ঘটনা সত্য সন্দেহ নাই।
—বটগাছের নীচে আশে-পাশে এমনি-আরও অনেক ঘটনা ঘটে। মানুষের মতো দুটি চোখ থাকিলে অনেক কিছু সে দেখিত। সে এখন বৃদ্ধ। তার গায়ে এখানে-ওখানে নানারকমের শিকড়, কোনো কোনো ডালে হয়তো পোকাও ধরিয়াছে। গাছের গুঁড়িটা এত মোটা যে কয়েকটি লোক মিলিয়াও নাগাল পাইবে না। গুঁড়ির কাছে চারিদিকে কে যেন বাঁধাইয়া দিয়াছে। গাছের নীচে প্রকান্ড বড়ো ছায়া এবং সেই ছায়াকে জড়াইয়া আরও বড়ো একটা হাট বসে। ছোটো ছোটো টিনের ঘরের সারি এত বেশি এবং ঘন যে হাঁটিবার পথও পাওয়া দুষ্কর।
এখন ১৯৩০ সাল। গান্ধীর আইন অমান্য আন্দোলন সারা ভারতবর্ষে আগুন ধরাইয়া দিয়াছে। সেই আগুনের ঢেউ পীরপুর গ্রামেও কিছুটা আসিয়া পৌঁছিল। একদিন কোথা হইতে একদল যুবক আসিয়া বাড়ি বাড়ি ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল।
তাহাদের সঙ্গে ছোটো একটা হারমোনিয়ম। তাহারা স্বদেশি গান গাহিয়া বিলাতি বর্জনের কথা বলিয়া কিছু টাকা-পয়সা সংগ্রহ করিল। লোকগুলি সকলের কাছেই এক অদ্ভুত রহস্যময় জীব; মেয়েরা চুপি চুপি বিস্ময়ভরা চোখে এই সুদর্শন যুবকদের দেখিল।
বিকালে বটগাছের নীচে এক সভা। অনেক লোক আসিল। দেখা গেল, কয়েকটি স্ত্রীলোকও সন্তান-সন্ততি-সহ বক্তৃতা শুনিতে আসিয়াছে। তাহারা এক হাতে ঘোমটা টানিয়া স্বদেশি বক্তৃতা শুনিল। সভায় সভাপতিত্ব করিলেন শ্রেষ্ঠ পত্রিকাপাঠক মনোহর চক্রবর্তী মহাশয়। তিনি গান্ধীর ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে যেসব অদ্ভুত গল্প শুনিয়াছেন তাহা সমবেত সকল লোককে শুনাইলেন। একজন শুধু বন্দেমাতরম শব্দেরই ব্যাখ্যা করিলেন। তিনি বলিলেন, ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের এই অপূর্ব মন্ত্র আজ প্রত্যেক ভারতবাসীর মুখে মুখে ফিরিতেছে বটে কিন্তু ইহার অর্থ অনেকেই জানে না। ইহার অর্থ হইল হে মাতা, তোমাকে বন্দনা করি।
এ ছাড়া সেই যুবকদের মধ্যেও দুই একজন বক্তৃতা দিল।
তারপর একেবারে ১৯৩৯ সাল। বটগাছের মৃত্যু আরম্ভ হইয়াছে, এতদিন চোখে পড়ে নাই, কিন্তু আজ দেখিতে বড়ো ভয়ানক। কতকগুলি ডাল এখন একেবারে জীর্ণ, পত্রহীন, ছোটো-ছোটো ডাল আর শুকনো পাতা সর্বদা ঝরিয়া পড়ে, এক মুসলমান বুড়ি তা কুড়াইয়া লয়। গাছের গুঁড়ির দিকে একটা মস্তবড় গর্তের মতো, একটা লোক বেশ লুকাইয়া থাকিতে পারে। হাটবারে চারদিকে বাঁধানো জায়গাটিতে অনেকে দোকান সাজাইয়া বসে, অনেকে বেশ আড্ডা মারে, কেহ কাঁঠাল ভাঙিয়াও খায়। মাঝে মাঝে দুই একজন সাধুও বসে। সেদিন হাটবার, সেদিনের অবস্থা দেখিলে এতকালের ইতিহাসকে ভুলেও মনে করা যায় না, দেখিয়া আশ্চর্য হইতে হয়, একটা ভীষণ কোলাহল চাঁদোয়ার মতো সেই প্রকান্ড বটগাছের নীচে গুম-গুম করিতে থাকে।
সেদিনও হাটবার। রাত থাকিতেই নানারকমের নৌকা আসিতেছে। একটার পর একটা করিয়া প্রায় আধমাইলখানেক নদী সেই নৌকায় ভরিয়া গেল। বেলা বারোটার পর হাট বেশ জমিয়া ওঠে। চারিদিক লোকে গিজ গিজ করে। বাহির হইতে যাহারা আসে তাহাদের চেহারা দেখিলেই বোঝা যায়। তাহাদের গায়ে নানারকমের জামা তাকে। ভিড় কোথাও পাতলা বলিয়া মনে হয় না। সব জায়গাতেই সমান। পীরপুর অথবা অন্যান্য গ্রাম হইতে যাহারাই হাট করিতে আসিতেছে তাহাদের প্রত্যেকেরই কাঁধে গামছা, আর একটি ঝাঁকা। সকলে আসিয়াই একেবারে হাট করিতে বসিয়া যায় এমন নয়, অনেকক্ষণ এখানে সেখানে গল্প করিয়া সকলের শেষে তবে হাট করে। এইদিনে কত পরিচিত লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। ফুলুরি, বেগুনি, জিলিপি—এসব যাহারা ভাজে, তাহাদের কথা বলিবারও অবসর নাই, কারণ সকলেই একটি পয়সার অন্তত কিনিয়া খায়।
হাটের মধ্যে কেমন একটা গন্ধ, যা অন্যদিন পাওয়া যায় না।
ছোটো ছোটো রাখালছেলেরা সস্তা সিগারেট কিনিয়া নির্ভয়ে খাইয়া বেড়াইতেছে। নতুন বিবাহ করিয়াছে যাহারা, অথবা যাহাদের কাছে তাহাদের স্ত্রীর গায়ের স্বাদ আজও পুরোনো হয় নাই, তাহারা বেশিরভাগই যেখানে গোলাপী রঙের সাবান, চিরুণী ইত্যাদি বিক্রি হয় সেখানে ভিড় করিয়া আছে। গ্রামের একমাত্র খলিফা রহমান তাহার বহু পুরানো সেলাই-এর কলখানা একেবারে হাটের মাঝখানে লইয়া বসিয়াছে। কত লোক তাহাদের লুঙ্গি সেলাই করাইয়া লইল, কেহ কেবল জামার ছেঁড়াটুকু তালি দিয়া লইল।
দেখিতে দেখিতে বেলা একটা বাজিয়া গিয়াছে। এমন সময় এক কান্ড ঘটিল। সকলে দেখিল বটগাছের নীচে বাঁধানো জায়গাটিতে দাঁড়াইয়া একটা লোক বক্তৃতা করিতেছে। লোকটা সেই সতীন মিত্র ছাড়া আর কেহ নয়। আজ নয় বছর পরে কী কারণে হঠাৎ মুক্তি পাইয়া কয়েকমাস হইল সে গ্রামে আসিয়াছে। আসিয়াই সাধারণ কৃষকদের সঙ্গে দারুণ মিশিতে লাগিল তাহাদের লইয়া কী জটলা করিতে লাগিল। আর আজ হঠাৎ দেখা গেল, ওই বটগাছের নীচে দাঁড়াইয়া সে বক্তৃতা করিতেছে। তাহার পাশে আর নীচে অনেকগুলি কৃষক। আস্তে আস্তে অন্যান্য কৃষকরাও একটা কৌতূহলবশে সেখানে গিয়া ভিড়িল, একটা বিপুল জনতার সৃষ্টি হইল।
সতীন বলিতেছিল– আমার চাষি-ভাইরা চেয়ে দেখুন, সব জিনিসেরই দর বেড়েছে কিন্তু যা বিক্রি করে আমরা দুটি খেয়ে বাঁচাব, সেসব জিনিসের দর বাড়েনি! কেন এমন হল?
সকলে তন্ময় হইয়া শুনিতে লাগিল। হায়দরের ছেলে বসির সতীনের পাশেই দাঁড়াইয়া আছে।