তুলসীবাবু জানালেন সেই পাতার রস খাবার পর থেকে তাঁর রক্তের চাপ একদম স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এটা আর বললেন না যে যদ্দিন পাখি ছিল তদ্দিন চক্রপৰ্ণের গুণ পরীক্ষা করার কথা তাঁর মনেই আসেনি। এই সবে দিন দশেক হল তিনি আবার কবিরাজিতে মন দিয়েছেন।
ভাল কথা, বললেন প্রদ্যোতবাবু, চক্রপর্ণ বলতে মনে পড়ল–আজ কাগজে দণ্ডকারণ্যের খবরটা পড়েছেন?
কী খবর?
তুলসীবাবু কাগজ রাখেন, কিন্তু সামনের পাতার বেশি আর এগোনো হয় না। কাগজটা হাতের কাছেই টেবিলের উপর ছিল। প্রদ্যোতবাবু খবরটা বার করে দিলেন। বেশ বড় হরফেই শিরোনাম রয়েছে–দণ্ডকারণ্যের বিভীষিকা।
খবরে বলছে গত দশ দিন ধরে দণ্ডকারণ্যের আশেপাশে অবস্থিত গ্রাম থেকে নানারকম গৃহপালিত পশু, হাঁস, মুরগি ইত্যাদি কোনও এক জানোয়ারের খাদ্যে পরিণত হতে শুরু করেছে। দণ্ডকারণ্যে বাঘের সংখ্যা কমই, আর এ যে বাঘের কীর্তি নয় তারও প্রমাণ পাওয়া গেছে। বাঘ খাদ্য টেনে নিয়ে যায়; এ জানোয়ার তা করে না। তা ছাড়া আধ-খাওয়া গোরু বাছুর ইত্যাদি দেখে বাঘের কামড়ের সঙ্গে এ জানোয়ারের কামড়ের পার্থক্য ধরা পড়ে। মধ্যপ্রদেশ সরকার কর্তৃক নিয়োজিত দুজন বাঘা শিকারি এক সপ্তাহ অনুসন্ধান করেও এমন কোনও জানোয়ারের সন্ধান পাননি যার পক্ষে এমন হিংস্র আচরণ সম্ভব। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে গ্রামবাসীদের মধ্যে বিষম আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। একজন গ্রামবাসী দাবি করে সে নাকি একরাত্রে তার গোয়াল থেকে একটি দ্বিপদবিশিষ্ট জীবকে ঝড়ের বেগে পালাতে দেখেছে। তারপরই সে তার গোয়ালে গিয়ে তার মহিষকে মৃত অবস্থায় দেখতে পায়। মহিষের তলপেটের বেশ খানিকটা অংশ নাকি খুবলে নেওয়া হয়েছিল।
তুলসীবাবু খবর পড়ে কাগজটা ভাঁজ করে আবার টেবিলের উপর রেখে দিলেন।
এটাও কি আপনার কাছে অবাক কাণ্ড বলে মনে হচ্ছে না? প্রদ্যোতবাবু প্রশ্ন করলেন।
তুলসীবাবু মাথা নাড়লেন। অর্থাৎ তিনি বিস্মিত হননি।
.
এর তিনদিন পর প্রদ্যোতবাবুর জীবনে একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটে গেল।
সকালে চায়ের কাপ এনে সামনে রাখলেন গিন্নী, সঙ্গে প্লেটে নতুন প্যাকেট থেকে বার করা তিনখানা ডাইজেসটিভ বিস্কুট। সেদিকে চোখ পড়তেই প্রদ্যোতবাবু হঠাৎ কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন।
আর তার পরেই তাঁর হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল।
মিনিবাসে করে একডালিয়া রোডে তাঁর কলেজের বন্ধু অনিমেষের কাছে যখন পৌঁছলেন তখন তাঁর নাড়ী চঞ্চল।
বন্ধুর হাত থেকে খবরের কাগজটা ছিনিয়ে পাশে ফেলে দিয়ে রুদ্ধশ্বাসে বললেন, তোর রিডার্স ডাইজেস্টগুলো কোথায় চট করে বল–বিশেষ দরকার।
অন্য অনেকের মতোই অনিমেষ সরকারের প্রিয় পাঠ্য পুস্তক হল রিডার্স ডাইজেস্ট পত্রিকা। বন্ধুর আচরণে বিস্ময় প্রকাশ করারও সময় পেলেন না তিনি। উঠে গিয়ে বুকশেলফের তলার তাক থেকে এক গোছা পত্রিকা বার করলেন টেনে।
কোন মাসেরটা চাচ্ছিস?
ঝড়ের বেগে এ সংখ্যা ও সংখ্যা উলটে দেখে অবশেষে যা খুঁজছিলেন তা পেলেন প্রদ্যোতবাবু।
এই চেহারা–এগজ্যাক্টলি!
একটি পাখির ছবির উপর আঙুল রেখেছেন প্রদ্যোতবাবু। জ্যান্ত পাখি নয়। শিকাগো ন্যাচরেল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে রাখা একটি পাখির আনুমানিক মূর্তি। হাতে বুরুশ নিয়ে মূর্তিটিকে পরিষ্কার করছে মিউজিয়ামের এক কর্মচারী।
অ্যান্ডালগ্যালর্নির্স, নামটা পড়ে বললেন প্রদ্যোতবাবু। অর্থাৎ টেরর বার্ড–ভয়াল পাখি। আয়তন বিশাল, মাংসাশী, ঘোড়ার চেয়েও দ্রুতগামী, আর অসম্ভব হিংস্র।
প্রদ্যোতবাবুর মনে যে সন্দেহটা উঁকি দিয়েছিল সেটা সত্যি বলে প্রমাণ হল যখন পরদিন তুলসীবাবু আপিসে এসে বললেন যে তাঁকে আরেকবারটি দণ্ডকারণ্যে যেতে হবে, এবং তিনি খুব খুশি হবেন যদি প্রদ্যোতবাবু তাঁর সঙ্গে যান। হাতিয়ার সমেত। ট্রেনে রিজার্ভেশন পাওয়া মুশকিল হতে পারে, কিন্তু তাতে পেছপা হলে চলবে না, ব্যাপারটা অত্যন্ত জরুরি।
প্রদ্যোতবাবু রাজি হয়ে গেলেন।
অ্যাডভেঞ্চারের উৎসাহে দুই বন্ধু ট্রেনযাত্রার গ্লানি অনুভব করলেন না। প্রদ্যোতবাবু যে রিডার্স ডাইজেস্টে পাখিটার কথা পড়েছেন সেটা আর বললেন না; সেটা বলার সময় ঢের আছে। তুলসীবাবু সবই বলে দিয়েছেন তাঁকে, আর সেই সঙ্গে কিঞ্চিৎ রহস্য করেছেন এটাও বলে যে, পাখিকে মারার প্রয়োজন হবে বলে তিনি মনে করেন না, বন্দুক নিতে বলেছেন শুধু সাবধান হবার জন্য। প্রদ্যোতবাবু বন্ধুর কথায় কান দেননি। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করতে হবে তাঁকে এটা তিনি স্থির করে নিয়েছেন। গত রবিবারের কাগজে খবর বেরিয়েছে যে এই নৃশংস প্রাণীকে যে হত্যা করতে পারবে, মধ্য প্রদেশ সরকার তাকে পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার দেবেন। এই প্রাণী এখন নরখাদকের পর্যায়ে এসে পড়েছে; একটি কাঠরের ছেলে সম্প্রতি তার শিকারে পরিণত হয়েছে।
জগদলপুরে পৌঁছে বনবিভাগের কর্তা মিঃ তিরুমালাইয়ের সঙ্গে কথা বলে শিকারের অনুমতি পেতে অসুবিধা হল না। তবে তিরুমালাই সতর্ক করে দিলেন যে স্থানীয় কোনও লোককে সঙ্গী। হিসেবে পাওয়া যাবে না। কোনও লোকই ওই বনের ত্রিসীমানায় যেতে রাজি হচ্ছে না।
প্রদ্যোতবাবু প্রশ্ন করলেন, আর যে-সব শিকারি আগে গেছে তাদের কাছ থেকে কিছু জানা গেছে। কি?