আবার সেই ছিমছাম ঘর, সেই হালফ্যাশানের চেয়ার।
এবার খুশি তো? জিজ্ঞেস করলেন সুনির্মল সেন।
তা তো বটেই, বললেন অক্ষয়বাবু। কিন্তু আমার আসার কারণ হচ্ছে আপনাকে ধন্যবাদ জানান। আপনার নিপুণ হাতের ছোঁয়া যে গল্পকে আরও কত বেশি ভাল করে দিয়েছে তা বলতে পারব না।
সুনির্মলবাবু ভুরু কুঁচকে তাঁর পাশের তাক থেকে একটা বক্স ফাইল টেনে এনে টেবিলের উপর রাখলেন। তারপর তার থেকে একটা পাণ্ডুলিপি বার করে অক্ষয়বাবুর দিকে এগিয়ে দিলেন।
আমার ছোঁয়া কোথায় আছে বার করুন তো দেখি।
অক্ষয়বাবু পাণ্ডুলিপির প্রত্যেক পাতায় একবার চোখ বুলিয়ে দেখলেন কোথাও কোনও কাটাকুটি নেই।
ওটা আপনারই হাতের লেখা তো? জিজ্ঞেস করলেন সুনির্মলবাবু। ওটাই আপনি পাঠিয়েছিলেন তো?
আজ্ঞে হ্যাঁ–এটাই পাঠিয়েছিলাম। তবে হাতের লেখা আমার নয়।
তবে কার?
অক্ষয়বাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ম্লান হাসি হেসে বললেন, আমার ছেলের।
শুকতারা, শারদীয়া ১৩৯৭
অঙ্ক স্যার, গোলাপীবাবু আর টিপু
টিপু ভূগোলের বইটা বন্ধ করে ঘড়ির দিকে দেখল। সাতচল্লিশ মিনিট পড়া হয়ে গেছে একটানা। এখন তিনটে বেজে তেরো মিনিট। এবার যদি ও একটু ঘুরে আসে তা হলে ক্ষতি কী? ঠিক এমনি সময় তো
সেদিন লোকটা এসেছিল। সে তো বলেছিল টিপুর দুঃখের কারণ হলে তবে আবার আসবে। তা হলে? কারণ তো হয়েছে। বেশ ভাল রকমই হয়েছে। যাবে নাকি একবার বাইরে?
নাঃ। মা বারান্দায় বেরিয়েছেন কীসের জন্য জানি। হুস করে একটা কাগ তাড়ালেন এক্ষুনি। তারপর ক্যাঁচ শব্দটায় মনে হল বেতের চেয়ারটায় বসলেন। বোধহয় রোদ পোয়াচ্ছেন। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে।
লোকটার কথা মনে পড়ছে টিপুর। এমন লোক টিপু কোনওদিন দেখেনি। ভীষণ বেঁটে, গোঁফদাড়ি নেই, কিন্তু বাচ্চা নয়। বাচ্চাদের এমন গম্ভীর গলা হয় না। তা হলে লোকটা বুড়ো কী? সেটাও টিপু বুঝতে পারেনি। চামড়া কুঁচকোয়নি কোথাও। গায়ের রঙ চন্দনের সঙ্গে গোলাপি মেশালে যেমন হয় তেমনই। টিপু মনে মনে ওকে গোলাপীবাবু বলেই ডাকে। লোকটার আসল নাম টিপু জানে না। জানতে চেয়েছিল, কিন্তু লোকটা বলল, কী হবে জেনে? আমার নাম উচ্চারণ করতে তোমার জিভ জড়িয়ে যাবে।
টিপু বেশ রেগে গিয়েছিল। কেন, জড়িয়ে যাবে কেন? আমি প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব বলতে পারি, কিংকর্তব্যবিমূঢ় বলতে পারি, এমনকী ফ্লকসিনসিনিহিলিপিলিফিকেশন বলতে পারি, আর তোমার নাম বলতে পারব না? তাতে লোকটা বলল, একটা জিভে আমার নাম উচ্চারণ হবে না।
তোমার বুঝি একটার বেশি জিভ আছে? জিজ্ঞেস করেছিল টিপু।
বাংলা বলতে একটার বেশি দরকার হয় না।
বাড়ির পিছনে যে নেড়া শিরীষ গাছটা আছে, তারই নীচে দাঁড়িয়ে ছিল লোকটা। এদিকটা বড় একটা কেউ আসে না। শিরীষ গাছটার পিছনে খোলা মাঠ, তারও পিছনে ধান খেত, আর তারও অনেক, অনেক পিছনে পাহাড়ের সারি। কদিন আগেই টিপু এদিকটায় এসে একটা ঝোঁপের ধারে একটা বেজিকে ঘোরাফেরা করতে দেখেছিল। আজ হাতে কিছু পাঁউরুটির টুকরো নিয়ে এসেছিল ঝোঁপটার ধারে ছড়িয়ে দেবার জন্য, যদি তার লোভে বেজিটা আবার দেখা দেয়। এমন সময় হঠাৎ চোখ পড়ল গাছতলায় দাঁড়ানো লোকটার দিকে। চোখাচুখি হতেই লোকটা ফিক করে হেসে বলল, হ্যালো।
সাহেব নাকি? সাহেব হলে কথা বলে বেশিদূর এগোনো যাবে না, তাই টিপু কিছুক্ষণ কিছু না বলে লোকটার দিকে তাকিয়ে ছিল। এবার লোকটাই ওর দিকে এগিয়ে এসে বলল, তোমার কোনও দুঃখ আছে?
দুঃখ?
দুঃখ।
টিপু তো অবাক! এমন প্রশ্ন তাকে কেউ কোনওদিন করেনি। সে বলল, কই না তো। দুঃখ তো নেই।
ঠিক বলছ?
বা রে, ঠিক বলব না কেন?
তোমার তো দুঃখ থাকার কথা। হিসেব করে তো তাই বেরোলো।
কীরকম দুঃখ? ভেবেছিলাম বেজিটাকে দেখতে পাব, কিন্তু পাচ্ছি না। সেরকম দুঃখ?
উঁহু উঁহু। যে-দুঃখে কানের পিছনটা নীল হয়ে যায়, হাতের তেলো শুকিয়ে যায়, সেরকম দুঃখ।
মানে ভীষণ দুঃখ?
হ্যাঁ।
না, সেরকম দুঃখ নেই।
লোকটা এবার নিজে দুঃখ ভাব করে মাথা নেড়ে বলল, নাঃ, তা হলে এখনও মুক্তি নেই।
মুক্তি?
মুক্তি। ফ্রিডম।
ফ্রিডম মানে মুক্তি সেটা আমি জানি, বলল টিপু। আমার দুঃখ হলে বুঝি তোমার মুক্তি হবে?
লোকটা টিপুর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে বলল, তোমার বয়স সাড়ে দশ?
হ্যাঁ, বলল টিপু।
আর নাম শ্রীমান তর্পণ চৌধুরী?
হ্যাঁ।
তা হলে কোনও ভুল নেই।
লোকটা যে ওর বিষয়ে এত খবর পেল কোত্থেকে, সেটা টিপু বুঝতে পারল না। টিপু বলল, শুধু আমার দুঃখ হলেই তোমার মুক্তি? আর কারুর দুঃখে নয়?
দুঃখে মুক্তি নয়, দুঃখ দূর করলে তবে মুক্তি।
কিন্তু দুঃখ তো অনেকের আছে। আমাদের বাড়িতে নিকুঞ্জ ভিখিরি এসে একতারা বাজিয়ে গান গায়। সে বলে তার তিন কুলে কেউ নেই। তার তো খুব দুঃখ।
তাতে হবে না, লোকটা মাথা নেড়ে বলল। তর্পণ চৌধুরী, বয়স সাড়ে দশ–এখানে তুমি ছাড়া আর কেউ আছে?
বোধহয় না।
তবে তোমাকেই চাই।
এবার টিপু একটা কথা জিজ্ঞেস না করে পারল না।
তুমি কীসের থেকে মুক্তির কথা বলছ? তুমি তো দিব্যি চলেফিরে বেড়াচ্ছ।
এটা আমার দেশ নয়। এখানে তো আমায় নির্বাসন দেওয়া হয়েছে।
কেন?
অত জানার কী দরকার তোমার?
বা রে, একজন লোকের সঙ্গে আলাপ হল, আর তার বিষয় জানতে ইচ্ছা করবে না? তুমি কোথায় থাকো, কী করো, কী নাম তোমার, আর কে কে চেনে তোমাকে সব জানতে ইচ্ছা করছে আমার।