৌদ্ধ ধর্ম ও যোগ শিখিবার জন্য ভারতবর্ষে আসিয়া ছিলেন। তিনি যাহা শিখিবার জন্য আসিয়ছিলেন, তাহার চেয়ে অনেক বেশী শিখিয়া যান। যাঁহার পদতলে বসিয়া তিনি এত শাস্ত্র শিখিয়াছিলেন, তিনি একজন বাঙালী । ইহা বাঙালীর পক্ষে কম গৌরবের কথা নয়। ইহার নাম শীলভদ্র, সমতটের এক রাজার ছেলে। হিউমান চুয়াং যখন ভারতবর্ষে আসেন তখন তিনি নালন্দা বিহারের অধ্যক্ষ ; বড় বড় রাজা এমন কি সম্রাট হর্ষবর্ধন পর্যন্ত তাঁহার নামে তটস্থ হইতেন, কিন্তু সে পদের গৌরব, মানুষের নহে । শীলভদ্রের পদের গৌরব অপেক্ষ বিদ্যার গৌরব অনেক বেশী ছিল। হিউয়ান্ চুয়াং একজন বিচক্ষণ বহুদর্শী লোক ছিলেন। তিনি গুরুকে দেবতার মত ভক্তি করিতেন। তিনি বলিয়া গিয়াছেন যে, নানা দেশে নানা গুরুর নিকট বৌদ্ধশাস্ত্রের ও বৌদ্ধযোগের গ্রন্থ সকল অধ্যয়ন করিয়া, তাঁহার যে সকল সন্দেহ কিছুতেই মিটে নাই, শীলভদ্রের উপদেশে সেই সকল সন্দেহ মিটিয়া গিয়াছে। কাশ্মীরের প্রধান প্রধান বৌদ্ধ পণ্ডিত তাঁহার সে সমস্ত সংশয় দূর করিতে পারেন নাই, শীলভদ্র তাহা এক-এক কথায় দূর করিয়া দিয়াছিলেন। শীলভদ্র মহাযান বৌদ্ধ ছিলেন, কিন্তু বৌদ্ধদিগের অন্যান্য সম্প্রদায়ের সমস্ত গ্রন্থই তাঁহার পড়া ছিল। এ ত অনেক বৌদ্ধেরই থাকিতে পারে, বিশেষ যাঁহারা বড় বড় মহাযান বিহারের কর্তা ছিলেন, তাঁহাদের থাকাই ত উচিত, কিন্তু শীলভদ্রের ইহা অপেক্ষা অনেক বেশী ছিল–তিনি ব্রাহ্মণদের সমস্ত শাস্ত্র আয়ত্ত করিয়াছিলেন। পাণিনি তাঁহার বেশ অভ্যাস ছিল এবং সেই সময় উহার যে সকল টীকাটিপ্পনী হইয়াছিল, তাহাও তিনি পড়াইতেন। ব্রাহ্মণের আদি গ্রন্থ যে বেদ, তাহাও তিনি হিউয়ান চুয়াংকে পড়াইয়া দিয়াছিলেন। তাঁহার মত সর্বশাস্ত্রবিশারদ পণ্ডিত ভারতবর্ষেও আর দেখিতে পাওয়া যায় কিনা সন্দেহ। তাঁহার যেমন পাণ্ডিত্য ছিল, তেমনি মনের উদারতা ছিল। হিউয়ান্ চুয়াং-এর পাণ্ডিত্য ও উৎসাহ দেখিয়া নালন্দার সমস্ত পণ্ডিতবর্গ তাঁহাকে দেশে যাইতে দিবেন না স্থির করিলেন, তখন শীলভদ্র বলিয়া উঠিলেন, “চীন একটি মহাদেশ, হিউয়ান্ চুয়াং ঐখানে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করিবেন, ইহাতে তোমাদের বাধ দেওয়া উচিত নয়। সেখানে গেলে ইঁহার দ্বারা সদধর্মের অনেক উন্নতি হইবে, এখানে বসিয়া থাকিলে কিছুই হইবে না।” আবার যখন কুমাররাজ ভাষ্করবর্মা হিউয়ান্ চুয়াংকে কামরূপ যাইবার জন্য বার বার অনুরোধ করিতে লাগিলেন এবং যাইতে রাজী হইলেন না, তখনও শীলভদ্র বলিলেন, “কামরূপে বৌদ্ধ ধর্ম এখনও প্রবেশলাভ করিতে পারে নাই, সেখানে গেলে যদি বৌদ্ধ ধর্মের কিছুমাত্র বিস্তার হয়, তাহার পরম লাভ।” এই সমস্ত ঘটনায় শীলভদ্রের ধর্মানুরাগ, দূরদর্শিতা ও নীতিকৌশলের যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়।