যে বাড়িতে রয়েছেন, সেটা কার?
ওটা আমার ঠাকুরদা তৈরি করেছিলেন। উনি ব্যবসা করতেন, অনেক পয়সা করেছিলেন। মারা যাবার আগে তিন ছেলেকে উইল করে টাকা সমান ভাগে ভাগ করে দিয়ে যান। কাজেই ব্ৰজ জ্যাঠার। টাকার অভাব নেই।
উনি কি তন্ত্র-টন্ত্র চর্চা করেছেন নাকি?
কী যে করেছেন তা কেউ সঠিক বলতে পারবে না। আমরা থাকতাম লখনৌয়ে, মেজো জ্যাঠার কাজ ছিল ব্যাঙ্গালোরে। ব্ৰজ জ্যাঠা কলকাতাতেই থাকতেন, তবে গোটা তিনেক চাকর ছাড়া দেখবার আর কেউ ছিল না। তন্ত্রের ব্যাপার জানি না, তবে ওঁর যে মানসিক ব্যারাম রয়েছে তাতে অন্তত আমার কোনও সন্দেহ নেই। কথা হচ্ছে–কী ব্যারাম?
সেটা এখনও ধরতে পারেননি?
ধরব কী করে? আমার সঙ্গে তো কথাই বলছেন না।…তবে আমার একটা প্রস্তাব আছে।
কী?
ওঁর চাকর বলছিল উনি নাকি ছোটদের উপর কখনও রাগ করেন না। তাই ভাবছিলাম, যদি আপনার ছেলেকে একবার সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারি, তা হলে হয়তো উনি মুখ খুলতে পারেন।
সুবু বলল, ওঁর একটা সবুজ বাক্স আছে কি?
অমিতাভবাবু চোখ বড় বড় করে বললেন, বাক্স মানে কী–সে তো এক বিশাল ট্রাঙ্ক। আমি ওঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ওতে কী আছে। উনি কোনও জবাবই দিলেন না।
শঙ্করবাবু বললেন, ঠিক আছে। আমার ছেলে যাবে; কিন্তু তার সঙ্গে তার বাবাও যাবে।
নিশ্চয়ই। সে তো খুব ভাল কথা। আমি খানিকটা জোর পাব।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে তিনজনে বেরিয়ে পড়ল। ব্রজবুডোর বাড়ির দরজায় ধাক্কা দিতেই একটা বুড়ো চাকর এসে দরজা খুলে দিল। বাবু কোথায়? জিজ্ঞেস করলেন অমিতাভবাবু।
দোতলায় শোবার ঘরে, বলল চাকর।
আজ বাইরে বসবেন না?
আজ্ঞে, আপনি আসার পর থেকেই উনি কেমন যেন হয়ে গেছেন। আজ বিকেলে চাও খেলেন না।
ঠিক আছে। আমরা ওঁর সঙ্গে একটু দেখা করব। আসুন মিস্টার—
চৌধুরী।
তিনজনে দোতলায় গিয়ে হাজির হল। ডান দিকে একটা দরজা, সেটাই ব্রজবুডোর শোবার ঘর। ডাঃ ব্যানার্জির পিছন পিছন শঙ্করবাবু আর সুবুও ঘরে ঢুকল।
ব্রজবুড়ো বালিশে পিঠ দিয়ে খাটে আধশোয়া। সুবুকে দেখেই তাঁর মুখে হাসি ফুটে উঠে সঙ্গে সঙ্গেই মিলিয়ে গেল।
তোমার সঙ্গে আবার এঁরা কেন? অভিমানের সুরে বললেন ব্রজবুড়ো।
সুবু বলল, আপনি সবুজ বাক্সটার কথা বলেছিলেন–সেটা দেখতে এলাম।
প্রকাণ্ড সবুজ ট্রাঙ্কটা সুবু ঘরে ঢুকেই দেখেছিল। খাটের উলটোদিকে দেয়ালের সামনে রাখা হয়েছে। বোঝাই যায় আদ্যিকালের ট্রাঙ্ক।
নিশ্চয়ই দেখাব, বললেন ব্রজবুড়ো। কিন্তু এখন না। এঁরা ঘর থেকে বেরোলে দেখাব।
ডাঃ ব্যানার্জি শঙ্করবাবুকে বললেন, চলুন মিস্টার চৌধুরী–আমরা পাশের ঘরে যাই। দুজন বেরিয়ে যেতে বুড়োর মুখে আবার হাসি ফুটল। সুবুর বুকের ভিতর আবার ধুকপুকুনি।
ব্রজবুড়ো খাট থেকে নেমে ট্যাঁক থেকে একটা চাবি বার করে ট্রাঙ্কটা খুলে ডালাটা উপরে তুলে দিলেন।
দ্যাখো!
এ কী! এ যে খেলনায় ভর্তি! রেলগাড়ি, বন্দুক, রাক্ষসের মুখোশ, বিল্ডিং ব্লক্স, মেকানো, লুডো, লটো, করতাল বাজানো সং, খেলার ড্রাম, খেলার গ্রামোফোন, তা ছাড়া আরও কত খেলা যেসব সুবু কোনওদিন চোখেই দেখেনিনাম শোনা তো দূরের কথা।
এগুলো কার? সুবু ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করল। ব্রজবুড়ো দুহাত মাথার উপর তুলে তুড়ি বাজিয়ে দুলিয়ে গান করছিলেন–আমি রামখেল তিলক সিং, তাই নাচি তিড়িং তিড়িং-এবার গান বন্ধ করে নিজের বুকে চাপড় মেরে চেঁচিয়ে উঠলেন–আমার!
সুবু বুঝল এই খেলার বন্দুকের আওয়াজ শুনেই পাশের বাড়ির লোক ভেবেছে পিস্তল, ওই মুখোশ পরে বুড়ো জানলায় দাঁড়াতেই ভেবেছে রাক্ষস, আর এই সব খেলনার নানারকম আওয়াজ শুনেই ভেবেছে বুড়ো তুকতাক করছে।
সুবু বলল, বাবা আর ডাক্তারবাবুকে ডাকি?
ওরা যদি আমার খেলনা নিয়ে নেয়? বুড়ো কর্কশ গলায় চেঁচিয়ে উঠল।
মোটেই নেবে না। ওরা খুব ভাল লোক। আপনার কোনও অনিষ্ট করবে না।
তবে ডাকো।
দুজনে এলেন। ট্রাঙ্কের ডালা এখনও খোলা।
অমিতাভ ব্যানার্জি ভিতরের জিনিসগুলো দেখে চাপা গলায় বললেন, সব ব্রিটিশ আমলের বিলিতি খেলনা। ওঁর নিজের ছেলেবেলার জিনিস। এর জুড়ি আজকাল আর এদেশে পাওয়া যাবে না।
তারপর ব্রজবুড়োর দিকে চেয়ে বললেন, আপনি বসুন জ্যাঠা, বসুন। আমরা আপনার ভাল করতেই এসেছি।
যে ভাল রয়েছে, তাকে আবার ভাল করবে কী? কড়া সুরে জিজ্ঞেস করলেন ব্রজ বুড়ো।
ঠিক বলেছেন, বললেন ডাঃ ব্যানার্জি। আমি ভুল বলেছিলাম। আপনার কোনও চিন্তা নেই। আমি কালকেই চলে যাব।
যাবে বইকী, নিশ্চয়ই যাবে।
অমিতাভ ব্যানার্জির সঙ্গে সুর আর শঙ্করবাবু নীচে নেমে এলেন। এও একরকম মনের ব্যারাম, জানেন তো? বললেন ডাঃ ব্যানার্জি। শরীরে বার্ধক্যের পুরো ছাপ, কিন্তু মন সেই বালক অবস্থার পরে আর বাড়েনি। বড়দের তাই সহ্য করতে পারেন না; নিজের বয়সের সাথী খোঁজেন। অথচ কোনও ছেলে। ওঁর কাছে যাবে না। কী করুণ অবস্থা ভেবে দেখুন তো?
আপনি সত্যিই কাল চলে যাবেন? শঙ্করবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
হ্যাঁ। আমি গেলে উনি ভাল থাকবেন। তা ছাড়া এই ব্যারামের চিকিৎসা বলে তো কিছু নেই।
শঙ্করবাবু ছেলের পিঠে হাত রেখে বললেন, তুই মাঝে মাঝে ব্রজবুড়োকে সঙ্গ দিস। তোর বন্ধুদেরও বলিস।
সুবুরা অমিতাভবাবুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি ফেরার উদ্যোগ করল। দোতলার ঘর থেকে তখন করতালের সঙ্গে সঙ্গে শোনা যাচ্ছে–