যাহা হউক শঙ্করের পর ত্রিপুরানন্দ, ব্ৰহ্মানন্দ ও পূর্ণানন্দ পূর্ববঙ্গে বৌদ্ধদিগকে হিন্দু করিয়া লইয়াছিলেন। ব্ৰহ্মানন্দদের পুস্তকে অক্ষোভ্য, বৈরোচন প্রভৃতি বুদ্ধের নাম পাওয়া যায়। অক্ষোভ্য এখানে ঋষি হইয়াছেন, বৈরোচন দেবতা হইয়াছেন। যে তারামন্ত্র সাধনের জন্য বশিষ্টদেবকে চীনে যাইয়া বুদ্ধদেবের শরণ লইতে হইয়াছিল, ব্রহ্মানন্দ সেই তারার পূজারই রহস্য লিখিয়া গিয়াছেন। বৌদ্ধ মতে তারা অক্ষোভ্যেরই শক্তি। বৌদ্ধ মতে তারা, একজটা, নীলসরস্বতীর উপাসনা আছে, তারারহস্যেও তাই। বৌদ্ধরা শূন্যবাদী, তারারহস্যেও শূন্যের উপর শূন্য, তাহার উপর শূন্য, এইরূপে ষষ্ঠ শূন্য পর্যন্ত উঠিয়াছে। বৌদ্ধমতে এই সকল দেবীর ধারণী আছে, সাধন আছে; তারারহস্যে তাঁহাদের গায়ত্রী আছে। বােধ হয় ঐ অঞ্চলে অনেক বৌদ্ধ ছিল বলিয়া, এই উপায়েই ব্ৰহ্মানন্দ তাহাদিগকে হিন্দু করিয়া লইয়াছেন।
ব্ৰহ্মানদের শিষ্য পূর্ণানন্দ একজন খুব ক্ষমতাশালী পুরুষ ছিলেন। তাহার সংগ্রহগুলি আরও মার্জিত। তাহার অনেকগুলি গ্রন্থ আছে। তিনি বেশ সংস্কৃত লিখিতে পারিতেন। পূর্ববঙ্গে ও বরেন্দ্রে তাঁহার বংশধরেরাই গুরুগিরি করিয়া থাকেন, তাঁহাদের শিষ্যশাখা অসংখ্য।
রাঢ়ে আগমবাগীশের সংগ্রহ আরও মার্জিত। তাঁহার গ্রন্থে পঞ্চমকারের কথা নাই বলিলেই হয়, তাই এ দেশে তাহার বড়ই আদর। কিন্তু তাহারও গ্রন্থে মঞ্জুঘোষের উপাসনার ব্যাপার আছে। মধুঘোষ যে একজন বোধিসত্ত্ব, তাহাতে আর সন্দেহ নাই।
তান্ত্রিক সংগ্রহকারেরা হতাবশিষ্ট বৌদ্ধগণকে নানা উপায়ে হিন্দু করিয়া লইয়াছেন, আপনার করিয়া লইয়াছেন। সুতরাং তাঁহারা বাংলা সমাজের যথেষ্ট উপকার করিয়া গিয়াছেন।
তান্ত্রিক মহাশয়েরা বঙ্গসমাজের অস্থিমজ্জায় প্রবেশ করিয়াছেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। বাংলা ভাষার সাহিত্য তাহার সাক্ষী। তাঁহাদের দলে বাংলা বই প্রচুর না হইলেও যথেষ্ট আছে এবং সেগুলি বেশ ভাল। তাঁহাদের শ্যামাবিষয়ক গানগুলি বাংলার একটি শ্লাঘার বিষয়। আজিও কেহ সংগ্রহ করে নাই, তাই তাহদের সংখ্যা করা যায় না। রামপ্রসাদের গান শুনিয়া মোহিত হয় না এমন বাঙালী কি কেহ আছে ? দেওয়ানজি মহাশয়ের ও কমলাকান্তের গান অনেক সময় হৃদয়ের নিগূঢ় তন্ত্রীগুলি বাজাইয়া দেয়।
বাঙালী হিন্দুর মধ্যে একেবারে বৈষ্ণব অর্থাং বৈষ্ণবসম্প্রদায়ভুক্ত লোকের অপেক্ষ স্মার্ত পঞ্চোপাসকের দলই অধিক। ইঁহারা যদিও শাক্তসম্প্রদায়ভুক্ত নন, কিন্তু বাঙালীর জানে হিন্দু হইলেই হয় তাহাকে বৈষ্ণব না-হয় শাক্ত হইতে হইবে। সেইজন্য যাহারা বৈষ্ণব নহে, তাহারা সকলেই শাক্ত, শাক্তসম্প্রদায়ভুক্ত না হইলেও শাক্ত। এই দলকে বৈষ্ণবের গান অপেক্ষা শ্যামাবিষয়ক গানেই বেশী মাতাইয়া তুলে।
১৯. বাঙালী ব্রাহ্মণ
বাঙালী ব্রাহ্মণ, শুধু বাংলার নয়, সমস্ত ভারতেরই গৌরবের স্থল। বিদ্যা, বুদ্ধি, শাস্ত্রজ্ঞানে তাঁহার কোন-জাতীয় ব্রাহ্মণ হইতেই ন্যূন নহেন, বরং তত্ত্ব বুদ্ধি ও বিচারশক্তিতে তাঁহাদের স্থান সর্বাপেক্ষা উচ্চ। কিন্তু আমরা এখন সে সকল গৌরবের কথা এখানে বলিব না। তাঁহাদিগকে বাংলার গৌরব বলিয়াছি, বাংলায় তাহারা কি করিয়াছেন তাহাই দেখাইব এবং সেই জন্য তাঁহাদের গৌরব করিব।
এই যে এত বড় একটা অনার্য দেশ, এখানে বৌদ্ধ, জৈন এবং অন্যান্য অব্রাহ্মণ ধর্মের এত প্রাদুর্ভাব ছিল, অথচ এখন এ দেশে জৈন বৌদ্ধ দেখিতেও পাওয়া যায় না, তাহাদের কীর্তিকলাপ পর্যন্ত লোকে একেবারে ভুলিয়া গিয়াছে,–চারিদিকের লোকে জানে বাংলা হিন্দুধর্মের দেশ–এটা কে করিল ? কাহার যন্ত্রে, কাহার দূরদর্শিতায়, কাহার নীতিজ্ঞানে এই দেশটা আর্য আচারে, আর্য বিদ্যায়, আর্য ধর্মে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে ? এ প্রশ্নের ত এক উত্তর। বাঙালী ব্রাহ্মণরাই এই কাজটি করিয়াছেন। বাংলায় রাজশক্তি ত তাঁহাদের অনুকূল ছিল না, বরং অনেক স্থানে অনেক সময় ঘোর প্রতিকূলই ছিল। এই রাজশক্তির বিরুদ্ধে অনবরত সংগ্রাম করিয়া দেশটাকে হিন্দু করিয়া তুলা একটা প্রকাণ্ড ব্যাপার, বঙ্গের ব্রাহ্মণের তাহা সুসিদ্ধ করিয়াছেন, আর এমনি ভাবে সুসিদ্ধ করিয়াছেন যে, মুসলমান ঐতিহাসিকেরা জানেন না যে, তাঁহাদের আগমনের সময়েই এদেশে হিন্দু ছাড়া আরও একটা প্রবল ধর্ম ছিল। মুসলমানের প্রাচীন সমাজ, বিশেষতঃ প্রাচীন বৌদ্ধসমাজ, একেবারে ধ্বংস করিয়া দিলে, তাহার পর কিরূপে ব্রাহ্মণের আবার ধীরে ধীরে সেই সমাজ আবার গড়িয়া তুলিলেন, তাহা পূর্বেই অনেকটা দেখাইয়াছি। স্মৃতি, দর্শন, বৈষ্ণব ধর্ম, শাক্ত ধৰ্ম, তাহাদের বিশেষ সাহায্য করিয়াছিল, কিন্তু তাহাতেই ব্রাহ্মণের নিশ্চিন্ত ছিলেন না। তাঁহারা দেখিয়াছিলেন, দেশীয় ভাষায় ছড়া লিখিয়া, দেশীয় ভাষায় গান গাইয়া, বৌদ্ধের কেমন দেশটাকে মাতাইয়া তুলিত। সুতরাং দেশ মাতাইতে হইলে যে, মাতৃভাষা ভিন্ন হয় না, এ তাহদের বেশ জ্ঞান হইয়াছিল। তাই তাহারা প্রথম হইতেই রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত প্রভৃতি বাংলা করা আরম্ভ করিয়া দেন।
এইরূপ করায় তাহাদের দুই কাজই হইয়াছিল। লোকের দৃষ্টি বৌদ্ধের দিক হইতে হিন্দুর দিকে পড়িয়াছিল এবং মুসলমানদের হাত হইতে উদ্ধার হইবার একটা বেশ যন্ত্র হইয়াছিল। রাজনীতিজ্ঞ মুসলমানেরাও একথা বেশ অনুভব করিয়াছিলেন, তাই তাহারা ঘরের পয়সা দিয়া বাংলা লেখার সাহায্য করিতেন। বাস্তবিকই স্মৃতি ও দর্শন অপেক্ষা এই সকল বাংলা তর্জমায় হিন্দু সমাজের বন্ধন বেশ শক্ত হইয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু এ তর্জমার মূলে ব্রাহ্মণ। এ কথাটা প্রথম তাঁহাদেরই মাথায় আসিয়াছিল এবং তাঁহারাই আগ্রহসহকারে এই কার্য করিয়া বাঙালীর গৌরব যথেষ্ট বৃদ্ধি করিয়া গিয়াছেন।
২০. কায়স্থ ও রাজা
পরে কিন্তু ব্রাহ্মণের এ বিষয়ে কায়স্থদের নিকট যথেষ্ট সাহায্য পাইয়াছিলেন। উঁহারা পূর্বেই বোধ হয় একটু দোটানায় ছিলেন। বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি তাঁহাদের আগে বেশ শ্রদ্ধা ছিল, কেননা, অনেক কায়স্থ অনেক বৌদ্ধগ্রন্থ লিখিয়া গিয়াছেন। ধর্মপালের সময় হইতে বল্লাল সেনের সময় পর্যন্ত তাঞ্জুরে আমরা অনেক কায়স্থের নাম দেখিতে পাই। পরে, যখন তাহারা দেখিলেন বৌদ্ধ ধৰ্ম আস্তে আস্তে লোপ হইল, তখন তাঁহারা একেবারে ব্রাহ্মণের দিকে ঝুঁকিয়া পড়িলেন এবং ব্রাহ্মণদের হইয়া পুরাণাদি বাংলা করিতে লাগিলেন। গুণরাজখাঁর কৃষ্ণমঙ্গল ও কাশীদাসের মহাভারত বাঙালীকে অনেক বড় করিয়া দিয়াছে। কাশীদাসের আরও দুই ভাই গদাধর ও কৃষ্ণদাস ভাল ভাল বই লিখিয়া গিয়াছেন। সকলেরই উদ্দেশ্য সেই এক— বাঙালী হিন্দু হউক। কায়স্থেরা শুধু বই লিখিয়াই সমাজের উপকার করিয়া গিয়াছেন, তাহা নহে। এদেশের অনেক জমিই তাঁহাদের হাতে ছিল, জমিদারভাবেও দেশের ও সমাজের যথেষ্ট উপকার করিয়া গিয়াছেন। রাজা গণেশ ও তাঁহার সন্তানসন্ততি বাংলার সুলতান না হইলে রায়মুকুট বড় কিছু করিতে পারিতেন না। হিরণ্য ও গোবৰ্ধন না থাকিলে চৈতন্য সম্প্রদায় গড়িতেই পারিতেন কিনা মনোহ। বুদ্ধিমন্ত খাঁ না থাকিলে নবদ্বীপের ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতসমাজকে অর্থের জন্য বিস্তর কষ্ট পাইতে হইত। এইরূপে কায়স্থ-ব্রাহ্মণে মিশিয়া বাংলায় একটা প্রকাণ্ড হিন্দুসমাজ গড়িয়া তুলিলেন।