রাত বেশি হচ্ছে বলে লীলাবতী পঞ্চুর মাকে বিদায় করে দিয়েছেন। বাড়ির মধ্যে ওই একটিমাত্র ঝি। তিনটি প্রাণীর সংসারে এর চেয়ে বেশি লীলাবতী চান না। তা ছাড়া রান্না করা আর খাওয়ানো তাঁর বিশেষ কাজ, নিষ্ঠার তৃপ্তি। সুব্রত তাঁর বাপের বাড়ির গাঁয়ের অতি দূর সম্পর্কের। হয়তো বা আত্মীয়তার চেয়ে অনিষ্টতাতেই সেখানে সম্পর্কের সৃষ্টি—এক বোনের ছেলে। এখন বিদেশে থাকে। অনেক বছর পর এসেছে। বড়ো হয়ে এই প্রথম তার লীলাবতীর সঙ্গে ভালো করে পরিচয়।
এখানে আসবার পর কয়েকটা দিন কেটেছে।
মালতী বললে, সে কী! খোট্টার দেশে ডালরুটি খেয়ে খেয়ে মুখ ফিরিয়ে এখন নিজের দেশে বসে খিদে বরং বাড়বে যে!
সুব্রত মুখ তুলে হেসে বললে, না মালতী। সেখানে বদহজম হয়ে গেছে। তাতে যে খিদে একেবারেই থাকে না।
-তাই হবে।
লীলাবতী এবার মালতীর দিকে চেয়ে বললেন, তুই আবার ওর কথায় সায় দিয়ে বসলি? ওর না-খাওয়ার অজুহাতকে প্রশ্রয় দেয়া হল না?
মালতী অপ্রতিভ হল।
সুব্রত বললে, অজুহাত মোটেই নয়। বিশ্বাস করুন মাসিমা আজ আমার সত্যি খিদে নেই।
–আচ্ছা সে কথা পরে হবে।
–পরে হবে মানে? ব্যাপারটা যে এখনেরই! সুব্রত হেসে উঠল।
লীলাবতীও হেসে বললেন, সুব্রত, ছোটোবেলায় তোমাকে দেখেছি যে উলটো?
–দেখুন মাসিমা ছোটোবেলা এমন একটি বয়েস যার গায়ের রঙ আর কোনো কালের রঙের সঙ্গে মেলে না। শুনেছি তখন কেবল নদীর দিকে ছুটে যেতাম। কিন্তু এখন জল দেখেই ভয় হয়, সাঁতার জানিনে! একেবারে উলটো।
-কি বল? তাহলে একেবারে খোট্টাই হয়ে গেছো দেখছি!
—কতকটা বটে। লীলাবতী একটু চিন্তিত হয়ে বললেন, তাহলে জলপথে বেড়ানো তোমার পক্ষে ভালো নয়।
–তা বটে।
এরপর কতক্ষণ চুপচাপ। সুব্রত মুখ নীচু করে নিঃশব্দে খেতে লাগল।
মালতী হঠাৎ বললে, ও কথা সব সময় সত্যি নয় মা। আমি এমন অনেক দৃষ্টান্ত দিতে পারি যেখানে খুব ভালো সাঁতার জেনেও জলে পড়ে মরেছে। তোমার
কী মনে নেই মাসেই
-তা জানি। কিন্তু সেটা হল অদৃষ্টের কথা। সাঁতার জানলে একটা আশা অন্তত থাকে তো?
মালতী কোনো উত্তর না দিয়ে অনির্দিষ্টভাবে চেয়ে রইল। তার এমন হয়, মাঝে মাঝেই হয়, পূর্ণ উদ্যমে একটা আলোচনায় যোগ দিয়ে শেষ পর্যন্ত আর টিকে থাকতে পারে না, ভেঙে পড়ে। কিন্তু সে নিজেও বুঝতে পারে তার এই স্বভাবের দুর্বলতা এবং এটা খুব বেশি দিনের অর্জিত নয়—সুব্রত আসার পর থেকেই। অথচ আলোচনার মাঝে ভেঙে পড়ায় সুব্রতর সঙ্গে যে কী সম্পর্ক সেটাও বিবেচ্য এবং এটা যেন একটা মিষ্টি স্বপ্ন। মালতী দেখে, এই স্বপ্নের রাত সবে শুরু হয়েছে। মালতী একটা কোমল প্রার্থনায় উল্লসিত হয়ে ওঠে : হে ঈশ্বর, এই রাতের উত্তরীয়কে মেলে দাও অশেষের দেহে।
তার আকস্মিক অন্যমনস্কতার কারণ যদি কেউ খোঁজে তবে এখানেই হয় তো একটু আলোর রেখা পাওয়া যেতে পারে, হয়তো পারে না, কারণ এখনও মালতী স্থির নিশ্চয় নয় সে কোনো ভিন্ন পথে চলেছে কি না, সে পথে তার একা চলায় সেই রাতটির সান্নিধ্য আছে তো!
কীসের সেই স্বপ্ন?
মালতীর অন্যমনস্কতা বেড়ে চলে। অথচ কোথায় গিয়ে শেষ হবে তার স্থিরতা নেই। চাইবার নির্দিষ্ট স্থানে সেখানে দৃষ্টির ক্লান্তি আসবে তার অক্লান্ত অন্যমনস্কতায় চোখের কার্যক্ষমতা শতগুণ বেড়ে যাবার কথা, এ ব্যাপারটা ভাববার এবং কাজে লাগাবার অবসর তার আছে। তাই দুপক্ষের গাম্ভীর্যনিবিড় নিস্তব্ধতায় মালতী তার স্বপ্নের পথ দিয়ে এমন এক জায়গায় গিয়ে পৌঁছোল যা সুব্রতও গভীরভাবে চেয়েছে।
সে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। খাওয়ার পর শোবার ঘরে ঢুকবার সময় সুব্রত দেখল অন্ধকার বারান্দায় যে মেয়েটি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে, সে মালতী।
সুব্রত কিছুমাত্র আশ্চর্য না হয়ে বললে, তুমি?
-হ্যাঁ।
–আচ্ছা মালতী, একটা কাজ করবে?
–বলুন।
-আমার একটা অভ্যাস—ঘুমুবার আগে বই না পড়লে বা কাছে বসে কেউ গল্প না করলে ঘুম হয় না। আপাতত বই যখন নেই তখন তুমি একটু গল্প করবে?
এ ছাড়া আর উপায় নেই তবু নির্লিপ্তভাবে মালতী বললে, আচ্ছা।
সুব্রত তার হাত ধরল—যদিও হাত ধরার কোনো প্রয়োজনই ছিল না। এবং দুজনে একসঙ্গে ঘরে ঢুকল। সুব্রত ঘুমুবার চেষ্টা না করে বসল একটা চেয়ারে, মালতী তার বিছানায়।
আগের সহজতা যদি ফিরিয়ে আনা যেত তবে মালতী যে কাউকে মনেপ্রাণে আশীর্বাদ করত। সুব্রত বললে, ছুটি ফুরিয়ে এল। এখন না-যাওয়াকে প্রশ্রয় দিলে চলবে না।
এইবার মালতীর চমকে ওঠা অস্বাভাবিক নয়, সে বললে, কী বললেন?
–বোধ হয় পরশু চলে যাব। এখানে অনেক দিন রইলাম। জীবনে একটা পরিবর্তন হল। কয়েকটি আপনার মানুষকে চিনতে পারলাম তাদের ভালো লাগল। এখন পশ্চিম মরুভূমিতে ফিরে গিয়ে নিজের মনের সঙ্গে বোঝাপড়া হয়ত আর হবে না—ঠিক সেখানেই মুশকিল। উপায় যদি থাকত তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতাম।
হঠাৎ এ কথার কী মানে মালতী তা বোঝে। তাই অভ্যাসমতো অনির্দেশ তাকাতে লাগল–দেখল, ওপরের দিকে, ফটোতে, মেঝেতে, চারদিকে। তারপর যখন তার এই অভ্যাসের সাময়িক সমাপ্তি হল সুব্রতর সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময়ে, তখন সে একপলক হেসে বললে, ঠিক নিয়ে যাবেন তো? তাহলে বাবাকে বলি?
-বলো।
—সেখানে কিছু দেখবার আছে?