বাকি যাহারা ছিল, তাহারা হিন্দু হইয়া গেল। তাহাদিগকে হিন্দু করিল কে ? ব্রাহ্মণেরা। ব্ৰাহ্মণ-পণ্ডিতদের ত এ বিষয়ে কৃতিত্ব আছেই, সঙ্গে সঙ্গে আরও দুই দল ব্রাহ্মণ উহাদের সহায় হইলেন। এক দলের নেতা চৈতন্য, অদ্বৈত ও নিত্যানন্দ। আর এক দলের নেতা গৌড়ীয় শঙ্কর, ত্রিপুরানন্দ, ব্ৰহ্মানন্দ, পূর্ণানন্দ ও আগমবাগীশ। এক দল বৈষ্ণব, আর-এক দল শাক্ত।
বৈষ্ণবদিগের মধ্যে চৈতন্যদেব একটি প্রকাণ্ড সম্প্রদায় সৃষ্টি করিয়া গিয়াছেন। তিনি নিজে বাঙালী ছিলেন, তাহার পরিকরও প্রায় সবই বাঙালী। ইঁহারা অনেক সংস্কৃত গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন এবং বাংলা ভাষার যথেষ্ট শ্ৰীবৃদ্ধি করিয়াছিলেন। রূপ, সনাতন, জীব, গোপালভট, কবিকর্ণপুর, বিশ্বনাথ চক্রবর্তী, বলদেব বিদ্যাভূষণ হইতে আরম্ভ করিয়া উপেন্দ্র গোস্বামী পর্যন্ত কত লোক যে সংস্কৃত গ্রন্থ রচনা করিয়া গিয়াছেন, তাহা গণিয়া শেষ করা যায় না। বাংলার ত কথাই নাই। বৃন্দাবনদাস, লোচনদাস, কৃষ্ণদাস কবিরাঙ্গ হইতে আরম্ভ করিয়া রঘুনন্দন গোস্বামী পর্যন্ত কত কত বৈষ্ণব লেখক বাংলা উংকৃষ্ট উংকৃষ্ট গ্রন্থ রচনা করিয়া গিয়াছেন। তাঁহারা বাংলা ভাষাকে মার্জিত কবিয়া দিয়া গিয়াছেন, নূতন জীবন দিয়া গিয়াছেন। বাংলায় বৈষ্ণবদিগের প্রধান কীর্তি— কীর্তনের পদ। বৌদ্ধদিগের চর্যাপদের অনুকরণে এই সকল পদাবলীর সৃষ্টি। পদাবলীর পদকর্তা অসংখ্য। রাধামোহন দাস ৮০০/৮৫০ পদ সংগ্ৰহ করিয় গিয়াছেন, তাঁহার দুই পুরুষ পরে বৈষ্ণবদাস ৩৩০০ পদ সংগ্ৰহ করিয়া গিয়াছেন, এখনও সংগ্ৰহ করিলে ২০,০০০ হাজারেরও অধিক হইবে। ভাবের মাধুর্যে, ভাষার লালিতে, স্বরের বৈচিত্রে এই সকল গান সকল সমাজেরই পরম আদরের জিনিস। এই সকল পদ গান করিবার জন্য নানারূপ কীর্তনের সৃষ্টি হইয়াছে। সেকালে যেমন বাংলায় নাটকের একটা স্বতন্ত্র ‘প্রবৃত্তি’ ছিল, এখনও কীর্তনের সেইরূপ নানা ‘প্রবৃত্তি’ হইয়াছে, তাহার মধ্যে দুইটি প্রধান- মনোহরশাহী ও রেনেটি। ভক্তিরত্নাকরে লেখা আছে যে, শ্ৰীখণ্ডে যখন প্রথম কীৰ্তন হয়, তখন স্বৰ্গ হইতে চৈতন্য সেখানে উপস্থিত হইয়াছিলেন। এখনও বোধ হয় ভাল কীৰ্তন জমিলে সেখানে চৈতন্য সপরিকর আবির্ভূত হন। বাংলার কীর্তন একটা সত্যসত্যই উপভোগের জিনিস। তাহার জন্য চৈতন্যদেবের ও তাঁহার সম্প্রদায়ের নিকট আমরা সম্পূর্ণরূপে ঋণী।
১৮. তান্ত্রিকগণ
তন্ত্র বলিলে কি বুঝায়, এখনও বুঝিতে পারি নাই। বৌদ্ধেরা বজ্রযান, সহজযান, কালচক্রযান– সকলকেই তন্ত্র বলে। কাশ্মীরী শৈবদের সকল গ্রন্থই তন্ত্র। নাথ-পন্থের সকল গ্রন্থই তন্ত্র। অন্যান্য শৈব সম্প্রদায়ের গ্রন্থও তন্ত্র। আবার শাক্তদের সব গ্রন্থও তন্ত্র। এখন আবার বৈষ্ণবদের পঞ্চরাত্রগুলিকেও তন্ত্র বলিতেছে। বাস্তবিকই বৈষ্ণবদের কয়েকখানি তন্ত্র আছে। এরূপ অবস্থায় তন্ত্র বলিলে হয় সব বুঝায়, নাহয় কিছুই বুঝায় না।
অনেক তন্ত্রে বলে, বেদে কিছু হয় না বলিয়াই আমাদের উৎপত্তি। আবার অনেকে বলেন, অথর্ববেদই তন্ত্রের মূল। মূলতন্ত্রগুলি হয় বুদ্ধদেবের মুখ হইতে উঠিয়াছে, নাহয় হরপার্বতীসংবাদ রূপে উঠিয়াছে। যেগুলি হরপার্বতীসংবাদ সেগুলি কেহ-না-কেই কৈলাস হইতে পৃথিবীতে ‘অবতারিত’ করিয়াছেন, না হইলে লোকে তাহ জানিবে কিরূপে ? একজন বৌদ্ধ তন্ত্রকার বলিয়াছেন, “আমরা ব্রাহ্মণদের মত সুশব্দবাদী নহি। আমরা সোজ-কথায় লিখি। যে ভাষা সকলে বুঝিতে পরিবে আমরা এমন ভাষায় লিখি।” মূল তন্ত্রে ব্যাকরণের বড় ধার ধারে না। কিন্তু মূল তন্ত্র বড় একটা পাওয়া যায় না, যাহা পাওয়া যায় তাহার অধিকাংশই সংগ্রহ। একজন তান্ত্রিক পণ্ডিত দুই-চারিধানি মূলতন্ত্র ও বহুসংখ্যক সংগ্রহ একত্র করিলেন, আবার তাহার উপর নিজের একখানি সংগ্রহ বাহির করিলেন। তাঁহার দলে সেই সংগ্রহ চলিতে লাগিল। এইরূপে অনেক সংগ্রহ চলিয়া গিয়াছে।
বাংলায় এই সকল সংগ্রহকর্তাদের প্রথম ও প্রধান– গৌড়ীয় শঙ্করাচার্য। তাঁহার অনেকগুলি সংগ্রহ পাওয়া গিয়াছে। তাঁহার স্তবগুলি বিশুদ্ধ সংস্কৃতে লেখা। সংস্কৃত ভাষায় তাহার যথেষ্ট অধিকার ছিল। তিনি নানা ছন্দে নানা স্তব লিখিয়া গিয়াছেন। তাঁহার অনেক গ্রন্থ বড় শঙ্করাচার্যের বলিয়া চলিয়া যাইতেছে। কিন্তু বড় শঙ্করাচার্য অদ্বৈতবাদী ছিলেন, তিনি তন্ত্র লিখিতে যাইবেন কেন ? তন্ত্রের সৃষ্টিপ্রক্রিয়া একটু নূতন। উহা ব্রাহ্মণদের কোন সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার সহিত মিলে না। কিন্তু এখন বাংলার লোকে ঐরূপ সৃষ্টিপ্রক্রিয়াই জানে। সংগ্রহকারের মূলতত্ত্ব অনেক পরিষ্কার করিয়া তুলিয়াছেন। মূলতত্ত্বে অনেক প্রক্রিয়া আছে যাহা সভ্যসমাজে বাহির করা চলে না। সংগ্রহকারেরা উহা মার্জিত করিয়া লইয়াছেন, কিন্তু মার্জিত করিয়া লইলেও তাঁহাদের গুহ্য উপাসনা বড় সুবিধার নয়। আমার বিশ্বাস তন্ত্র-সম্বন্ধে আলোচনা, যত কম হয়, ততই ভাল। কিন্তু যে সকল মহাপুরুষের এই লোকায়ত তন্ত্রশাস্ত্রকে মার্জিত করিয়া সভ্য সমাজের উপযোগী করিয়া গিয়াছেন এবং এইরূপ করায় অনেক লোক হিন্দু হইয়াছে ও হিন্দু হইয়া রহিয়াছে, তাঁহারা যে খুব দূরদর্শী ও সমাজনীতিকুশল, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই।