এগুলো বন্ধ। ওই দুটো কথায় যেন এক মুহূর্তে পৃথিবীটা টিপুর চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে গেল।–এগুলো বন্ধ!
আর বন্ধ যাতে হয় তার জন্য বাবাও অঙ্ক স্যারের থেকে নিয়ে বইগুলো তাঁর আলমারির তাকে ভরে ফেলে চাবিবন্ধ করে দিলেন।
মা অবিশ্যি ব্যাপারটা শুনে বেশ খানিকক্ষণ গজর গজর করেছিলেন। খাবার সময় একবার তো বলে ফেললেন, যে লোক এমন কথা বলতে পারে তাকে মাস্টার করে রাখা কেন বাপু?
বাবা পরপর তিনবার উঁহু বলে মা-কে থামিয়ে দিলেন।–তুমি বুঝছ না। উনি যা বলছেন টিপুর ভালর জন্যই বলছেন।
ছাই বলছেন। তারপর টিপুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, তুই ভাবিসনে রে। আমি বলব তোকে গল্প। তোর দিদিমার কাছ থেকে অনেক গল্প শুনেছি ছেলেবেলায়। সব তো আর ভুলিনি।
টিপু কিছু বলল না। মুশকিল হচ্ছে কি, মার কাছে টিপু এককালে অনেক গল্পই শুনেছে। তার বাইরে মা আর কিছু জানেন বলে মনে হয় না। আর জানলেও, বই পড়ার মজা মুখে শোনা গল্পে নেই। বইয়ে ডুবে যাওয়া একটা আলাদা ব্যাপার। সেখানে শুধু গল্প আর তুমি–মাঝখানে কেউ নেই। সেটা মা-কে বোঝাবে কী করে?
আরও দুদিন গেল টিপুর বুঝতে যে, এবার সত্যি-সত্যিই সে দুঃখ পাচ্ছে। গোলাপীবাবু যে দুঃখের কথা বলেছিলেন, এটা সেই দুঃখ। এবার এক উনিই যদি কিছু করতে পারেন।
আজ রবিবার। বাবা ঘুমোছেন। মা বারান্দা ছেড়ে ঘরে ঢুকে সেলাই-এর কল চালাচ্ছেন। এখন। বেজেছে সাড়ে তিনটে। এখন একবার পিছনের দরজা দিয়ে বাইরে যাওয়া যেতে পারে। লোকটা যে কেন বলে গেল না সে কোথায় থাকে! সে না এলে টিপু সটান তার বাড়িতে চলে যেতে পারত।
টিপু পা টিপে টিপে একতলায় নেমে পিছনের দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল।
চারদিকে রোদ ঝলমল করছে, কিন্তু তাও বেশ শীত শীত ভাব। দূরে ধানখেতে সোনালি রঙ ধরে আছে পাহাড়ের লাইন অবধি। একটা ঘুঘু ডেকে চলেছে একটানা, আর চিড়িক চিড়িক শব্দটা নিশ্চয়ই ওই শিরীষ গাছের বাসিন্দা কোনও একটা কাঠবেড়ালি করছে।
হ্যালো।
আরে! কী আশ্চর্য! কখন যে লোকটা এসে দাঁড়িয়েছে গাছতলায়, সেটা টিপু দেখতেই পায়নি!
তোমার কানের পিছনে নীল রঙ, হাতের তেলো খসখসে, বুঝতেই পারছি তোমার দুঃখের কারণ ঘটেছে।
তা ঘটেছে বইকী!
লোকটা এগিয়ে আসছে টিপুর দিকে। আবার সেই পোশাক। আবার মাথার চুলগুলো ফ্যূৎ করে ঝুঁটির মতো উড়ছে বাতাসে।
কী ঘটেছে সেটা বলতে হবে তো, নইলে আমি কিংকর্তব্যমতিত্ব।
টিপুর হাসি পেলেও, লোকটাকে শুধরোবার চেষ্টা না করে অঙ্ক স্যারের পুরো ব্যাপারটা সংক্ষেপে বলে ফেলল। বলতে বলতে চোখে জল এসে গেলেও মনের জোরে নিজেকে সামলে নিল টিপু।
হুঁ, বলে লোকটা ষোলোবার ধীরে ধীরে মাথা উপর-নীচ করল। টিপু ভেবেছিল আর থামবেই না; আর সেইসঙ্গে এও মনে হয়েছিল যে, লোকটা হয়তো কোনও উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। যদি না পায় তা হলে যে কী দশা হবে সেটা ভেবে টিপুর আবার চোখে জল এসে গিয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত লোকটা মাথা নাড়া থামিয়ে আবার হু বলাতে টিপুর ধড়ে প্রাণ এল।
তুমি কিছু করতে পারবে কী? টিপু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল।
ভেবে দেখতে হবে। পাকস্থলীটা খাটাতে হবে।
পাকস্থলী? কেন, তোমরা মাথা খাটাও না বুঝি?
লোকটা কোনও উত্তর না দিয়ে বলল, তোমার এই নরহরি স্যারকে কাল দেখলাম না মাঠে ঘোড়া চড়তে?
কোন মাঠে? হামলাটুনির মাঠে?
যে মাঠে ভাঙা বাড়িটা আছে।
হ্যাঁ হ্যাঁ। তুমি কি সেইখানেই থাকো?
ওই ভাঙা বাড়িটার পিছনেই আমার ট্রিডিঙ্গিপিডিটা রয়েছে।
টিপু কথাটা ঠিক করে শোনেনি নিশ্চয়ই। তবে শুনলেও সেটা যে তার জিভ দিয়ে কিছুতেই বেরোত সেটা সে জানে।
লোকটা এখনও আছে, আর আবার মাথাটা উপর-নীচ করতে আরম্ভ করেছে।
এবার একত্রিশবার নাড়াবার পর মাথা থামিয়ে লোকটা বলল, আজ ফুল মুন। তুমি যদি ব্যাপারটা দেখতে চাও, তা হলে চাঁদ যখন মাঠের মাঝখানের খেজুর গাছটার ঠিক মাথায় আসবে তখন মাঠে এসে যেও। আড়ালে থেকো; কেউ যেন দেখে না ফেলে। তারপর দেখা যাক কী করা যায়!
টিপুর হঠাৎ একটা চিন্তা মাথায় ঢুকে তাকে ভীষণ ভয় পাইয়ে দিল।
তুমি অঙ্ক স্যারকে মেরে-টেরে ফেলবে না তো?
এই প্রথম লোকটাকে হো হো করে হাসতে দেখল টিপু, আর সেইসঙ্গে দেখল লোকটার মুখের ভিতর একটার উপর আরেকটা জিভ। আর দেখল যে, লোকটার দাঁত বলে কিছু নেই।
মেরে ফেলব?–লোকটা কোনওরকমে হাসি থামাল।–উঁহু। আমরা কাউকে মারি-টারি না। একজনকে চিমটি কাটার কথা ভেবেছিলাম বলেই তো আমার নির্বাসন প্রথম ছক কেটে বেরোলো পৃথিবীর নাম, সেখানে হবে নির্বাসন; তারপর ছক কেটে বেরোলো এই শহরের নাম; তারপর তোমার নাম। তোমার দুঃখ থেকে মুক্তি দিয়েই মুক্তি।
ঠিক আছে, তা হলে–
লোকটা সেদিনের মতোই টিপুর কথা শেষ হবার আগেই কুলগাছের উপর দিয়ে হাই জাম্প করে হাওয়া।
.
টিপুর শরীরের ভিতরে সেই যে মিহি কাঁপুনি শুরু হল সেটা রইল রাত অবধি। আশ্চর্য কপাল, আজ মা বাবা দুজনেই রাত্রে নেমন্তন্ন খেতে যাবেন সুশীলবাবুদের বাড়ি। সুশীলবাবুর নাতির মুখে ভাত। টিপুরও নেমন্তন্ন ছিল, কিন্তু সামনে পরীক্ষা, তাই মা নিজেই বললেন, তোর আর গিয়ে কাজ নেই। বাড়িতে বসে পড়াশুনা কর।
সাড়ে সাতটায় বাবা বেরিয়ে গেলেন। টিপু পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করে পুব দিকটা হলদে হতে শুরু করেছে দেখে বেরিয়ে পড়ল।