তিরুমালাই গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, এ পর্যন্ত চারজন শিকারি প্রাণীটির সন্ধানে গিয়েছিল। প্রথম তিনজন বিফল হয়ে ফিরে এসেছেন। চতুর্থজন ফেরেননি।
ফেরেননি?
না। তারপর থেকে আর কেউ যেতে চাচ্ছে না। আপনারাও যাবেন কি না সেটা ভাল করে ভেবে দেখুন।
প্রদ্যোতবাবুর গলা শুকিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তুলসীবাবুর শান্ত ভাব দেখে তিনি জোর করে মনে সাহস ফিরিয়ে আনলেন। বললেন, আমরা তাও যাব।
.
এবারে হাঁটতে হল আরও বেশি, কারণ ট্যাক্সিওয়ালা মেন রোড ছেড়ে বনের ভেতরের রাস্তা দিয়ে যেতে রাজি হল না। তুলসীবাবুর দৃঢ় বিশ্বাস ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে কাজ হয়ে যাবে; পঞ্চাশ টাকা বকশিশ দেওয়া হবে শুনে ট্যাক্সি সেই সময়টুকুর জন্য অপেক্ষা করতে রাজি হল। দুই বন্ধু গাড়ি থেকে নেমে বনের সেই বিশেষ অংশটির উদ্দেশে রওনা দিলেন।
বসন্তকাল, তাই বনের চেহারা বদলে গেছে, গাছপালা সবই ঋতুর নিয়ম মেনে চলছে। কচি সবুজে চারদিক ছেয়ে গেছে। কিন্তু আশ্চর্য এই যে পাখির ডাক একেবারেই নেই। কোয়েল দোয়েল পাপিয়া কবিদের একচেটিয়া বসন্তের পাখি সব গেল কোথায়?
তুলসীবাবুর কাঁধে এবারও তাঁর ঝোলা। তাতে একটি খবরের কাগজের মোড়ক রয়েছে সেটা প্রদ্যোতবাবু জানেন, যদিও তাতে কী আছে জানেন না। তুলসীবাবু ভোরে উঠে বেরিয়েছিলেন, কিন্তু কোথায় গিয়েছিলেন সেটা জিজ্ঞেস করা হয়নি। প্রদ্যোতবাবুর নিজের সঙ্গে রয়েছে তাঁর বন্দুক ও টোটা।
গতবারের তুলনায় আগাছা কম থাকাতে বনের মধ্যে দৃষ্টি অনেক দূর পর্যন্ত যাচ্ছে। তাই একটা। দেবদারু গাছের পিছনে উপুড় হওয়া পা ছড়ানো মানুষের দেহটাকে বেশ দূর থেকেই দেখতে পেলেন প্রদ্যোতবাবু। তুলসীবাবু দেখেননি। প্রদ্যোতবাবু থেমে ইশারা করায় তাঁকে থামতে হল।
প্রদ্যোতবাবু বন্দুকটাকে শক্ত করে বাগিয়ে ধরে এগিয়ে গেলেন দেহটার দিকে। তুলসীবাবুর ভাব দেখে মনে হল এ ব্যাপারে তাঁর বিশেষ কৌতূহল নেই।
অর্ধেক পথ গিয়ে প্রদ্যোতবাবু ফিরে এলেন।
আপনি ফ্যাকাশে হয়ে গেলেন যে মশাই, বললেন তুলসীবাবু, এ তো সেই চতুর্থ শিকারি? তাই হবে, ধরা গলায় বললেন প্রদ্যোতবাবু, তবে লাশ শনাক্ত করা মুশকিল হবে। মুণ্ডুটাই নেই।
বাকি পথটা দুজনে কেউই কথা বললেন না।
সেই নিম গাছটার কাছে পৌঁছতে লাগল এক ঘণ্টা, অর্থাৎ মাইল তিনেক হাঁটতে হয়েছে। প্রদ্যোতবাবু দেখলেন চক্ৰপর্ণের গাছটা ডালপাতা গজিয়ে আবার আগের চেহারায় এসে দাঁড়িয়েছে।
চঞ্চু! চঞ্চু!
প্রদ্যোতবাবুর এই সংকট মুহূর্তেও হাসি পেল। কিন্তু তার পরেই মনে হল তুলসীবাবুর পক্ষে এটাই স্বাভাবিক। এই রাক্ষুসে পাখি যে তাঁর পোষ মেনেছিল সেটা তো তিনি নিজেই দেখেছেন।
বনের পুবদিকে পাহাড় থেকে বার বার তুলসীবাবুর ডাক প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।
চঞ্চু! চঞ্চু! চঞ্চু!
মিনিট পাঁচেক ডাকার পর প্রদ্যোতবাবু দেখলেন যে বেশ দূরে, গাছপালা ঝোঁপঝাড়ের ফাঁক দিয়ে একটা কী যেন তাঁদেরই দিকে এগিয়ে আসছে, এবং এতই দ্রুত গতিতে যে তার আয়তন প্রতি মুহূর্তেই বেড়ে চলেছে।
এবার আর সন্দেহের কোনও কারণ নেই। ইনিই সেই ভয়াল পাখি।
প্রদ্যোতবাবু অনুভব করলেন তাঁর হাতের বন্দুকটা হঠাৎ যেন ভারী বলে মনে হচ্ছে। প্রয়োজনে ওটা ব্যবহার করতে পারবেন কি?
চঞ্চু গতি কমিয়ে একটা ঝোঁপ ভেদ করে বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে এল।
অ্যান্ড্যালগ্যালর্নির্স। নামটা মনে থাকবে প্রদ্যোতবাবুর। মানুষের সমান উঁচু পাখি। উটপাখিও লম্বা হয়, তবে সেটা প্রধানত তার গলার জন্য। এ পাখির পিঠই তুলসীবাবুর মাথা ছাড়িয়ে গেছে। অর্থাৎ একমাসে পাখি উচ্চতায় বেড়েছে প্রায় দেড় ফুট। গায়ের রঙও বদলেছে। বেগুনির উপর কালোর ছোপ ধরেছে। আর জ্বলন্ত হলুদ চোখের ওই দৃষ্টি পাখির খাঁচাবন্দি অবস্থায় প্রদ্যোতবাবুর সহ্য করতে অসুবিধা হয়নি, কিন্তু এখন সে-চোখের দিকে চাওয়া যায় না। পাখির দৃষ্টি সটান তার প্রাক্তন মালিকের দিকে।
পাখি কী করবে জানা নেই। তার স্থির নিশ্চল ভাব আক্রমণের আগের অবস্থা হতে পারে মনে করেই বোধ হয় প্রদ্যোতবাবুর কাঁপা হাতে ধরা বন্দুকটা খানিকটা উঁচিয়ে উঠেছিল। ওঠামাত্র পাখির দৃষ্টি বন্দুকের দিকে ঘুরল আর তার পরমুহূর্তেই প্রদ্যোতবাবু শিউরে উঠলেন দেখে যে পাখির গায়ের প্রত্যেকটি পালক উঁচিয়ে উঠে তার আকৃতি আরও শতগুণে ভয়াবহ করে তুলেছে।
ওটা নামিয়ে ফেলুন, চাপা ধমকের সুরে বললেন তুলসীবাবু।
প্রদ্যোতবাবুর হাত নেমে এল, আর সেই সঙ্গে পাখির পালকও নেমে এল। তার দৃষ্টিও আবার ঘুরে গেল তুলসীবাবুর দিকে।
তোর পেটে জায়গা আছে কি না জানি না, তবে আমি দিচ্ছি বলে যদি খাস।
তুলসীবাবু ঝোলা থেকে ঠোঙাটা আগেই বার করেছিলেন, এবার তাতে একটা ঝাঁকুনি দেওয়াতে একটি বেশ বড় মাংসের খণ্ড ছিটকে বেরিয়ে পাখিটার সামনে গিয়ে পড়ল।
অনেক লজ্জা দিয়েছিস আমাকে, আর দিসনি।
প্রদ্যোতবাবু অবাক হয়ে দেখলেন যে পাখিটা ঘাড় নিচু করে ঠোঁট দিয়ে মাটি থেকে মাংসখণ্ড তুলে নিয়ে তার মুখে পুরল।
এবার সত্যিই গুডবাই।
তুলসীবাবু ঘুরলেন। প্রদ্যোতবাবু চট করে পাখির দিকে পিঠ করার সাহস না পেয়ে কিছুক্ষণ পিছু হাঁটলেন। তারপর পাখি এগোচ্ছে না বা আক্রমণ করার কোনও লক্ষণ দেখাচ্ছে না দেখে ঘুরে গিয়ে স্বাভাবিক ভাবে হাঁটা শুরু করলেন।