মিস্টার ব্যানার্জির ডানহাতটা ধীরে ধীরে তাঁর কোটের ভেস্ট পকেটের দিকে চলে গেল। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই যেন ম্যাজিকের মতো আমার কাছে ব্যাপারটা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গিয়ে আমার মন থেকে সমস্ত ভয় দূর করে দিল। বললাম, আপনার পিস্তলের দরকার নেই মশাই–এটা সেই কালো বেড়ালটা।
আমার কথায় অনীকও যেন ভরসা পেল। ব্যানার্জি পকেট থেকে তাঁর হাত বার করে এনে চাপা গলায় বললেন, হাউ রিডিকুলাস।
এবার জ্বলন্ত চোখ দুটো আমাদের ঘরের দিকে এগিয়ে এল। চৌকাঠ পেরোতেই মোমবাতির আলোতে প্রমাণ হল আমার কথা। এটা সেই কালো বেড়ালটাই বটে!
চৌকাঠ পেরিয়ে বেড়ালটা বাঁ দিকে ঘুরল। আমাদের দৃষ্টি তার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছে, তাকে অনুসরণ করছে।
এবারে আমাদের তিনজনের গলা দিয়ে একসঙ্গে একটা শব্দ বেরিয়ে পড়ল। আচমকা বিস্ময়ের ফলে যে-শব্দ আপনা থেকেই মানুষের মুখ থেকে বেরোয়–এ সেই শব্দ। এই শব্দের কারণ আর কিছুই না–আমরা যতক্ষণ তন্ময় হয়ে তাস খেলেছি তারই ফাঁকে কীভাবে কোত্থেকে জানি একটা গাঢ় লাল মখমলে মোড়া হাই ব্যান্ড চেয়ার এসে ফায়ার প্লেসের পাশে তার জায়গা করে নিয়েছে।
অমাবস্যার রাতের অন্ধকারের মতো কালো বেড়ালটা চেয়ারটার দিকে নিঃশব্দে এগিয়ে গেল। তারপর এক মুহূর্ত সেটার সামনে দাঁড়িয়ে একটা নিঃশব্দ লাফে সেটার ওপর উঠে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়ল। আর সেই মুহূর্তে একটা অদ্ভুত শব্দ শুনে আমার রক্ত হিম হয়ে গেল। কোনও এক অশরীরী বৃদ্ধের খিলখিলে হাসির ফাঁকে ফাঁকে বারবার উচ্চারিত হচ্ছে–সাইমন সাইমন সাইমন সাইমন–আর তার সঙ্গে ছেলেমানুষি খুশি হওয়া হাততালি।
একটা আর্তনাদ শুনে বুঝলাম অনীক অজ্ঞান হয়ে গেছে। আর মিস্টার ব্যানার্জি? তিনি অনীককে কোলপাঁজা করে তুলে ঊর্ধ্বশ্বাসে প্যাসেজ দিয়ে দরজার দিকে ছুটছেন।
আমিও আর থাকতে পারলাম না। তাস মোমবাতি ফ্লাস্ক চাদর স্যান্ডউইচ সব পড়ে রইল। দরজা পেরিয়ে মাঠ, মাঠ পেরিয়ে গেট, গেট পেরিয়ে ব্যানার্জির মরিস মাইনর।
ভাগ্যে ব্যাঙ্গালোরের রাস্তায় লোক চলাচল কম, নইলে আজ একটিমাত্র পাগলা গাড়ির পাগলা ছুটে কটা লোক যে জখম হতে পারত তা ভাবলেও গায়ে কাঁটা দেয়।
অনীকের জ্ঞান গাড়িতেই ফিরে এসেছিল, কিন্তু তার মুখে কোনও কথা নেই। প্রথম কথা বললেন মিস্টার ব্যানার্জি। অনীকের বেয়ারার হাত থেকে ব্র্যান্ডির গেলাসটা ছিনিয়ে নিয়ে এক ঢোকে অর্ধেকটা নামিয়ে দিয়ে ঘড়ঘড়ে চাপা গলায় বলে উঠলেন, সসা সাইমন ওয়াজ এ ক্যাট।
আমার নিজেরও কিছুই বলার অবস্থা নেই, কিন্তু আমার মন তাঁর কথায় সায় দিল।
সত্যিই, ব্রাউন সাহেবের বুদ্ধিমান, খামখেয়ালি, অভিমানী, অনুগত, আদরের সাইমন–যার মৃত্যু হয় বজ্রাঘাতে আজ থেকে একশো তেরো বছর আগে–সেই সাইমন ছিল আমাদের আজকের দেখা একটি পোষা কালো বেড়াল!
সন্দেশ, আষাঢ়-শ্রাবণ ১৩৭৮
জয়ন্ত নন্দী : ছোটদের পত্রিকা হাউই-এর সম্পাদক
তরুণ সান্যাল : জয়ন্তর বন্ধু
তিনকড়ি ধাড়া : হাউই-এর দপ্তরের কর্মচারী। কাজ–বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করা
তন্ময় সেনগুপ্ত : লেখক
মুকুল : দপ্তরের কর্মচারী
ধনঞ্জয়/আলম : দপ্তরের বেয়ারা
অর্দ্বেন্দু রায় : জনৈক গ্রাহকের বাবা
.
বালিগঞ্জে ছোটদের পত্রিকা হাউই-এর দপ্তর। ঘরের মাঝখানে একটা টেবিল–তার পিছনে একটা চেয়ারে সম্পাদক জয়ন্ত নন্দী বসে আছে। জয়ন্তর বয়স বছর ৩৫। তার উলটোদিকে দুটো চেয়ারের মধ্যে একটায় তার বন্ধু তরুণ সান্যাল হাতে একটি সিগারেট নিয়ে বসে। ঘরের একপাশে দেখা যাচ্ছে বেয়ারা আলম নতুন হাউই পত্রিকা ডাকে দেবার জন্য সেগুলো ব্রাউন কাগজের প্যাকেটে ভরছে। পিছন দিকে মঞ্চের মাঝখানে একটা বন্ধ দরজা, তার পিছনেও একটা ঘর আছে বোঝা যায়। বন্ধ দরজার পাশে একটা খালি চেয়ার। জয়ন্ত আর তরুণের সামনেই চায়ের পেয়ালা। তরুণ তার কাপে চুমুক দিয়ে সিগারেটে একটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে।
তরুণ ॥ তা হলে তোদের অবস্থা বেশ ভালই বলছিস?
জয় ॥ তা ভাই তেরো হাজার সাবস্ক্রিপশন, স্টল থেকে হাজার চারেক বিক্রি হয়–খারাপ আর কী করে বলি বল। আর বিজ্ঞাপন থেকেই খরচা উঠে আসে। এ মাসে তো চারখানা রঙিন বিজ্ঞাপন আছে, তার মধ্যে দুটো রেগুলার আর দুটো অকেশনাল। ছাপাও খারাপ হচ্ছে না। আগের প্রেসটা সুবিধের ছিল না। গত বৈশাখ থেকে প্রেস বদলেছি–এখন বেশ ঝরঝরে হয়েছে। এই যে দেখ না—
জয়ন্ত একটা পত্রিকা টেবিলের উপর থেকে তুলে তরুণকে দেয়। তরুণ সেটা উলটেপালটে দেখে।
জয়ন্ত ॥ তোর তো লেখার হাত বেশ ভাল ছিল। একটা লেখ না আমাদের কাগজের জন্য।
তরুণ ॥ পয়সা দিচ্ছিস লেখকদের?
জয় ॥ তা দিচ্ছি বই কী। নেহাত খারাপ নয়। একটা গল্পের জন্য একশো টাকা। উপন্যাস হলে ফাইভ হান্ড্রেড। অবিশ্যি লেখক নতুন না নামী তার উপর রেট খানিকটা নির্ভর করছে।
তরুণ ॥ নামটিও কাগজের ভাল হয়েছে। হাউই। ভেরি অ্যাট্রাকটিভ।
জয়ন্ত ॥ এই পুজোর জন্য একটা উপন্যাস পেয়েছি–সম্পূর্ণ অপরিচিত লেখক নাম নবারুণ চট্টোপাধ্যায়। তোকে বলছি এমন ট্যালেন্টেড লেখক সচরাচর চোখে পড়ে না। আমি তো পড়ে তাজ্জব। ভদ্রলোক থাকেন আবার বাগবাজারেনা হলে একবার ডেকে এনে আলাপ করার ইচ্ছে ছিল।